Feeds:
পোস্ট
মন্তব্য

Archive for সেপ্টেম্বর, 2008

সুন্দরবন, কিছু অনুভূতি, এবং একটি গল্পো।।
এ.এইচ.এম. আলী রেজা

আচছা, লোকটা কি বাতিকগ্রস্ত নাকি? কেন ? কোন কিছু চিন্তা-ভাবনা না করেই এই যে উনি ঘোষনা দিলেন, আমাদের এই অভিযানে যদি আমরা গোলবনের হাঁস (গধংশবফ ঋরহভড়ড়ঃ) দেখতে পারি তাহলে আমাদের এই পুরো দলের বান্দরবন ভ্রমনের ব্যবস্থা করবে গাইড টুরস। আর যে অভিযাত্রী প্রথম ঐ পাখীটিকে দেখবে তার জন্য দুটো ভ্রমনই একদম ফ্রি। আরে না, উনি কি কোন চিন্তা-ভাবনা ছাড়া এই ঘোষনা দিয়েছেন নাকি গাধা ? আমার তো তাই মনে হচ্ছে। কারনটা তো আমি বুঝতে পারছিনা। একটু বুঝিয়ে বলতে পারবি ? তাহলে শোন, প্রকৃতি প্রেমিক হাসান মনসুর সাহেব বিলুপ্তপ্রায় ঐ গোলবনের হাঁস পাখীটাকে পৃথিবীর বুকে টিকে থাকা নিশ্চিত করতেই ঘোষনাটা দিয়েছেন। এই যেমন ধর ঘোষনার কারনেই কিন্তু আমরা এই জাহাজের প্রায় ৬৫ জন মানুষ পাখিটার বর্তমান অবন্থা স¤পর্কে জানতে পেরেছি। আমাদের মধ্যে খুব অল্প পরিমান হলেও পাখিটাকে পৃথিবীর বুকে তার প্রকৃত আবাসভুমিতে টিকিয়ে রাখার ইচ্ছা জন্মেছে।

এবং …….. কথোপকথোন চলছিল পৃথিবীর বৃহত্তম স্রোতজ বনভুমি সুন্দরবনের সুপতি খালের মধ্যদিয়ে চলমান জাহাজ ‘এম.ভি. অবসর‘ এর একটি কামরায়। আলোচনায় অংশগ্রহনকারীরা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাণিবিদ্যা বিভাগের চতুর্থ বর্ষের কয়েকজন ছাত্র-ছাত্রী। ওরা ছাড়াও জাহাজে আছে একই বর্ষের প্রায় ৬০ জন ছাত্র-ছাত্রী। সপ্তাহব্যাপী এক শিক্ষাসফরে তারা এখন সুন্দরবনের আনাচে কানাচে ঘুরছে। সাথে রয়েছে বিভাগের দলনেতা ছাড়াও বেশ কয়েকজন শিক্ষক-শিক্ষিকা এবং তাদের গাইড সুন্দরবন বাঘ গবেষক জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের এক তরুণ শিক্ষক। শিক্ষার্থীদের সর্বোত্তম সেবা প্রদানের লক্ষ্যে দলের সঙ্গে যোগ দিয়েছেন গাইড টুরস এর ব্যবস্থাপনা পরিচালক জনাব হাসান মনসুর সাহেবের সহধর্মিনী মিসেস তপতী মনসুর। যাত্রার দিন। পূর্বনির্ধারিত সময় বিকাল ৩ টার মধ্যে ছাত্র-ছাত্রীরা বিভাগের সামনে পৌঁছে গেছে। কি যেন এক ভীষণ অস্থিরতায় ছটফট করছে সবাই। স্বপ্নীল সেই বনভূমিতে কখন পৌঁছাবে, অজানা-অনাবিস্কৃত সেই জগতকে কিভাবে দেখবে, কিংবা প্রিয়জন বা প্রিয়স্থান ত্যাগের বেদনায় অবশ হয়ে যাচ্ছে অভিযাত্রীদের তনু-মন। সদরঘাটে অপেক্ষামান এম.ভি. অবসরে পৌঁছতে প্রায় পাঁচটা। জাহাজের আকৃতি, ডিজাইন এবং অন্যান্য সুবিধাদি দেখে সবাই একেবারে মুগ্ধ। এতটা আশা করেনি কেউই। যেন ছোট-খাটো একটা টাইটানিক! সন্ধ্যার ঘনায়মান অন্ধকার নেমে আসার আগেই অবসর, ভেঁপু বাজিয়ে যাত্রা শুরু করল আগামী সাত দিনের স্বপ্নময় অভিযাত্রায়। মাষ্টার ব্রীজ থেকে ইঞ্জিনরূমে পাঠানো টুং টাং শব্দে আপার ডেকে ভীড় করা অভিযাত্রীদের সবাই যেন স্বপনপাড়ের ডাক শুনতে পেল। সহসা তাদের মনে প্রশ্ন জাগল, স্বপ্নলোকের সোনার চাবি কি তারা খুঁজে পাবে? জবাব পেল ভেতর থেকে, ‘নিশ্চয় পাবে‘।

তীব্র এ বিশ্বাস বুকে নিয়ে মোহময় আবেশ জড়িয়ে অভিযাত্রীরা এগিয়ে চলল অজানার উদ্দেশ্যে। সেদিন রাতে আলোচনা হলো পরবর্তী দিনগুলোতে তাদেরকে কি কি করতে হবে এবং কোথায় কোথায় যেতে হবে ইত্যাদি। রাতের খাবার শেষে সবাই ভীড় করল জাহাজের ডেকে। অন্ধকারের বুক চিরে জাহাজের সার্চ লাইট তার পথ খুঁজে নিচ্ছে। দূরে চলমান বা নোঙ্গরকরা যানগুলোর স্তিমিত আলো, জাহাজের গায়ে পানির ছলাৎ ছলাৎ শব্দ, ইঞ্জিনের ধুক ধুক আওয়াজ, বি¯তৃত আকাশে হীরের টুকরোর মত দ্যুতিময় অসংখ্য তারা, মুক্ত বাতাস – এমনই এক মোহময় আবেশ সৃষ্টি করেছে যেন সেটাকে আর জাগতিক কোন বাহন মনে হয়না। এ যেন অনন্ত নক্ষত্র বীথির কোন একটাতে মহাজাগতিক, অপার্থিব কোন এক বাহন। নিয়ে যাবে কোন এক স্বপ্নলোকে। পরেরদিন। ভোরে সবার ঘুম ভাঙলো সূর্যোদয়ের অনেক আগে। জাহাজ চলছে মেঘনা নদী দিয়ে, সোজা দক্ষিণে। ঘুম ভাঙতেই জাহাজের উপরের ডেকে চলে এলো অনেকেই। দেখল বিশাল থালার মত সূর্য পূর্বাকাশে ক্ষণে ক্ষণে তার রূপ বদল করছে। কি দ্রুততায় জ্বলন্ত এই বস্তুটি একটি দিনের আগমন বার্তা জানাচ্ছে। শহরের অপরিকল্পিত এবং অসামসঞ্জস্যপূর্ণ বিল্ডিং আর চুরি হয়ে যাওয়া আকাশে তারা কখনোই এটা প্রত্যক্ষ করেনি বা হয়ত করতে পারেনি। বাকি সারাদিন কেটে গেল ডেকে বসে চারপাশের পরিবেশ আর সেসব বিষয় নিয়ে গল্প করতে করতে। দূরে, বহু দূরে যত, দূর দৃষ্টি যায়; অনন্তকাল যেন ক্লান্তিহীনভাবে সেদিকে তাকিয়ে থাকা যায়। এ যেন স্বর্গের অনুভূতি, কি অপূর্ব, কি অকৃত্রিম। অভিযাত্রীদের মনে কে যেন চুপি চুপি বলে: ভালোবাসি, ভালোবাসি, ভালোবাসি, প্রাণভরে ভালোবাসি টকটকে লাল সূর্য, নীল আকাশ, বসন্তের হাওয়া, ছোট ছোট ঢেউ খেলে যাওয়া এ নদী – তোমাদের সত্যিই খুব ভালোবাসি। সহসা তারা উপলব্ধি করল, এই প্রকৃতি কত প্রানবন্ত, কত বিশ্বস্ত, কত অকৃত্রিম। মানুষের স্বেচ্ছাচারী মনোভাব আর কার্যকলাপে বিপন্ন এই প্রকৃতির কথা ভেবে হাহাকার জাগে তাদের হৃদয়ে।

তারা কাতর মিনতি করে ‘আমাদের কাছ থেকে তোমরা কখনো হারিয়ে যেও না‘। প্রকৃতি যেন কথা বলে ওঠে ‘এই সুন্দর পৃথিবীকে আমরা পর করতে চাই না, কিন্তু তোমাদের অদূরদর্শী আর স্বেচ্ছাচারী কার্যকলাপে আজ আমার প্রাণ ওষ্ঠাগত। জেনে রেখো তোমরা না থাকলেও আমি ভালো থাকব। কিন্তু আমি ভালো না থাকলে তোমরা শান্তিতে থাকতে পারবে না‘। সন্ধা সাড়ে সাতটা। মাস্টার ব্রীজ থেকে ঘোষনা এল ‘জাহাজ সুন্দরবন নামের স্বপ্নময় জগতে প্রবেশ করছে‘। জাহাজ চলছে দক্ষিণ-পূর্ব দিকে। উদ্দেশ্য সুপতি ফরেস্ট অফিস। যেখান থেকে বনে ঢোকার অনুমতি নিতে হবে। রাতের প্রাত্যহিক আলোচনায় সুন্দরবনের পরিচয়, এর ইতিহাস, বাস্তুতন্ত্র, সংরক্ষণ প্রয়োজনীয়তা, ইত্যাদি বিষয়ে বিস্তারিত আলোচনা করলেন তরুণ গবেষক জাবির শিক্ষক, সুন্দরবন যার গবেষণার ক্ষেত্র। মন্ত্র-মুগ্ধের মত সবাই শুনল এবং মনে মনে মিলিয়ে দেখার চেষ্টা করল যা শুনছে এবং যা দেখছে তার মধ্যে সামঞ্জস্য কতটুকু। কি আশ্চর্য ? পুরোটাই মিলে যাচ্ছে। প্রকৃতি এবং প্রাণী নিয়ে গবেষণার সার্থকতা খুজে পেল তারা। রাতের খাওয়া ও আলোচনা শেষে অভিযাত্রীরা আবার চলে গেল জাহাজের খোলা ডেকে। এক অপার্থিব সৌন্দর্যে বুঁদ হয়ে রইল সবাই। ডেকে চিৎ হয়ে শুয়ে আকাশের দিকে তাকিয়ে পলকহীন চোখে চেয়ে রইল কেউ কেউ। জাহাজ চলেছে নদীর বুক চিরে, পানিতে ফেনা তুলে। চারিদিকে দিগন্ত বিস্তৃত মেঘমুক্ত আকাশ। কৃঞ্চপক্ষ রাতের মোহনীয় সৌন্দর্য আপ ুত সবাই। সপ্তর্ষী, কালপুরূষ, ক্যাসিওপিয়া, স্করপিয়ন সহ অসংখ্য নক্ষত্রপুঞ্জের সমন্বয়ে গড়ে ওঠা আকাশ যেন অসংখ্য বিরহীর অশ্রƒজলে সাজানো। শীতের হিমেল হাওয়া আর আকাশের বিশাল বি¯তৃতির পটভুমিতে মাঝে মাঝেই কেঁপে কেঁপে ওঠে অভিযাত্রীদের চঞ্চল তনু-মন। সে এক অসীম অব্যক্ত ভালোলাগা। রাত সাড়ে দশটা। সুপতি ফরেষ্ট অফিস। বনে ঢোকার অনুমতি নিতে দলনেতা এবং জাবির শিক্ষক যাচ্ছিলেন ফরেস্ট অফিসে। উপস্থিত অভিযাত্রীদেরকে জানতে চাওয়া হল, ‘কে কে যাবে‘? অমনি যে যে অবস্থায় ছিল লাফ দিলো ¯িপড বোটে। ছাত্র-ছাত্রীদের কেউ এর আগে কখনো সুন্দরবনে আসেনি, অথচ কারো কোন ভয় বা সংকোচ নেই। হয়ত এরা বিপদের তীব্রতাটাই আঁচ করতে পারেনি অথবা এরাইতো কলম্বাস, স্যাপিলাল, কুক, লিভিং ষ্টোন, ইবনে বতুতা, পার্কো পোলোর উত্তরসুরী। এদের মত মানুষেরাই তো হাতের মুঠোয় মৃত্যু নিয়ে পৃথিবীকে, পৃথিবীর মানুষকে দিয়েছে অসামান্য জ্ঞান কিন্তু নিজেরা হয়েছেন নিঃশেষ। আর তাইতো এদের মতো মানুষের দৃপ্ত পদক্ষেপের কথা ভেবেই কবিগুরু লিখেছেন : আমরা যাব যেখানে কোনো যায় নি নেয়ে সাহস করি। ডুবি যদি তো ডুবি-না কেন। ডুবুক সবি, ডুবুক তরী। প্রথমে ¯িপড বোট, পরে কাঠের নৌকা দিয়ে তারা ফরেস্ট অফিসের জেটিতে পৌঁছল।

প্রথমে অফিসে না গিয়ে, হঠাৎ কি যেন ভেবে গহীন অন্ধকারে রাওনা দিল সবাই। টর্চের অর্পযাপ্ত আলোয় সবার আগে জাবির শিক্ষক, একদম পেছনে একজন ফরেস্ট গার্ড এবং মাঝখানে দলনেতা এবং অন্যান্য অভিযাত্রী। অসাধারণ রোমাঞ্চকর এবং ভয়ঙ্কর অভিযান। ফরেষ্ট গার্ডদের ভাষ্যমতে দুই/তিন দিন আগেও বাঘ এসেছিল এখানে। যে কোন মুহুর্তে পৃথিবীর সবচেয়ে বিষাক্ত রাজগোখরা সাপসহ যে কোন সাপের সাথে দেখা হতে পারে। সামনে পড়তে পারে পৃথিবীর বিখ্যাত শিকারী প্রাণি ’বাংলার বাঘ’। নিকষ কালো বনের মধ্যদিয়ে এগিয়ে যাচ্ছে আট-দশ জনের একটি দল। সুন্দরী ও অন্যান্য স্রোতজ বৃক্ষের শ্বাসমুলের ফাকে পা বাঁচিয়ে নিঃশব্দে হাটা একেবারে সহজ কাজ নয়। অল্পদুর যেতেই হঠাৎ দেখা গেল বাঘের একেবারে টাটকা পায়ের ছাপ। মাত্র কয়েক ঘন্টা আগেই এখানে এসেছিলো আমাদের সবার আকাংখিত ‘বাঘ মামা‘। টর্চ বাহকরা এদিক ওদিক আলো ফেলছে নিজেদের নিরাপত্তার কথা ভেবে। কিন্তু এ বনে মামাকে দেখা কি এতই সহজ যে ’এলাম, দেখলাম এবং চলে গেলাম’। সুন্দরবনে কাজ করে এমন অনেক মানুষ আছেন যারা ২০/২৫ বছর জঙ্গলে থেকেও কখনো মামার মুখোমুখি হননি। দেড়-দুই ঘন্টা পর শেষ হলো নিশি অভিযান। জাহাজে ফিরলো সবাই। এরই মধ্যে অভিযানের কথা রাষ্ট্র হয়ে গেছে। দলের যারা এই নিশি অভিযানে যাওয়ার সুযোগ পায়নি তারা আগে থেকে সিদ্ধান্ত নিয়ে রেখেছে ‘বয়কট করো ওদেরকে‘। মান ভাঙ্গালেন দলনেতা, অনেক কষ্টে। পরবর্তী দিন। অভিযাত্রীদের জন্য অপেক্ষা করছে অভুতপূর্ব সব অভিজ্ঞতা। ঘুম ভেঙে কেবিন ছেড়ে বের হতেই দুই পাশের চোখ জুড়ানো, মন ভুলানো অপূর্ব সবুজ বন-বনানী। ভোর পাঁচটা। রাতের অন্ধকার তখনো কাটেনি। আকাশের দিগন্তরেখা লাল হতে শুরূ করেছে মাত্র। জঙ্গলে তখনো গভীর ঘুম। রাতের অন্ধকার ও হালকা কুয়াশার চাদরে আবৃত সবুজ। মুগ্ধ নয়নে অভিযাত্রীরা তাকিয়ে আছে মায়া মাখানো প্রকৃতির দিকে। মনে মনে ভাবছে নাগরিক জীবনের যান্ত্রিক ব্যস্ততায় আর কখনো হয়ত এমন সকাল তাদের জীবনে আসবে না। কিছুক্ষণের মধ্যেই সবুজের ফাঁকে ফাঁকে সোনালী আলোর ছটা সূর্যোদয়ের বার্তা জানালো। জাহাজের ডেকে দাঁড়ানো মানুষগুলো দু‘চোখে শিশুর সরলতা ও বিস্ময় নিয়ে অবলোকন করছে নব প্রভাতের রাঙা আলো। নদীর সোনালী পানি কেটে, দু‘পাশের নিচ্ছিদ্র সবুজ চিরে এম.ভি. অবসর চলেছে সোজা দক্ষিণে।

এ যেন পাহাড়ী খরস্রোতা নদীর ব্যগ্র হয়ে সাগরের সাথে মিলিত হবার আনন্দে সামনের দিকে ছুটে চলা। এই চলা যেন শুধুমাত্র যাত্রীদেরকে জীবনের শ্রেষ্ঠ অভিজ্ঞতাকে আবিস্কার করার। ভোর ছয়টা। জাহাজ এগিয়ে চলেছে সুন্দরবনের অন্যতম আকর্ষন ‘কটকা‘ জেটির উদ্দেশ্যে। অপেক্ষার প্রহর গুনছে সবাই। কখন নামতে পারবে তাদের সেই অতি প্রিয়, অতি প্রতিক্ষিত জঙ্গলে। ছোট চিকন কটকা খাল। জাহাজ চলছে মন্থর গতিতে। অলস সময়। হটাৎ একটি কালো রঙের অতি সাধারণ পাখি তাদের জাহাজের খুব সামনে দিয়ে উড়ে গেল। পাখিটা কিছুদুর উড়ে গিয়ে খালের ওপারে তীরের খুব কাছাকাছি পানিতে বসল। কেউ কেউ বাইনোকুলার দিয়ে চেনার চেষ্টা করল। পারল না। পরে দলনেতা এবং শিক্ষকদের মাধ্যমে জানা গেল পাখিটির নাম গোলবনের হাঁস, যেটাকে তারা হন্যে হয়ে খুজছে। অমনি শুরু হলো চিৎকার চেঁচামেচি। তাদেরকে শান্ত করলেন তপতী মনসুর। প্রতিশ্র“ত হল বান্দরবন ভ্রমণ। কটকা জেটি। নিঃশব্দে জঙ্গলে নামলো সবাই। এ এক অবর্ণনীয় রোমাঞ্চকর অনুভূতি, জঙ্গলে এত কাছ থেকে প্রকৃতি, বন্য জীবন এবং পশু-পাখি দেখা। পৃথিবীর সবচেয়ে সুন্দর হরিণগুলোর একটা, চিত্রা হরিণ, এই বনের স্থায়ী বাসিন্দা। এই মায়াবতী হরিণের দুষ্টু ও চতুর চাহুনি সবাইকে এই স্রোতজ বনের প্রেমের বাঁধনে আকড়ে ফেলল। সহসা তাদের মনে হল ‘এখান থেকে তারা আর কখনো নগরে ফিরে যাবেনা, কক্ষনো না‘। হরেক রকমের পরিযায়ী এবং স্থানীয় পাখির মনোরম সৌন্দর্য তাদেরকে পাগল করে তুলল। বিশেষজ্ঞদের কাছ থেকে তারা সেগুলোর নাম জেনে নোট বুকে লিখে নিল। ঘন্টা তিনেকের অভিযান শেষে জাহাজে ফিরল সবাই। সকালের নাস্তা ও সামান্য বিশ্রাম নিয়ে আবার বের হল সবাই। গন্তব্য কটকার সমুদ্রপাশের বনাঞ্চল। এখানে তারা এ এলাকার প্রকৃতি পর্যবেক্ষণ এবং কিছু নমুনা সংগ্রহ করবে। ঘন গরাণ আর সুন্দরীর জঙ্গল। গাছের ভিড়ে জঙ্গলের মাটির সাথে সূর্যের সখ্যতা খুবই কম। প্রায় এক থেকে দেড় ফুট লম্বা শ্বাসমুলের ভেতর দিয়ে সতর্কতার সঙ্গে নিঃশব্দে হাটতে হয়। ছন্দপতন হলেই ঝপ্পাস। নতুন হলেও অভিযাত্রীদের বেশীর ভাগ সদস্যই বেশ সাচ্ছন্দে, দ্রুতই এগিয়ে যাচ্ছে। যারা এখানে পুরানো, তাদের হাতে লম্বা লাঠি। এই লাঠি শ্বাসমুলের ভেতর দিয়ে হাটতে খুবই সাহায্য করে। যাই হোক, কটকার জঙ্গলে বাহারী প্রজাপতি অভিযাত্রীদের আনন্দ দেবার জন্যই কখনো তাদের খুব নিকটে এসে আবার দ্রুত দূরে সরে যায়। যেন ছোটদের কানামাছি খেলা। সে এক অপূর্ব পরিবেশ, অকল্পনীয় দৃশ্য। দৃশ্যটা আরো অবর্ণনীয় হয়ে ওঠে যখন জংলী পথ চলতে চলতে হঠাৎ আবিস্কার করল তাদের সামনে বিশাল সমুদ্র – শুধু সমুদ্র নয়, এটাই তো আমাদের বঙ্গোপসাগর। আসলে অভিযাত্রীরা কখনো কল্পনাও করেনি তারা হঠাৎ এতটা সামনে বঙ্গোপসাগরকে দেখবে। আর তাই খুশীর মাত্রাটা ছিল আরো একটু বেশী। হাটতে হাটতে আকস্মিক একটা শব্দ শুনে দুজন অভিযাত্রী দাড়িয়ে সেটা বোঝার চেষ্টা করল। কিছুক্ষন থেমে থেমে আসছে শব্দটা। যদিও তারা কখনো জঙ্গলে বাঘের ডাক শোনেনি, কিন্তু তারপরও এ ডাক তাদের ভুল হবার নয়। হ্যাঁ, এটা মামার ডাক, একটু থেমে থেমে আসছে, এবং তারা যেদিক থেকে এসেছে সেদিক থেকেই। বেশ কিছুক্ষন শোনার পর তারা যখন আবিস্কার করল শব্দটা আস্তে আস্তে তাদের দিকেই আসছে তখন তাদের তো জ্ঞান হারাবার জোগাড়।

ঠিক তখনই উৎঘাটিত হল সত্যিটা, বাঘরূপী প্রাণীটা হল তাদের দলের অন্য আর একজন সদস্য। দলের সদস্যদের সাহসের মাত্রাটা পরীক্ষা করার জন্য এই পরিকল্পনা। এভাবে পুরো একটা দিন তারা বনের সৌন্দর্য এবং বিভিন্ন ধরনের জীব বৈজ্ঞানিক বিষয় বুঝতেই কেটে গেল। দুপুরে খাবার পর্ব শেষ। আবার রওনা হল অভিযাত্রীরা। উদ্দেশ্য সমুদ্র সৈকত। কটকা সৈকতে এসে কেউ কেউ এত খুশী ও উদ্বেলিত হল যে কোনভাবেই তাদেরকে সমুদ্রে নামা থেকে বিরত রাখা গেল না। ছাত্র-ছাত্রীদের স্বাধীনতা থাকায় যারা সমুদ্রে নামতে আগ্রহী না তারা দু‘ভাগে ভাগ হয়ে একভাগ গেল জাবি শিক্ষকের সঙ্গে আমডাহুর গাছের ফল ও ফুলের ছবি তুলতে, অন্য দল থাকল দলের বয়োজষ্ঠ সদস্য এবং তাদের শিক্ষকদের সঙ্গে। তারা কটকা সৈকতে তাদের সুন্দর স্মৃতির সবচেয়ে উপভোগ্য সূর্যাস্তটা কাটাল। মনে মনে ভাবল জীবনে প্রতিটি সূর্যাস্ত যদি এমন হতো। ইস! তাহলে না কত মজাই হত। এমন সুন্দর স্মৃতি নিয়ে সন্ধার পর অভিযাত্রীদের পুরো দলটা জাহাজে ফিরল। রাতে খাবার পর ছাত্র-ছাত্রীরা নিজেদের উদ্যোগে এক ঘন্টার একটি সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান উপহার দিল। স্বল্প সময়ের প্রস্তুুতিতে এত সুন্দর উপভোগ্য অনুষ্ঠান যা দেখে মুগ্ধ না হয়ে পারা যায় না। রাত সাড়ে দশটার দিকে জাবি শিক্ষকের নেতৃত্ব লাইন ধরে টর্চ লাইট হাতে অভিযাত্রীরা রওনা দিল কটকা রেস্ট হাউজের সামনে হরিণ দেখতে। দলের নেতা সবার সামনে গিয়ে উজ্জল টর্চের আলো ফেলল রেস্ট হাউজের সামনে পাতা খেতে আসা হরিণ গুলোর উপর। আহা ! আকাশের মিটিমিটি তারা যেন মাটিতে নেমে এসেছে। মায়াময় আর রহস্যে ঘেরা জঙ্গল আরো বেশী রহস্যময় হয় যখন চোখের সামনে সেই তারার মেলা দ্রুত গতিতে জঙ্গলের ভেতর একে একে হারিয়ে যায়। যেন বুঁদ হয়ে সৌন্দর্য গিলছে সবাই। সে এক অবর্ণনীয় অনুভূতি। এ দৃশ্য উপভোগ করা যায়, বর্ণনা করলে কার্পণ্য হয়। অভিযান শেষে যখন পুরো দল জাহাজে ফিরল তখন ঘড়ির কাটায় মধ্য রাত পার হয়ে গেছে। পরদিন সকাল। জাহাজ চলছে ‘মান্দারবাড়ী‘। যাওয়ার পথে আবার আলোচনা। বিষয় সুন্দরবনের বাঘ ও তার জীবনবৃত্তান্ত। আলোচক জাবির শিক্ষক। চলল দুপুর পর্যন্ত। দুপুর একটা। খোলা লাউঞ্জে দুপুরের খাওয়া চলছে। হঠাৎ যেন কিসের শক্ত একটা ধাক্কা খেয়ে থেমে গেল ‘অবসর‘। জায়গাটা নীল কমলের খুব কাছে হবে। সাধ্যমত চেষ্টার পর অবসরের নাবিক জাহিদ সাহেব জানালেন, ‘আমরা চরে আটকা পড়েছি। পরবর্তী জোয়ার না আসা পর্যন্ত এখানেই থাকতে হবে‘। পাক্কা ছয় ঘন্টা। নিঃসন্দেহে দুঃখজনক খবর। কিন্তু অধিকাংশ সদস্যই এই ঘটনাকে আশীর্বাদ হিসাবে নিল। চারিদিকে অনন্ত সমুদ্র অভিযাত্রীদেরকে এমনই মোহাবিষ্ট করেছিল যে ভবিষ্যতে কি হবে না হবে সে কথা তাদেরকে ভাবিত করেনি। বরং অতি মনোরম প্রাকৃতিক পরিবেশ, ফুরফুরে হওয়া, ঢেউয়ের শব্দ, পাখির কলতান, দূরের আবছা-আবছা বনের প্রান্ত তাদেরকে এতটাই আনন্দিত করেছিল যে সেখানেই তারা তাদের বাকি জীবনটা কাটিয়ে দিতে রাজি। জাহাজ চরে আটকা পড়ায় পূর্বনির্ধারিত পরিকল্পনার কিছুটা পরিবর্তন করতে হলো। কাছেই সমুদ্র সৈকত। সিদ্ধান্ত হলো বিকালটা সেখানেই কাটানো হবে। বিকালে সৈকত অভিযান। বিস্মিত সবাই। মন্তব্য করল ‘এমন সুন্দর সৈকত এর আগে কখনো দেখিনি‘। এখানকার দিগন্ত বিস্তৃত সাগর, তার কোলে অভিযাত্রীদের স্বাগত জানালো ঝিরঝির বাতাস আর ছোট ছোট ঢেউ দিয়ে। পিছনে সুন্দরবন, সামনে মুক্ত অসীম আকাশের ছায়া বুকে নিয়ে বঙ্গোপসাগর। অভিযাত্রীরা সম্মোহিত। তাদের নিষ্পাপ আচরণ, উদ্বেলিত হৃদয়, যেন সাগরকেও ¯পর্শ করেছিল। তাইতো সে মাথায় ফেনার ফুল তুলে, প্রবল কলেবরে ঢেউ হয়ে তাদের পায়ের কাছে লুটিয়ে পড়ছিল। কখনোবা তাদের গায়ে নিজেকে আছড়িয়ে ফেলছিল। এ যেন অবনত ভঙ্গিতে কোন এক দেবতার কাছে তাঁর ভক্তবৃন্দের শ্রদ্ধার্ঘ্য। সৈকতের অভিযান শেষে ফুরফুরে মেজাজে জাহাজে ফিরতে ফিরতে সন্ধ্যা পার হয়ে গেছে। রাতে খাবার দেওয়া হয়েছে লাউঞ্জে। বেশীরভাগ সদস্য খওয়া-দাওয়া শুরু করেছে। হঠাৎ কয়েকজন ছাত্রীর চিৎকারে সচকিত হয়ে উঠল সবাই। অনেকে চিৎকারের উৎসস্থলের সন্ধান করতে ব্যস্ত। একজন ছাত্রী বিশাল একটা প্রজাপতির মতো প্রাণীকে দুই হাতের মাঝের ফাঁকে নিয়ে দৌড় দিচ্ছে জাহাজের নিচতলায় স্থাপিত সাময়িক লাইব্রেরী কক্ষে। উদ্দেশ্য বই-এর ছবির সঙ্গে মিলিয়ে মথটিকে সনাক্ত করা। অনেকক্ষণ ঘাটাঘাটির পর সনাক্ত করা সম্ভব হল। হ্যা, এটি পৃথিবীর বৃহত্তম মথগুলোর একটি, যার নাম ’এটলাস মথ’। সনাক্ত করার পর এটিকে ল্যাবরটরিতে জমা দেবার উদ্দেশ্যে ক্লোরোফর্ম দিয়ে অচেতন করে সংরক্ষণের ব্যবস্থা করা হলো। এর আগেই জাবির শিক্ষক তাঁর ক্যামেরাতে বন্দী করে রাখলেন মথটির বাহ্যিক গঠন ও আকৃতি। এভাবে হাসি আনন্দ আর কৌতুহলে কেটে গেল আরও একটা দিন। পরবর্তী দিন। সূর্য উঠার আগেই জাহাজ পৌছে গেল সুন্দরবনের সবচেয়ে দক্ষিন-পশ্চিমের দ্বীপ ‘মান্দারবাড়ি‘।

অভিজ্ঞদের মতে, জগত বিখ্যাত এই স্রোতজ বনের সবচেয়ে সুন্দর এবং মোহনীয় জায়গা এটি। এখানকার বিশেষত্ব হলো জায়গাটা একদম বন্য, আদি, অকৃত্রিম। জনমানুষের চিহ্ন লাগেনি। বছরের বেশীরভাগ সময় থাকে মানুষ যাতায়াতের অনুপযোগী। শীতকালে যখন নদী খুব শান্ত থাকে তখনই শুধু বেশ কিছু বড় নদী পার হয়ে মান্দারবাড়ী পৌঁছনো সম্ভব। সেখানে পৌঁছামাত্রই সবাই জাহাজ থেকে নেমে সুশৃংখলভাবে সৈকত ধরে হাটা শুরু করল। এখানে বাঘের সংখ্যা মোটামুটি ভালো, কদাচিৎ মানুষখেকোর সন্ধানও পাওয়া যায়। আর তাই এখানে অতিরিক্ত সাবধানতার কথা আগে থেকেই অভিযাত্রীদেরকে জানানো হয়েছিল। সৈকত ধরে হাটতে থাকার সময় অভিযাত্রীরা মেছো বাঘ এবং আরো কিছু ছোট বিড়াল গোত্রীয় প্রাণীর পায়ের ছাপ দেখল। হাটতে হাটতে একসময় সৈকত ছেড়ে অভিযাত্রীরা ঢুকে পড়ল জঙ্গলে। ঘন জঙ্গলে অসংখ্য শ্বাসমুলের মাঝে নিঃশব্দে পা ফেলে এলাকার একমাত্র মিঠা পানির পুকুরের দিকে এগিয়ে চলল সবাই। উদ্দেশ্য ‘যদি মামার দেখা পায়‘। চারপাশে অনেক বড় আর ঘন হুদো বন। দেখলেই সন্দেহ হয়, হয়ত ওখানেই লুকিয়ে আছে মামা। এই হুদো বনগুলো দেখতে এমন যে মামা যদি এর আড়ালে লুকিয়ে থাকে তবে কয়েকফুট দূর থেকেও তাঁকে খুঁজে পাওয়া যাবে না। আর সে কারণেই বাঘ এই হুদো বনের আড়াল থেকে শিকার ধরতেই সবচেয়ে বেশি পছন্দ করে। যে কোন মুহুর্তে অভিযাত্রীদের দল বাঘের শিকার হতে পারে – এমন আশংকা একেবারে উড়িয়ে দেওয়া যায় না। যদিও অস্ত্রধারী ফরেস্ট গার্ড সারাক্ষণই তাদের নিরাপত্তায় ব্যাস্ত। আর তাই, সবাই ভীরু পায়ে, চারপাশে সর্তকদৃষ্টি রেখে এগিয়ে চলছে। একসময় নিরাপদে পুকুর পাড়ে পৌছে গেল সবাই। পুকুর পাড়ে মামার দেখা না মিললেও অসংখ্য নতুন-পুরনো পায়ের ছাপ দেখা গেল। সময় হলো জাহাজে ফেরার। ঘন ঝানা গাছ এবং তার উর্দ্ধমুখী শেকড়ের মধ্যদিয়ে আলো-আঁধারি ঘেরা জঙ্গলে প্রতি মুহুর্তে বাঘের আক্রমনের আশংকায় প্রান হাতের মুঠোয় নিয়ে অভিযাত্রীরা ফেরার পথে এগিয়ে চলছে। জানিনা কখন শেষ হবে এই প্রানান্ত যাত্রা। কিছু বুঝে উঠার আগেই হটাৎ সবাই জঙ্গল থেকে সমুদ্র সৈকতে পৌছল। সবাই জানে সৈকত বিপদমুক্ত এলাকা। সুতারং এখন হাটায় সর্তকতা কম। অভিযাত্রীদের একজন সৈকতে একটি মরা সামুদ্রিক কচ্ছপ আবিস্কার করল। জানা গেল ওটা একটা সামুদ্রিক কাছিম। নাম জলপাইরঙ্গী কাছিম (ঙষরাব জরফষবু ঞঁৎঃষব)। জাবির শিক্ষক জানালেন সমুদ্রে মাছ ধরার জালে ঞঊউ (ঞঁৎঃষব ঊীপষঁফবৎ উবারপব) ব্যবহার না করায় প্রতিবছর এভাবে অসংখ্য সামুদ্রিক কাছিম মারা যাচ্ছে আমাদের সমুদ্রসীমায়। তিনি আরো জানালেন খুব শীঘ্রই ব্যবস্থা না নিলে আমাদের সমুদ্রসীমানায় সামুদ্রিক কাছিম আশংকাজনক হারে কমে যাবে। মান্দারবাড়ীর অভিযান শেষে জাহাজে ফেরা মাত্রই জাহাজ রওনা দিল হিরন পয়েন্টের উদ্দেশ্যে। নামার আগেই কারো কারো মন্তব্য ‘এখানে না এসেই জায়গাটার নাম এত শুনেছি যে এখানে না এলে সুন্দরবন অভিযান পরিপূর্ণ হতনা‘। অল্প সময়ের মধ্যেই জাহাজ হিরন পয়েন্ট পৌছে গেল। কৌতুহলী দল দ্রƒত সেখানে নামল বিস্ময়কর কিছু দেখার আশায়। এমন নামকরা জায়গায় নিশ্চয় কত রোমাঞ্চকর অভিজ্ঞতা অপেক্ষা করছে তাদের জন্য। বিপুল উৎসাহ-উদ্দীপনা নিয়ে তারা তন্ন তন্ন করে ঘুরলো হিরন পয়েন্টের প্রতিটি প্রান্ত। শেষমেশ তারা সুন্দরবনকে ‘বিশ্ব ঐতিহ্য এলাকা‘ হিসাবে ঘোষনার ফলক এবং তাতে মুদ্রিত লেখা পড়ে ব্যর্থ মনে জাহাজে ফিরে এলো। দ্রুত জাহাজে উঠে অভিযাত্রীদের স্থান ত্যাগের তাড়নাই বোঝা গেল জায়গাটার উপর তারা খুব একটা সন্তুষ্ট নয়। হিরন পয়েন্ট থেকে জাহাজ এবার চলছে উত্তর-পশ্চিম বরাবর। এদিকে দুপুরের খাওয়া শেষ করে অভিযাত্রীরা জাহাজের উপরের ডেকে উচ্চ কন্ঠে গানের জমজমাট আসর বসিয়েছে। তাদের আলোচনায় বোঝা গেল পরবর্তী গন্তব্য ‘দুবলার চর‘ নিয়ে তারা বেশ আশাবাদী। গান শেষ হতে না হতেই জাহাজ পৌছে গেল নির্দিষ্ট গন্তব্যে। দুবলার জেটিতে জাহাজ ভেড়ানোর সঙ্গে সঙ্গে নেমে পড়ল সবাই। তাদেরকে আগে থেকেই এখানকার শুটকি মাছের দুর্গন্ধ স¤পর্কে একটা ধারনা দেওয়া হয়েছিল। আর তাই কাউকে কাউকে দেখা গেল রুমাল বা খন্ড কাপড় দিয়ে তৈরী বিশেষ ধরনের মাস্ক ব্যবহার করতে। জেলে পল ীতে গিয়ে অভিযাত্রীরা কিছুটা বিস্মিত হলো। শুটকির প্রাচুর্যতা খুবই কম যদিও দেশে প্রস্তুতকৃত শুটকির একটা বড় অংশই আসে দুবলা থেকে। চরের জেলে-মহাজনদের সাথে আলোচনায় বোঝা গেল এ মৌসুমের অধিকাংশ শুটকি আগেই বাজারজাত করা হয়ে গেছে।

অভিযাত্রীদের মাঝে যারা মাৎস্যবিদ্যায় আগ্রহী তাদেরকে দেখা গেল জেলেদের সঙ্গে কথা বলতে। তাদের জীবনযাত্রা, পারিবারিক ও প্রাত্যহিক জীবন, শুটকি তৈরীর প্রক্রিয়া, বাজারজাতকরণ, ইত্যাদি বিষয় ছিল ক্ষুদে জ্ঞান পিপাসুদের জানার বিষয়বস্তু। শুটকির পরিমান কম থাকলেও তাদের শিক্ষকদের ইচ্ছায় এবং জেলেদের আন্তরিকতায় দলের সদস্যরা প্রায় ২০/২৫ রকমের শুটকির নমুনা সংগ্রহ করতে পারলো। প্রায় দু‘ঘন্টার অভিযান শেষে ফেরার পথে তারা জবা জাতীয় গাছ দেখতে পেল। গাছটিতে একই ডালে দু‘রঙের ফুল দেখে বিস্মিত সবাই। জানা গেল এটি বাগানে চাষ করা জবা ফুলের বন্য প্রজাতি। এলাকার লোকেরা একে বোলা বা ভোলা নামে ডাকে। অভিযান শেষে জাহাজ রওনা দিতে দিতে সূর্য পশ্চিম আকাশে ঢলে পড়েছে। পরিকল্পনা অনুযায়ী সন্ধ্যা এবং পরবর্তী রাতটা কাটানো হবে কচিখালি ফরেস্ট অফিসের কাছে। কারন এই পথ দিয়েই জাহাজ ফিরে যাবে ঢাকার রাস্তায়। কচিখালির আরেক নাম ‘টাইগার পয়েন্ট‘। সঙ্গী জাবির শিক্ষক জানালেন তিনি যে কয়েকবার বাঘ দেখেছেন এবং বাঘের ছবি তুলেছেন তার বেশীর ভাগই এই এলাকা থেকে। সুতারাং অভিযাত্রীদের মনে সেই পুরনো বাঘ দেখার চিন্তাটা নতুন করে আবার মাথাচাড়া দিল। সন্ধ্যার বেশ কিছুক্ষণ আগেই জাহাজ কচিখালী পৌঁছল। জাহাজ জেটিতে নোঙ্গর করা মাত্র নেমে পড়ল সবাই, বাঘ দেখতে। যেন বাঘ খাঁচায় ভরা আছে, ওরা যাবে এবং তাড়াতাড়ি শুধু একটু দেখে ফিরে আসবে। অভিযাত্রীরা সবাই খুবই নিঃশব্দে এবং সুশৃংখলভাবে কচিখালি মাঠের পুকুর পর্যন্ত পৌছে গেল। এ কয়দিনের নিয়মতান্ত্রিক জীবন যাপনে তারা এখন বেশ সুশৃংখল। পরিকল্পনা অনুযায়ী ওখানেই তাদেরকে নিঃশব্দে বসে থাকতে হবে সন্ধ্যা পার হয়ে যাওয়া পর্যন্ত। উদ্দেশ্য যদি মামা আসে তাহলে তার সঙ্গে একটা সৌজন্য সাক্ষাৎ!!! পড়ন্ত বিকাল। শব্দহীন ৬৫ জোড়া চোখ বিরামহীনভাবে খুঁজে চলেছে সেই একটি প্রাণীকে। হঠাৎ তাদের মনে প্রশ্ন এল সুন্দরবনে এসে কেন তারা শুধু বাঘের দেখা পাওয়ার চিন্তায় মগ্ন? বাঘ ছাড়া কি অন্য কিছু দেখা বা উপভোগ করার নেই এই বনে? এই যে সুন্দর এই পড়ন্ত বিকালে তাদের সামনে ঘাস খাচ্ছে কমপক্ষে শ‘দুয়েক চিত্রা হরিণ এবং তাদের বাচ্চা-কাচ্চারা। অল্পদূরেই দেখা যাচ্ছে কয়েক জোড়া বন্যশুকর বনের প্রান্ত জুড়ে মাটি খুড়ে তার খাদ্যদ্রব্য খুজছে। গাছের পাতা ও ডালের ফাঁকে মাঝেমাঝেই উকি দিয়ে শয়তানি করছে আমাদের জাত ভাই, সুন্দরবনের একমাত্র বানরগোত্রীয় প্রাণি ‘রেসাস বানর‘। প্রকৃতির এই অপূর্ব সৌন্দর্যের কি কোন মূল্য নেই? কিন্তু আমরা তাকে সেই মূল্য দিতে শিখিনি। শিখিনি কিভাবে তাকে সুন্দরভাবে আমাদের নিজেদের কাজে লাগানো যায় তার সুচিন্তিত উপায়সমূহকে। ব্যবহার করতে শিখিনি আমাদের সুস্থ্য বুদ্ধিবৃত্তিকে। আর যার ফলে আমাদের এই দুরবস্থা। ভাবতে ভাবতে তারা অনেক দূর চলে যায়। হঠাৎ চিন্তায় ছেদ পড়ে, আবার ভাবে: হ্যাঁ, এইতো…….তাদের চিন্তা অনেক দূর এগিয়েছে। তারা পারবে আগামী দিনের সমস্যা সঙ্কুল পথের হাল ধরতে। সন্ধ্যার পর এসব ভাবতে ভাবতে কখন যে তারা জাহাজে ফিরে এসেছে মনে নেই। আগামীকাল সকালে জাহাজ রওনা দেবে ঢাকার উদ্দেশ্যে। আবার ফিরে যেতে হবে সেই পরিচিত গন্ডিতে, যেখানকার মানুষ চিন্তা করে কাজ করেনা। সুন্দরবনের এই মায়াময় প্রাকৃতিক পরিবেশে এসে অভিযাত্রীরা এটুকু বুঝতে শিখেছে যে তাদের পরিচিত মানুষগুলোর অপরিকল্পিত কার্যকলাপে আজ তাদের অতি প্রিয় এই বনভুমি হুমকির সম্মুখীন। এসব চিন্তা নিয়ে ব্যথা ভরা মন নিয়ে পরদিন সন্ধ্যায় সদরঘাটে জাহাজ থেকে নামার সময় দলের সবচেয়ে কম কথা বলা ছেলে মাসুম তার সহপাঠি সাথীকে বলল, ‘বাঘ না দেখে ভালোই হয়েছে, কারণ বাঘ দেখলে এই চিন্তাগুলো করতে শিখতাম না………‘

Read Full Post »

কাঁসালং – এর বাঁকে – সূর্য উৎসব ২০০৮

একলা পথিক

াত প্রায় ১০টা। শাহাবাগ ছবির হাটে অন্যান্য সাধারণ দিনের চেয়ে লোক সমাগম আজ বেশ বেশি। প্রায় দেড় শতাধিক লোকের সমাগম জায়গাটাকে বেশ উৎসবমুখর করে তুলেছে। আমি যখন পৌঁছলাম তখন লম্বা কিউ নজরে পড়লো। কাঁধে হ্যাভারস্যাক, ¯ি পিং ব্যাগ আর আপাদমস্তক গরম কাপড়ে ঢাকা লোকগুলোকে দেখলেই বোঝা যায় কোন অভিযানে যাওয়ার জন্য প্রস্তুত সকলে। এগিয়ে গিয়ে দেখলাম সূর্য-উৎসবের অভিযাত্রিরা সবাই নিজেদের আইডি কার্ড, ফুড-কুপন বুঝে নিচ্ছেন সেই সাথে জেনে নিচ্ছেন বাসে তার অবস্থান। কিছুক্ষণের মাঝেই ১৩৬ জন অভিযাত্রির দল নিয়ে ৪টি বাস ছুটবে রাঙ্গামাটির উদ্দেশ্যে। সূর্য-উৎসব ২০০৮-এ এবারের গন্তব্য বাংলাদেশের দ্বিতীয় বৃহত্তম জঙ্গল, পাবলাখালী। এর আগে এখানে যাওয়াতো দূরের কথা অভিযাত্রীদের কেউ এর নাম ও শুনেনি, তাই এ যাত্রায় সকলেই রোমাঞ্চিত ও শিহরিত নিজ দেশে নতুন ভূ-খন্ড আবিস্কারের আশায়।

বিগত সাত বছর যাবত বাংলাদেশ অ্যাস্ট্রোনমিকেল এসোসিয়েশন বাংলাদেশের বিভিন্ন অংশে সূর্য-উৎসব পালন করে আসছে। প্রথম সূর্য উৎসব পালন করা হয়েছিল বাংলাদেশের সর্ব দক্ষিণের সর্বশেষ ভূ-খন্ড সেন্টমার্টিন দ্বীপের ছেড়া দ্বীপে। পরবর্তীতে অংশগ্রহণকারীদের বিপুল আগ্রহের কথা বিবেচনা করে নিয়মিতভাবে এ উৎসব আয়োজনের সিদ্ধান্ত নেয়া হয়। সেই থেকে শুরু। পরবর্তী বছরগুলোতে এ উৎসব পালিত হয় – পৃথিবীর সর্ববৃহৎ ম্যানগ্রভ বন ‘সুন্দরবন’, দেশের সর্বোচ্চ শৃঙ্গ ‘কেওক্রাডং’ সৌন্দর্যের বেলাভূমি ‘নিঝুম দ্বীপ’, বাংলাদেশের উত্তরের সর্বশেষ সীমানা পঞ্চগড়ের ‘বাংলাবান্দা’, গাড়ো পাহাড়ের পাদদেশে প্রবাহিত সোমেশ্বরী নদীর তীরে ‘বিরিশিরি’ এবং গত বছর উজ্জাপিত হয় সুনামগঞ্জের “টাঙ্গুয়ার হাওর” – এ, আর এ বছর স্থান নির্ধারণ করা হয় “পাবলাখালী অভায়ারণ্য”। ৪২ হাজার ৮৭ হেক্টরের এই অভায়ারণ্যে বন্য হাতি ছাড়াও রেসাস বানর, মুখপোড়া হনুমান, উল ুক, কাঠবিড়ালি, সাম্বার হরিণসহ নানান রকম বন্যপ্রাণী ও পাখির বাস। পার্বত্য বনভূমির মেেধ্য এটাই সবচেয়ে সমৃদ্ধ তবে পাহাড়ের মাঝ দিয়ে বয়ে চলা জলরাশিও, কম গুরুত্ব বহন করে না। রাঙ্গামাটি শহর থেকে ১১২ কি.মি. দূরে কাপ্তাই হ্রদের একদম উত্তরে কাসালং নদীর পাশে ১০০ থেকে ৩০০ মিটার উচু পাহাড়ি এলাকায় এই পাবলাখালী আর কাসালং নদী বিভিন্ন ধারায় পাহাড়ি পথে প্রবাহিত হ্রদ সৃষ্টি করেছে গুরুত্বপূর্ণ জলাশয়। ১৯৬২ সালের জুনে একে গেইম অভয়ারণ্য হিসাবে প্রতিষ্ঠা করা হয় আর ১৯৮৩ সালে ঘোষণা করা হয় বন্যপ্রাণী অভয়ারণ্য হিসাবে। সূর্য-উৎসবের জায়গা নির্ধারণের ঘটনাটাও কিন্তু কম মজার না। সূর্য-উৎসব মানেই হলো এ্যাডভেঞ্চার এবং উৎসবের এক অপূর্ব মিশেল।

আর এবার উৎসব ব্যবস্থাপনায় বেসরকারি পর্যটন সংস্থা “ইনসাইটা ট্যুরিজম” যুক্ত হয়ে উৎসবে এনেছে নতুন মাত্রা। সে যাই হোক স্থান নির্ধারণের ঘটনাটা বলি – পূর্ববর্তী উৎসবের স্থানগুলো পর্যালোচনা করে দেখা গেল, সমুদ্র, নদী, পাহাড়, বন এমনকি হাওড়-এও উৎসব করা হয়ে গেছে। তাই এমন একটা জায়গার খোঁজ করতে হবে যেখানে অন্যবারের চেয়ে একটু বেশি কিছু পাওয়া যায়। নানান জনের কাছ থেকে নানান প্রস্তাবও আসতে লাগলো কিন্তু কোনটাই মনমত হচ্ছে না। সে সময় উৎসবের অন্যতম পরিচালক নওরজ ইমতিয়াজ ‘নিসর্গ’ থেকে একটি বই সংগ্রহ করেন যেখানে বাংলাদেশে সব বনাঞ্চলগুলোর বর্ণনা দেয়া আছে। অন্যান্য বনগুলোর নাম পরিচিত ঠেকলেও পাবলাখালী নামটা সকলের কাছে একদম নতুন, সেই সাথে বনের বর্ণনা আগ্রহের মাত্রা আরও বাড়িয়ে দিল, কারণ এখানে একই সাথে আছে – নদী, পাহাড় ও বন। এযে একের ভিতর তিন। সেই সাথে আছে বন্যপ্রাণীর পর্যাপ্ততা; কাজেই ঠিক করা হল এখানেই হবে এবারের সূর্য-উৎসব। কিন্তু সমস্যা হল এখন পর্যন্ত শুধু কাগজে-কলমেই জায়গাটা আমাদের পরিচিত স্বশরীরে আমাদের কেউই এর ত্রিসীমানায় যায়নি।

এমন অপরিচিত জায়গায়তো আর হুট করে এক দল লোক নিয়ে হাজির হওয়া যায় না। আর দলের সদস্য সংখ্যা যদি শতাধিক হয়, যার মধ্যে বৃদ্ধ থেকে শুরু করে শিশু পর্যন্ত রয়েছে সে ক্ষেত্রে তো প্রশ্নই ওঠে না। বিশাল ম্যাপ বিছিয়ে শুরু হলো গবেষনা । কি করে যাওয়া যায় এই জায়গায়। অনেক আলোচনা-পর্যালোচনা পর্যবেক্ষণ শেষে মোটামুটি একটা ধারণা পাওয়া গেল জায়গাটার অবস্থান সম্পর্কে। ঠিক হল আমি এবং মাহবুবুল আলম প্রধান (জুয়েল) রেকি করতে যাবো। ম্যাপ দেখে মনে হলো খাগড়াছড়ি দিয়ে গেলেই কাছাকাছি হবে। নির্ধারিত দিনে সায়দাবাদ বাস স্ট্যান্ড থেকে রাতের বাসে আমি আর জুয়েল রওনা দিলাম অজানার উদ্দেশ্যে। পরিচিত পথ ধরে বাস ছুটলো অপরিচিতের পথে। জানালা দিয়ে দ্রুত সরে যাওয়া ল্যাম্পপোস্ট দেখতে দেখতে আর বাসের ঝাকুনিতে কখন যে ঘুমিয়ে গেছি জানি না। যখন চোখ খুলে া তখন আধার ফিকে হয়ে ভোরের আলো ফুটতে শুরু করেছে। আশে পাশের দৃশ্যপট পাল্টে গেছে, বাস ছুটে চলছে আকাঁবাকা পাহাড়ি পথ ধরে, চারিধার কুয়াশার চাদরে মোড়ানো। দূর পাহাড়ের গা ঘেষে বয়ে চলছে ঘন মেঘ। সকাল আটটায় পৌঁছলাম খাগড়াছড়ি কলেজ রোড বাস স্টেশনে। এখান থেকে বাস বদল করে যেতে হবে মারিশ্যা। সাথে সাথেই বাস পেয়ে যাওয়ায় নাস্তার পিছনে সময় নষ্ট না করে আবার বাসে চেপে বসলাম। সাড়ে দশটা নাগাদ মারিশ্যা পৌঁছলাম। কিন্তু এরপর! বিপত্তি বাঁধলো তখন যখন স্থানীয় কেউই পাবলাখালীর কোন হদিশ দিতে পারলো না। তারা যেন আমাদের মুখেই এই নাম প্রথম শুনেছে। পরে আমরা দু’জন ঠিক করলাম বনবিভাগের অফিসে গেলেই আসল তথ্য পাওয়া যাবে। আমাদের দৃঢ় বিশ্বাস বইয়ে যেহেতু উলে খ আছে তখন এ বনও অবশ্যই আছে। অনেক খোঁজাখুজি করে পেয়ে গেলাম বন বিভাগের অফিস। বন কর্মকর্তারা আন্তরিকতার সাথেই আমাদের সহায়তা করলেন।

বাৎলে দিলেন পাবলাখালী যাওয়ার পথ, ট্রলারও ঠিক করে দিলেন যাওয়ার জন্য; সেই সাথে দিয়ে দিলেন প্রয়োজনীয় নির্দেশনা। প্রায় আড়াই ঘন্টা নদী পথ পেড়িয়ে অবশেষে পৌনে তিনটায় পৌঁছলাম পাবলাখালী ফরেস্ট রেঞ্জের ঘাটে যা স্থানীয়ভাবে আমতলী ঘাট হিসাবে পরিচিত। ফরেস্ট রেঞ্জার খলিলুর রহমান গাজী এবং গেইম অভয়ারণ্য রেঞ্জার এ.এফ.জি মোস্তফা আমাদের যথেষ্ট সমাদর করলেন। তাদের জানালাম আমাদের আগমনের হেতু এবং জানতে চাইলাম আমাদের পরবর্তী করণীয় বিষয়াদি। সৌজন্য সাক্ষাৎ শেষ করতে করতে প্রায় সাড়ে তিনটা। পেট অনেক আগেই জানান দিয়ে দিয়েছে যে সকাল থেকে ওখানে কিছু পড়েনি। তাই দু’জন রওনা হলাম কাছের বাজারে গিয়ে পেট পুজোটা সেরে নিতে। মনিরের হোটেলে খেয়ে আমরা মুগ্ধ এমন প্রত্যন্ত অঞ্চলে এমন রান্না পাব আশা করি নি। ভাত, মাছ, মাংস, সব্জি সবই আছে এবং রান্নাও অপূর্ব। খেতে খেতেই জানতে পারলাম কাছের বনে বন্য হাতির পাল এসেছে। এমন সুযোগতো আর হেলায় হারানো যায় না; তাই দুজন ঠিক করলাম খাওয়া সেরে হাতি দেখতে যাব। মনিরকে বলতেই সে ব্যবস্থাও করে দিল। সামসুদ্দিন নামে এক বয়জষ্ঠকে আমাদের সাথে দিল বনে নিয়ে যাবার জন্য। যেতে হবে নৌকায়, আমরা সামসু চাচার সাথে রওনা হলাম যেখানে তার নৌকা বাঁধা আছে। তার ছোট্ট নৌকায় রওনা হলাম পাহাড়েরর মাঝ দিয়ে আকাঁবাকা বয়ে চলা জলপথ দিয়ে। চারিধার অদ্ভুত নিস্তব্ধতা। নানান যান্ত্রিক আওয়াজে অভ্যস্ত আমাদের এই কানে প্রকৃতির এই নিস্তব্ধতাকে অপার্থিব বলে মনে হচ্ছিল। নাম না জানা পাখির গান, গাছের শুকনো পাতার উপর দিয়ে বয়ে চলা শীতের বাতাসের শব্দ আর পানিতে বৈঠা পড়ার শব্দ মিলে তৈরি হয়েছে এক অদ্ভুত সিম্ফনী। আমরা কেউ কোন আওয়াজ করছি না পাছে ছন্দ পতন ঘটে। পাহাড়গুলো লতা গুল্মো ছাওয়া, তারই ছায়া পড়েছে স্বচ্ছ জলাধারে। দূরে আরও দুটি মাছ ধরার নৌকা চোখে পড়লো যারা নিজ মনে জাল টানছে। প্রায় ঘন্টা দেড়েক চলার পর হঠাৎ কানে এলো হাতির ডাক, সচিকিত হয়ে নড়ে চড়ে বসলাম সকলে। উত্তেজনায় নৌকাটাও দুলে উঠলো খানিকটা। সামসু চাচা আঙ্গুল তুলে দেখালেন ওই পাহাড়েই আছে মামারা। স্থানীয়রা হাতিকে মামা ডাকে। আমরা নৌকা ভিরালাম বিপরীত দিকের টিলায়। একেবারে বন্য হাতির মুখোমুখি হবার ইচ্ছে আমাদের কারুরই নেই। পাহাড়ের মাথায় যখন উঠলাম ততক্ষণে হাতির দল সরে যাচ্ছে আরও ভিতরের দিকে।

শেষতক একটি বড় হাতির আর একটি হস্তিশাবকের অবয়বই চোখে পড়লো শুধু। বাচ্চাটার মাই হবে হয়তো। ফিরে এলাম বন বিভাগের অফিসে। রাতটা তাদের এখানেই কাটালাম। পরদিন ভোরে একটি ছোট লঞ্চে করে রওনা হলাম রাঙামাটির উদ্দেশ্যে। পাবলাখালী থেকে মাইনী, লঙ্গদু, বর্ণছড়ি, শুভলং পাড় হয়ে রাঙামাটি পৌঁছতে দুপুর গড়িয়ে গেল। যাই হোক ফিরে আসা যাক মূল কাহিনীতে, ছবির হাট থেকে বাস ছাড়লো ১১টা ৪০ মিনিটে, শুরু হলো অ্যাডভেঞ্চার পাবলাখালী। আমাদের এই দলে ছাত্র, শিক্ষক, চিকিৎসক, প্রকৌশলী, চাকুরীজীবি, ব্যবসায়ী, সাংবাদিক, মিডিয়াকর্মী, সমাজকর্মী সহ নানান পেশার মানুষ রয়েছে। সেই সাথে আমাদের আতিথ্য গ্রহণ করেছেন বিশিষ্ট কথা সাহিত্যিক এবং প্রকৃতিবিদ বিপ্রদাশ বড়–য়া এবং নিসর্গী মোকারম হোসেন। মাঝরাতে যখন কুমিল ার ময়নামতিতে পৌঁছলাম তখন দেখি কৃষ্ণপক্ষের অষ্টমির চাঁদও আমাদের সাথে হাজির হয়েছে উৎসবে যোগ দিতে।

জ্যেৎস্না-কুয়াশায় মিশেল আবরণে ঢাকা চারিধার। দল-বল নিয়ে ডলি রিসোর্টে ঢুকে পুরো জায়গাটা সরগরম করে তুল াম। বয়-বেয়ারা সব ব্যস্ত হয়ে পড়লো একসাথে এত লোককে সামাল দিতে। সব্জি-পরটা আর চা খেয়ে সকলে বেশ চাঙা হয়ে উঠলো। সকলের হাসি-ঠাট্টা আর গান রাতের নিস্তব্ধতা ভেঙে পরিবেশটাকে উৎসবমুখর করে তুলেছে। চট্টগ্রাম শহর ছাড়িয়ে রাঙ্গামাটি যখন পৌঁছলাম রাত তখন শেষ হয়ে গেছে, কিন্তু সূর্যের দেখা নেই। বছরের এই সময়টাতে সূর্যের এই লুকচুরি খেলা হরহামেশাই চলে। তা চলুক ওতে আমাদের আনন্দে কোন ভাটা পরবে না। রাঙ্গামাটির কর্ণফুলি নদী লাগোয়া হোটেল সুফিয়া ইন্টারন্যাশনালে উঠে সবাই প্রাতরাশ এবং নাস্তা পর্ব শেষ করে ছুট দিল ফিশারিজ ঘাটে যেখানে রিজার্ভ লঞ্চ কেয়ারী কর্ণফুলি আমাদের অপেক্ষায় তীরে ভাসমান। প্রথম গন্তব্য মাইনি। আমাদের শুভেচ্ছা জানাতে ডিস্ট্রিক ফরেষ্ট অফিসার উত্তম কুমার সাহা ঘাটে এলেন। তার সাথে সৌজন্য সাক্ষাৎ শেষে সাড়ে ১০টায় আমারা যাত্রার দ্বিতীয় ধাপ শুরু করলাম। এর মাঝে অভিযাত্রী দল নিজেদের মধ্যে আলাপ পরিচয় সেরে নিলেন। নওরজ ইমতিয়াজের পরিচালনায় শুরু হলো উৎসব ব্রিফিং। বাংলাদেশের অন্যতম মাউন্টেনিয়র মুসা ইব্রাহিম (বাংলাদেশ থেকে যে ক’জন সৌভাগ্যবান এখন পর্যন্ত হিমালয় পর্বতে গিয়েছেন তিনি তার মধ্যে একজন) অভিযাত্রীদের অ্যাডভেঞ্চার সম্পর্কে নানান তথ্য দিলেন সেই সাথে ভাগাভাগি করে নিলেন নিজের অভিজ্ঞতা। ঘুড়ি প্রেমী বেনু ভাই অভিযাত্রীদের দিলেন ঘুড়ি সম্পর্কে নানান মজার তথ্য। বিপ্রদাশ বড়–য়া যিনি যৌবন থেকে আজ অব্দি চড়ে বেড়িয়েছেন এখানকার পাহাড়, নদী আর অরণ্য; তার কাছ থেকে জানলাম নানান রমাঞ্চকর অজানা তথ্য। আঙ্গুল দিয়ে দেখিয়ে দিলেন শুভলং ঝর্ণার বিপরীতে ওই দূর পানির নিচেই তলিয়ে গেছে চাকমা রাজার বাড়ি। জানতে পারলাম এখানকার সব পাহাড়াই নাকি উত্তর-পূর্বমুখী। নিসর্গী মোকারম হোসেন জানালেন এখানকার পরিবেশ বিপর্যয়ের কথা। কথার ফাঁকে বেনুভাই কখন যে তার আমনীকৃত চীনা চড়কি আর ঘুড়ির পসরা খুলে বসেছেন খেয়ালই করি নি। আমরা ক’জন তার কাছে থেকে কয়েকটা চরকি নিয়ে হাওয়ার বিপরীতে ঘুড়াতে লাগলাম আর উনি উড়াতে লাগরেন ডাউস সাউজের ঘুড়ি।

কখনো বেসাতি, কখনো অক্টোপাস, আমরা ঘুড়ি না ওড়ালেও কনটিকি আঁকা বাইশ ফুটের একটা পাল কেয়ারীর মাথায় উড়িয়ে দিয়েছিলাম সেই সকালেই। হাওয়ার তোরে পালটাও উড়তে লাগলো পতপত করে। দুপুর আড়াইটা নাগাদ পৌঁছলাম মাইনি বাজারে। নেমেই পালা করে পেট পুজা শুরু করে দিল। পালা করে কারণ একবারে এত লোক বসার ব্যবস্থা এখানে নেই। অভিযাত্রীদলও শৃঙ্খলার সাথে খাওয়ার পর্বটা শেষ করে আবার লঞ্চে গিয়ে উঠলো। লঞ্চ ঘুরিয়ে সকলকে নিয়ে আসা হলো রাবেতা হাসপাতালের ঘাটে। আমাদের অভ্যর্থনা জানাতে অপেক্ষায় ছিলেন রাবেতার কর্মকর্তারা। পরিচয় পর্ব শেষ করে রওনা হলাম দুই কিলোমিটার দূরে অবস্থিত রাবেতা কলেজ ক্যাম্পাসে। পথের একধারে ফল-ফুলের বাগান আর অন্যধারে পাহাড়ের কোল ঘেষে লেক। আশেপাশের সৌন্দর্য পাহাড়ি পথে দুই কিলোমিটার হাটার ক্লান্তি অনেকটা কামিয়ে দিল। রাবেতা কলেজে ব্যাগ-ট্যাগ রেখেই স্থানীয় ছাত্র-শিক্ষক এবং অভিযাত্রীদের মধ্যে শুরু হলো বলিভল খেলা, দলের কিছু অংশ সারা দিনের ক্লান্তি ঝেড়ে ফেলতে ঝাপ দিল পাশের লেকে। ভলেন্টিয়াররা সবাই লঞ্চ হতে প্রয়োজনীয় সরঞ্জাম নামাতে ব্যস্ত। এর মধ্যেই এক জন ‘গেল গেল’ বলে চিৎকার করে পাহাড় কাপিয়ে তুলে া। বছরের শেষ সূর্য অস্ত যাই যাই করছে। সবাই ছুটলো কলেজের পাশেই একটা পাহাড়ের উপর সেনাবাহিনীর হেলিপ্যাডে। সেখান থেকে পুরো এলাকাটা চমৎকার দেখা যায়। সকলের চোখের সামনে পাহাড়ের ফাঁক গলে টুপ করে ডুবে গেল বছরের শেষ সূর্যটা। আলো-আধাঁরিতে ছাওয়া চারিধার আধ-খাওয়া চাঁদটা উঁকি দিচ্ছে আকাশে। পাহাড়ি এলাকায় মশার প্রকোপ বেশি এবং মারাত্মকও বটে। একবার ম্যালেরিয়া হলে আর রক্ষা নেই। কাজেই হাত-পায় আর শরীরের খোলা অংশে মশারোধক ক্রিম ওডোমস মাখতে ব্যস্ত হয়ে পড়লো সবাই। সন্ধ্যা সাতটা। সকলে গোল হয়ে বসে আছি হেলিপ্যাডে। শুরু হয় রাতের উৎসব প্রস্তুতির প্রথম অংশ। মেজবা আজাদের পরিচালনায় পরিচয়পর্ব এবং উৎসব ব্রিফিং শেষ করে সকলে ফিরে এলাম কলেজ ক্যাম্পাসে। ছোট ছোট দলে ভাগ হয়ে সকলে ঝাপিয়ে পড়লো প্রস্তুতি কর্মে। কেউ বানাতে লাগলো মঙ্গল প্রদীপ, কেউ ফানুস, কেউ বা রঙিন লণ্ঠন। কলেজের মাঠে সেলিম ভাইয়ের নেতৃত্বে একদল লাকড়িতে আগুন জ্বালিয়ে শুরু করলো বিভিন্ন আঞ্চলিক গান। খাবার আয়োজনে আমাদের ফুড মিনিস্টার জুয়েলের সজাগ দৃষ্টি। সকলে যখন যার যার কাজে ব্যস্ত তখন সে ব্যস্ত খাবার আয়োজনে। রাত নয়টায় জুম চাষের ভাত, মুরগির মাংস, ডিম, ডাল আর টমেটোর সালাদ দিয়ে অভিযাত্রী দল খাবার পর্বটা সেরে নিলেন পরম তৃপ্তির সাথে। খাবারের পর এমন ঠান্ডায় এক কাপ গরম চা যদি পাওয়া যেত তবে খাওয়ার ষোলকলা পূর্ণ হতো। তবে এমন পাহাড়ি এলাকায় যার ত্রিসীমানায় কোন লোকালয় নেই সেখানে এমন বিলাসী ইচ্ছাটাকে অনেকেই যখন বুকের মাঝেই কবর দিতে যাচ্ছিলেন তখনই ফুড মিনিস্টার এসে গম্ভিরস্বরে ঘোষণা দিলেন, আপনাদের জন্য চা পানের আয়োজন করা হয়েছে। যে যত কাপ ইচ্ছা খেতে পারেন। সকলে লক্ষ্য করলেন মাঠের এক কোনে বেঞ্চির উপর চা বানানোর সরঞ্জাম নিয়ে দুটি লোক বসে আছে।

এরই মাঝে কত্থেকে যেন সে চাওয়ালা যোগার করে ফেলেছে। এই না হলে কি আর ফুড-মিনিস্টার; বলার আগেই সব বুঝে ‘লক্ষ্মি ছেলে’! রাত ১১টায় যার যার মতো মঙ্গল প্রদীপ, লণ্ঠন আর ফানুস হাতে ক্যান্টনমেন্টের লেকে ছুটলো সবাই। হেলিপ্যাড থেকে লেক পর্যন্ত পুরো পথটাকে সাজানো হলো রঙিন কাগজে মোড়া লণ্ঠন দিয়ে, কিছু লণ্ঠন ঝুলিয়ে দেয়া হলো গাছের ডালে। অল্প অল্প কুয়াশার মধ্যে লাল-নীল-হলুদ-সবুজ কাগজে মোড়া লণ্ঠনগুলো পুরো এলাকাকেই আচ্ছাদিত করলো এক অলৌকিক অবরণে। সূর্য উৎসবে যোগ দিতে মাইনির ২৫ বেঙ্গল রেজিমেন্টের জোন কামান্ডার লেঃ কর্ণেল মুস্তাফিজ সপরিবারে চলে এলেন। ঠিক জিরো আওয়ারে রাতের আকাশ আলো করে জ্বলে উঠলো ফ্লেয়ার। লেকের জলে ভাসানো হলো মঙ্গল প্রদীপ। দূর থেকে দেখে মনে হচ্ছিল পুরনো বছরের সকল জীর্ণতা-গ ানি মুছে নতুন বারতা নিয়ে ধীর গতিতে এগিয়ে চলছে কোন আলোর মিছিল। অভিযাত্রীরা প্রত্যেকে নতুন বছরের শুভেচ্ছা বিনিময় করলো। ফানুস স্পেশালিস্ট নূর মোহাম্মদ এরই মধ্যে ফানুস ওড়ানোর সকল আয়োজন সম্পন্ন করে ফেলেছে। বাতাসের বাড়াবাড়িতে প্রথম দু’টি উড়ার আগেই পুড়ে খাক হলেও পরের দু’টি দিব্যি উড়ে গেল উচুতে। নীচ থেকে অবাক হয়ে দেখতে লাগলাম সকলে এই সফল উৎক্ষেপন। উচুতে ফানুসগুলোতে আগুন ধরে যাওয়ায় তৈরি হল অদ্ভুত এক আলোর খেলা। তারপর হেলিপ্যাডে সেনাবাহিনীর আতিথীয়তা গ্রহণ করলাম। শীতের রাতে সেনাবাহিনীর আয়োজনে চা-পর্ব উৎসবে এনে দিল নতুন মাত্রা।

প্রদীপ দিয়ে হেলিপ্যাডটাকেও সাজানো হলো। সীমান্ত লাগোয়া দুর্গম সেই পাহাড়ি এলাকায় মধ্যরাতের এই উৎসব সমতলের বাসিন্দারা নিশ্চয়ই অনেকদিন মনে রাখবে। তাছাড়া পাহাড়ের ওপর হেলিপ্যাডে নববর্ষ উৎযাপনের অভিজ্ঞতাও নিশ্চয়ই কোন অভিযাত্রীর নেই। রাত ১টা নাগাদ সবাই ঘুমাতে চলে গেলাম। আমাদের পরবর্তী গন্তব্যের উদ্দেশ্যে রওনা দেয়ার জন্য ভোর ৪টায় উঠতে হবে তাই সারা দিনের কর্ম ক্লান্ত শরীরটাকে খানিকটা আরাম দেয়া প্রয়োজন। ভোর ৪টায় সবাইকে টেনেটুনে ওঠানো হল ঘুম থেকে। ব্যাগগুছিয়ে সকলে লঞ্চে উঠে বসলো। অভিযাত্রীদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে সেনাবাহিনীর একটা পেট্রোল বোটও ঘাটে হাজির। কিন্তু ঘন কুয়াশার কারণে লঞ্চ ছাড়া যাচ্ছে না। ক্যাপ্টেন একদমই নড়তে সাহস পাচ্ছে না। অবশেষে ভোর ছয়টায় অন্ধকার ফিকে হয়ে আসার পর লঞ্চ চলতে শুরু করলো। পূব আকাশে এরই মাঝে বছরের প্রথম সূর্যটা হয়তো উঠে গেছে কিন্তু কুয়াশার বৈরীতায় তার সাথে আর দেখাই হল না। মাইনী থেকে পাবলাখালীর এক ঘন্টা পথ পার হতে আমাদের আড়াই ঘন্টা সময় লাগলো। যে ডুবো পাহাড়ের ভয়ে দেরীতে লঞ্চ ছাড়া হলো ঘুরে ফিরে একের পর এক সেই ডুবো পাহাড়েই লঞ্চ আটকাতে লাগলো। ডুবো পাহাড় এড়াতে গিয়ে পথ ভুল হলো একবার। এর মধ্যে যে কত মাঝিকে পটানো হলো লঞ্চের সাথে থেকে দেখিয়ে দেয়ার জন্য কিন্তু লাভ কিছুই হলো না। তাদের বাতলে দেওয়া পথেও চোরা পাহাড় থেকে বাচা গেল না।

লঞ্চ যখন নানান ডুবো পাহাড়ে গোত্তা খাচ্ছিল তখন বিপ্রদাস বড়–য়া ব্যস্ত ছিলেন অভিযাত্রীদের এই নদীপথ সম্পর্কে নানান তথ্য দিতে। লঞ্চ যাচ্ছে কাসালং নদী দিয়ে। আর এই পুরো ব কে রয়েছে কর্ণফুলী, মাইনী এবং চেংরি নদী। এই ফাঁকে স্বর্ণা সকলের মাঝে টি-সার্ট ও সূর্য মুকুট বিলিয়ে দিল। সমস্ত প্রতিবন্ধকতা পার করে অবশেষে সকাল ৯টায় লঞ্চ পৌঁছলো আমাদের বহুল প্রতিক্ষিত পাবলাখালীর ঘাটে। সদলবলে আমরা উঠলাম জঙ্গলের রেষ্টহাউজ ‘বনসখী’তে। এখানেই হবে আমাদের পরবর্তী কার্যক্রম। মনিরকে আগেই বলাছিল দেড়শ লোকের নাস্তার আয়োজন করে রাখতে এবং সে তার দায়িত্ব দক্ষতার সাথেই পালন করেছে। অভিযাত্রী দল লাইনে দাড়িয়ে যার যার খাবার সংগ্রহ করলেন। যে রান্না ঘরটা থেকে খাবার পরিবেশন করা হচ্ছিল রেকি করতে এসে সেটা আধ-ভাঙ্গা দেখেছিলাম। না ঝড়ে ভাঙ্গেনি ভেঙ্গে দিয়েছিল বন্য হাতি। এ খবর শুনতেই অভিযাত্রীদের কারো কারো মধ্যে আতঙ্ক, কারো কারো মধ্যে উত্তেজনা দেখা গেল। নাস্তা সেরে তাই দলবল নিয়ে বেড়িয়ে পড়লাম জঙ্গল দর্শনে। পুরো দলের নেতৃত্ব দিচ্ছিলেন বিপ্রদাশ বড়–য়া, মোকারম হোসেন। সাথে কয়েকজন বনকর্মকর্তা ও নিরাপত্তারক্ষিও ছিল। তারা জানালেন, কাসালং রিজার্ভের অংশ বিশেষ এই বন চারটি ব ক নিয়ে গঠিত-শিশক পশ্চিম, শিশক পূর্ব, সর্বাতলী পূর্ব এবং মাইখ্যা ব ক। মিয়ানমার আর ভারতের সীমান্ত ঘেসা এই পাবলাখালী বনের পুরোটাই পাহাড়ী জঙ্গলবিশেষ মাঝ দিয়ে বয়ে চলা ছোট ছোট খাল সৃষ্টি করছে ছোট ছোট দ্বীপের। বড়–য়া মশাই অভিযাত্রীদের ধরে ধরে চেনালেন চাম্ভুল, লোহাকাঠ, কাননচূড়া, পদাউক, আদি কাটা মেহেদী, শীলকড়ই, কাজুবাদাম, সেগুন ইত্যাদি। বনের ভিতর একটু ঢুকতেই গাছের ফাঁকে কিছু একটা নড়েচড়ে উঠতেই থমকে দাড়ালাম সকলে। শীতল শিহরণ নেমে গেল মেরুদন্ড বেয়ে। হাতি নয়তো! আমাদের অবাক করে দিয়ে এক ছুটে গাছে উঠে গেল এক বানর ছানা। আরও কিছু দূর যেতে চোখে পড়লো নরম মাটিতে হাতির তাজা পায়ের ছাপ। হয়তো গত রাতেই চড়ে বেড়িয়েছে হাতির দল।

পাশে পরে আছে হাতির লেদা। হাতির হজম শক্তি খুব খারাপ, যা খায় তার অল্পই হজম করতে পারে। চ্যানেল আইয়ের রহমান মোস্তাফিজ দেখালেন সাপের ফেলে রাখা খোলস। দূরের গাছটাতে ছুটাছুটি করছে কয়েকটা কাঠবিড়ালি। হঠাৎই তীক্ষè ডাক দিয়ে হলুদ ডানা ঝাপটে উড়ে গেল একটি পাখি। বড়–য়া মশাই বললেন, এর নাম ‘বেনে বৌ’। নিরাপত্তার খাতিরে জঙ্গলের বেশি ভেতরে আমাদের যেতে দেয়া হল না। অগত্তা জঙ্গল পরিভ্রমণের ইতি টেনে ফিরে এলাম রেষ্টহাউজে। ফিরে দেখি অবাক কান্ড! রেষ্টহাউজের সামনে উঠছে চলি শ ফিট লম্বা বিশাল এক রঙিন সূর্য। বেনীআসহকলা সূর্যের এই সাত রঙের মিশেলে বানানো হয়েছে কাপড়ের এই সূর্য। মাঝখানে লাল হলুদ কমলা ১৫ ফুট ব্যসের এক বৃত্ত। তার চারপাশে সাত রঙের সাতটি ডানা। টান টান করে বেঁধে দেয়া হয়েছে গাছের সাথে। সকালের সূর্য না দেখার কষ্টটাকে ভুলতেই বুঝি এই আয়োজকদেও এই আয়োজন। চারদিকে বাঁশে মাথায় উড়িয়ে দেয়া হল সাত রঙা পতাকা। অভিযাত্রী বনকর্মকর্তা, সেনাকর্মকর্তাসহ স্থানীয় সকলে এর মাঝে দাড়িয়ে ছবি তুললো। এখানকার স্কুলের শিশুরাও চলে এসেছিল উৎসবে যোগ দেয়ার জন্য। তাদের জন্য আগে থেকে কিছু খেলনা নিয়ে এসেছিলাম- বাশি, টুমটুম গাড়ি, বেলুন পেয়ে তো তারা মহা খুশি। তাদের নিয়ে আরও কিছু অনুষ্ঠান করার ইচ্ছা ছিল, তবে সময়ের অভাবে করা সম্ভব হলো না। সন্ধ্যের আগেই আমাদের ফিরতে হবে রাঙ্গামাটি। দুপুর নাগাদ লঞ্চ ছুটলো রাঙ্গামাটির উদ্দেশ্যে। সেই সাথে ছুটলো মনিরের খাবারের ট্রলার। মনির দুপুরের খাবার ট্রলারে করে নিয়ে এসেছিল। ট্রলার থেকে খাবার বেড়ে পে ট লঞ্চে দিচ্ছে আর হাতে হাতে পৌঁছে যাচ্ছে অভিযাত্রীদের হাতে।

প্রকৌশলী মঞ্জুর ভাইয়ের দুই ছেলে চমৎকার ভলেন্টিয়ারী কাজ করলো। মনির খাবার শেষ করে মাইনী মুখ থেকে সকলের কাছ থেকে বিদায় নিয়ে ফিরে গেল পাবলাখালী। আর অন্যরা যোগ দিল সেলিম ভাইয়ের গানের আসরে। সেলিম ভাইয়ের গান সকলকে মাতিয়ে রাখলো সাড়াটা পথ। এক ফাঁকে আমি সকলের হাতে ফ্রেন্ডশীপ ব্যান্ড পরিয়ে দিলাম। বন্ধুত্ব করার এই তো সুযোগ। ঘোর সন্ধ্যায় ফিরে এলাম রাঙ্গামাটির ফিশারিজ ঘাটে। মাঝে অবশ্য শুভলং থেমেছিলাম সবুজ পাহাড়ের ছায়া ঘেরা লেকটাকে পাহাড়ের উপড় থেকে দেখার জন্য, এই ফাঁকে অনেকে শুভলং বাজারে হালকা নাস্তাও সেরে নিলেন। সুফিয়াতে রাতের খাবার শেষ করে বাস ছেড়ে দিল ঢাকার পথে। দু’দিনের টানা সফরে ক্লান্ত শহুরে মানুষগুলো আবার ফিরে যাচ্ছে যান্ত্রিক জীবনে এক টুকরো মায়াময় স্মৃতি আর আকাশে শুক্লপক্ষের চাঁদ নিয়ে। ঢুলু ঢুলু চোখে সবাই যখন বাসের নরম গদিতে শরীর এলিয়ে দিয়েছে, কারো কি মনে পড়েছিল পাশের চোরাখালী গ্রাম থেকে আসা সেই চাকমা শিশুটির কথা? এই প্রচন্ড শীতেও উদোম গা আর খালি পায়ে এসেছিল আমাদের কাছে। আবাক নেত্রে চেয়েছিল আমাদের দিকে। গরম কাপড়ে মোড়া এই মানুষগুলোকেই হয়তো তার কাছে সবচেয়ে অদ্ভুত দর্শনীয় বস্তু বলে মনে হয়েছিল।

Read Full Post »

অদেখা এক বনের পথে

অদেখা এক বনের পথে

মোকারম হোসেন

কোথাও বেড়াতে যাবার নিমন্ত্রণ উপেক্ষা করা কঠিন। কিন্তু আয়োজক সংস্থার কর্ণধার মশহুরুল আমিন মিলনের ভ্রমণ প্রস্তুতি ব্রীফ শুনে অনেকেই ভয়ে কেটেপড়ার কথা ভাবছিলেন। কারণ পাবলাখালী অভয়ারণ্যে নাকি হাতির উৎপাত আছে। সবশেষে তিনি আসল কথাটা পাড়লেন। সেই বনের ভেতর নাকি একটা রাতও কাটাতে হবে সবাইকে। আ্যডভেঞ্চার ট্যুর বলে কথা। সবার সঙ্গে আমিও সাহস সঞ্চয় করে বসে থাকলাম। শেষমেষ যাবার সিদ্ধান্ত হলো। রাঙামাটি জেলার মাইনি উপজেলায় অবস্থিত দেশের দ্বিতীয় বৃহত্তম অভয়ারণ্যে নতুন বছরের প্রথম সূর্য দেখতে যাব আমরা। ৩০ ডিসেম্বর রাতে গাড়িতে উঠতে গিয়ে দেখি এলাহি কান্ড। ১৩০ জনের একটা দল। নানান পথ, নানান মতের মানুষ। একদল সংবাদকর্মীও আছেন। চারচারটে গাড়ি দাঁড়িয়ে।

সমস্ত কিছুই গোছাল। নওরোজ ইমতিয়াজ, মুসা ইব্রাহিম আর মশহুরুল আমিন মিলনকে ছুটোছুটি করতে দেখা গেল। আমার আগেই কথাশিল্পী ও নিসর্গী বিপ্রদাশ বড়–য়া চলে এসেছেন। ১১টা ৪০ মিনিটে রাতের নিস্তব্ধতা ভেঙে রাঙামাটির উদ্দেশ্যে আমাদের যাত্রা শুরু হলো। রাতভর কুয়াশার লুকোচুরি। পথের ওপরই যেন তাদের ঘরবাড়ি। আমাদের গাড়ি হঠাৎ করেই সেসব ঘরের ভেতর ঢুকে পড়ছে। তারপর আবার মুক্ত পথে। এভাবেই মধ্যরাত গড়িয়ে এলো। কুয়াশার চাদর যেন আদরমেখে আছে চারপাশে। কি মনে করে হঠাৎ থামল গাড়িটা। নষ্টটষ্ট হলো নাতো! বাইরে উঁকি দিয়ে বুঝলাম এখন চা বিরতি। অন্য গাড়িগুলোও এসে দাঁড়াচ্ছে। এটাও একটা চমক। জানতাম একছুটে একেবারেই চট্টগ্রাম। সবাই ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র দলে বিভক্ত হয়ে চা-গল্পে মেতে উঠল। অবশ্য বেশিক্ষণ এই গল্প চলল না, হ্যামিলনের বাঁশিঅলার (বাস) দিকে ছুটতে হলো। পরিবেশ-প্রকৃতির নানান প্রসঙ্গে আমাদের নির্ঘুম রাত কাটল। ভোরের আলো ফোটার আগেই আমাদের গাড়ি চট্টগ্রাম শহর অতিক্রম করল। কুয়াশামোড়ানো ভোরে রাঙামাটি শহরের হোটেল সুফিয়াতে গাড়ি থামল। হোটেলে ঢুকে দেখি সবকিছু প্রথম গাড়ির বন্ধুদের দখলে। বাথরুমের সামনে দীর্ঘ লাইন। যেন টিকিট কেটে সবাই গাড়িতে ওঠার জন্য অপেক্ষা করছে। এটাই বাস্তবতা। সবার জন্যতো আর একটা একটা বাথরুম থাকবে না।

বিপ্রদাশ বড়–য়া আমার আগে আগেই নাস্তার টেবিলে এসে বসলেন। নাস্তা সেরে ফিশারি ঘাটে অপেক্ষমান কেয়ারি কর্ণফুলিতে চেপে শুরু হলো আমাদের চমকপ্রদ ভ্রমণ। বার কয়েক ভ্রমণের সুবাদে দু’পাশের প্রায় সব দৃশ্য আমার মুখস্ত। এই অঞ্চলের সবছিুই বিপ্রদার নখদর্পণে। পাহাড়গুলোতে কোন কোন জাতের গাছ থাকে, কোন কোন জাতের প্রাণী থাকে। মানুষের নির্মমতায় যেসব প্রাণী ইতোমধ্যেই বিলুপ্ত হয়ে পড়েছে তাদের কথাও জানা গেল। প্রসঙ্গত তিনি হাতির গল্পও বললেন। আমরা যেখানে যাচ্ছি সেখানে প্রায়শই হাতির দেখা মিলে। এসব বন্যহাতিরা যথার্থই বিপদজনক। লঞ্চ ছাড়ার কিছুক্ষণের মধ্যেই এই দ্বিতল জলজানে উৎসব আমেজ ছড়িয়ে পড়ল। ক্রমেই দুর্গম হয়ে উঠছে পাহাড়। কোথাও খাড়া পাহাড়, কোথাও ঘনজঙ্গল, কোথাও পাহাড়ের গায়ে সময়ের বলিরেখা স্পস্ট। শাখামৃগ বানরের দল নেমে এসেছে লেকের কিনারে। এখানে তাদের বিরক্ত করার কেউ নেই। তারপর চোখে পড়ল শীতের হতশ্রী সুবলং ঝরনা। নানান কৃত্রিম স্থাপনায় এখানকার প্রাকৃতিক সৌন্দর্য বিঘিœত হয়েছে। তারপর সুবলং বাজার। কাছাকাছি দূরত্বে পেদা তিং তিংয়ে পেটপুরে খাবার ব্যবস্থা। এদিকের পাহাড়গুলো ন্যাড়া। এরই ফাঁকে নওরোজ ইমতিয়াজের সঞ্চলনায় শুরু হলো আলোচনা পর্ব । মুসা ইব্রাহিম জানালেন অ্যাডভেঞ্চার আর পাহাড়ে ঘোরার গল্প ও করণীয়, বিপ্রদাশ বড়–য়া বললেন এখানকার আদি ইতিহাস, জীববৈচিত্র আর প্রাকৃতিক সৌন্দর্য নিয়ে। আমি বললাম ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতার কথা। বিশ বছরের ব্যবধানে এখানে বদলে গেছে অনেক কিছুই। কিন্তু ততক্ষণে সবার চোখ দু’পাশের অপার সৌন্দর্যের কোলে সমর্পিত। জলচর পাখিদের সঙ্গে শীতের অতিথি পাখিরাও নেমেছে। কোথাও কোথাও পাহাড় অনেক দূরে সরে যাচ্ছে। মাঝে মাঝে পণ্যবাহী ট্রলার পাশকাটিয়ে চলে যায়। কিছু কিছু টিলা বিচ্ছিন্ন, দ্বীপের মতো। এমন কয়েকটি বাজারও চোখে পড়ল।

সংখ্যায় আদিবাসীরা কম। বাসস্থান হারিয়ে তারা আরো গভীর পাহাড়ে ঠাঁই নিয়েছে। কাপ্তাই বাঁধের কারণে সরু নদীর পানি ফুলেফেঁপে লেকে পরিনত হয়েছে। তাতে এখানকার জীববৈচিত্রও মারাÍক ক্ষতির সম্মুখীন হয়েছে। পৌষের সোনারোদ, পাহাড়, অরণ্য আর নীল জলরাশির মোহ সবাইকে যেন আচ্ছন্ন করে রাখল। এদিকে দুপুর গড়িয়ে এলো। তবুও ক্লান্তিহীন চোখ। দুপুর আড়াইটার দিকে আমরা মাইনিমুখ বাজার পৌঁছালাম। ছোট হোটেল, দুই পর্বে সারল খাবার। তারপর পাশ্ববর্তী রাবেতার কলেজের উদ্দেশ্য লঞ্চ মুখ ঘোরালো। সেখানেই আমাদের রাত যাপনের ব্যবস্থা। নিরাপত্তা ও বিবিধ কারণে পাবলাখালীতে রাতযাপনের সিদ্ধান্ত বাতিল। এতে ৪০ ভাগ অ্যাডভেঞ্চার কমে গেল। ব্যাগ-বোচকা রেখে সবাই ছড়িয়ে পড়লেও সুতার টানে আবার ৭টার দিকে লাগোয়া হ্যালিপ্যাড চত্বরে ফিরে এলো সবাই। কেউ কেউ ছুটলেন বছরের শেষ সূর্যকে বিদায় জানাতে। সেখানে পরিচয় পর্বের পর একজন সেনাকর্মকর্তা সবাইকে প্রয়োজনীয় পরামর্শ দিলেন।

কলেজের মাঠেই রাতের রান্নার আয়োজন। ওদিকে প্রথম প্রহরের প্রস্তুতি। দলে দলে ভাগ হয়ে বসল সবাই। রঙিন কাগজ, সরা আর মোমবাতির সমন্বয়। একফাঁকে রাতের খাবারটা সেরে ফেলল সবাই। তারপর মধ্যরাতের আগেই সবাই লেকের ধারে জড়ো হলাম। সবার বয়েআনা মঙ্গল প্রদীপগুলো লেকের পানিতে ভাসিয়ে দেওয়া হলো। জিরো আওয়ারে রাতের আকাশ উজ্জ্বল করে জ্বলল ফ্লেয়ার। আর তখনি সবার হর্ষধ্বনি। তারপর আকাশে উড়ল ফানুস। প্রথম প্রহরের এই অনুষ্ঠানে যোগদিতে সপরিবারে এলেন মাইনির ২৫ বেঙ্গল রেজিমেন্টের জোন কমান্ডার লে. কর্ণেল মুস্তাফিজ। প্রথম প্রহরকে বরণ করার আনুষ্ঠানিকতা চলল অনেকক্ষণ। মধ্যরাতের এমন উৎসব এখানকার মানুষ কি আর কখনো দেখেছে। এবার ঘুমোতে যাবার পালা। তাও মাত্র দু’ঘন্টার জন্য। রাত চারটায় আবার কেয়ারি কর্ণফুলির যাত্রা। উদ্দেশ্য পাবলাখালীতে গিয়েই বছরের নতুন সূর্যকে দেখা। কিন্তু আমাদের আশা নিরাশায় পরিনত হলো। ঘনকুয়াশায় যাত্রা স্থগিত। লেকের পানিতে কনকনে শীতের ভেতর সবার কাঁপাকাঁপি অবস্থা। অবশেষে ভোর ছয়টার দিকে লঞ্চ ছাড়ল। সেনাবাহিনীর একটি দলও আমাদের সঙ্গে ইঞ্জিন নৌকা নিয়ে চলল। অসংখ্য ডুবোচরে পথ হারিয়ে পাবলাখালী পৌঁছুতে প্রায় দু’ঘন্টা সময় লাগল। তখনো দেখা নেই সূর্যদেবের। এই অরণ্যের রেস্টহাউস ‘বনসখীতে’ সকালের নাস্তার ব্যবস্থা।

কিন্তু যে রসুই ঘরে তৈরি হলো আমাদের নাস্তা সে রসুইঘর নাকি কিছুদিন আগে বন্যহাতির দল গুড়িয়ে দিয়েছিল। এমন খবর শোনার পর সবার চেহারায় ফের আতঙ্কের ছাপ। রেস্ট হাউসের অদূরে গাছের ডালে বানর দেখে সেই আতঙ্ক আরো বদ্ধমূল হলো। এবার বনে ঘোরাঘুরির পালা। কেউ কেউ থেকে গেলেন সূর্য বানাতে। আমরা চললাম বন দেখতে। বিচিত্র পাখির ডাক শোনা যাচ্ছে। ইতোমধ্যেই অনেক গাছ চোখে পড়েছে। চুন্দুল, কনকচূড়া, পাদাউক, আদি কাঁটা মেহেদী, আদি জারুল, শীলকড়ই, চাপালিশ, কাজুবাদাম, সেগুন ইত্যাদি। তারপর কিছু গর্জন, মুচকুন্দ, গুলগুলি লতা, শিমূল, নাগেশ্বর। অগভীর বনে এত অল্পকিছু দেখে মন ভরল না। নিরাপত্তার খাতিরে বেশি নিবিড়তায়ও যাওয়া গেল না। এখান থেকে মাত্র ৮/১০ কিমি. দূরে ভারতের মিজোরাম বর্ডার। ৪২ হাজার ৮৭ হেক্টর আয়তনের এই বনে আরো আছে রেসাস বানর, মুখপোড়া হনুমান, উল ুক, বন্য শূকর, বনবিড়াল, উদবিড়াল আর বিচিত্র পাখি। হাতি আর বানর মোটামুটি সহজলভ্য। কিছুক্ষণের মধ্যেই আমরা রেস্টহাউজে ফিরে এলাম। বন্ধুদের প্রচেষ্টায় তৈরি হলো এক ঝলমলে সূর্য। তারপর তাকে মাটির শয্যায় সাজানো হলো।

এবার নতুন সূর্যের পাশে দাঁড়িয়ে ছবি তোলার পালা। সূর্য উৎসবের আনুষ্ঠানিকতা এখানেই শেষ। ওদিকে দুপুর হয়ে এসেছে। আজকেই আমরা ফিরে যাব রাঙামাটি শহরে। সেখান থেকে ঢাকার গাড়িগুলো ছাড়বে। কিন্তু দুপুরের খাবার যে তখনো বাকি। সিদ্ধান্ত ছিল এখানে খাওয়া দাওয়া হবে, তারপর লঞ্চ ছাড়বে। কিন্তু সময় স্বল্পতার কারণে তা আর হলো না। বেছে নেয়া হলো এক অভিনব পদ্ধতি। খাবারগুলো একটা ছোট্ট নৌকায় তুলে কেয়ারি কর্ণফুলীর সঙ্গে বাঁধা হলো। ছেড়ে দিল লঞ্চ। পেছনে কাসালং, মাইনি আর কর্ণফুলী। আমাদের বিদায় জানাতে এসেছে গ্রামের শিশুরা। লঞ্চ ছেড়ে দেবার কিছুক্ষণের মধ্যেই খাদ্যতরী থেকে খাবার পরিবেশন শুরু হলো। সবাই সিটে বসেই খাবার খেয়ে নিল। এটাও একটা মজার অভিজ্ঞতা। আবার দু’পাশের সেই মনোহর দৃশ্য। ক্লান্ত হয় না চোখ।

Read Full Post »

 

রাঙ্গামাটির প্রাকৃতিক মনোমুগ্ধকর সৌন্দর্য্য উপভোগ করবেন কিভাবে
সত্রং চাকমা, সাংবাদিক, দৈনিক সমকাল

রাঙ্গামাটির রঙে চোখ জুড়ালো সাম্পান মাঝির গানে মন ভরালো………। আসলে গানের মতোই রাঙ্গামাটির পথ। পাহাড়ের আকা বাকাঁ পথ, উচুনিচু পাহাড়-পর্বত বেষ্টিত সবুজ অরন্যে ঝর্ণা ঘেরায় অপরুপ প্রাকৃতিক সৌন্দর্য্য আপনার মনকে সহজেই আকৃষ্ট করবে। বন্দর নগরী চট্টগ্রাম থেকে মাত্র ৭০ কিলোমিটার দুরবর্তী পশ্চিমে বৃহত্তর চট্টগ্রাম জেলা, পূর্বে ভারতের মিজোরাম রাজ্যে, উত্তরে পার্বত্য খাগড়াছড়ি এবং দক্ষিণে পার্বত্য বান্দরবান জেলার অবস্থানে প্রাকৃতিক সৌন্দর্য্যরে শহর রাঙ্গামাটি। রাঙ্গামাটির মোট আয়তন হচ্ছে ৬ হাজার ৪শ ৮১ বর্গকিলোমিটার। জলবিদ্যূৎ উৎপাদনের জন্য ১৯৬০ সালে কর্ণফূলী নদীর ওপর বাধঁ দিয়ে কাপ্তাইয়ে নির্মিত হয় ২৫৬ বর্গমাইল এলাকা বি¯তৃত কৃত্রিম জলধারা(কাপ্তাই হ্রদ)। এ জলধারে তলিয়ে গেছে ৫৪ হাজার একর প্রথম শ্রেনীর আবাদী জমিসহ পূরনো রাজবাড়ি, বহু পূরণো অনেক বৌদ্ধ মন্দির, বাজার,শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, অসংখ্য ঘরবাড়ি এবং বিস্তীর্ন সবুজ বনবনানী। এ বাধেঁর ফলে উদ্ধাস্তু হয়েছিল প্রায় এক লাখের বেশী লোক। কৃত্রিম কাপ্তাই হ্রদ সৃষ্টি হওয়ার কারণে রাঙ্গামাটিতে গড়ে উঠে আকর্ষনীয় পর্যটন স্পট। ৭০ দশকের শেষের দিকে সরকার রাঙ্গামাটি জেলাকে পর্যটন এলাকা হিসেবে ঘোষনা করে এবং পর্যটন কর্পোরেশন পর্যটকদের সুবিধার্থে আকর্ষনীয় স্পট স্থাপন করে। পর্যটন কর্পোরেশন স্পটে হোটেল, অফিস এবং মনোরঞ্জনের জন্য দুই পাহাড়ের মাঝখানে একটি আকর্ষনীয় ঝুলন্ত সেতু স্থাপন করে।

 

এ ঝুলন্ত সেতুর পূর্বের দিকে তাকালে দেখা যাবে অপূর্ব জলরাশিসহ ছোটবড় বি¯তৃণ সবুজ পাহাড়। নৈসর্গিক সৌন্দর্যের অপরূপ লীলা ভুমি ও মনোলোভা আকর্ষণীয় পর্যটন স্থানগুলো উপভোগ করতে চাইলে আপনি এক্ষুনি ঘুরে আসতে পারেন রাঙ্গামাটির অপরুপ প্রাকৃতিক সৌন্দর্য্য। কি কি দেখার রয়েছেঃ পর্যটনের ঝুলন্ত সেতু, সুভলং ঝর্ণা ও প্রাকৃতিক সৌন্দর্য্য,ে পেদা টিং টিং, সাংফাং রেস্টুরেন্ট, চাকমার রাজার রাজ বাড়ি, রাজ বন বিহার, উপজাতীয় যাদু ঘর, জেলা প্রশাসনে বাংলো, বীর শ্রেষ্ঠ মুন্সি আব্দু রউফের সমাধি সৌধ এবং আদিবাসীদের গ্রাম ও জীবনযাত্রার দৃশ্য। এখানে আদিবাসীদের জীবন যাত্রা সর্ম্পকে বিশেষভাবে জানার ইচ্ছা থাকলে স্থানীয় উপজাতীয় সাংস্কৃতিক ইনষ্টিটিউট এ গিয়ে জানা যায়। প্রতিবছর এপ্রিলে আদিবাসীরা “বিজু-সাংগ্রাই-বৈসুক উৎসব বা চৈত্র সংক্রান্তী উৎসব” হয় ব্যাপক উৎসাহ-উদ্দীপনা ও জাকজমকভাবে। অর্থাৎ প্রতি বছর এপ্রিল মাসের দ্বিতীয় সপ্তাহের দিকে এ উৎসব পালিত হয়ে থাকে। এটি পার্বত্য চট্টগ্রামে আদিবাসীদের প্রধান সামাজিক উৎসব। দর্শনীয় স্থানগুলোতে কিভাবে যাবেন ঃ রাজবাড়ী, উপজাতীয় যাদুঘর, জেলা প্রশাসন বাংলো, রাজ বন বনবিহার ইচ্ছে করলে আপনি একটি সিএনজি বা বেবী টেক্সী ভাড়া করে ঘুরে আসতে পারেন। কারণ এগুলো একেবারেই শহরের মধ্যেই অবস্থিত। বলে রাখা ভাল, চাকমা রাজ বাড়ীতে অতীত চাকমা রাজ বংশের বেশ কিছু নিদর্শন রয়েছে।

চাকমা রাজ বাড়ী, পুরনো একটি কামান, রাজ দরবার দেখার মতো। চাকমা রাজা আদিবাসী পাহাড়িদের কাছে অত্যন্ত সন্মানীত। রাঙ্গামাটির আরেকটি দর্শনীয় স্থান হচ্ছে রাজ বন বিহার। রাজ বন বিহার বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বীদের জন্য একটি তীর্থস্থান হিসাবে পরিগনিত। বৌদ্ধ ধর্মের বেশ কিছু নিদর্শনও রয়েছে এখানে। পার্বত্য বেীদ্ধ ধর্মীয় গুরু বনভন্তে এ বিহারে তাঁর অবস্থান। উপজাতীয় যাদুঘরে রয়েছে পার্বত্য চট্টগ্রামের উপজাতীয়দের কৃষ্টি,সংস্কৃতির প্রাচীন নিদর্শন। উপজাতীয় সাংস্কৃতিক ইনিষ্টিটিউটে এ যাদুঘর নির্মিত হয়েছে। রাঙ্গামাটির আরেকটি প্রধান আকর্ষন হচ্ছে পর্যটন কমপেক্সে। এ পর্যটন কমপে ক্সের ঝুলন্ত ব্রীজটি দেখার মতো। দুটি পাহাড়ের মধ্যে সংযোগ ঘটিয়ে কাপ্তাই হ্রদের উপর ঝুলে আছে এ সেতু। বছরের দু,এক মাস অবশ্য এ সেতু হ্রদের পানিতে ডুবে থাকে। তবে শীতের মৌসুমে কাপ্তাই হ্রদের পানি কমে যাওয়ায় সেতুর উপর পানি থাকে না। পিকনিক করতে আসা লোকজন খুব আনন্দ নিয়ে সেতু পার হয়ে পাহাড়ের চুড়ায় পিকনিক করে থাকে। রাঙ্গামাটির ঝুলন্ত সেতু দেততে হলে আপনাকে পর্যটন কর্পোরেশনকে মাথাপিছু ৫টাকা দিতে হবে। এছাড়া সুভলং ঝর্ণা বা সুভলংএর প্রাকৃতিক দৃশ্যে,নানিয়ারচরের বুড়িঘাট এলাকায় বীর শ্রেষ্ঠ মুন্সি আব্দুর রউফ এর স্মৃতি সৌধ,পেদা টিং টিং, সাংফাং রেস্টুরেন্ট, ইকো টুক টুক ভিলেজএর পর্যটন স্পট দেখতে হলে আপনাকে অবশ্যই ইঞ্জিন চালিত নৌকা ভাড়া করতে হবে। এখানে মনে করিয়ে দেয়া ভাল সুভলং এর প্রাকৃতিক ঝর্ণা খুবই উপভোগ করার মতো ও সুভলং এর প্রাকৃতিকদৃশ্য অত্যন্ত মনোমুগ্ধকর। তবে বর্ষা মৌসুমেই ঝর্নাগুলো জীবন্ত থাকে। শীতে ঝর্ণা গুলোতে খুব একটা পানি থাকে না। নানিয়ারচরের বুড়িঘাটে রয়েছে বীর শ্রেষ্ঠ শহীদ ল্যান্স নায়ক মুন্সি আব্দুর রউফের স্মৃতিসৌধ। বীর শ্রেষ্ঠ ল্যান্স নায়ক মুন্সি আব্দুর রউফ মুক্তিযুদ্ধের সময় নানিয়ার চরের বুড়িঘাটে শহীদ হন। স্থানীয় এক আদিবাসী তাঁকে ওই স্থানে কবর দিয়েছিলেন। রাঙ্গামাটির বি ডি আর ওই স্থানে এ স্মৃতিসৌধ নির্মান করেছেন। তবে এসব স্থান পরিদর্শনের সময় সারাদিনের জন্য নৌকা ভাড়া করলে এক সঙ্গে রাজবাড়ি, বন বিহার, পর্যটনের ঝুলন্ত সেতু ও জেলা প্রশাসকের বাংলোও দেখতে পারবেন। ইঞ্জিন বোটে করে যাওযার সময় কাপ্তাই হ্রদের স্বচ্ছ জলরাশির বুক ছিড়ে যখন সুভলং এ দিকে এগোবেন তখন প্রথমে একটি সবুজ দ্বীপের মাঝে চোখে পড়বে বেসরকারী পর্যটন স্পট পেদা টিং টিং রেস্টরেন্ট ও পর্যটন স্পট। পেটাটিং টিং শব্দটি চাকমা ভাষায় নামকরণ করা হয়েছে। এর অর্থ হল পেট ভরে খাওয়া। ১৯৯৭সালে পার্বত্য শান্তি চুক্তির পরবর্তী সময়ে রাঙ্গামাটি শহরের অদূরে বালুখালীতে গড়ে উঠেছে এ বেসরকারী পর্যটন পেদা টিং টিং। পুরো একটি সেগুন বাগানকে পর্যটন কেন্দ্রে পরিনত করা হয়েছে।

সারি সারি সেগুন গাছের সাথে রয়েছে কিছু বনের পশু পাখি। এখানে উপজাতীয় ঐতিহ্যের খাবার সহ রকমারী খাওয়ার জন্য রয়েছে রেষ্টুরেন্ট ও থাকার জন্য রয়েছে উপজাতীয় ঐতিহ্যের টং ঘর। তাছাড়াও পেদাটিং টিং পর্যটন স্পটের একট অদুরে মনোরম প্রাকৃতিক পরিবেশে গড়ে উঠেছে পর্যটন বা পিকনিক স্পট সাংফাং ও ইকো টুক টুক ভিলেজ। এখানেও আদিবাসীদের ঐতিহ্যের খাবারসহ রকমারী খাওয়ার জন্য রয়েছে রেষ্টুরেন্ট। পেদা টিং টিং ফেলিয়ে সবুজ পাহাড়ের বুক ছিড়ে যখন সুভলং উদ্দেশ্যে এগোতে থাকবেন তখন দেখতে পাবেন কিছূ আদিবাসী গ্রাম। সেখানে রয়েছে নির্মল পাহাড়ি সরলতা ও জীবনযাত্রা। আপনি ইচ্ছে করলে সে সব গ্রাম ঘুরে দেখতে পারেন। আর এসব গ্রামের পাহাড়ের মাঝে মধ্যে দেখতে পাবেন জুমক্ষেত(পাহাড়ের চূড়ায় চাষাবাদ)। এভাবে মনোমুগ্ধকর পরিবেশে যেতে যেতে এক সময় পৌঁছে যাবেন নয়নাভিরাম সুভলং। সুভলং এর ঝর্ণার কাছাকাছি পৌঁছতে দেখতে পাবেন দু’দিকে সুউচ্চ পাহাড়। এক সময় এখানে কাপ্তাই বাঁধ নির্মানের জন্য পরিকল্পনা নেয়া হয়েছিল কিন্তু বাঁধ নির্মান করা হলে ভারতের কিছু এলাকা জলমগ্ন হয়ে যায়। তাই সে কারণে পরিকল্পনা বাতিল করা হয়েছিল। এর পর দেখতে পাবেন পাহাড়ের কোল থেকে নেমে আসা কয়েকটি ঝর্না। তবে এর মধ্যে সব চেয়ে বড় ঝর্ণাটিতে দেখলে সত্যিই মনের মধ্যে ভালো লাগবে। এসব ঝর্ণাতে পাহাড়ের ওপর থেকে নেমে আসা ঝর্ণার পানির পাথুরে মাটিতে আছড়ে পড়ার অপূর্ব দৃশ্য। এখানে আপনি ইচ্ছে করলে গোসল করতে পারবেন ও আপনার সাথে ক্যামরা থাকলে পছন্দ মত ছবিও নিতে পারেন। এখানে মনে করিয়ে দেয়া ভালো ঝর্ণার পানি সাধারণত বর্ষার মওসুমে সময় সচল থাকে। শুস্ক মওসুমে একেবারেই পানি থাকে না। তবে এ ঝর্ণাটি দেখতে হলে আপনাকে প্রবেশ ফি হিসেবে পাঁচ টাকার টিকিট কাটতে হবে। এরপর ঝর্ণা দেখা শেষ হলে আপনি কিছুক্ষনের জন্য সুভলং বাজারে ঘুরে আসতে পারেন। সেখানে সেনাবাহিনীর একটি মনোরম ক্যান্টিনও রয়েছে। ইচ্ছে করলে সেখান থেকে হালকা নাস্তা, চা খেতে পারেন। কারণ এখান থেকে সোজাসোজি আপনাকে রওনা দিতে হবে শহরে দিকে। এছাড়াও রাঙ্গামাটি শহরের অদুরে বালুখালীতে হট্টিকালচার নার্সারীর বিশাল এলাকা জুড়ে যে উদ্যান রয়েছে তার সৌন্দয্যও পর্যটকদের দৃষ্টি আকৃষ্ট করেছে। প্রায় সব সময় এ উদ্যানে পিকনিক হচ্ছে। হর্টিকালচার নার্সারীটি পরিণত হয়েছে আরেক পর্যটন কেন্দ্রে সারি সারি ফল ও ফুল গাছের সাথে রয়েছে কিছু বনের পশু পাখি কিচির মিচির ডাকের শব্দ। সব মিলিয়ে এ উদ্যান পর্যটকদের কাছে অত্যন্ত আকর্ষনীয় স্থান হিসাবে পরিচিতি পেয়েছে। বোট ভাড়া কোথায় পাওয়া যায়ঃ ইঞ্জিন চালিত নৌকা বা বোট ভাড়া রাঙ্গামাটি শহরে কয়েকটি স্থানে পাওয়া যাবে।

 

তবলছড়ি বাজারস্থ বোট ঘাটে, রির্জাভ বাজার, বনরুপায়। এখানে বোট ওয়ালা নতুন লোক হলে আপনার কাছ থেকে হয়তো বেশী ভাড়া চাইতে পারে। তার জন্য দরদাম করে নেয়াই ভালো হবে। সারাদিনের জন্য ভাড়া বা শুভলং যেতে চাইলে আপনাকে আট থেকে এক হাজার টাকা দিতে হবে। আর যদি ২/৩ ঘন্টার জন্য ভাড়া করেন ৬/৭শ টাকা দিতে হবে। এছাড়া পর্যটনের ঝুলন্ত সেতুর পাশেও বোট ভাড়া পাওয়া যায়। তবে সেগুলো একটু ভাড়া বেশী। কেনাকাটা করতে চানঃ পাহাড়িদের তৈরী কাপড়-চোপড় ও হাতের তৈরী বিভিন্ন জিনিসপত্র আপনার বন্ধুর জন্য বা যে কারোর জন্য অথবা আপনার নিজের জন্য কেনাকাটা করতে পারেন। এসবে মধ্যে রয়েছে তবলছড়ি এলাকায়। বিশেষ করে তবলছড়ি বেইন টেক্স টাইল শো রুমে, বনরুপার জুমঘর ও রাজবাড়ি এলাকায় সজপদর। এসব শো রুম থেকে কম দামে বিভিন্ন জিনিসপত্র কিনতে পারেন। কোথায় উঠবেনঃ রাঙ্গামাটি পর্যটন মোটেল। এই মোটেল শহর থেকে একটু দূরে হলেও মনোরম প্রাকৃতিক পরিবেশে বেষ্টিত। এখানে প্রতি রুমের ভাড়া এসি বারশ টাকা, নন এসি ছয়শ টাকা। এছাড়া দল বেধে বন্ধু-বান্ধবদের নিয়ে বা পরিবার পরিজনদের নিয়ে থাকতে চান অসুবিধা নেই। এখানে কটেজের সুব্যবস্থা রয়েছে। প্রতি কটেজের ভাড়া পড়বে দেড় হাজার টাকা। বেসরকারী পর্যটন পেদাটিং টিং এ যারা নির্জন প্রাকৃতিক পরিবেশে রাতযাপন করতে পছন্দ বা যারা সদ্য বিবাহিত দম্পত্তি তারা এখানে হানিমুন করতে পারেন। এখানের প্রতিটি কটেজের ভাড়া পড়বে এক হাজার টাকা। এছাড়া হোটেল সুফিয়া, গ্রীণ ক্যাসেল, মোটেল জর্জসহ ইত্যাদি হোটেলে প্রতি রুমের এসি ভাড়া ৮শ টাকা ও নন এসি ৫শ টাকা। তবে কম দামের হোটলে থাকতে চান তাও পাবেন। কোথায় খাওয়াদাওয়া করতে চানঃ পর্যটনের নিজস্ব রেস্টুরেন্ট ও বার রয়েছে, তবলছড়ির অরণ্যেক রেস্টুরেন্ট, বনরুপায় ক্যাপে লিংক, দি রৌপ, রাজবাড়ির মেজাং ও হেবাং রেস্টুরেন্ট ,রির্জাভ বাজারের গ্রীন ক্যাসেল রেস্টুরেন্ট। এছাড়া আদিবাসীদের তৈরী নিজস্ব খাবার খেতে ইচ্ছে করে পাবেন অবশ্যই। এসব রেস্টরেন্টুটের মধ্যে রয়েছে পেদা টিং টিং। এছাড়া পেদাটিং টিং থেকে একটু নতুণ গড়ে উঠা রেস্টুরেন্ট সাংপাং। এখানে হুর হেবাং( বাশেঁর মধ্যে রান্না করা মুরগি তরকারী) বদা হেবাং(কলা পাতায় রান্নায় ডিম তরকারী) ইত্যাদি। পেদাটিং টিং টিং যেতে হলে শহর থেকে ২/৩ কিলোমিটার দূরে আপনাকে ইঞ্জিন বোটে করে যেতে হবে। অবশ্যই পেদাটিং টিং কর্তৃপক্ষের নিজস্ব বোট রয়েছে প্রতিজনকে ভাড়া দিতে হয় দশ টাকা করে। এজন্য আপনাকে রাঙ্গামাটি প্রেস ক্লাবের পাশে তাদের একটি অফিস রয়েছে সেখানে যোগাযোগ করতে হবে। অথবা ইচ্ছে করলে বোট ভাড়া করতে পারেন কয়েক ঘন্টার জন্য বোট ভাড়া লাগবে ৪/৫শ টাকা।

 

কাপ্তাই উপজেলাঃ কাপ্তাই না গেলে রাঙ্গামাটি বেড়াতে আসা আরও একটি সাধ অপূর্ন থেকে যাবে। এখানে কাপ্তাই জল বিদ্যূৎ উৎপাদন কেন্দ্র, কর্ণফূলী পেপার মিলস্, কর্ণফূলীর নদীর অপূর্ব দৃশ্য, কাপ্তাই জাতীয় উদ্যোন ইত্যাদি দেখার জায়গা রয়েছে। তবে কাপ্তাই জল বিদ্যূৎ উৎপাদন কেন্দ্র, কর্ণফূলী পেপার মিলস দেখতে চাইলে আপনাকে কর্তৃপক্ষের কাছে অনুমতি লাগবে। কাপ্তাই কর্ণফূলী নদীর ধারে খাওয়াদাওয়া করার জন্য অনেক রেস্টুরেন্টও রয়েছে। কাপ্তাইয়ে আপনি ইচ্ছে করলে রাতযাপনও করতে পারেন। তবে সে রকম ভালো মানের হোটেল নেই। তার চেয়ে কোন রেস্ট হাউসে উঠা ভালো হবে।

 

কাপ্তাই যেতে হলে আপনি তবল ছড়ি বাজার থেকে স্পীড বোটে করে যেতে পারেন। তাতে ভাড়া লাগবে ৩০টাকা। অথবা রির্জাভ বাজার থেকে বাসে করে যেতে পারেন কাপ্তাই বড়ইছড়ি পর্ষন্ত। বাস ভাড়া পড়বে প্রতিজন ২৫টাকা করে। এছাড়া ইচ্ছে করলে রাঙ্গামাটি থেকে স্পীড বোট ভাড়া করতে পারেন। ভাড়া পড়বে ১হাজার থেকে ১২শ টাকা পর্ষন্ত। আপনি ইচ্ছে করলে চট্গ্রাম থেকেও বাসে করে কাপ্তাই যেতে পারবেন। কিভাবে যাবেনঃ ঢাকা থেকে বিমান, ট্রেনে বা বাসে অথবা সরাসরি রাঙ্গামাটি যাওয়া যাবে। যদি ঢাকা থেকে বিমানে, ট্রেনে বা চট্টগ্রাম বাসে করে গেলে আপনাকে চট্টগ্রামে অবশ্যই নামতে হবে। চট্টগ্রামে পৌঁেছ অক্সিজেনএর বাস স্টান্ডে যেতে হবে। সেখান থেকে প্রতি ২৫মিনিট পর পর বিরতীহীন বাস ছাড়ে। ভাড়া পড়বে ৮৫টাকা। তবে এখান থেকে আবার লোকাল বাসও পাওয়া যায়। আর আপনি একটু আরামে চেয়ার কোস বাসে( বিআরটিসি, এস আলম, সোদিয়া, চ্যালেঞ্জার, কর্নফূলী) করে রাঙ্গামাটি যেতে চান তাও পাবেন। তবে এসব চেয়ার কোচ সব সময় পাওয়া যায় না। এসব চেয়ার কোচগুলো নিজস্ব কাউন্টার থেকে টিকিট পাওয়া যাবে। ভাড়া পড়বে একশ টাকা। এছাড়া আপনি সরাসরি ঢাকা থেকে রাঙ্গামাটিতে আসতে চান। তাতেও পাবেন। ঢাকার কমলাপুর স্টেশন, কলা বাগান, গাবতলী, টি টি পাড়া ফকিরাপুল কাউন্টার থেকে পাবেন ডলফিন, সোদিয়া, এস আলমের টিকিট। টিকিটের দাম ৪০০টাকা। এছাড়া সরাসরি শ্যামলী পরিবহনের এসি চেয়ার কোচ পাবেন কলা বাগান, মতিঝিল ও কল্যাণপুর থেকে বাসের টিকিট পাবে ৫০০টাকায় এবং কমলাপুর বিআরটিসি কাউন্ডার থেকে পাবেন বিআরটিসির নন এসরি টিকিট। আপনার ঢাকা থেকে রাঙ্গামাটি পৌঁছতে সময় লাগে ৭/৮ ঘন্টা আর চট্টগ্রাম থেকে রাঙ্গামাটিতে আসতে সময় লাগবে দুই থেকে আড়াই ঘন্টা। যোগাযোগঃ রাঙ্গামাটি পর্যটন হোটেলের ফেন নম্বর হল- ৬৩১২৬,৬১০৪৬। পেদা টিং টিং-৬২০৮২, গ্রীণ ক্যাসেল-৬১২০০, সুফিয়া-৬১১৭৪, মোনতলা-৬১৬১৮, মেজাং-৬২৯৪৪ ও অরণ্যেক-৬২০৮২।

 

 

Read Full Post »

নৈসর্গীক সৌন্দর্যের পার্বত্য সাজেক

আল-ফারুক আযম, সাজেক থেকে ফিরে ॥অনেকদিন থেকেই দেশের দক্ষিণ-পূর্বাঞ্চল ভারতের মিজোরাম রাজ্য সন্নিহিত সাজেক উপত্যকায় যাবার ইচ্ছা ছিল। তাদের নিয়ে নানা রূপকথার মত গল্প শুনেই সেখানে মন টেনেছে বার বার। বৈচিত্র্যময় উপজাতি জীবনধারা আর নৈসর্গীক অপরূপ সৌন্দর্য আমাকে হাতছানিতে ডেকেছে। কিন্তু দেশের মানচিত্রে গ্রথিত এই সাজেক উপত্যকাটি এতই দূর্গম ও অরণ্যাবৃত যে ইচ্ছে করলেই সেখানে যাওয়া যায়না। এখানে বৃটিশ শাসনামল থেকেই উপেক্ষা আর অবহেলার মধ্যদিয়ে অতিবাহিত হচ্ছে এখানকার সহজ, সরল আদিবাসীদের জীবন যাত্রা। অঘোষিতভাবে নিষিদ্ধ এই জনপদের মানুষের যাতায়াতের একমাত্র উপায় পায়ে হাটা পাহাড়ি আঁকা-বাঁকা উঁচু-নিঁচু মেঠ পথ। সেখানে টেলিফোন, মোবাইল, ই-মেইল, ইন্টারনেট তো দূরের কথা, জরুরী প্রয়োজনে এখানে কখনই ডাক পিয়ন যায়নি। এখানকার মানুষের জন্য পোষ্ট অফিস ৫০ কিলোমিটার দূরে মারিশ্যা বাজারে অবস্থিত। সবুজ পাহাড়ের বুক চিরে নিরাপত্তা কাজে নিয়োজিত সেনাবাহিনীর পৃষ্ঠপোষকতায় এই প্রথমবারের মত সাজেক পর্যন্ত সড়ক যোগাযোগ স্থাপিত হয়েছে। যা এখনও বাস্তবায়নাধীন। এই সড়ক যোগাযোগ স্থাপিত হলে এখানকার আদিবাসীরা তাদের জুমের ফসল ধান, তিল, তিসি, মিষ্টি কমলা, তরু-তরকারি অনাসায়ে বাজারজাত করতে পারবে এ স্বপ্ন দেখতে শুরু করেছে। একমাত্র সড়ক যোগাযোগের অভাবে জীবন ও জীবিকার সন্ধানে এখানকার মানুষ পারি জমাতো পার্শ্ববর্তী দেশ ভারতের মিজোরাম রাজ্যের বিভিন্ন হাট-বাজারে। সাজেকের মানুষের উঠা-বসা, হাট-বাজার, বিয়ে-সাদি, লেখা-পড়া, যাওয়া-আসা সবই চলে মিজোরামের সাথে। এসকল কারণেই অনেকদিনের কৌতুহল ছিল স্ব চোঁখে দেখবো, কেন তারা স্বদেশের মাটি আঁকড়ে ধরে ভীন দেশে পারি জমায়।

সেই থেকেই সাজেকের ভিন্ন জীবন নিয়ে খোঁজ নিতে শুরু করি……… পার্বত্য চট্টগ্রামে আরও ১০টির মত আদিবাসীর বসবাস সত্বেও সাজেকের এই ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠীর জীবন যাপন একেবারেই ভিন্ন ও বৈচিত্র্যময়। সাজেকের পাংখোয়া ও লুসাই উপজাতিদের মিজো জাতি গোষ্ঠী বলা হয়। মূলতঃ এরূপ ১০ ভাষা-ভাষি আদিবাসীকে মিজো জাতি হিসেবে পরিচিত। তাদের মধ্যে রাঙ্গামাটি জেলার সাজেক ইউনিয়নের রুইলুই, কংলক, শিয়ালদাই, বেথলিং, তৈচৈ, ওল্ড লংকর-নিউ লংকর মৌজায় পাংখোংয়া ও লুসাই উপজাতিরা বসবাস করে থাকে। এই মিজোদের চাল-চলন, আচার ব্যবহার উঠা-বসা সবই ভারতের মিজোরাম রাজ্যের সংস্কৃতির সাথে মিল খুজে পাওয়া যায়। বেশিরভাগ সাজেকবাসী গান শোনে ইংরেজি ও মিজো ভাষায়। মাঝে মাঝে হিন্দী ও ব্যান্ডের গানও শোনে তারা। কথা বলে মিজো ও ইংরেজি ভাষায়। লেখা-পড়া ইংরেজিতে হয়। মিজোরামের বিভিন্ন বিদ্যালয়ে যে লেখা-পড়া হয় তা ইংরেজি অক্ষরে। মিজোদের নিজস্ব অক্ষর ইংরেজিতে। মিজোরামের ইংরেজিতে এক্স, ওয়াই, কিউ অক্ষর নেই। সে জন্য মিজোরা ইংরেজি শিখতে পড়তে ও বলতে পারে খুব দ্রুত। তবে মিজো কথ্য ভাষার সাথে ইংরেজি ভাষার মিল নেই বললেই চলে। সাজেকবাসীর ঘুম ভাংগে ইংরেজি গান শুনে। বাংলা গান তেমন বুঝেনা বিধায় ইংরেজির প্রতি আকর্ষণ বেশি। হিন্দি ভাষাও কম বুঝে। ওয়েষ্টান কালচারে অভ্যস্ত খৃষ্টান ধর্মাবলম্বী লুসাই, পাংখোয়াদের পোষাক পরিচ্ছেদ, আচার ব্যবহার, মিজো ও ইংরেজিতে কথা বলার ধরণ দেখে মনে হবে সাজেক উপত্যাকা যেন বাংলাদেশের বুকে একখন্ড ইউরোপ। আমাদের প্রিয় মাতৃভূমি বাংলাদেশের এই জনপদের দৃশ্যপট দেখে কেউ আর কষ্ট করে টাকা খুইয়ে ভারত, নেপাল, ভূটানে যেতে চাইবেনা।

কিন্তু ভীনদেশে যাওয়া যতই না সহজ সাজেক যাওয়া তত সহজ নয়। ইন্সার্জেন্সি, কাউন্টার ইন্সারজেন্সির কারণে নিরাপত্তার অভাবে এতদিন সেখানে যাওয়া হয়নি। ১৯৯৭ সালের ২রা ডিসেম্বর পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তির পর পার্বত্য এলাকার পরিস্থিতি স্বাভাবিক হয়ে আসায় পার্বত্য জেলাগুলোতে পর্যটকদের আনাগোনা বেড়ে গেছে। তবে সাজেক এলাকায় অবাধ যাতায়াতের উপর এখনও পর্যন্ত নিষেধাজ্ঞার অদৃশ্য প্রাচীর রয়েছে। সেখানে ইচ্ছে করলেও যে কেউ যে কোন মূর্হুতে যেতে পারে না। এই অদৃশ্য প্রাচীর ভেদ করে অজানাকে জয় করতে আমরা কয়েকজন সাজেকে যাবার পরিকল্পনা করি। সাজেক আবিশ্বারের অভিপ্রায়ে যাত্রা হল শুরু……… রাজধানী ঢাকা থেকে দেশের একদল দামাল ছেলের আগ্রহ তারাও সাজেক যাবে। কোন পথে যাবে তা তাদের ছিল অজানা। দলটি প্রথমবার এসেছিল খাগড়াছড়িতে অলৌকিক দেবতা পুকুর, রহস্যময় আলুটিলা গুহা দেখতে। এরপর তারা আবার আসে তবলছড়ির অপরূপ ঝর্ণাটিলা দেখতে। সেবারই তারা সাজেক যাওয়ার বিষয়ে চূড়ান্ত সিন্ধান্ত নেয়। ঢাকায় ফিরে তারা আমার সাথে ফোনে যোগাযোগও করে যথারীতি। সাজেক জয় করার অভিপ্রায় নিয়ে অবশেষে ১০/১৫ জনের বিশাল দল বীরের বেশে খাগড়াছড়ি আসে। ইতিপূর্বে তারা দেশের সর্বোচ্চ পর্বতমালা বান্দরবানের তাজিংডং, কেউক্রডংসহ অনেক উঁচু পর্বত জয় করেছিল। খাগড়াছড়ি বাজার থেকে কাক ডাকা ভোরে ঝটপট নাস্তা খেয়ে একটি চাঁদের গাড়ীতে করে আমরা বেড়িয়ে পরি স্বপ্নে দেখা সাজেকের উদ্দেশ্যে। আঁকা-বাঁকা উঁচু-নিঁচু রাস্তার দু’পাশে পাহাড়ি সাদা কাঁশ বন পাড়ি দিয়ে, দূরে সবুজের ঢেউ তোলা দিগন্ত ছু’তে তীরের বেগে আমাদের জীপটি ছুটছে। খাগড়াছড়ি জেলা শহর থেকে ২৫ কি.মি. দূরে দীঘিনালা সেনা জোনের সামনে ধীরে চলুন, সামনে সেনা ক্যাম্প লেখা দেখে পথে প্রথম সামান্য ধাক্কা খেলাম। সেনাবাহিনীর ক্যাম্পের সামনে প্রথমে আমাদের গতীরোধ করা হয়। কোথায় যাচ্ছেন? উত্তরে বললাম বাঘাইছড়ি। আমাদের ব্যাগ তল াশীর পর ছেড়ে দেয়া হল। এরপর আরও ৫ কি.মি. যেতে না যেতেই জোড়া ব্রীজ এলাকায় আরেক দফা তল াশী।

কোথায় যাচ্ছেন? উত্তরে বললাম বাঘাইছড়ি। তেমন তল াশী ছাড়াই ছেড়ে দেয়া হয়। এরপর আরও প্রায় ১০ কি.মি. দূরে বাঘাইহাট সেনাবাহিনীর একটি জোনের সামনে রাস্তায় বাঁশ দিয়ে আটকে দেয়া হয় আমাদের জীপটিকে। খাগড়াছড়ি থেকে ৩৫ কি.মি. আসার পর বাঘাইহাট সেনা জোনের সামনে এসে জানতে পারি এখান থেকে সাজেকের মূল লক্ষ্যস্থলের দূরত্ব ৪০ কি.মি.। উলে খ্য, বাঘাইহাট জোনটিও কিন্তু সাজেক ইউনিয়নের অর্ন্তগত। এই জোন থেকে নির্দেশ আসলো সকলের ব্যাগ তল াশী করতে হবে। ব্যাগ তল াশী করা হলো। এরপর জিজ্ঞেস করা হয় কোথায় যাবেন? উত্তরে এবারই প্রথম বললাম সাজেক যাবো। সাজেকের কথা বলতেই সেনা সদস্যরা হতচকিত হয়ে বলেন কি? সাজেক! পারমিশন আছে? আমরা বললাম কিসের পারমিশন। এরপর শুরু হয় হায়ার অথরেটির সাথে ওয়ার্লেস যোগাযোগ। আমাদের আটকে দিয়ে বলা হয় বিগবস জোন কমান্ডার সাহেব আপনাদের কয়েকজনকে জোনে যেতে বলেছেন, কথা বলবেন। সবাইকে রেখে আমি রুবেল, লিপটন ভাই উপরে গেলাম। তৎকালীন জোন কমান্ডার বললেন, সাজেক যাবেন কেন? আমরা বললাম বেড়াতে। কমান্ডার বললেন, সেখানে কোন বাঙ্গালী যেতে পারে না। বললাম কেন? উত্তরে বললেন, নিরাপত্তার অভাবে। নিশ্চিত অপহরণ অথবা মৃত্যুর মূখে আপনাদের ঠেলে দেয়া ঠিক হবে না। তিনি উদাহরণ টেনে বললেন, বছর খানে আগেও সাজেকের গঙ্গারাম ব্রীজ সেনাবাহিনীর তত্বাবধানে নির্মানকালে সেনা উপস্থিতি কয়েক মিনিটের মধ্যে ছিল না এ সুযোগে সন্ত্রাসীরা অস্ত্রের মূখে ৭জন নির্মাণ শ্রমিককে অপহরণ করে নিয়ে যায়। দীর্ঘ ৩৫দিন পরে সেনাবাহিনী কমান্ড অপারেশন চালিয়ে তাদের উদ্ধার করে নিয়ে আসে। এছাড়াও খাগড়াছড়ি-রাঙ্গামাটি সড়কের কালাপাহাড়ে তিন বিদেশী প্রকৌশলী অপহরণের কথাও তিনি স্মরণ করিয়ে দিয়ে বলেন, আপনাদের অপহরণ করা হলে পুরো পার্বত্য এলাকার সেনাবাহিনী ব্যস্ত হয়ে পরবে। দেশের অনেক ক্ষতি হবে।

এই দূর্গম বিশাল রিজার্ভ বনভূমি ও পাহাড়ি এলাকায় নিরাপত্তা ব্যবস্থা তেমন জোরদার করা সম্ভব হয়নি। শুধু সাজেকের রুইলুই ও কংলাক মৌজার মাঝখানে একটি বিডিআর ক্যাম্প রয়েছে। বেথলিং ও শিয়ালদই মৌজায় বিডিআর থাকলেও পুরো এলাকা নজরদারীতে আনা বাস্তবেই কষ্ট সাধ্য ব্যাপার। আমাদের মধ্যে রুবেল ভাই বললেন সাজেক কি বাংলাদেশের অংশ নয়? উত্তরে কমান্ডার বললেন, অবশ্যই বাংলাদেশের অংশ। তাহলে কেন এভাবে নিষেধাজ্ঞা আরোপ করছেন? উত্তরে কমান্ডার বললেন, পার্বত্য চট্টগ্রাম বিশেষ এলাকা হিসেবে পরিগনিত হয়ে আসছে। আর সাজেক আরও বিশেষ এলাকা হিসেবে বৃটিশ আমল থেকেই প্রতিষ্ঠিত। কমান্ডার সাফ সাফ জানিয়ে দিয়ে বললেন সাজেক আপনাদের কোন ভাবেই যেতে দেয়া হবে না। বড় জোর মাচালং বাজার পর্যন্ত বাঙ্গালীরা যেতে পারে সেখানে পর্যন্ত যেতে পারেন। একথা বললেও তিনি অবশেষে তার সামনে দিয়ে মাচালং পর্যন্তও যেতে দিলেন না কারণ, আমরা মাচালং যেতে পারলে পায়ে হেটেই সাজেকের মূল লক্ষ্যে চলে যেতে পারি এ অশংকায়। কমান্ডারের অশংকা অবশ্য ভূল ছিল না।

আমাদের দৃঢ়তা দেখে তিনি বিশ্বাস করেছেন যে দেশের এই দুঃসাহসী ছেলেদের কোনভাবেই রুখা যাবে না। তারা সাজেক যাবেই। আলাপচারিতায় কমান্ডার অবশ্য বলেই ফেলছিলেন আপনাদের সাজেক যাওয়ার কথা শুনে আমার দেখতে ইচেছ করছে কোন সেই দুঃসাহসী ছেলেরা সাজেক যেতে সাহস করে! আমাদের জীবনের নিরাপত্তার কথা ভেবে জোন কমান্ডার আমাদের যেতে দেননি। অতিথি আপ্যায়নের মধ্যদিয়ে তাঁর আন্তরিকতার যে কোন অভাব ছিল না তা আমরা বুঝতে পেরেছিলাম। আমরা হতাশ হয়ে ফিরে আসি বাঘাইছড়ি মারিশ্যা বাজারে। সেখানে আসার আগেই আমরা জানতে পেরেছি পানি পথে সাজেকের রাস্তা রয়েছে। এজন্য মারিশ্যা বাজারে যেতে হবে। মারিশ্যা বাজার গিয়ে আমাদের দলটি ছোট হয়ে গেল ২০ জনের দলটি ১৩ জন হয়ে গেল। মারিশ্যা বাজারে এসে সন্ধ্যার পর নৌকা ঠিক করা হলো। পরদিন সকালেই আমরা বেড়িয়ে পরবো নদীপথে সাজেকের উদ্দেশ্যে। পরিকল্পনা বাস্তবায়নে জুননুন ভাই কয়েকজনের সাথে মারিশ্যার আমরা যে হোটেলে উঠেছে সেখানে বসে কয়েক দফা বৈঠক করলেন। মারিশ্যা বাজারের কয়েকজন দোকানদার বললেন ভাই কোথায় যাবেন? উত্তরে বললাম সাজেক। দোকানদাররা বললো আমাদের জম্ম মারিশ্যা বাজারে সাজেক আমাদের উপজেলার একটি ইউনিয়ন সত্বেও কোন দিনই সেখানে যেতে সাহস করিনি। আপনারা কি ওখানে মরতে যাবেন? কি দরকার সেখানে যাওয়ার। সেখানে একজাতীয় উপজাতি আছে যারা মানুষ হত্যা করে খেয়ে ফেলে। এসকল কথা শুনে আমাদের মাঝে অদৃশ্য আতংক তাড়া করে ফিরতে লাগলো।

সাজেক যাওয়া হবে কি হবে না এ জন্য দোটানায় পড়লেও গোপনে চলতে থাকে পরিকল্পনা। পরিকল্পা হয় বৌদ্ধদের একটি বনবিহারে। সেখানে আমরা সন্ধ্যার আগে আগে বেড়াতে গিয়েছিলাম। লিপটন, রুবেল, রশিদ, সিনা ও জুননুন ভাই মারিশ্যা বাজারে ফিরে এসে ভাগ্যক্রমে নৌকা ঘাটে সাজেকের কংলাক মৌজার হেডম্যান চংমিংথাংগার খোঁজ পান। তার সাথে পরিচয় হয়। তিনি বলেন, রাত্রে কথা হবে। একথা বলে চলে যান। রাতে আমরা কয়েকজন বেড়িয়ে পরি সাজেকের কংলাক মৌজার হেডম্যানের খোঁজে। তার সাথে দেখা হয় শহরের একটু ভেতরে একটি গীর্জা ঘরে। হেডম্যান বললেন, এতো লোক সাজেক যাবেন, বিপদ হতে পারে। অপহরণ করতে পারে চুক্তি বিরোধী ইউপিডিএফ’র লোকজন। তবে আমি চাই আপনারা আমাদের ওখানে যান। আমরা তো বিচ্ছিন্ন অবস্থায় থাকি। স্বদেশী অতিথিদের দেখা পাই না। আপনারা আমাদের ওখানে গেলে আমাদের জীবন যে কত কষ্টের তা জানতে পারবেন। এতো লোক একসাথে সাজেক গেলে বিডিআর, আর্মীরা তো সমস্যা করবে। আপনারা বাঙ্গালী আপনাদের কিছু হলে তাদের নিকট আমাকে জবাবদীহি করতে হবে। আবার মাচালং যাওয়ার পর পার্টির লোকেরা সন্দেহ করে ধরে ফেলবে। এসকল নানা কথার পরেও আমাদের অতিমাত্রায় চাপাচাপির ফলে হেডম্যান আমাদের সাথে মাচালং বাজার পর্যন্ত যেতে রাজি হলেন, কারণ পরদিন সকালে মারিশ্যা বাজারে বাঘাইছড়ি উপজেলা পষিদ কার্যালয়ে রাঙ্গামাটি জেলা প্রশাসক আসবেন সাজেকসহ উপজেলার বিভিন্ন বিষয় নিয়ে বৈঠক হবে। সেজন্যই তিনি সাজেক থেকে মারিশ্যা এসেছিলেন। রাতে খেতে বসেই আমাদের ঘিরে ধরে এক গাড়ি ভর্তি পুলিশ। আমাদের প্রতি নির্দেশ রুমে চলেন ব্যাগ চেক করা হবে। সন্দেহের মাত্রা দেখে মনে হয় যেন আমরা বাংলাদেশী নই।

সাজেক যাবার কথা ফাঁস হয়ে যাওয়ায় সন্দেহের আঙ্গুলি আমাদের দিকে অতিমাত্রায় ছিল। সবার নাম ঠিকানা নিয়ে ব্যাগ চেক করে কিছু না পেয়ে আমাদের প্রতি নির্দেশ দেয়া হল ঢাকায় বা খাগড়াছড়ি, রাঙ্গামাটি যেখানে খুশি ফিরে যান, সাজেক যাওয়া যাবে না। মধ্যরাত পর্যন্ত পুলিশের নজরদারীর কারণে আমরা রুদ্ধদ্বার বৈঠক করে অনেককেই অন্ধকারে রেখে সিদ্ধান্ত নেই ফজরের আজান দেয়ার সাথে সাথে নৌকায় উঠে পুলিশের চোঁখ ফাঁসি দিয়ে পানি পথে মাচালং নদী দিয়ে সাজেকের উদ্দেশ্যে প্রথমে মাচালং বাজার যাবো। সিন্ধান্ত অনুযায়ী সেভাবেই রওয়ানা হলাম। আলো আঁধারীর মধ্যে মারিশ্যা বাজারের অদূরে একটি গ্রামের পাশে দিয়ে বয়ে যাওয়া নদী ঘাটে গিয়ে দেখি তখনও নৌকা আসেনি। খানিক পরে দেখা গেল হেডম্যানসহ নৌকাটি আসছে। উঠে পরলাম সকলে সাবধানে। রিজার্ভ ফরেষ্টের মাঝ দিয়ে বয়ে যাওয়া মাচালং নদীর দু’পাশে আদিবাসীদের ঘর-বাড়ি, বড় বড় গাছ পালা, নদীর পারে নানা রকম চাষাবাদ করার দৃশ্য দেখে আমরা মুগ্ধ হয়ে উঠি। জুননুন ভাইএর ক্যামেরায় বন্দি হচ্ছিল এসকল প্রাকৃতিক সৌন্দর্যে লালীত ছবি। আমিও আমার ডিজিটাল ক্যামেরায় কিছু ছবি বন্দি করি। এরই মধ্যে চোঁখে পরে বিশাল বড় বাঁশের চালা। আদিবাসীরা জানালো লক্ষ লক্ষ বাঁশ সাজেক রিজার্ভ ফরেষ্ট থেকে আসছে, নদী পথে কাপ্তাই লেক হয়ে কর্ণফুলী পেপার মিলে যাবে। অনেক দূর গিয়ে যেখানে বাঘের ভয় সেখানেই রাত হয় অবস্থায় পরি। আবার সেই বাঘাইহাট সেনা জোন। যেখান থেকে আমাদের নিরাপত্তার অভাবের কথা বলে ফেরত পাঠানো হয়েছিল। অদৃশ্য ভয়, সংশয়ে সকলেই কিংকর্তব্য বিমূঢ় হয়ে গেল। নদীর পারেই সেনাবাহিনীর নজরদাবী রয়েছে।

বুদ্ধি করে আমরা নৌকায় শুয়ে পরি। চেক পোষ্টকে ফাঁকি দিয়ে রক্ষা পাই। নয়তো আবারও ফেরত যেতে হতো। এবার ফেরত গেলে আর সাজেক যাওয়া হতো না। এরপর কিছু দূর গিয়ে দেখি আবারও সেনাবাহিনীর ক্যাম্প। তবে তেমন নজরদারী নেই। পোষ্ট থেকে সেনাবাহিনী আমাদের দেখতে পেলেও শ্রমিক ভেবে হয়তো কিছু বলেনি। পরে জানতে পারি ইঞ্চিনিয়াংি কোরের এসকল সেনাদের দায়িত্ব সন্ত্রাসীদের নজরদারী করা নয়, নির্মাণ কাজে সহায়তা করা ও স্থাপনার নিরাপত্তা ও সংরক্ষণ করা। ক্যাম্পের পাশে মাচালং নদীতে বেশ বড় ধরণের পাশাপাশি ২টি ব্রীজ। নব নির্মিত এই গঙ্গারাম ব্রীজ থেকেই ৭ নির্মাণ শ্রমিককে সন্ত্রাসীরা অপহরণ করেছিল। যে কথা জানিয়েছিলেন জোন কমান্ডার। মাচালং বাজারে গেলেই দেখা হবে ইউপিডিএফ’র লোকজনদের সাথে এজন্য অগ্রিম গিয়ে নেতাদের সাথে দেখা করতেই সাজেক যাবার অনুমতি নিতেই রুবেল, লিপটন আমি ও হেডম্যান ব্রীজের সামনে নৌকা থেকে বিকল্প পথে রাস্তায় চলে আসি। এসেই দেখা মেলে একটি নির্জন স্থানে চায়ের দোকান। সেখানে বসে চা খাওয়ার পর্ব শেষ করতে না করতেই যাত্রীবাহী জীপ চলে আসে। আমরা জীপে উঠে দেখি জীপে কোন বাংলাভাষাভাষি লোকজন নেই। স্থানীয় আদিবাসীরাই জীপের যাত্রী। জীপটি পথে টাইগারটিলা, শুকনানন্দারাম, ভিজানন্দারামসহ কয়েকটি স্থানে সেনাবাহিনী কর্তৃক চেকিং করা হলো। জীপের হেলপারকে কানে কানে বললাম এতো চেকিং কেন? উত্তরে বললো জীপে অস্ত্র আসে তাই। কোথা থেকে আসে। বলল সাজেক থেকে। কারা আনে বলে পাহাড়িরা। আমি বললাম কই, পথে তো কোন অস্ত্র দেখি নাই বলে আগে আসতো, এখন তেমন আসে না। পথে আসতে চেঁখে পরে সবুজের প্রতি করুন নিষ্ঠুরতার প্রতিচ্ছবি। হাজার হাজার সেগুন, গামারি, কড়ই, চাপালিশ গাছ কে বা কারা কেটে নিয়ে সাবাড় করে ফেলেছে। পৌঁছে যাই মাচালং বাজারে। এখানে দেখা করি ইউপিডিএফ’র নেতা প্রদীপন খীসার সাথে। তার সাথে আমার আগে থেকেই পরিচয় ছিল। তিনি আমাদের সাজেক যাওয়ার অনুমতি দেন শর্ত সাপেক্ষে।

সাজেকের পথে সরকারি রিজার্ভ এলাকায় ১০ নম্বর গ্রামে বসবাসরত ৩০/৪০টি চাকমা পরিবার বসবাস করে। বিডিআর’র এসকল পরিবারের অনেক জুমের ক্ষেত পুড়িয়ে দিয়েছে। তাদের সরকারি রিজার্ভ ফরেষ্ট এলাকায় বসবাসের সরকারি নির্দেশের কথা বলে তাড়িয়ে দিতে চাইছে। অথচ এই আদিবাসীরা ৬০’র দশকে রাঙ্গামাটিরকাপ্তাই লেকে বাঁধ দিয়ে জল বিদ্যুতের প্রকল্প স্থাপন করায় পানিতে তাদের বস্তু ভিটা তলিয়ে যাওয়ায় উচ্ছেদ হয়ে যায়। পরবর্তীতে ৮০’র দশকে গেরিলা যুদ্ধের শিকার হয়েও এরা উদ্বাস্তু হয়ে যাযাবর জীবন যাপন করছে। কোন মত মাথা গোঁজার ঠাই এখানে করলেও সরকারের নিষ্ঠুরমত আইনের মারপ্যাচে তাদেরকে বসবাসের ন্যুন্যতম অধিকারটুকু হরণ করার চেষ্টা চলছে। প্রতিটি রাত তাদের এখন কাটে অজানা এক আশংকায়। মাচালং বাজারে পাশে একজন চাকমা আদিবাসীর বাড়িতে রাত কাটানোর কথা থাকলেও আমি নিজেই বাঁধ সাজি। সে বাড়িতে কিছুক্ষন অপেক্ষার পর একটি কিশোর আদিবাসী জানালো পথে পার্টির লোকদের দেখা হতে পারে। টর্জ লাইট জ্বালানো যাবে না। লাইট দেখে দূর থেকে তারা সেনাবাহিনী ভেবে গুলি করতে পারে। ওদিকে আমরা এই সেনাবাহিনী বা পুলিশের ভয়েই রাতে রওয়ানা হই সাজেকের দূর্গম পাহাড়ি অরণ্য পথে। তারা আমাদের খোঁজ পেলে আর সাজেক যেতে দেবে না বার বার এই আশংকা তাড়া করে ফিরছিল।

সন্ধ্যা প্রায় ঘনিয়ে আসছে এমন সময় আমরা মাচালং বাজার থেকে সাজেকের উদ্দেশ্যে রওয়ানা দেই। আমাদের সাথে ইউপিডিএফ’র দু’জন সদস্য সাজেক যাওয়ার পাহাড়ি দূর্গম পথ দেখাতে সহায়তা করেন। একে তো রাত তার উপর পাহাড়ি আঁকা-বাঁকা উঁচু নিঁচু রাস্তা। সমস্ত রাস্তা ঢাসা জঙ্গলে ঢাকা। মাঝে মাঝে ছড়া, ঝিরি ও নদী। ঝরণার পানিতে রাস্তা কখনও বা পিচ্ছিল। পুরো পথেই ক্লান্তিহীন ঝিঝি পোকার ডাক শুনে একে তো কান ঝালাপালা অবস্থা, তার উপর পাখ-পাখালী, বন্য পশু জীব যানোয়ারের হাক ডাক শুনা যাচ্ছিল। পথিমধ্যে ক্লান্ত শরীরে রাস্তার পাশে একটি টং ঘরে আশ্রয় নেই আমরা ১৫জন। ক্ষুধার তীব্র জ্বালায় আমরা মাচালং বাজার থেকে আনা খাজা মজা করে গিলে ফেলি। এরপর আবার পথ চলা। এ যেন অজানাকে জানার অচেনাকে চেনার শ্বাসরুদ্ধকর স্মৃতি এখনও ভূলতে পারি না। আমরা অবশেষে রাত ১০টার দিকে সাজেকের ১০ নম্বর গ্রামে চাকমা পাড়ায় গিয়ে পৌঁছি। সেখানে আমাদের অভ্যর্থনা জানান, এলাকার কারবারি খুলা রাম চাকমাসহ অন্যান্য গ্রামবাসী। মাঝ রাতে খাওয়া দাওয়া শেষে অবচেতনে ক্লান্ত শরীর ঘুমিয়ে পরে। সকালে সূর্য্যি মামা জাগার আগেই জুননুন ভাই পাহাড়ে সূর্যদ্বয়ের ছবি ক্যামেরা বন্দি করতে ঘুম থেকে জেগে উঠেন। ক্যামেরা বন্দি করেন এখানকার অপরূপ সব দৃশ্য। আমিও ডিজিটাল ক্যামেরায় বন্দি করি বেশ কিছু অনাবিল সুন্দর পাহাড়ের প্রথম আলোর ছবি। ছবিতে মেঘের ভেলা দেখে বিস্মিত হই খানিকটা। সকালের খাবার খেয়ে এখান থেকে আবারও পায়ে হেটে যেতে হবে আসল সাজেক পাহাড়ের চূড়ায়।

আবার রওয়ানা হলাম আমরা। হাট হাটতে অদ্ভুত সব ছবি কোনটা রেখে কোনটা ক্যামেরা বন্দি করি এনিয়েই কয়েকজন ব্যস্ত। এ কারণে এবার ক্লান্তি অনেকটাই কম আঘাত করতে পেরেছে, যদিও বা আসল কষ্টটা এখনই বেশি ছিল। পথে পথে অসংখ্য স্থানে এমন সব রাস্তা চেঁখে পড়েছে তা লেখে বর্ণনা করা আসলেই দুস্কর। কেন না এমন রাস্তাও পেয়েছি, যেখানে বিশাল গাছই হয়েছে একটি সাঁকো। গাছের উপর দিয়ে ছড়া পার হতে হবে। কোথাও খাড়া ঢালুর বাঁকে বাঁকে পথ চলতে হয়েছে। পা পিচলে গেলে নিশ্চিত মৃত্যু এমন রাস্তাও পার হতে হয়েছে। পায়ে হাটা সরু রাস্তার দু’পাশ কোটি কোটি বাঁশ রীতিমত কল্পনার ছবির মত। অনেক দূর এসে দেখা পাই সিজকছড়া নামে একটি পাহাড়ি ছড়া। পাথরের উপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে স্বচ্ছ সাদা পানি। সেখানে আমরা মনের সুখে গোসল সেরে নেই। সেখান থেকেই মূলতঃ প্রায় ২০০০ ফুট উঁচু পাহাড় চূড়ায় আসল সাজেক অবস্থিত। আর আমাদের গন্তব্য সেখানেই। উঠতে উঠতে বহু দূর উঠেও কোন কূল কিনারা পাওয়া যায়নি। মাঝে মাঝে সূর্য্যরে আলোও হারিয়ে যায় জঙ্গলের কারণে। অবশেষে হঠাৎ দেখা মেলে একটি হেলিকপ্টারের। আমরা থমকে দ্বারাই। এতো কষ্টের পরেও কি সাজেক যেতে পারবো না এ আশংকা দেখা দেয়। এই গভীর অরণ্যে কেন হেলিকপ্টার তার রহস্য তখনও অজানা ছিল। আমরা ভেবেছি সরকারের দায়িত্বশীল ব্যক্তিদের চোঁখ ফাঁকি দিয়ে সাজেকের পথ পারি দেওয়ায় আমাদের খুঁজতেই হয়তো বা হেলিকপ্টার এসেছে। কিছুক্ষণ পর হেলিকপ্টার ফিরে গেলেও হতাশার ঘোর তখনও কাটেনি। হাটতে হাটতে দূর থেকেই দেখা মেলে বৃটিশ আমলের বিডিআর ক্যাম্প। একজন লুসাই আদিবাসী আমাদের খবর দিলেন, আপনারা এখন সাজেক যাবেন না। বিডিআর ক্যাম্পে সিনিয়র অফিসার এসেছেন, এ কারণে রুইলুই গ্রামে বিডিআর টহল দিচ্ছে। একথা শুনে আমরা আরেক দফা অপেক্ষা করতে থাকি। পরে বিডিআর চলে গেলে আমরা রওয়ানা হই।

অবশেষে পৌঁছে যাই স্বপ্নের সাজেক। সাজেকের পাহাড় চূঁড়া থেকে মিজোরামের লুসাই পাহাড়ের অদ্ভুত দৃশ্য দেখে সকল ক্লান্তি ও কষ্ট নিমিষেই ¤ ান হয়ে যায়। প্রকৃতির এতো সুন্দর রূপ আগে কখনও দেখিনি। সাজেকের এই প্রাকৃতিক রূপের সাথে পাংখোয়া ও লুসাই আদিবাসীদের বৈচিত্রময় জীবন যাত্রা দেখে আরও বিস্মিত ও হতবাগ হয়ে যাই। উঁচু মাচার ঘরে গাছের গুড়ি কেঁটে বানানো সিঁড়ি, ঘরের ছাউনী বাঁশের পাতার। ঘরের সামনে ফুলের বাগান, মাঝে মাঝেই ক্যাকটাস ও অর্কিড শোভা পাচ্ছে রুইলুই গ্রামটি। ঢালুতে ২/৩ শত বছরের পুরোনো বিশাল বিশাল গাছ। বাড়ির অদূরেই অসংখ্য কমলা বানান। এরই মাঝে চোঁখে পড়ে অসংখ্য ঔষুধী গাছ-গাছড়া। একে বারে ঢালুতে যেদিন তাকাই সেদিকই লক্ষ কোটি বাঁশ আর বাঁশ। সেই ঘর থেকে একে একে বেড়িয়ে আসছে আদিবাসীরা। কেউ পানি আনতে, কেউ বা জুম ক্ষেতে উৎপাদিত ফসল আনতে ব্যস্ত তারা। পরনে তাদের জিন্সের প্যান্ট, গায়ে হাতা কাঁটা সট গেঞ্জি, ব্রা, শার্ট, স্টাট ইত্যাদি। লাবন্যময়ী রূপসী মেয়েদের দেখে মনে হয়েছে বোম্বের কোন নায়িকা এখানে শুটিং-এ এসেছে। পোষাক দেখে মনে হয়েছে এ যেন বাংলাদেশের ভেতর এক খন্ড ইউরোপ। বিকেল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত ঘোরাঘুরি এক পর্যায়ে জানাগেল তাদের ধর্ম খৃষ্টান। মিজো ভাষায় তারা কথা বললেও ইংরেজি তাদের অক্ষর ইংরেজী। লুসাই ও পাংখোয়া আদিবাসীরা বাংলা ভাষার চেয়ে ইংরেজিতে কথা বলতেই বেশি পছন্দ করে। এসকল ভিন্ন জীবন ধারার সাথে পার্বত্য এলাকার অনেক উপজাতিই পরিচিত নয়। রাতে চংমিং থাংগা (৬২)’র সাথে কথা হয়। তিনি জানান অজানা নানা কথা। এখানকার বাঁশে বাঁশে নাকি ফুল ফুটেছে। ফুল থেকে গোলা ধরে ধরে। এসকল গোলা দেখা দেয়া মানে নিশ্চিতভাবেই বলা যায় ২০০৭ সালের পর কোটি কোটি ইদুর দেখা দেবে।

এ বিশ্বাসকে লালন করে সাজেকজুড়ে দেখা দিয়েছে ইদুর বন্যা আতংক। এক জাতীয় ছোট ইদুর (মাউস) জুমের ধান, তিল,তিসি, মারফা বা শষা, মিষ্টি কুমড়াসহ সকল সফল বিনষ্ট করে ফেলবে, এ কারণে সাজেকজুড়ে দেখা দেবে দূর্ভিক্ষ। চারদিক খাদ্যের জন্য হাহাকার পরে যাবে। তখন এখানকার অধিবাসীদের বেঁচে থাকার একমাত্র অবলম্বন হবে এক জাতীয় পাহাড়ি আলু। যা আকারে লম্বা এবং মাটির ভেতর থাকে। আজ থেকে ৫০ বছর আগে একবার এরূপ ঘটনা ঘটে। তৎকালীন সরকার সামান্য রেশন দিয়ে সহায়তা করেছিল। এর আগেও একবার অর্থাৎ ১০০ বছর পূর্বে ইদুরের উৎপাত এখানকার মুরুব্বিরা দেখেছে। এ নিয়ে প্রতি ৫০ বছর পর পর ইদুর আতংক এখানকার মানুষকে তাড়া করে ফিরে। ইদুর যে আসবে তার আলামত ইতিমধ্যে স্পষ্ট হয়ে উঠেছে। সাজেকের পৃথিবী বিখ্যাত সুস্বাদু হাজার হাজার কমলা গাছ মারা গেছে। বাঁশগুলো মরে যাচ্ছে। ইদুর জুমের চাষ বিনষ্ট করার পর পরই সাজেকের বির্স্তীন সজুব বাঁশ জ্বলে পুরে হলুদ বর্ণ ধারণ করবে। ইতোমধ্যে সাজেক সংলগ্ন ভারতের মিজোরাম রাজ্যে ইদুর বন্যা আতংক দেখা দিয়েছে। সে জন্য রাজ্য সরকার আগাম প্রস্তুতি হিসেবে বাঁশগুলো তুলে ফেলছে। কৃষকদের জুম চাষের পরিবর্তে স্বল্প ও দীর্ঘস্থানী চাষাবাদে সহায়তা করছে। এছাড়াও ইদুর মারার প্রয়োজনীয় ঔষধ সরবরাহ করা হয়েছে। সম্ভাব্য দুর্ভীক্ষ সামাল দিতে মিজোরামের খাদ্য গুদামে পর্যাপ্ত খাদ্য শষ্য মওজুত করা হয়েছে। অথচ বাংলাদেশ সরকার সাজেকের এই দূর্ভীক্ষের বিষয়ে কিছুই জানে না। এ কথাগুলো শুনে সত্যিই রূপ কথার গল্প মনে হয়েছে। সাজেক নিয়ে আরও রসহ্য ঘেরা ও অলৌকিক নানা কথা শুনতে শুনতে ক্লান্ত শরীর ঘুমিয়ে পরে। সাদ সকালে সূর্য্যি মামা জানার আগেই আমি উঠে দেখি ততক্ষনে জুননুন ভাই ক্যামেরা নিয়ে প্রস্তুত, সাজেকে প্রথম সূর্যদ্বয়ের ছবি তোলার জন্য। আমিও ক্যামেরা নিয়ে প্রস্তুত। অন্ধকারের ঘোর কাঁটতে না কাঁটতেই হঠাৎ সাজেক ও মিজোরামের লুসাই পাহাড়ের মাঝ বরাবর আঁকা-বাঁকা বিশাল সাগর দেখে আমরা রীতিমত হতবাগ। এই দূর্গম পাহাড়ে আবার পানি বা সাগর এলো কোথা থেকে। যতই সামনে যাই ততই দেখি সবুজের বুক চিরে সাদার আর সাদা পানির খেলা।

তাৎক্ষনিকভাবে এই সাগরের কুল কিনারা আর রহস্য কিছুই বুঝতে পানিনি। কারণ আগের দিন বিকেলে তো এখানে কোন পানি, সাগর, নদী দেখিনি। তবে শুনেছি এই পাহাড়ের মাঝে একটি নদী আছে। যে নদীর নাম সাজেক নদী। মূলতঃ এই নদীর নামেই সাজেকের নাম করণ হয়েছে। এরই মখ্যে পূর্বাকাশে উঁকি দিয়ে ঝিলিক মারে সূর্য্যি মামা। সূর্য্যটার আলোক রস্মি সোজা আচড়ে পরছে সাজেকের উঁচু পাহাড়ে যেখানে আমরা দ্বাড়িয়ে রয়েছি। এমতাবস্থায় আমাদের ক্যামেরা ঝলকে উঠলো। ক্যামেরা বন্দি করলাম পৃথিবীর শ্রেষ্ট সব ছবি। এতো ছবি তুলি তবুও মন যে ভরে না। ম্যামোরী কার্ড শেষ হলেই মনে কষ্ট দেখা দেয়। একটু পরে তাকিয়ে দেখি এতো সাগর, মহা সাগর, নদী নয়, এতো মেঘের ভেলা ভেসে বেড়াচ্ছে লুসাই-সাজেক পাহাড়ের বাঁকে বাঁকে। সবার উপর নীল আকাশ, তার ফাঁকে লাল সূর্য্য, মাঝে সবুজ পাহাড়, নিচে সাদা মেষের সাগর আসলে এক অদ্ভুত দৃশ্য যা বাস্তবে না দেখলে বুঝানো যাবে না। ফিচার, নিউজ, গদ্য, পদ্য লিখে সাজেকের এই দৃশ্যপটের অনুভূতি ব্যক্ত করা সত্যিই দুষ্কর। লাল, নীল, সাদা, সবুজের খেলার সাথে আরও কত রঙের খেলা যে মাখা মাখি করে সাজেকের নির্জন পাহাড়ি আদিবাসী পলি তে তা ভাষায় প্রকাশ করা যায়না। কোন কবি এখানে আসলে যেতে চাইবেনা। কোন শিল্পী এখানে আসলে শুধু ছবিই আঁকবে, ভূলে যাবে নাওয়া খাওয়া, কোন গায়ক এখানে আসলে হেরে গলা ছেড়ে দিয়ে মনের আনন্দে গাইবে গান, আর কোন লেখক এখানে আসলে মনের মাধুরী মিশিয়ে এতো দীর্ঘ দেখা লেখবে তাতেই বিরক্তি অনুভব করবে না পাঠকেরা।

Read Full Post »