সে এক সুন্দর বন……….
অচিন রহস্যের অধরা হাতছানি
যাচ্ছি মামার বাড়ি। সঙ্গে কবীর ভাই। ৫ দিনের এই যাযাবর দলের সর্দ্দার। ছোট্ট শরীর। পেছনে লম্বা ঝুটি। ঝুটি নাড়িয়ে একের পর এক গপ্পো বলে যাচ্ছেন। সবই মামার গপ্পো। সেবার এ্যাপলো ভাই মামার তাড়া খেয়ে অল্পের জন্য প্রাণে বেঁচে গেছেন! মামাকে দেখে গামছা রাশেদ ছবি তুলতেই ভুলে গিয়েছিল। আর ফুটা জাহাঙ্গীর? ক্যামেরার লেন্স ক্যাপ না খুলেই শেষ করে দেয় আধা রোল। আত্মারাম খাঁচাছাড়া সব কথাবার্তা। ভয়ংকর সব স্মৃতি_বলার ঢংয়ে শব্দ করে হেসে উঠছে সবাই। হাসির দমকে বাসে ভুমিকম্প দশা। বাস যাচ্ছে খুলনা। আর আমরা যাচ্ছি সুন্দর বন। সুন্দর বনে বাঘকে ‘মামা’ ডাকে সবাই। আমরা আমাদের মামার বাড়ি যাচ্ছি…।
ঘাটের নাম জেলখানার ঘাট। নদীর নাম পশুর। ৭ ঘন্টার বাসযাত্রা শেষে খুলনায় পৌঁছলাম শেষ বিকেলে। রাত নটায় লঞ্চ ছাড়বে। ঘাটে ভেড়ানো ‘ভটভটি’-কাঠের কালো শরীরে শ্যালো বসানো ট্রলার। ট্রলারের ঘাড়ে চেপে উঠলাম গাইডের লঞ্চে_ অভিযান-টু। আমাদের জলে ভাসা পদ্ম। এই পদ্মে ভেসে পাড়ি দেব পশুর-আন্ধার মানিক, সাগরের মোহনা হয়ে কচিখালি, নীল ডুমুর আরও কত নদী। পথ অল্প কিন্তু সুন্দরবনকে পরিখা করে ঘিরে আছে যেন এইসব নদীরা। জলের বুকে নেই কোনও সীমানা প্রাচীর। কত শত নামে কত শত নদী, ক্যানেল, খাল- ধানসাগর, রুপসা, পশুর, মেলাগাং, হরিনহাটা,দুধমুখি, মোহনা, সুমতি, সুন্দরী, ছেড়া কটকা, কটকা, কচিখালি ইত্যাদি ইত্যাদি। বন বিভাগের হিসেবে অন্তত ৩৫০ নদী আছে বনকে ঘিরে। ছোট বেলার রুপকথার গল্প যেন। সাত সমুদ্দুর তের নদী পার করে তবেই সুন্দরবন। মামার বাড়ি।
লঞ্চ চলছে একটানা। সকাল ৯ টায় পেঁৗছলাম সুমতি। সুমতির সঙ্গী এখানে বেতমোড় খাল। মনের আয়নায় কানে বাজল ছোট্টবেলাকার কবিতা, ‘ঐ দেখা যায় মরা নদীর স্রোতা…….’। কোথাও জনমানব নেই। নেই মোবাইল নেটওয়ার্কও। হুটহাট একটা জেলে নৌকা দেখা যাচ্ছে তখনও। চারপাশে থরে থরে সাজানো বনভুমি। একে তিন টুকরোয় ভাগ করেছে বন বিভাগ। শরণখোলাজোন হচ্ছে গ্রিন জোন। এই বনের অভয়ারণ্য। খূলনা অংশে মিডেল জোন_হিরণ পয়েন্ট। আর সাতক্ষীরায় পরেছে রেডজোন। ৬ হাজার ৬৪ কিলোমিটার মাটিতে জুড়ে থাকা এই সবুজের মেলায় এলোমেলো বিলি কেটে গেছে ছোট-বড় নদীরা। নদীর পাশ ঘেঁষে সুন্দরী, গেওয়া, কেওরা, ধুন্দল, গোলপাতা আর কতশত চিন-অচিন বৃক্ষ। একটা অদ্ভুত দৃশ্য-নদীর কোল ঘেঁষা গাছগুলোর নীচের দিককার ডাল-পাতা যেন বড় যত্ন করে ইঞ্চি মেপে একসমানে কাটা; জলরেখা যথেষ্ট নিচে। কারণ খুঁজতে আবার ডাক পড়ল গাইডের। সহজ উত্তর। অথচ মাথায় আসেনি। কারণ-ফ্ল্যাটবন্দি নগরবাসী জীবনে জোয়ার-ভাটার হিসেব কেবল স্কুলের পাঠ্য বইয়ের পাতায় বন্দি। এখানে যেন চাক্ষুষ উদাহরণ_জোয়ারে পানি বেড়ে জলসীমা কুলছাপিয়ে গাছ ছোয়। আর ভাটায় কুলের মাটিরও অন্তত তিন-চার হাত নীচ দিয়ে বয়ে যায় শান্ত নদী। জোয়ারে বাড়া পানির কারণেই গাছের পাতা-ডাল ওপর্যন্ত জন্মায় না। কখনও-সখনও জন্মালেও জলের কারণে পচে খসে যায়। আর এজন্যই দুর থেকে দেখলে মনে হয় ঘন বনের জংলী গাছেরা এই অদ্ভত নকশায় ছাটা যেন।
সুন্দর বনের মাটিতে প্রথম নামলাম আন্ধারমানিক। তবে সন্ধ্যা হয়ে যাওয়ায় বনে ঢোকা হল না। লঞ্চ নোঙড় করল পাড় ছেড়ে বেশ খানিকটা দুরে। আমরা কজন ট্রলারে চেপে রেঞ্জ অফিসে এলাম। কেননা এখান থেকে আমাদের সঙ্গে বনরক্ষি উঠবেন। এখানে মজার একটা কেলা আছে। বসতি নেই বলে এভানকার মাপিরও আলাদা নাম-পরিচয় নেই। যেখানে রেঞ্জ বা বন বিভাগের কোনও প্রকল্প আছে সেখানকার মাটির একটা নাম দেয়া আছে। আর তা রাখা হয়েছে নদীর নামে। আন্ধারমানিক নদীর কুল ঘেষা পারের নাম আন্ধার মানিক। সুমতি রেঞ্জের সঙ্গী সুমতি নদী। চাঁদপাই রেঞ্জের পাড়ের নাম চাদপাই গ্রাম। পরদিন ভোরের দেখা পেলাম কচিখালি নদীর। আর ডাঙ্গার নাম খাতা-কলমে শরনখোলা রেঞ্জ। তবে পরিচিতি কচিখালি অভয়ারন্য নামে। এটুকুতে আবার রেঞ্জ অফিসের বাংলোর পাশে অভয়ারণ্য বানানো হয়েছে। তবে আমরা সেখানে কোনও নির্ভয় প্রানীর দেখা না পেলেও পরিচয় হল নানা রঙা বহু জাতের ছত্রাকের সঙ্গে। সহজ কথায় ব্যাঙের ছাতার কত শত রং আর রুপ হতে পারে তা বোধকরি এখানে এলে দেখা মেলে। পুরাতন রেঞ্চ অফিসের পথে, কাঠের ব্রীজে, নারকেল বনে কোথায় নেই। আর আছে হরগজার ঘনবন। গুল্মজাতীয় গাছ। তবে যে কোনও অর্কিডের চেয়ে কম রুপসী নয় সে। খাবার পানির জোগান দিতে যে পুকুর আর নালা আছে তার সবই শাদা শাপলায় ঢাকা। তারপর নামলাম ডেমের চর। নামটা অদ্ভুত। এই চর ওপর থেকে দেখতে ঠিক ডিমের মতো বলেই এমনটা নাম হয়েছে। চর বোঝাই কাকড়ার ঘরবসতি। আর আছে অচিন কিছু জংলী ফুলের লতাবাহার।
সে এক সুন্দর বন……….
জানুয়ারি 31, 2009 তৈরী করেছেন btwa
মন্তব্য করুন