Archive for সেপ্টেম্বর, 2008
সুন্দরবন, কিছু অনুভূতি, এবং একটি গল্পো
Posted in সুন্দর বন on সেপ্টেম্বর 13, 2008| Leave a Comment »
সুন্দরবন, কিছু অনুভূতি, এবং একটি গল্পো।।
কাঁসালং – এর বাঁকে – সূর্য উৎসব ২০০৮
Posted in ভ্রমণ on সেপ্টেম্বর 13, 2008| Leave a Comment »
কাঁসালং – এর বাঁকে – সূর্য উৎসব ২০০৮
একলা পথিক
াত প্রায় ১০টা। শাহাবাগ ছবির হাটে অন্যান্য সাধারণ দিনের চেয়ে লোক সমাগম আজ বেশ বেশি। প্রায় দেড় শতাধিক লোকের সমাগম জায়গাটাকে বেশ উৎসবমুখর করে তুলেছে। আমি যখন পৌঁছলাম তখন লম্বা কিউ নজরে পড়লো। কাঁধে হ্যাভারস্যাক, ¯ি পিং ব্যাগ আর আপাদমস্তক গরম কাপড়ে ঢাকা লোকগুলোকে দেখলেই বোঝা যায় কোন অভিযানে যাওয়ার জন্য প্রস্তুত সকলে। এগিয়ে গিয়ে দেখলাম সূর্য-উৎসবের অভিযাত্রিরা সবাই নিজেদের আইডি কার্ড, ফুড-কুপন বুঝে নিচ্ছেন সেই সাথে জেনে নিচ্ছেন বাসে তার অবস্থান। কিছুক্ষণের মাঝেই ১৩৬ জন অভিযাত্রির দল নিয়ে ৪টি বাস ছুটবে রাঙ্গামাটির উদ্দেশ্যে। সূর্য-উৎসব ২০০৮-এ এবারের গন্তব্য বাংলাদেশের দ্বিতীয় বৃহত্তম জঙ্গল, পাবলাখালী। এর আগে এখানে যাওয়াতো দূরের কথা অভিযাত্রীদের কেউ এর নাম ও শুনেনি, তাই এ যাত্রায় সকলেই রোমাঞ্চিত ও শিহরিত নিজ দেশে নতুন ভূ-খন্ড আবিস্কারের আশায়।
বিগত সাত বছর যাবত বাংলাদেশ অ্যাস্ট্রোনমিকেল এসোসিয়েশন বাংলাদেশের বিভিন্ন অংশে সূর্য-উৎসব পালন করে আসছে। প্রথম সূর্য উৎসব পালন করা হয়েছিল বাংলাদেশের সর্ব দক্ষিণের সর্বশেষ ভূ-খন্ড সেন্টমার্টিন দ্বীপের ছেড়া দ্বীপে। পরবর্তীতে অংশগ্রহণকারীদের বিপুল আগ্রহের কথা বিবেচনা করে নিয়মিতভাবে এ উৎসব আয়োজনের সিদ্ধান্ত নেয়া হয়। সেই থেকে শুরু। পরবর্তী বছরগুলোতে এ উৎসব পালিত হয় – পৃথিবীর সর্ববৃহৎ ম্যানগ্রভ বন ‘সুন্দরবন’, দেশের সর্বোচ্চ শৃঙ্গ ‘কেওক্রাডং’ সৌন্দর্যের বেলাভূমি ‘নিঝুম দ্বীপ’, বাংলাদেশের উত্তরের সর্বশেষ সীমানা পঞ্চগড়ের ‘বাংলাবান্দা’, গাড়ো পাহাড়ের পাদদেশে প্রবাহিত সোমেশ্বরী নদীর তীরে ‘বিরিশিরি’ এবং গত বছর উজ্জাপিত হয় সুনামগঞ্জের “টাঙ্গুয়ার হাওর” – এ, আর এ বছর স্থান নির্ধারণ করা হয় “পাবলাখালী অভায়ারণ্য”। ৪২ হাজার ৮৭ হেক্টরের এই অভায়ারণ্যে বন্য হাতি ছাড়াও রেসাস বানর, মুখপোড়া হনুমান, উল ুক, কাঠবিড়ালি, সাম্বার হরিণসহ নানান রকম বন্যপ্রাণী ও পাখির বাস। পার্বত্য বনভূমির মেেধ্য এটাই সবচেয়ে সমৃদ্ধ তবে পাহাড়ের মাঝ দিয়ে বয়ে চলা জলরাশিও, কম গুরুত্ব বহন করে না। রাঙ্গামাটি শহর থেকে ১১২ কি.মি. দূরে কাপ্তাই হ্রদের একদম উত্তরে কাসালং নদীর পাশে ১০০ থেকে ৩০০ মিটার উচু পাহাড়ি এলাকায় এই পাবলাখালী আর কাসালং নদী বিভিন্ন ধারায় পাহাড়ি পথে প্রবাহিত হ্রদ সৃষ্টি করেছে গুরুত্বপূর্ণ জলাশয়। ১৯৬২ সালের জুনে একে গেইম অভয়ারণ্য হিসাবে প্রতিষ্ঠা করা হয় আর ১৯৮৩ সালে ঘোষণা করা হয় বন্যপ্রাণী অভয়ারণ্য হিসাবে। সূর্য-উৎসবের জায়গা নির্ধারণের ঘটনাটাও কিন্তু কম মজার না। সূর্য-উৎসব মানেই হলো এ্যাডভেঞ্চার এবং উৎসবের এক অপূর্ব মিশেল।
আর এবার উৎসব ব্যবস্থাপনায় বেসরকারি পর্যটন সংস্থা “ইনসাইটা ট্যুরিজম” যুক্ত হয়ে উৎসবে এনেছে নতুন মাত্রা। সে যাই হোক স্থান নির্ধারণের ঘটনাটা বলি – পূর্ববর্তী উৎসবের স্থানগুলো পর্যালোচনা করে দেখা গেল, সমুদ্র, নদী, পাহাড়, বন এমনকি হাওড়-এও উৎসব করা হয়ে গেছে। তাই এমন একটা জায়গার খোঁজ করতে হবে যেখানে অন্যবারের চেয়ে একটু বেশি কিছু পাওয়া যায়। নানান জনের কাছ থেকে নানান প্রস্তাবও আসতে লাগলো কিন্তু কোনটাই মনমত হচ্ছে না। সে সময় উৎসবের অন্যতম পরিচালক নওরজ ইমতিয়াজ ‘নিসর্গ’ থেকে একটি বই সংগ্রহ করেন যেখানে বাংলাদেশে সব বনাঞ্চলগুলোর বর্ণনা দেয়া আছে। অন্যান্য বনগুলোর নাম পরিচিত ঠেকলেও পাবলাখালী নামটা সকলের কাছে একদম নতুন, সেই সাথে বনের বর্ণনা আগ্রহের মাত্রা আরও বাড়িয়ে দিল, কারণ এখানে একই সাথে আছে – নদী, পাহাড় ও বন। এযে একের ভিতর তিন। সেই সাথে আছে বন্যপ্রাণীর পর্যাপ্ততা; কাজেই ঠিক করা হল এখানেই হবে এবারের সূর্য-উৎসব। কিন্তু সমস্যা হল এখন পর্যন্ত শুধু কাগজে-কলমেই জায়গাটা আমাদের পরিচিত স্বশরীরে আমাদের কেউই এর ত্রিসীমানায় যায়নি।
এমন অপরিচিত জায়গায়তো আর হুট করে এক দল লোক নিয়ে হাজির হওয়া যায় না। আর দলের সদস্য সংখ্যা যদি শতাধিক হয়, যার মধ্যে বৃদ্ধ থেকে শুরু করে শিশু পর্যন্ত রয়েছে সে ক্ষেত্রে তো প্রশ্নই ওঠে না। বিশাল ম্যাপ বিছিয়ে শুরু হলো গবেষনা । কি করে যাওয়া যায় এই জায়গায়। অনেক আলোচনা-পর্যালোচনা পর্যবেক্ষণ শেষে মোটামুটি একটা ধারণা পাওয়া গেল জায়গাটার অবস্থান সম্পর্কে। ঠিক হল আমি এবং মাহবুবুল আলম প্রধান (জুয়েল) রেকি করতে যাবো। ম্যাপ দেখে মনে হলো খাগড়াছড়ি দিয়ে গেলেই কাছাকাছি হবে। নির্ধারিত দিনে সায়দাবাদ বাস স্ট্যান্ড থেকে রাতের বাসে আমি আর জুয়েল রওনা দিলাম অজানার উদ্দেশ্যে। পরিচিত পথ ধরে বাস ছুটলো অপরিচিতের পথে। জানালা দিয়ে দ্রুত সরে যাওয়া ল্যাম্পপোস্ট দেখতে দেখতে আর বাসের ঝাকুনিতে কখন যে ঘুমিয়ে গেছি জানি না। যখন চোখ খুলে া তখন আধার ফিকে হয়ে ভোরের আলো ফুটতে শুরু করেছে। আশে পাশের দৃশ্যপট পাল্টে গেছে, বাস ছুটে চলছে আকাঁবাকা পাহাড়ি পথ ধরে, চারিধার কুয়াশার চাদরে মোড়ানো। দূর পাহাড়ের গা ঘেষে বয়ে চলছে ঘন মেঘ। সকাল আটটায় পৌঁছলাম খাগড়াছড়ি কলেজ রোড বাস স্টেশনে। এখান থেকে বাস বদল করে যেতে হবে মারিশ্যা। সাথে সাথেই বাস পেয়ে যাওয়ায় নাস্তার পিছনে সময় নষ্ট না করে আবার বাসে চেপে বসলাম। সাড়ে দশটা নাগাদ মারিশ্যা পৌঁছলাম। কিন্তু এরপর! বিপত্তি বাঁধলো তখন যখন স্থানীয় কেউই পাবলাখালীর কোন হদিশ দিতে পারলো না। তারা যেন আমাদের মুখেই এই নাম প্রথম শুনেছে। পরে আমরা দু’জন ঠিক করলাম বনবিভাগের অফিসে গেলেই আসল তথ্য পাওয়া যাবে। আমাদের দৃঢ় বিশ্বাস বইয়ে যেহেতু উলে খ আছে তখন এ বনও অবশ্যই আছে। অনেক খোঁজাখুজি করে পেয়ে গেলাম বন বিভাগের অফিস। বন কর্মকর্তারা আন্তরিকতার সাথেই আমাদের সহায়তা করলেন।
বাৎলে দিলেন পাবলাখালী যাওয়ার পথ, ট্রলারও ঠিক করে দিলেন যাওয়ার জন্য; সেই সাথে দিয়ে দিলেন প্রয়োজনীয় নির্দেশনা। প্রায় আড়াই ঘন্টা নদী পথ পেড়িয়ে অবশেষে পৌনে তিনটায় পৌঁছলাম পাবলাখালী ফরেস্ট রেঞ্জের ঘাটে যা স্থানীয়ভাবে আমতলী ঘাট হিসাবে পরিচিত। ফরেস্ট রেঞ্জার খলিলুর রহমান গাজী এবং গেইম অভয়ারণ্য রেঞ্জার এ.এফ.জি মোস্তফা আমাদের যথেষ্ট সমাদর করলেন। তাদের জানালাম আমাদের আগমনের হেতু এবং জানতে চাইলাম আমাদের পরবর্তী করণীয় বিষয়াদি। সৌজন্য সাক্ষাৎ শেষ করতে করতে প্রায় সাড়ে তিনটা। পেট অনেক আগেই জানান দিয়ে দিয়েছে যে সকাল থেকে ওখানে কিছু পড়েনি। তাই দু’জন রওনা হলাম কাছের বাজারে গিয়ে পেট পুজোটা সেরে নিতে। মনিরের হোটেলে খেয়ে আমরা মুগ্ধ এমন প্রত্যন্ত অঞ্চলে এমন রান্না পাব আশা করি নি। ভাত, মাছ, মাংস, সব্জি সবই আছে এবং রান্নাও অপূর্ব। খেতে খেতেই জানতে পারলাম কাছের বনে বন্য হাতির পাল এসেছে। এমন সুযোগতো আর হেলায় হারানো যায় না; তাই দুজন ঠিক করলাম খাওয়া সেরে হাতি দেখতে যাব। মনিরকে বলতেই সে ব্যবস্থাও করে দিল। সামসুদ্দিন নামে এক বয়জষ্ঠকে আমাদের সাথে দিল বনে নিয়ে যাবার জন্য। যেতে হবে নৌকায়, আমরা সামসু চাচার সাথে রওনা হলাম যেখানে তার নৌকা বাঁধা আছে। তার ছোট্ট নৌকায় রওনা হলাম পাহাড়েরর মাঝ দিয়ে আকাঁবাকা বয়ে চলা জলপথ দিয়ে। চারিধার অদ্ভুত নিস্তব্ধতা। নানান যান্ত্রিক আওয়াজে অভ্যস্ত আমাদের এই কানে প্রকৃতির এই নিস্তব্ধতাকে অপার্থিব বলে মনে হচ্ছিল। নাম না জানা পাখির গান, গাছের শুকনো পাতার উপর দিয়ে বয়ে চলা শীতের বাতাসের শব্দ আর পানিতে বৈঠা পড়ার শব্দ মিলে তৈরি হয়েছে এক অদ্ভুত সিম্ফনী। আমরা কেউ কোন আওয়াজ করছি না পাছে ছন্দ পতন ঘটে। পাহাড়গুলো লতা গুল্মো ছাওয়া, তারই ছায়া পড়েছে স্বচ্ছ জলাধারে। দূরে আরও দুটি মাছ ধরার নৌকা চোখে পড়লো যারা নিজ মনে জাল টানছে। প্রায় ঘন্টা দেড়েক চলার পর হঠাৎ কানে এলো হাতির ডাক, সচিকিত হয়ে নড়ে চড়ে বসলাম সকলে। উত্তেজনায় নৌকাটাও দুলে উঠলো খানিকটা। সামসু চাচা আঙ্গুল তুলে দেখালেন ওই পাহাড়েই আছে মামারা। স্থানীয়রা হাতিকে মামা ডাকে। আমরা নৌকা ভিরালাম বিপরীত দিকের টিলায়। একেবারে বন্য হাতির মুখোমুখি হবার ইচ্ছে আমাদের কারুরই নেই। পাহাড়ের মাথায় যখন উঠলাম ততক্ষণে হাতির দল সরে যাচ্ছে আরও ভিতরের দিকে।
শেষতক একটি বড় হাতির আর একটি হস্তিশাবকের অবয়বই চোখে পড়লো শুধু। বাচ্চাটার মাই হবে হয়তো। ফিরে এলাম বন বিভাগের অফিসে। রাতটা তাদের এখানেই কাটালাম। পরদিন ভোরে একটি ছোট লঞ্চে করে রওনা হলাম রাঙামাটির উদ্দেশ্যে। পাবলাখালী থেকে মাইনী, লঙ্গদু, বর্ণছড়ি, শুভলং পাড় হয়ে রাঙামাটি পৌঁছতে দুপুর গড়িয়ে গেল। যাই হোক ফিরে আসা যাক মূল কাহিনীতে, ছবির হাট থেকে বাস ছাড়লো ১১টা ৪০ মিনিটে, শুরু হলো অ্যাডভেঞ্চার পাবলাখালী। আমাদের এই দলে ছাত্র, শিক্ষক, চিকিৎসক, প্রকৌশলী, চাকুরীজীবি, ব্যবসায়ী, সাংবাদিক, মিডিয়াকর্মী, সমাজকর্মী সহ নানান পেশার মানুষ রয়েছে। সেই সাথে আমাদের আতিথ্য গ্রহণ করেছেন বিশিষ্ট কথা সাহিত্যিক এবং প্রকৃতিবিদ বিপ্রদাশ বড়–য়া এবং নিসর্গী মোকারম হোসেন। মাঝরাতে যখন কুমিল ার ময়নামতিতে পৌঁছলাম তখন দেখি কৃষ্ণপক্ষের অষ্টমির চাঁদও আমাদের সাথে হাজির হয়েছে উৎসবে যোগ দিতে।
জ্যেৎস্না-কুয়াশায় মিশেল আবরণে ঢাকা চারিধার। দল-বল নিয়ে ডলি রিসোর্টে ঢুকে পুরো জায়গাটা সরগরম করে তুল াম। বয়-বেয়ারা সব ব্যস্ত হয়ে পড়লো একসাথে এত লোককে সামাল দিতে। সব্জি-পরটা আর চা খেয়ে সকলে বেশ চাঙা হয়ে উঠলো। সকলের হাসি-ঠাট্টা আর গান রাতের নিস্তব্ধতা ভেঙে পরিবেশটাকে উৎসবমুখর করে তুলেছে। চট্টগ্রাম শহর ছাড়িয়ে রাঙ্গামাটি যখন পৌঁছলাম রাত তখন শেষ হয়ে গেছে, কিন্তু সূর্যের দেখা নেই। বছরের এই সময়টাতে সূর্যের এই লুকচুরি খেলা হরহামেশাই চলে। তা চলুক ওতে আমাদের আনন্দে কোন ভাটা পরবে না। রাঙ্গামাটির কর্ণফুলি নদী লাগোয়া হোটেল সুফিয়া ইন্টারন্যাশনালে উঠে সবাই প্রাতরাশ এবং নাস্তা পর্ব শেষ করে ছুট দিল ফিশারিজ ঘাটে যেখানে রিজার্ভ লঞ্চ কেয়ারী কর্ণফুলি আমাদের অপেক্ষায় তীরে ভাসমান। প্রথম গন্তব্য মাইনি। আমাদের শুভেচ্ছা জানাতে ডিস্ট্রিক ফরেষ্ট অফিসার উত্তম কুমার সাহা ঘাটে এলেন। তার সাথে সৌজন্য সাক্ষাৎ শেষে সাড়ে ১০টায় আমারা যাত্রার দ্বিতীয় ধাপ শুরু করলাম। এর মাঝে অভিযাত্রী দল নিজেদের মধ্যে আলাপ পরিচয় সেরে নিলেন। নওরজ ইমতিয়াজের পরিচালনায় শুরু হলো উৎসব ব্রিফিং। বাংলাদেশের অন্যতম মাউন্টেনিয়র মুসা ইব্রাহিম (বাংলাদেশ থেকে যে ক’জন সৌভাগ্যবান এখন পর্যন্ত হিমালয় পর্বতে গিয়েছেন তিনি তার মধ্যে একজন) অভিযাত্রীদের অ্যাডভেঞ্চার সম্পর্কে নানান তথ্য দিলেন সেই সাথে ভাগাভাগি করে নিলেন নিজের অভিজ্ঞতা। ঘুড়ি প্রেমী বেনু ভাই অভিযাত্রীদের দিলেন ঘুড়ি সম্পর্কে নানান মজার তথ্য। বিপ্রদাশ বড়–য়া যিনি যৌবন থেকে আজ অব্দি চড়ে বেড়িয়েছেন এখানকার পাহাড়, নদী আর অরণ্য; তার কাছ থেকে জানলাম নানান রমাঞ্চকর অজানা তথ্য। আঙ্গুল দিয়ে দেখিয়ে দিলেন শুভলং ঝর্ণার বিপরীতে ওই দূর পানির নিচেই তলিয়ে গেছে চাকমা রাজার বাড়ি। জানতে পারলাম এখানকার সব পাহাড়াই নাকি উত্তর-পূর্বমুখী। নিসর্গী মোকারম হোসেন জানালেন এখানকার পরিবেশ বিপর্যয়ের কথা। কথার ফাঁকে বেনুভাই কখন যে তার আমনীকৃত চীনা চড়কি আর ঘুড়ির পসরা খুলে বসেছেন খেয়ালই করি নি। আমরা ক’জন তার কাছে থেকে কয়েকটা চরকি নিয়ে হাওয়ার বিপরীতে ঘুড়াতে লাগলাম আর উনি উড়াতে লাগরেন ডাউস সাউজের ঘুড়ি।
কখনো বেসাতি, কখনো অক্টোপাস, আমরা ঘুড়ি না ওড়ালেও কনটিকি আঁকা বাইশ ফুটের একটা পাল কেয়ারীর মাথায় উড়িয়ে দিয়েছিলাম সেই সকালেই। হাওয়ার তোরে পালটাও উড়তে লাগলো পতপত করে। দুপুর আড়াইটা নাগাদ পৌঁছলাম মাইনি বাজারে। নেমেই পালা করে পেট পুজা শুরু করে দিল। পালা করে কারণ একবারে এত লোক বসার ব্যবস্থা এখানে নেই। অভিযাত্রীদলও শৃঙ্খলার সাথে খাওয়ার পর্বটা শেষ করে আবার লঞ্চে গিয়ে উঠলো। লঞ্চ ঘুরিয়ে সকলকে নিয়ে আসা হলো রাবেতা হাসপাতালের ঘাটে। আমাদের অভ্যর্থনা জানাতে অপেক্ষায় ছিলেন রাবেতার কর্মকর্তারা। পরিচয় পর্ব শেষ করে রওনা হলাম দুই কিলোমিটার দূরে অবস্থিত রাবেতা কলেজ ক্যাম্পাসে। পথের একধারে ফল-ফুলের বাগান আর অন্যধারে পাহাড়ের কোল ঘেষে লেক। আশেপাশের সৌন্দর্য পাহাড়ি পথে দুই কিলোমিটার হাটার ক্লান্তি অনেকটা কামিয়ে দিল। রাবেতা কলেজে ব্যাগ-ট্যাগ রেখেই স্থানীয় ছাত্র-শিক্ষক এবং অভিযাত্রীদের মধ্যে শুরু হলো বলিভল খেলা, দলের কিছু অংশ সারা দিনের ক্লান্তি ঝেড়ে ফেলতে ঝাপ দিল পাশের লেকে। ভলেন্টিয়াররা সবাই লঞ্চ হতে প্রয়োজনীয় সরঞ্জাম নামাতে ব্যস্ত। এর মধ্যেই এক জন ‘গেল গেল’ বলে চিৎকার করে পাহাড় কাপিয়ে তুলে া। বছরের শেষ সূর্য অস্ত যাই যাই করছে। সবাই ছুটলো কলেজের পাশেই একটা পাহাড়ের উপর সেনাবাহিনীর হেলিপ্যাডে। সেখান থেকে পুরো এলাকাটা চমৎকার দেখা যায়। সকলের চোখের সামনে পাহাড়ের ফাঁক গলে টুপ করে ডুবে গেল বছরের শেষ সূর্যটা। আলো-আধাঁরিতে ছাওয়া চারিধার আধ-খাওয়া চাঁদটা উঁকি দিচ্ছে আকাশে। পাহাড়ি এলাকায় মশার প্রকোপ বেশি এবং মারাত্মকও বটে। একবার ম্যালেরিয়া হলে আর রক্ষা নেই। কাজেই হাত-পায় আর শরীরের খোলা অংশে মশারোধক ক্রিম ওডোমস মাখতে ব্যস্ত হয়ে পড়লো সবাই। সন্ধ্যা সাতটা। সকলে গোল হয়ে বসে আছি হেলিপ্যাডে। শুরু হয় রাতের উৎসব প্রস্তুতির প্রথম অংশ। মেজবা আজাদের পরিচালনায় পরিচয়পর্ব এবং উৎসব ব্রিফিং শেষ করে সকলে ফিরে এলাম কলেজ ক্যাম্পাসে। ছোট ছোট দলে ভাগ হয়ে সকলে ঝাপিয়ে পড়লো প্রস্তুতি কর্মে। কেউ বানাতে লাগলো মঙ্গল প্রদীপ, কেউ ফানুস, কেউ বা রঙিন লণ্ঠন। কলেজের মাঠে সেলিম ভাইয়ের নেতৃত্বে একদল লাকড়িতে আগুন জ্বালিয়ে শুরু করলো বিভিন্ন আঞ্চলিক গান। খাবার আয়োজনে আমাদের ফুড মিনিস্টার জুয়েলের সজাগ দৃষ্টি। সকলে যখন যার যার কাজে ব্যস্ত তখন সে ব্যস্ত খাবার আয়োজনে। রাত নয়টায় জুম চাষের ভাত, মুরগির মাংস, ডিম, ডাল আর টমেটোর সালাদ দিয়ে অভিযাত্রী দল খাবার পর্বটা সেরে নিলেন পরম তৃপ্তির সাথে। খাবারের পর এমন ঠান্ডায় এক কাপ গরম চা যদি পাওয়া যেত তবে খাওয়ার ষোলকলা পূর্ণ হতো। তবে এমন পাহাড়ি এলাকায় যার ত্রিসীমানায় কোন লোকালয় নেই সেখানে এমন বিলাসী ইচ্ছাটাকে অনেকেই যখন বুকের মাঝেই কবর দিতে যাচ্ছিলেন তখনই ফুড মিনিস্টার এসে গম্ভিরস্বরে ঘোষণা দিলেন, আপনাদের জন্য চা পানের আয়োজন করা হয়েছে। যে যত কাপ ইচ্ছা খেতে পারেন। সকলে লক্ষ্য করলেন মাঠের এক কোনে বেঞ্চির উপর চা বানানোর সরঞ্জাম নিয়ে দুটি লোক বসে আছে।
এরই মাঝে কত্থেকে যেন সে চাওয়ালা যোগার করে ফেলেছে। এই না হলে কি আর ফুড-মিনিস্টার; বলার আগেই সব বুঝে ‘লক্ষ্মি ছেলে’! রাত ১১টায় যার যার মতো মঙ্গল প্রদীপ, লণ্ঠন আর ফানুস হাতে ক্যান্টনমেন্টের লেকে ছুটলো সবাই। হেলিপ্যাড থেকে লেক পর্যন্ত পুরো পথটাকে সাজানো হলো রঙিন কাগজে মোড়া লণ্ঠন দিয়ে, কিছু লণ্ঠন ঝুলিয়ে দেয়া হলো গাছের ডালে। অল্প অল্প কুয়াশার মধ্যে লাল-নীল-হলুদ-সবুজ কাগজে মোড়া লণ্ঠনগুলো পুরো এলাকাকেই আচ্ছাদিত করলো এক অলৌকিক অবরণে। সূর্য উৎসবে যোগ দিতে মাইনির ২৫ বেঙ্গল রেজিমেন্টের জোন কামান্ডার লেঃ কর্ণেল মুস্তাফিজ সপরিবারে চলে এলেন। ঠিক জিরো আওয়ারে রাতের আকাশ আলো করে জ্বলে উঠলো ফ্লেয়ার। লেকের জলে ভাসানো হলো মঙ্গল প্রদীপ। দূর থেকে দেখে মনে হচ্ছিল পুরনো বছরের সকল জীর্ণতা-গ ানি মুছে নতুন বারতা নিয়ে ধীর গতিতে এগিয়ে চলছে কোন আলোর মিছিল। অভিযাত্রীরা প্রত্যেকে নতুন বছরের শুভেচ্ছা বিনিময় করলো। ফানুস স্পেশালিস্ট নূর মোহাম্মদ এরই মধ্যে ফানুস ওড়ানোর সকল আয়োজন সম্পন্ন করে ফেলেছে। বাতাসের বাড়াবাড়িতে প্রথম দু’টি উড়ার আগেই পুড়ে খাক হলেও পরের দু’টি দিব্যি উড়ে গেল উচুতে। নীচ থেকে অবাক হয়ে দেখতে লাগলাম সকলে এই সফল উৎক্ষেপন। উচুতে ফানুসগুলোতে আগুন ধরে যাওয়ায় তৈরি হল অদ্ভুত এক আলোর খেলা। তারপর হেলিপ্যাডে সেনাবাহিনীর আতিথীয়তা গ্রহণ করলাম। শীতের রাতে সেনাবাহিনীর আয়োজনে চা-পর্ব উৎসবে এনে দিল নতুন মাত্রা।
প্রদীপ দিয়ে হেলিপ্যাডটাকেও সাজানো হলো। সীমান্ত লাগোয়া দুর্গম সেই পাহাড়ি এলাকায় মধ্যরাতের এই উৎসব সমতলের বাসিন্দারা নিশ্চয়ই অনেকদিন মনে রাখবে। তাছাড়া পাহাড়ের ওপর হেলিপ্যাডে নববর্ষ উৎযাপনের অভিজ্ঞতাও নিশ্চয়ই কোন অভিযাত্রীর নেই। রাত ১টা নাগাদ সবাই ঘুমাতে চলে গেলাম। আমাদের পরবর্তী গন্তব্যের উদ্দেশ্যে রওনা দেয়ার জন্য ভোর ৪টায় উঠতে হবে তাই সারা দিনের কর্ম ক্লান্ত শরীরটাকে খানিকটা আরাম দেয়া প্রয়োজন। ভোর ৪টায় সবাইকে টেনেটুনে ওঠানো হল ঘুম থেকে। ব্যাগগুছিয়ে সকলে লঞ্চে উঠে বসলো। অভিযাত্রীদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে সেনাবাহিনীর একটা পেট্রোল বোটও ঘাটে হাজির। কিন্তু ঘন কুয়াশার কারণে লঞ্চ ছাড়া যাচ্ছে না। ক্যাপ্টেন একদমই নড়তে সাহস পাচ্ছে না। অবশেষে ভোর ছয়টায় অন্ধকার ফিকে হয়ে আসার পর লঞ্চ চলতে শুরু করলো। পূব আকাশে এরই মাঝে বছরের প্রথম সূর্যটা হয়তো উঠে গেছে কিন্তু কুয়াশার বৈরীতায় তার সাথে আর দেখাই হল না। মাইনী থেকে পাবলাখালীর এক ঘন্টা পথ পার হতে আমাদের আড়াই ঘন্টা সময় লাগলো। যে ডুবো পাহাড়ের ভয়ে দেরীতে লঞ্চ ছাড়া হলো ঘুরে ফিরে একের পর এক সেই ডুবো পাহাড়েই লঞ্চ আটকাতে লাগলো। ডুবো পাহাড় এড়াতে গিয়ে পথ ভুল হলো একবার। এর মধ্যে যে কত মাঝিকে পটানো হলো লঞ্চের সাথে থেকে দেখিয়ে দেয়ার জন্য কিন্তু লাভ কিছুই হলো না। তাদের বাতলে দেওয়া পথেও চোরা পাহাড় থেকে বাচা গেল না।
লঞ্চ যখন নানান ডুবো পাহাড়ে গোত্তা খাচ্ছিল তখন বিপ্রদাস বড়–য়া ব্যস্ত ছিলেন অভিযাত্রীদের এই নদীপথ সম্পর্কে নানান তথ্য দিতে। লঞ্চ যাচ্ছে কাসালং নদী দিয়ে। আর এই পুরো ব কে রয়েছে কর্ণফুলী, মাইনী এবং চেংরি নদী। এই ফাঁকে স্বর্ণা সকলের মাঝে টি-সার্ট ও সূর্য মুকুট বিলিয়ে দিল। সমস্ত প্রতিবন্ধকতা পার করে অবশেষে সকাল ৯টায় লঞ্চ পৌঁছলো আমাদের বহুল প্রতিক্ষিত পাবলাখালীর ঘাটে। সদলবলে আমরা উঠলাম জঙ্গলের রেষ্টহাউজ ‘বনসখী’তে। এখানেই হবে আমাদের পরবর্তী কার্যক্রম। মনিরকে আগেই বলাছিল দেড়শ লোকের নাস্তার আয়োজন করে রাখতে এবং সে তার দায়িত্ব দক্ষতার সাথেই পালন করেছে। অভিযাত্রী দল লাইনে দাড়িয়ে যার যার খাবার সংগ্রহ করলেন। যে রান্না ঘরটা থেকে খাবার পরিবেশন করা হচ্ছিল রেকি করতে এসে সেটা আধ-ভাঙ্গা দেখেছিলাম। না ঝড়ে ভাঙ্গেনি ভেঙ্গে দিয়েছিল বন্য হাতি। এ খবর শুনতেই অভিযাত্রীদের কারো কারো মধ্যে আতঙ্ক, কারো কারো মধ্যে উত্তেজনা দেখা গেল। নাস্তা সেরে তাই দলবল নিয়ে বেড়িয়ে পড়লাম জঙ্গল দর্শনে। পুরো দলের নেতৃত্ব দিচ্ছিলেন বিপ্রদাশ বড়–য়া, মোকারম হোসেন। সাথে কয়েকজন বনকর্মকর্তা ও নিরাপত্তারক্ষিও ছিল। তারা জানালেন, কাসালং রিজার্ভের অংশ বিশেষ এই বন চারটি ব ক নিয়ে গঠিত-শিশক পশ্চিম, শিশক পূর্ব, সর্বাতলী পূর্ব এবং মাইখ্যা ব ক। মিয়ানমার আর ভারতের সীমান্ত ঘেসা এই পাবলাখালী বনের পুরোটাই পাহাড়ী জঙ্গলবিশেষ মাঝ দিয়ে বয়ে চলা ছোট ছোট খাল সৃষ্টি করছে ছোট ছোট দ্বীপের। বড়–য়া মশাই অভিযাত্রীদের ধরে ধরে চেনালেন চাম্ভুল, লোহাকাঠ, কাননচূড়া, পদাউক, আদি কাটা মেহেদী, শীলকড়ই, কাজুবাদাম, সেগুন ইত্যাদি। বনের ভিতর একটু ঢুকতেই গাছের ফাঁকে কিছু একটা নড়েচড়ে উঠতেই থমকে দাড়ালাম সকলে। শীতল শিহরণ নেমে গেল মেরুদন্ড বেয়ে। হাতি নয়তো! আমাদের অবাক করে দিয়ে এক ছুটে গাছে উঠে গেল এক বানর ছানা। আরও কিছু দূর যেতে চোখে পড়লো নরম মাটিতে হাতির তাজা পায়ের ছাপ। হয়তো গত রাতেই চড়ে বেড়িয়েছে হাতির দল।
পাশে পরে আছে হাতির লেদা। হাতির হজম শক্তি খুব খারাপ, যা খায় তার অল্পই হজম করতে পারে। চ্যানেল আইয়ের রহমান মোস্তাফিজ দেখালেন সাপের ফেলে রাখা খোলস। দূরের গাছটাতে ছুটাছুটি করছে কয়েকটা কাঠবিড়ালি। হঠাৎই তীক্ষè ডাক দিয়ে হলুদ ডানা ঝাপটে উড়ে গেল একটি পাখি। বড়–য়া মশাই বললেন, এর নাম ‘বেনে বৌ’। নিরাপত্তার খাতিরে জঙ্গলের বেশি ভেতরে আমাদের যেতে দেয়া হল না। অগত্তা জঙ্গল পরিভ্রমণের ইতি টেনে ফিরে এলাম রেষ্টহাউজে। ফিরে দেখি অবাক কান্ড! রেষ্টহাউজের সামনে উঠছে চলি শ ফিট লম্বা বিশাল এক রঙিন সূর্য। বেনীআসহকলা সূর্যের এই সাত রঙের মিশেলে বানানো হয়েছে কাপড়ের এই সূর্য। মাঝখানে লাল হলুদ কমলা ১৫ ফুট ব্যসের এক বৃত্ত। তার চারপাশে সাত রঙের সাতটি ডানা। টান টান করে বেঁধে দেয়া হয়েছে গাছের সাথে। সকালের সূর্য না দেখার কষ্টটাকে ভুলতেই বুঝি এই আয়োজকদেও এই আয়োজন। চারদিকে বাঁশে মাথায় উড়িয়ে দেয়া হল সাত রঙা পতাকা। অভিযাত্রী বনকর্মকর্তা, সেনাকর্মকর্তাসহ স্থানীয় সকলে এর মাঝে দাড়িয়ে ছবি তুললো। এখানকার স্কুলের শিশুরাও চলে এসেছিল উৎসবে যোগ দেয়ার জন্য। তাদের জন্য আগে থেকে কিছু খেলনা নিয়ে এসেছিলাম- বাশি, টুমটুম গাড়ি, বেলুন পেয়ে তো তারা মহা খুশি। তাদের নিয়ে আরও কিছু অনুষ্ঠান করার ইচ্ছা ছিল, তবে সময়ের অভাবে করা সম্ভব হলো না। সন্ধ্যের আগেই আমাদের ফিরতে হবে রাঙ্গামাটি। দুপুর নাগাদ লঞ্চ ছুটলো রাঙ্গামাটির উদ্দেশ্যে। সেই সাথে ছুটলো মনিরের খাবারের ট্রলার। মনির দুপুরের খাবার ট্রলারে করে নিয়ে এসেছিল। ট্রলার থেকে খাবার বেড়ে পে ট লঞ্চে দিচ্ছে আর হাতে হাতে পৌঁছে যাচ্ছে অভিযাত্রীদের হাতে।
প্রকৌশলী মঞ্জুর ভাইয়ের দুই ছেলে চমৎকার ভলেন্টিয়ারী কাজ করলো। মনির খাবার শেষ করে মাইনী মুখ থেকে সকলের কাছ থেকে বিদায় নিয়ে ফিরে গেল পাবলাখালী। আর অন্যরা যোগ দিল সেলিম ভাইয়ের গানের আসরে। সেলিম ভাইয়ের গান সকলকে মাতিয়ে রাখলো সাড়াটা পথ। এক ফাঁকে আমি সকলের হাতে ফ্রেন্ডশীপ ব্যান্ড পরিয়ে দিলাম। বন্ধুত্ব করার এই তো সুযোগ। ঘোর সন্ধ্যায় ফিরে এলাম রাঙ্গামাটির ফিশারিজ ঘাটে। মাঝে অবশ্য শুভলং থেমেছিলাম সবুজ পাহাড়ের ছায়া ঘেরা লেকটাকে পাহাড়ের উপড় থেকে দেখার জন্য, এই ফাঁকে অনেকে শুভলং বাজারে হালকা নাস্তাও সেরে নিলেন। সুফিয়াতে রাতের খাবার শেষ করে বাস ছেড়ে দিল ঢাকার পথে। দু’দিনের টানা সফরে ক্লান্ত শহুরে মানুষগুলো আবার ফিরে যাচ্ছে যান্ত্রিক জীবনে এক টুকরো মায়াময় স্মৃতি আর আকাশে শুক্লপক্ষের চাঁদ নিয়ে। ঢুলু ঢুলু চোখে সবাই যখন বাসের নরম গদিতে শরীর এলিয়ে দিয়েছে, কারো কি মনে পড়েছিল পাশের চোরাখালী গ্রাম থেকে আসা সেই চাকমা শিশুটির কথা? এই প্রচন্ড শীতেও উদোম গা আর খালি পায়ে এসেছিল আমাদের কাছে। আবাক নেত্রে চেয়েছিল আমাদের দিকে। গরম কাপড়ে মোড়া এই মানুষগুলোকেই হয়তো তার কাছে সবচেয়ে অদ্ভুত দর্শনীয় বস্তু বলে মনে হয়েছিল।
অদেখা এক বনের পথে
Posted in ভ্রমণ on সেপ্টেম্বর 13, 2008| Leave a Comment »
অদেখা এক বনের পথে
মোকারম হোসেন
কোথাও বেড়াতে যাবার নিমন্ত্রণ উপেক্ষা করা কঠিন। কিন্তু আয়োজক সংস্থার কর্ণধার মশহুরুল আমিন মিলনের ভ্রমণ প্রস্তুতি ব্রীফ শুনে অনেকেই ভয়ে কেটেপড়ার কথা ভাবছিলেন। কারণ পাবলাখালী অভয়ারণ্যে নাকি হাতির উৎপাত আছে। সবশেষে তিনি আসল কথাটা পাড়লেন। সেই বনের ভেতর নাকি একটা রাতও কাটাতে হবে সবাইকে। আ্যডভেঞ্চার ট্যুর বলে কথা। সবার সঙ্গে আমিও সাহস সঞ্চয় করে বসে থাকলাম। শেষমেষ যাবার সিদ্ধান্ত হলো। রাঙামাটি জেলার মাইনি উপজেলায় অবস্থিত দেশের দ্বিতীয় বৃহত্তম অভয়ারণ্যে নতুন বছরের প্রথম সূর্য দেখতে যাব আমরা। ৩০ ডিসেম্বর রাতে গাড়িতে উঠতে গিয়ে দেখি এলাহি কান্ড। ১৩০ জনের একটা দল। নানান পথ, নানান মতের মানুষ। একদল সংবাদকর্মীও আছেন। চারচারটে গাড়ি দাঁড়িয়ে। 
সমস্ত কিছুই গোছাল। নওরোজ ইমতিয়াজ, মুসা ইব্রাহিম আর মশহুরুল আমিন মিলনকে ছুটোছুটি করতে দেখা গেল। আমার আগেই কথাশিল্পী ও নিসর্গী বিপ্রদাশ বড়–য়া চলে এসেছেন। ১১টা ৪০ মিনিটে রাতের নিস্তব্ধতা ভেঙে রাঙামাটির উদ্দেশ্যে আমাদের যাত্রা শুরু হলো। রাতভর কুয়াশার লুকোচুরি। পথের ওপরই যেন তাদের ঘরবাড়ি। আমাদের গাড়ি হঠাৎ করেই সেসব ঘরের ভেতর ঢুকে পড়ছে। তারপর আবার মুক্ত পথে। এভাবেই মধ্যরাত গড়িয়ে এলো। কুয়াশার চাদর যেন আদরমেখে আছে চারপাশে। কি মনে করে হঠাৎ থামল গাড়িটা। নষ্টটষ্ট হলো নাতো! বাইরে উঁকি দিয়ে বুঝলাম এখন চা বিরতি। অন্য গাড়িগুলোও এসে দাঁড়াচ্ছে। এটাও একটা চমক। জানতাম একছুটে একেবারেই চট্টগ্রাম। সবাই ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র দলে বিভক্ত হয়ে চা-গল্পে মেতে উঠল। অবশ্য বেশিক্ষণ এই গল্প চলল না, হ্যামিলনের বাঁশিঅলার (বাস) দিকে ছুটতে হলো। পরিবেশ-প্রকৃতির নানান প্রসঙ্গে আমাদের নির্ঘুম রাত কাটল। ভোরের আলো ফোটার আগেই আমাদের গাড়ি চট্টগ্রাম শহর অতিক্রম করল। কুয়াশামোড়ানো ভোরে রাঙামাটি শহরের হোটেল সুফিয়াতে গাড়ি থামল। হোটেলে ঢুকে দেখি সবকিছু প্রথম গাড়ির বন্ধুদের দখলে। বাথরুমের সামনে দীর্ঘ লাইন। যেন টিকিট কেটে সবাই গাড়িতে ওঠার জন্য অপেক্ষা করছে। এটাই বাস্তবতা। সবার জন্যতো আর একটা একটা বাথরুম থাকবে না।
বিপ্রদাশ বড়–য়া আমার আগে আগেই নাস্তার টেবিলে এসে বসলেন। নাস্তা সেরে ফিশারি ঘাটে অপেক্ষমান কেয়ারি কর্ণফুলিতে চেপে শুরু হলো আমাদের চমকপ্রদ ভ্রমণ। বার কয়েক ভ্রমণের সুবাদে দু’পাশের প্রায় সব দৃশ্য আমার মুখস্ত। এই অঞ্চলের সবছিুই বিপ্রদার নখদর্পণে। পাহাড়গুলোতে কোন কোন জাতের গাছ থাকে, কোন কোন জাতের প্রাণী থাকে। মানুষের নির্মমতায় যেসব প্রাণী ইতোমধ্যেই বিলুপ্ত হয়ে পড়েছে তাদের কথাও জানা গেল। প্রসঙ্গত তিনি হাতির গল্পও বললেন। আমরা যেখানে যাচ্ছি সেখানে প্রায়শই হাতির দেখা মিলে। এসব বন্যহাতিরা যথার্থই বিপদজনক। লঞ্চ ছাড়ার কিছুক্ষণের মধ্যেই এই দ্বিতল জলজানে উৎসব আমেজ ছড়িয়ে পড়ল। ক্রমেই দুর্গম হয়ে উঠছে পাহাড়। কোথাও খাড়া পাহাড়, কোথাও ঘনজঙ্গল, কোথাও পাহাড়ের গায়ে সময়ের বলিরেখা স্পস্ট। শাখামৃগ বানরের দল নেমে এসেছে লেকের কিনারে। এখানে তাদের বিরক্ত করার কেউ নেই। তারপর চোখে পড়ল শীতের হতশ্রী সুবলং ঝরনা। নানান কৃত্রিম স্থাপনায় এখানকার প্রাকৃতিক সৌন্দর্য বিঘিœত হয়েছে। তারপর সুবলং বাজার। কাছাকাছি দূরত্বে পেদা তিং তিংয়ে পেটপুরে খাবার ব্যবস্থা। এদিকের পাহাড়গুলো ন্যাড়া। এরই ফাঁকে নওরোজ ইমতিয়াজের সঞ্চলনায় শুরু হলো আলোচনা পর্ব । মুসা ইব্রাহিম জানালেন অ্যাডভেঞ্চার আর পাহাড়ে ঘোরার গল্প ও করণীয়, বিপ্রদাশ বড়–য়া বললেন এখানকার আদি ইতিহাস, জীববৈচিত্র আর প্রাকৃতিক সৌন্দর্য নিয়ে। আমি বললাম ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতার কথা। বিশ বছরের ব্যবধানে এখানে বদলে গেছে অনেক কিছুই। কিন্তু ততক্ষণে সবার চোখ দু’পাশের অপার সৌন্দর্যের কোলে সমর্পিত। জলচর পাখিদের সঙ্গে শীতের অতিথি পাখিরাও নেমেছে। কোথাও কোথাও পাহাড় অনেক দূরে সরে যাচ্ছে। মাঝে মাঝে পণ্যবাহী ট্রলার পাশকাটিয়ে চলে যায়। কিছু কিছু টিলা বিচ্ছিন্ন, দ্বীপের মতো। এমন কয়েকটি বাজারও চোখে পড়ল।
সংখ্যায় আদিবাসীরা কম। বাসস্থান হারিয়ে তারা আরো গভীর পাহাড়ে ঠাঁই নিয়েছে। কাপ্তাই বাঁধের কারণে সরু নদীর পানি ফুলেফেঁপে লেকে পরিনত হয়েছে। তাতে এখানকার জীববৈচিত্রও মারাÍক ক্ষতির সম্মুখীন হয়েছে। পৌষের সোনারোদ, পাহাড়, অরণ্য আর নীল জলরাশির মোহ সবাইকে যেন আচ্ছন্ন করে রাখল। এদিকে দুপুর গড়িয়ে এলো। তবুও ক্লান্তিহীন চোখ। দুপুর আড়াইটার দিকে আমরা মাইনিমুখ বাজার পৌঁছালাম। ছোট হোটেল, দুই পর্বে সারল খাবার। তারপর পাশ্ববর্তী রাবেতার কলেজের উদ্দেশ্য লঞ্চ মুখ ঘোরালো। সেখানেই আমাদের রাত যাপনের ব্যবস্থা। নিরাপত্তা ও বিবিধ কারণে পাবলাখালীতে রাতযাপনের সিদ্ধান্ত বাতিল। এতে ৪০ ভাগ অ্যাডভেঞ্চার কমে গেল। ব্যাগ-বোচকা রেখে সবাই ছড়িয়ে পড়লেও সুতার টানে আবার ৭টার দিকে লাগোয়া হ্যালিপ্যাড চত্বরে ফিরে এলো সবাই। কেউ কেউ ছুটলেন বছরের শেষ সূর্যকে বিদায় জানাতে। সেখানে পরিচয় পর্বের পর একজন সেনাকর্মকর্তা সবাইকে প্রয়োজনীয় পরামর্শ দিলেন।
কলেজের মাঠেই রাতের রান্নার আয়োজন। ওদিকে প্রথম প্রহরের প্রস্তুতি। দলে দলে ভাগ হয়ে বসল সবাই। রঙিন কাগজ, সরা আর মোমবাতির সমন্বয়। একফাঁকে রাতের খাবারটা সেরে ফেলল সবাই। তারপর মধ্যরাতের আগেই সবাই লেকের ধারে জড়ো হলাম। সবার বয়েআনা মঙ্গল প্রদীপগুলো লেকের পানিতে ভাসিয়ে দেওয়া হলো। জিরো আওয়ারে রাতের আকাশ উজ্জ্বল করে জ্বলল ফ্লেয়ার। আর তখনি সবার হর্ষধ্বনি। তারপর আকাশে উড়ল ফানুস। প্রথম প্রহরের এই অনুষ্ঠানে যোগদিতে সপরিবারে এলেন মাইনির ২৫ বেঙ্গল রেজিমেন্টের জোন কমান্ডার লে. কর্ণেল মুস্তাফিজ। প্রথম প্রহরকে বরণ করার আনুষ্ঠানিকতা চলল অনেকক্ষণ। মধ্যরাতের এমন উৎসব এখানকার মানুষ কি আর কখনো দেখেছে। এবার ঘুমোতে যাবার পালা। তাও মাত্র দু’ঘন্টার জন্য। রাত চারটায় আবার কেয়ারি কর্ণফুলির যাত্রা। উদ্দেশ্য পাবলাখালীতে গিয়েই বছরের নতুন সূর্যকে দেখা। কিন্তু আমাদের আশা নিরাশায় পরিনত হলো। ঘনকুয়াশায় যাত্রা স্থগিত। লেকের পানিতে কনকনে শীতের ভেতর সবার কাঁপাকাঁপি অবস্থা। অবশেষে ভোর ছয়টার দিকে লঞ্চ ছাড়ল। সেনাবাহিনীর একটি দলও আমাদের সঙ্গে ইঞ্জিন নৌকা নিয়ে চলল। অসংখ্য ডুবোচরে পথ হারিয়ে পাবলাখালী পৌঁছুতে প্রায় দু’ঘন্টা সময় লাগল। তখনো দেখা নেই সূর্যদেবের। এই অরণ্যের রেস্টহাউস ‘বনসখীতে’ সকালের নাস্তার ব্যবস্থা।
কিন্তু যে রসুই ঘরে তৈরি হলো আমাদের নাস্তা সে রসুইঘর নাকি কিছুদিন আগে বন্যহাতির দল গুড়িয়ে দিয়েছিল। এমন খবর শোনার পর সবার চেহারায় ফের আতঙ্কের ছাপ। রেস্ট হাউসের অদূরে গাছের ডালে বানর দেখে সেই আতঙ্ক আরো বদ্ধমূল হলো। এবার বনে ঘোরাঘুরির পালা। কেউ কেউ থেকে গেলেন সূর্য বানাতে। আমরা চললাম বন দেখতে। বিচিত্র পাখির ডাক শোনা যাচ্ছে। ইতোমধ্যেই অনেক গাছ চোখে পড়েছে। চুন্দুল, কনকচূড়া, পাদাউক, আদি কাঁটা মেহেদী, আদি জারুল, শীলকড়ই, চাপালিশ, কাজুবাদাম, সেগুন ইত্যাদি। তারপর কিছু গর্জন, মুচকুন্দ, গুলগুলি লতা, শিমূল, নাগেশ্বর। অগভীর বনে এত অল্পকিছু দেখে মন ভরল না। নিরাপত্তার খাতিরে বেশি নিবিড়তায়ও যাওয়া গেল না। এখান থেকে মাত্র ৮/১০ কিমি. দূরে ভারতের মিজোরাম বর্ডার। ৪২ হাজার ৮৭ হেক্টর আয়তনের এই বনে আরো আছে রেসাস বানর, মুখপোড়া হনুমান, উল ুক, বন্য শূকর, বনবিড়াল, উদবিড়াল আর বিচিত্র পাখি। হাতি আর বানর মোটামুটি সহজলভ্য। কিছুক্ষণের মধ্যেই আমরা রেস্টহাউজে ফিরে এলাম। বন্ধুদের প্রচেষ্টায় তৈরি হলো এক ঝলমলে সূর্য। তারপর তাকে মাটির শয্যায় সাজানো হলো।
এবার নতুন সূর্যের পাশে দাঁড়িয়ে ছবি তোলার পালা। সূর্য উৎসবের আনুষ্ঠানিকতা এখানেই শেষ। ওদিকে দুপুর হয়ে এসেছে। আজকেই আমরা ফিরে যাব রাঙামাটি শহরে। সেখান থেকে ঢাকার গাড়িগুলো ছাড়বে। কিন্তু দুপুরের খাবার যে তখনো বাকি। সিদ্ধান্ত ছিল এখানে খাওয়া দাওয়া হবে, তারপর লঞ্চ ছাড়বে। কিন্তু সময় স্বল্পতার কারণে তা আর হলো না। বেছে নেয়া হলো এক অভিনব পদ্ধতি। খাবারগুলো একটা ছোট্ট নৌকায় তুলে কেয়ারি কর্ণফুলীর সঙ্গে বাঁধা হলো। ছেড়ে দিল লঞ্চ। পেছনে কাসালং, মাইনি আর কর্ণফুলী। আমাদের বিদায় জানাতে এসেছে গ্রামের শিশুরা। লঞ্চ ছেড়ে দেবার কিছুক্ষণের মধ্যেই খাদ্যতরী থেকে খাবার পরিবেশন শুরু হলো। সবাই সিটে বসেই খাবার খেয়ে নিল। এটাও একটা মজার অভিজ্ঞতা। আবার দু’পাশের সেই মনোহর দৃশ্য। ক্লান্ত হয় না চোখ।
রাঙ্গামাটির প্রাকৃতিক মনোমুগ্ধকর সৌন্দর্য্য উপভোগ করবেন কিভাবে
Posted in ভ্রমণ on সেপ্টেম্বর 13, 2008| Leave a Comment »
সত্রং চাকমা, সাংবাদিক, দৈনিক সমকাল
রাঙ্গামাটির রঙে চোখ জুড়ালো সাম্পান মাঝির গানে মন ভরালো………। আসলে গানের মতোই রাঙ্গামাটির পথ। পাহাড়ের আকা বাকাঁ পথ, উচুনিচু পাহাড়-পর্বত বেষ্টিত সবুজ অরন্যে ঝর্ণা ঘেরায় অপরুপ প্রাকৃতিক সৌন্দর্য্য আপনার মনকে সহজেই আকৃষ্ট করবে। বন্দর নগরী চট্টগ্রাম থেকে মাত্র ৭০ কিলোমিটার দুরবর্তী পশ্চিমে বৃহত্তর চট্টগ্রাম জেলা, পূর্বে ভারতের মিজোরাম রাজ্যে, উত্তরে পার্বত্য খাগড়াছড়ি এবং দক্ষিণে পার্বত্য বান্দরবান জেলার অবস্থানে প্রাকৃতিক সৌন্দর্য্যরে শহর রাঙ্গামাটি। রাঙ্গামাটির মোট আয়তন হচ্ছে ৬ হাজার ৪শ ৮১ বর্গকিলোমিটার। জলবিদ্যূৎ উৎপাদনের জন্য ১৯৬০ সালে কর্ণফূলী নদীর ওপর বাধঁ দিয়ে কাপ্তাইয়ে নির্মিত হয় ২৫৬ বর্গমাইল এলাকা বি¯তৃত কৃত্রিম জলধারা(কাপ্তাই হ্রদ)। এ জলধারে তলিয়ে গেছে ৫৪ হাজার একর প্রথম শ্রেনীর আবাদী জমিসহ পূরনো রাজবাড়ি, বহু পূরণো অনেক বৌদ্ধ মন্দির, বাজার,শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, অসংখ্য ঘরবাড়ি এবং বিস্তীর্ন সবুজ বনবনানী। এ বাধেঁর ফলে উদ্ধাস্তু হয়েছিল প্রায় এক লাখের বেশী লোক। কৃত্রিম কাপ্তাই হ্রদ সৃষ্টি হওয়ার কারণে রাঙ্গামাটিতে গড়ে উঠে আকর্ষনীয় পর্যটন স্পট। ৭০ দশকের শেষের দিকে সরকার রাঙ্গামাটি জেলাকে পর্যটন এলাকা হিসেবে ঘোষনা করে এবং পর্যটন কর্পোরেশন পর্যটকদের সুবিধার্থে আকর্ষনীয় স্পট স্থাপন করে। পর্যটন কর্পোরেশন স্পটে হোটেল, অফিস এবং মনোরঞ্জনের জন্য দুই পাহাড়ের মাঝখানে একটি আকর্ষনীয় ঝুলন্ত সেতু স্থাপন করে।

এ ঝুলন্ত সেতুর পূর্বের দিকে তাকালে দেখা যাবে অপূর্ব জলরাশিসহ ছোটবড় বি¯তৃণ সবুজ পাহাড়। নৈসর্গিক সৌন্দর্যের অপরূপ লীলা ভুমি ও মনোলোভা আকর্ষণীয় পর্যটন স্থানগুলো উপভোগ করতে চাইলে আপনি এক্ষুনি ঘুরে আসতে পারেন রাঙ্গামাটির অপরুপ প্রাকৃতিক সৌন্দর্য্য। কি কি দেখার রয়েছেঃ পর্যটনের ঝুলন্ত সেতু, সুভলং ঝর্ণা ও প্রাকৃতিক সৌন্দর্য্য,ে পেদা টিং টিং, সাংফাং রেস্টুরেন্ট, চাকমার রাজার রাজ বাড়ি, রাজ বন বিহার, উপজাতীয় যাদু ঘর, জেলা প্রশাসনে বাংলো, বীর শ্রেষ্ঠ মুন্সি আব্দু রউফের সমাধি সৌধ এবং আদিবাসীদের গ্রাম ও জীবনযাত্রার দৃশ্য। এখানে আদিবাসীদের জীবন যাত্রা সর্ম্পকে বিশেষভাবে জানার ইচ্ছা থাকলে স্থানীয় উপজাতীয় সাংস্কৃতিক ইনষ্টিটিউট এ গিয়ে জানা যায়। প্রতিবছর এপ্রিলে আদিবাসীরা “বিজু-সাংগ্রাই-বৈসুক উৎসব বা চৈত্র সংক্রান্তী উৎসব” হয় ব্যাপক উৎসাহ-উদ্দীপনা ও জাকজমকভাবে। অর্থাৎ প্রতি বছর এপ্রিল মাসের দ্বিতীয় সপ্তাহের দিকে এ উৎসব পালিত হয়ে থাকে। এটি পার্বত্য চট্টগ্রামে আদিবাসীদের প্রধান সামাজিক উৎসব। দর্শনীয় স্থানগুলোতে কিভাবে যাবেন ঃ রাজবাড়ী, উপজাতীয় যাদুঘর, জেলা প্রশাসন বাংলো, রাজ বন বনবিহার ইচ্ছে করলে আপনি একটি সিএনজি বা বেবী টেক্সী ভাড়া করে ঘুরে আসতে পারেন। কারণ এগুলো একেবারেই শহরের মধ্যেই অবস্থিত। বলে রাখা ভাল, চাকমা রাজ বাড়ীতে অতীত চাকমা রাজ বংশের বেশ কিছু নিদর্শন রয়েছে।
চাকমা রাজ বাড়ী, পুরনো একটি কামান, রাজ দরবার দেখার মতো। চাকমা রাজা আদিবাসী পাহাড়িদের কাছে অত্যন্ত সন্মানীত। রাঙ্গামাটির আরেকটি দর্শনীয় স্থান হচ্ছে রাজ বন বিহার। রাজ বন বিহার বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বীদের জন্য একটি তীর্থস্থান হিসাবে পরিগনিত। বৌদ্ধ ধর্মের বেশ কিছু নিদর্শনও রয়েছে এখানে। পার্বত্য বেীদ্ধ ধর্মীয় গুরু বনভন্তে এ বিহারে তাঁর অবস্থান। উপজাতীয় যাদুঘরে রয়েছে পার্বত্য চট্টগ্রামের উপজাতীয়দের কৃষ্টি,সংস্কৃতির প্রাচীন নিদর্শন। উপজাতীয় সাংস্কৃতিক ইনিষ্টিটিউটে এ যাদুঘর নির্মিত হয়েছে। রাঙ্গামাটির আরেকটি প্রধান আকর্ষন হচ্ছে পর্যটন কমপেক্সে। এ পর্যটন কমপে ক্সের ঝুলন্ত ব্রীজটি দেখার মতো। দুটি পাহাড়ের মধ্যে সংযোগ ঘটিয়ে কাপ্তাই হ্রদের উপর ঝুলে আছে এ সেতু। বছরের দু,এক মাস অবশ্য এ সেতু হ্রদের পানিতে ডুবে থাকে। তবে শীতের মৌসুমে কাপ্তাই হ্রদের পানি কমে যাওয়ায় সেতুর উপর পানি থাকে না। পিকনিক করতে আসা লোকজন খুব আনন্দ নিয়ে সেতু পার হয়ে পাহাড়ের চুড়ায় পিকনিক করে থাকে। রাঙ্গামাটির ঝুলন্ত সেতু দেততে হলে আপনাকে পর্যটন কর্পোরেশনকে মাথাপিছু ৫টাকা দিতে হবে। এছাড়া সুভলং ঝর্ণা বা সুভলংএর প্রাকৃতিক দৃশ্যে,নানিয়ারচরের বুড়িঘাট এলাকায় বীর শ্রেষ্ঠ মুন্সি আব্দুর রউফ এর স্মৃতি সৌধ,পেদা টিং টিং, সাংফাং রেস্টুরেন্ট, ইকো টুক টুক ভিলেজএর পর্যটন স্পট দেখতে হলে আপনাকে অবশ্যই ইঞ্জিন চালিত নৌকা ভাড়া করতে হবে। এখানে মনে করিয়ে দেয়া ভাল সুভলং এর প্রাকৃতিক ঝর্ণা খুবই উপভোগ করার মতো ও সুভলং এর প্রাকৃতিকদৃশ্য অত্যন্ত মনোমুগ্ধকর। তবে বর্ষা মৌসুমেই ঝর্নাগুলো জীবন্ত থাকে। শীতে ঝর্ণা গুলোতে খুব একটা পানি থাকে না। নানিয়ারচরের বুড়িঘাটে রয়েছে বীর শ্রেষ্ঠ শহীদ ল্যান্স নায়ক মুন্সি আব্দুর রউফের স্মৃতিসৌধ। বীর শ্রেষ্ঠ ল্যান্স নায়ক মুন্সি আব্দুর রউফ মুক্তিযুদ্ধের সময় নানিয়ার চরের বুড়িঘাটে শহীদ হন। স্থানীয় এক আদিবাসী তাঁকে ওই স্থানে কবর দিয়েছিলেন। রাঙ্গামাটির বি ডি আর ওই স্থানে এ স্মৃতিসৌধ নির্মান করেছেন। তবে এসব স্থান পরিদর্শনের সময় সারাদিনের জন্য নৌকা ভাড়া করলে এক সঙ্গে রাজবাড়ি, বন বিহার, পর্যটনের ঝুলন্ত সেতু ও জেলা প্রশাসকের বাংলোও দেখতে পারবেন। ইঞ্জিন বোটে করে যাওযার সময় কাপ্তাই হ্রদের স্বচ্ছ জলরাশির বুক ছিড়ে যখন সুভলং এ দিকে এগোবেন তখন প্রথমে একটি সবুজ দ্বীপের মাঝে চোখে পড়বে বেসরকারী পর্যটন স্পট পেদা টিং টিং রেস্টরেন্ট ও পর্যটন স্পট। পেটাটিং টিং শব্দটি চাকমা ভাষায় নামকরণ করা হয়েছে। এর অর্থ হল পেট ভরে খাওয়া। ১৯৯৭সালে পার্বত্য শান্তি চুক্তির পরবর্তী সময়ে রাঙ্গামাটি শহরের অদূরে বালুখালীতে গড়ে উঠেছে এ বেসরকারী পর্যটন পেদা টিং টিং। পুরো একটি সেগুন বাগানকে পর্যটন কেন্দ্রে পরিনত করা হয়েছে।
সারি সারি সেগুন গাছের সাথে রয়েছে কিছু বনের পশু পাখি। এখানে উপজাতীয় ঐতিহ্যের খাবার সহ রকমারী খাওয়ার জন্য রয়েছে রেষ্টুরেন্ট ও থাকার জন্য রয়েছে উপজাতীয় ঐতিহ্যের টং ঘর। তাছাড়াও পেদাটিং টিং পর্যটন স্পটের একট অদুরে মনোরম প্রাকৃতিক পরিবেশে গড়ে উঠেছে পর্যটন বা পিকনিক স্পট সাংফাং ও ইকো টুক টুক ভিলেজ। এখানেও আদিবাসীদের ঐতিহ্যের খাবারসহ রকমারী খাওয়ার জন্য রয়েছে রেষ্টুরেন্ট। পেদা টিং টিং ফেলিয়ে সবুজ পাহাড়ের বুক ছিড়ে যখন সুভলং উদ্দেশ্যে এগোতে থাকবেন তখন দেখতে পাবেন কিছূ আদিবাসী গ্রাম। সেখানে রয়েছে নির্মল পাহাড়ি সরলতা ও জীবনযাত্রা। আপনি ইচ্ছে করলে সে সব গ্রাম ঘুরে দেখতে পারেন। আর এসব গ্রামের পাহাড়ের মাঝে মধ্যে দেখতে পাবেন জুমক্ষেত(পাহাড়ের চূড়ায় চাষাবাদ)। এভাবে মনোমুগ্ধকর পরিবেশে যেতে যেতে এক সময় পৌঁছে যাবেন নয়নাভিরাম সুভলং। সুভলং এর ঝর্ণার কাছাকাছি পৌঁছতে দেখতে পাবেন দু’দিকে সুউচ্চ পাহাড়। এক সময় এখানে কাপ্তাই বাঁধ নির্মানের জন্য পরিকল্পনা নেয়া হয়েছিল কিন্তু বাঁধ নির্মান করা হলে ভারতের কিছু এলাকা জলমগ্ন হয়ে যায়। তাই সে কারণে পরিকল্পনা বাতিল করা হয়েছিল। এর পর দেখতে পাবেন পাহাড়ের কোল থেকে নেমে আসা কয়েকটি ঝর্না। তবে এর মধ্যে সব চেয়ে বড় ঝর্ণাটিতে দেখলে সত্যিই মনের মধ্যে ভালো লাগবে। এসব ঝর্ণাতে পাহাড়ের ওপর থেকে নেমে আসা ঝর্ণার পানির পাথুরে মাটিতে আছড়ে পড়ার অপূর্ব দৃশ্য। এখানে আপনি ইচ্ছে করলে গোসল করতে পারবেন ও আপনার সাথে ক্যামরা থাকলে পছন্দ মত ছবিও নিতে পারেন। এখানে মনে করিয়ে দেয়া ভালো ঝর্ণার পানি সাধারণত বর্ষার মওসুমে সময় সচল থাকে। শুস্ক মওসুমে একেবারেই পানি থাকে না। তবে এ ঝর্ণাটি দেখতে হলে আপনাকে প্রবেশ ফি হিসেবে পাঁচ টাকার টিকিট কাটতে হবে। এরপর ঝর্ণা দেখা শেষ হলে আপনি কিছুক্ষনের জন্য সুভলং বাজারে ঘুরে আসতে পারেন। সেখানে সেনাবাহিনীর একটি মনোরম ক্যান্টিনও রয়েছে। ইচ্ছে করলে সেখান থেকে হালকা নাস্তা, চা খেতে পারেন। কারণ এখান থেকে সোজাসোজি আপনাকে রওনা দিতে হবে শহরে দিকে। এছাড়াও রাঙ্গামাটি শহরের অদুরে বালুখালীতে হট্টিকালচার নার্সারীর বিশাল এলাকা জুড়ে যে উদ্যান রয়েছে তার সৌন্দয্যও পর্যটকদের দৃষ্টি আকৃষ্ট করেছে। প্রায় সব সময় এ উদ্যানে পিকনিক হচ্ছে। হর্টিকালচার নার্সারীটি পরিণত হয়েছে আরেক পর্যটন কেন্দ্রে সারি সারি ফল ও ফুল গাছের সাথে রয়েছে কিছু বনের পশু পাখি কিচির মিচির ডাকের শব্দ। সব মিলিয়ে এ উদ্যান পর্যটকদের কাছে অত্যন্ত আকর্ষনীয় স্থান হিসাবে পরিচিতি পেয়েছে। বোট ভাড়া কোথায় পাওয়া যায়ঃ ইঞ্জিন চালিত নৌকা বা বোট ভাড়া রাঙ্গামাটি শহরে কয়েকটি স্থানে পাওয়া যাবে।
তবলছড়ি বাজারস্থ বোট ঘাটে, রির্জাভ বাজার, বনরুপায়। এখানে বোট ওয়ালা নতুন লোক হলে আপনার কাছ থেকে হয়তো বেশী ভাড়া চাইতে পারে। তার জন্য দরদাম করে নেয়াই ভালো হবে। সারাদিনের জন্য ভাড়া বা শুভলং যেতে চাইলে আপনাকে আট থেকে এক হাজার টাকা দিতে হবে। আর যদি ২/৩ ঘন্টার জন্য ভাড়া করেন ৬/৭শ টাকা দিতে হবে। এছাড়া পর্যটনের ঝুলন্ত সেতুর পাশেও বোট ভাড়া পাওয়া যায়। তবে সেগুলো একটু ভাড়া বেশী। কেনাকাটা করতে চানঃ পাহাড়িদের তৈরী কাপড়-চোপড় ও হাতের তৈরী বিভিন্ন জিনিসপত্র আপনার বন্ধুর জন্য বা যে কারোর জন্য অথবা আপনার নিজের জন্য কেনাকাটা করতে পারেন। এসবে মধ্যে রয়েছে তবলছড়ি এলাকায়। বিশেষ করে তবলছড়ি বেইন টেক্স টাইল শো রুমে, বনরুপার জুমঘর ও রাজবাড়ি এলাকায় সজপদর। এসব শো রুম থেকে কম দামে বিভিন্ন জিনিসপত্র কিনতে পারেন। কোথায় উঠবেনঃ রাঙ্গামাটি পর্যটন মোটেল। এই মোটেল শহর থেকে একটু দূরে হলেও মনোরম প্রাকৃতিক পরিবেশে বেষ্টিত। এখানে প্রতি রুমের ভাড়া এসি বারশ টাকা, নন এসি ছয়শ টাকা। এছাড়া দল বেধে বন্ধু-বান্ধবদের নিয়ে বা পরিবার পরিজনদের নিয়ে থাকতে চান অসুবিধা নেই। এখানে কটেজের সুব্যবস্থা রয়েছে। প্রতি কটেজের ভাড়া পড়বে দেড় হাজার টাকা। বেসরকারী পর্যটন পেদাটিং টিং এ যারা নির্জন প্রাকৃতিক পরিবেশে রাতযাপন করতে পছন্দ বা যারা সদ্য বিবাহিত দম্পত্তি তারা এখানে হানিমুন করতে পারেন। এখানের প্রতিটি কটেজের ভাড়া পড়বে এক হাজার টাকা। এছাড়া হোটেল সুফিয়া, গ্রীণ ক্যাসেল, মোটেল জর্জসহ ইত্যাদি হোটেলে প্রতি রুমের এসি ভাড়া ৮শ টাকা ও নন এসি ৫শ টাকা। তবে কম দামের হোটলে থাকতে চান তাও পাবেন। কোথায় খাওয়াদাওয়া করতে চানঃ পর্যটনের নিজস্ব রেস্টুরেন্ট ও বার রয়েছে, তবলছড়ির অরণ্যেক রেস্টুরেন্ট, বনরুপায় ক্যাপে লিংক, দি রৌপ, রাজবাড়ির মেজাং ও হেবাং রেস্টুরেন্ট ,রির্জাভ বাজারের গ্রীন ক্যাসেল রেস্টুরেন্ট। এছাড়া আদিবাসীদের তৈরী নিজস্ব খাবার খেতে ইচ্ছে করে পাবেন অবশ্যই। এসব রেস্টরেন্টুটের মধ্যে রয়েছে পেদা টিং টিং। এছাড়া পেদাটিং টিং থেকে একটু নতুণ গড়ে উঠা রেস্টুরেন্ট সাংপাং। এখানে হুর হেবাং( বাশেঁর মধ্যে রান্না করা মুরগি তরকারী) বদা হেবাং(কলা পাতায় রান্নায় ডিম তরকারী) ইত্যাদি। পেদাটিং টিং টিং যেতে হলে শহর থেকে ২/৩ কিলোমিটার দূরে আপনাকে ইঞ্জিন বোটে করে যেতে হবে। অবশ্যই পেদাটিং টিং কর্তৃপক্ষের নিজস্ব বোট রয়েছে প্রতিজনকে ভাড়া দিতে হয় দশ টাকা করে। এজন্য আপনাকে রাঙ্গামাটি প্রেস ক্লাবের পাশে তাদের একটি অফিস রয়েছে সেখানে যোগাযোগ করতে হবে। অথবা ইচ্ছে করলে বোট ভাড়া করতে পারেন কয়েক ঘন্টার জন্য বোট ভাড়া লাগবে ৪/৫শ টাকা।
কাপ্তাই উপজেলাঃ কাপ্তাই না গেলে রাঙ্গামাটি বেড়াতে আসা আরও একটি সাধ অপূর্ন থেকে যাবে। এখানে কাপ্তাই জল বিদ্যূৎ উৎপাদন কেন্দ্র, কর্ণফূলী পেপার মিলস্, কর্ণফূলীর নদীর অপূর্ব দৃশ্য, কাপ্তাই জাতীয় উদ্যোন ইত্যাদি দেখার জায়গা রয়েছে। তবে কাপ্তাই জল বিদ্যূৎ উৎপাদন কেন্দ্র, কর্ণফূলী পেপার মিলস দেখতে চাইলে আপনাকে কর্তৃপক্ষের কাছে অনুমতি লাগবে। কাপ্তাই কর্ণফূলী নদীর ধারে খাওয়াদাওয়া করার জন্য অনেক রেস্টুরেন্টও রয়েছে। কাপ্তাইয়ে আপনি ইচ্ছে করলে রাতযাপনও করতে পারেন। তবে সে রকম ভালো মানের হোটেল নেই। তার চেয়ে কোন রেস্ট হাউসে উঠা ভালো হবে।
নৈসর্গীক সৌন্দর্যের পার্বত্য সাজেক
Posted in ভ্রমণ on সেপ্টেম্বর 2, 2008| Leave a Comment »