Feeds:
পোস্ট
মন্তব্য

সে এক সুন্দর বন……….

সে এক সুন্দর বন……….
অচিন রহস্যের অধরা হাতছানি
যাচ্ছি মামার বাড়ি। সঙ্গে কবীর ভাই। ৫ দিনের এই যাযাবর দলের সর্দ্দার। ছোট্ট শরীর। পেছনে লম্বা ঝুটি। ঝুটি নাড়িয়ে একের পর এক গপ্পো বলে যাচ্ছেন। সবই মামার গপ্পো। সেবার এ্যাপলো ভাই মামার তাড়া খেয়ে অল্পের জন্য প্রাণে বেঁচে গেছেন! মামাকে দেখে গামছা রাশেদ ছবি তুলতেই ভুলে গিয়েছিল। আর ফুটা জাহাঙ্গীর? ক্যামেরার লেন্স ক্যাপ না খুলেই শেষ করে দেয় আধা রোল। আত্মারাম খাঁচাছাড়া সব কথাবার্তা। ভয়ংকর সব স্মৃতি_বলার ঢংয়ে শব্দ করে হেসে উঠছে সবাই। হাসির দমকে বাসে ভুমিকম্প দশা। বাস যাচ্ছে খুলনা। আর আমরা যাচ্ছি সুন্দর বন। সুন্দর বনে বাঘকে ‘মামা’ ডাকে সবাই। আমরা আমাদের মামার বাড়ি যাচ্ছি…।
ঘাটের নাম জেলখানার ঘাট। নদীর নাম পশুর। ৭ ঘন্টার বাসযাত্রা শেষে খুলনায় পৌঁছলাম শেষ বিকেলে। রাত নটায় লঞ্চ ছাড়বে। ঘাটে ভেড়ানো ‘ভটভটি’-কাঠের কালো শরীরে শ্যালো বসানো ট্রলার। ট্রলারের ঘাড়ে চেপে উঠলাম গাইডের লঞ্চে_ অভিযান-টু। আমাদের জলে ভাসা পদ্ম। এই পদ্মে ভেসে পাড়ি দেব পশুর-আন্ধার মানিক, সাগরের মোহনা হয়ে কচিখালি, নীল ডুমুর আরও কত নদী। পথ অল্প কিন্তু সুন্দরবনকে পরিখা করে ঘিরে আছে যেন এইসব নদীরা। জলের বুকে নেই কোনও সীমানা প্রাচীর। কত শত নামে কত শত নদী, ক্যানেল, খাল- ধানসাগর, রুপসা, পশুর, মেলাগাং, হরিনহাটা,দুধমুখি, মোহনা, সুমতি, সুন্দরী, ছেড়া কটকা, কটকা, কচিখালি ইত্যাদি ইত্যাদি। বন বিভাগের হিসেবে অন্তত ৩৫০ নদী আছে বনকে ঘিরে। ছোট বেলার রুপকথার গল্প যেন। সাত সমুদ্দুর তের নদী পার করে তবেই সুন্দরবন। মামার বাড়ি।
লঞ্চ চলছে একটানা। সকাল ৯ টায় পেঁৗছলাম সুমতি। সুমতির সঙ্গী এখানে বেতমোড় খাল। মনের আয়নায় কানে বাজল ছোট্টবেলাকার কবিতা, ‘ঐ দেখা যায় মরা নদীর স্রোতা…….’। কোথাও জনমানব নেই। নেই মোবাইল নেটওয়ার্কও। হুটহাট একটা জেলে নৌকা দেখা যাচ্ছে তখনও। চারপাশে থরে থরে সাজানো বনভুমি। একে তিন টুকরোয় ভাগ করেছে বন বিভাগ। শরণখোলাজোন হচ্ছে গ্রিন জোন। এই বনের অভয়ারণ্য। খূলনা অংশে মিডেল জোন_হিরণ পয়েন্ট। আর সাতক্ষীরায় পরেছে রেডজোন। ৬ হাজার ৬৪ কিলোমিটার মাটিতে জুড়ে থাকা এই সবুজের মেলায় এলোমেলো বিলি কেটে গেছে ছোট-বড় নদীরা। নদীর পাশ ঘেঁষে সুন্দরী, গেওয়া, কেওরা, ধুন্দল, গোলপাতা আর কতশত চিন-অচিন বৃক্ষ। একটা অদ্ভুত দৃশ্য-নদীর কোল ঘেঁষা গাছগুলোর নীচের দিককার ডাল-পাতা যেন বড় যত্ন করে ইঞ্চি মেপে একসমানে কাটা; জলরেখা যথেষ্ট নিচে। কারণ খুঁজতে আবার ডাক পড়ল গাইডের। সহজ উত্তর। অথচ মাথায় আসেনি। কারণ-ফ্ল্যাটবন্দি নগরবাসী জীবনে জোয়ার-ভাটার হিসেব কেবল স্কুলের পাঠ্য বইয়ের পাতায় বন্দি। এখানে যেন চাক্ষুষ উদাহরণ_জোয়ারে পানি বেড়ে জলসীমা কুলছাপিয়ে গাছ ছোয়। আর ভাটায় কুলের মাটিরও অন্তত তিন-চার হাত নীচ দিয়ে বয়ে যায় শান্ত নদী। জোয়ারে বাড়া পানির কারণেই গাছের পাতা-ডাল ওপর্যন্ত জন্মায় না। কখনও-সখনও জন্মালেও জলের কারণে পচে খসে যায়। আর এজন্যই দুর থেকে দেখলে মনে হয় ঘন বনের জংলী গাছেরা এই অদ্ভত নকশায় ছাটা যেন।
সুন্দর বনের মাটিতে প্রথম নামলাম আন্ধারমানিক। তবে সন্ধ্যা হয়ে যাওয়ায় বনে ঢোকা হল না। লঞ্চ নোঙড় করল পাড় ছেড়ে বেশ খানিকটা দুরে। আমরা কজন ট্রলারে চেপে রেঞ্জ অফিসে এলাম। কেননা এখান থেকে আমাদের সঙ্গে বনরক্ষি উঠবেন। এখানে মজার একটা কেলা আছে। বসতি নেই বলে এভানকার মাপিরও আলাদা নাম-পরিচয় নেই। যেখানে রেঞ্জ বা বন বিভাগের কোনও প্রকল্প আছে সেখানকার মাটির একটা নাম দেয়া আছে। আর তা রাখা হয়েছে নদীর নামে। আন্ধারমানিক নদীর কুল ঘেষা পারের নাম আন্ধার মানিক। সুমতি রেঞ্জের সঙ্গী সুমতি নদী। চাঁদপাই রেঞ্জের পাড়ের নাম চাদপাই গ্রাম। পরদিন ভোরের দেখা পেলাম কচিখালি নদীর। আর ডাঙ্গার নাম খাতা-কলমে শরনখোলা রেঞ্জ। তবে পরিচিতি কচিখালি অভয়ারন্য নামে। এটুকুতে আবার রেঞ্জ অফিসের বাংলোর পাশে অভয়ারণ্য বানানো হয়েছে। তবে আমরা সেখানে কোনও নির্ভয় প্রানীর দেখা না পেলেও পরিচয় হল নানা রঙা বহু জাতের ছত্রাকের সঙ্গে। সহজ কথায় ব্যাঙের ছাতার কত শত রং আর রুপ হতে পারে তা বোধকরি এখানে এলে দেখা মেলে। পুরাতন রেঞ্চ অফিসের পথে, কাঠের ব্রীজে, নারকেল বনে কোথায় নেই। আর আছে হরগজার ঘনবন। গুল্মজাতীয় গাছ। তবে যে কোনও অর্কিডের চেয়ে কম রুপসী নয় সে। খাবার পানির জোগান দিতে যে পুকুর আর নালা আছে তার সবই শাদা শাপলায় ঢাকা। তারপর নামলাম ডেমের চর। নামটা অদ্ভুত। এই চর ওপর থেকে দেখতে ঠিক ডিমের মতো বলেই এমনটা নাম হয়েছে। চর বোঝাই কাকড়ার ঘরবসতি। আর আছে অচিন কিছু জংলী ফুলের লতাবাহার।

নীলগিরির টানে

নীলগিরির টানে
আহমেদ রিয়াজ

দূর থেকে চিম্বুকের পাহাড় দেখা যাচ্ছে। দূর থেকে দেখা যাচ্ছে চিম্বুকের টাওয়ার। কিছুক্ষণ পর আর দেখা গেল না। মেঘ গিলে ফেলেছে টাওয়ারসমেত পুরো চিম্বুক পাহাড়। যদিও আমাদের গনতব্য চিম্বুক নয়। আমাদের গনতব্য চিম্বুক থেকে আরো ২৫ কিলোমিটার দক্ষিণে কাপ্রুপাড়া। ওয়াইজংশন পেরিয়ে এসেছি বেশিক্ষণ হয়নি। বান্দরবান থেকে চিম্বুকের পথে একটা রাসতা দুভাগ হয়ে গিয়েছে। রাসতাটা দেখতে ইংরেজি ওয়াই-এর মতো বলে এর নাম ওয়াইজংশন। বাম দিকের রাসতা চলে গেছে রুমার দিকে। আর ডানদিকেরটা চিম্বুক ও থানছির পথে। ওয়াইজংশনে রয়েছে একটি আর্মি ক্যাম্প। রাসতা থেকে খানিকটা উঁচুতে ক্যাম্প। আমরা ক্যাম্পে গেলাম। ক্যাম্পের কমান্ডার আমাদের স্বাগত জানালেন। সঙ্গে ছিল আপ্যায়নের ব্যবস্থা। আমরা বলতে আমরা চার বন্ধু_ শামীম মাহমুদ রানা, সাইফুর রহমান মনু, মেজর দানিয়েল ও আহমেদ রিয়াজ।
আর্মি ক্যাম্পে থাকতে থাকতেই হুড়মুড়িয়ে বৃষ্টি নামল। পাহাড়ের বৃষ্টি নাকি এমন হুড়মুড়িয়ে নামে। এই আছে এই নেই। বৃষ্টি থামার পর আবার জিপে করে চিম্বুকের পথে। চিম্বুক থেকে আট কিলোমিটার আগে থাকতেই দেখা গেল মেঘের চাদরে হাওয়া হয়ে গিয়েছে চিম্বুক। এবার ওই মেঘকে ধাওয়া করবো আমরা। আঁকাবাঁকা পাহাড়ী পথে একটু জোরেই ছোটানো হলো গাড়ি। শহুরে জীবনে মেঘের ধাওয়া খাননি এমন মানুষ খুব কমই আছেন। এবার মেঘকেই ধাওয়া দেয়ার ইচ্ছেটা তাড়িয়ে বেড়াচ্ছে। কিন্তু বাতাসের যে গতি, মনে হচ্ছে চিম্বুকের মেঘ ধরা যাবে না। আসলেই ধরা গেল না। চিম্বুক পেরোনোর ঠিক সামান্য আগে পশ্চিম থেকে পূর্ব দিকে সরে গেছে মেঘ। পাহাড়ী পিচের রাসতায় যেতে যেতে একটা আফসোস থেকে গেল_মেঘের ভিতর দিয়ে যাওয়া হলো না। খানিক পর দেখা গেল ওই রাসতার ওপর এক খণ্ড মেঘ জমে আছে। মেঘখণ্ডটি এই এত্তটুকুন। রাসতার ওপর মেঘখণ্ড দেখেই সবাই খুশি।
কাপ্রুপাড়ার পথে ডানে বামে তাকিয়ে দেখা গেল আরো অনেক মেঘ ভেসে বেড়াচ্ছে পাহাড়গুলোর উপর দিয়ে। পাহাড়ী রাসতা যেমন হয়, কখনো উঁচু কখনো নিচু, কখনো ডানে ঘোরানো, কখনো বামে ঘোরানো। মেঘ দেখতে দেখতে পাহাড়ী রাসতা ধরে কাপ্রুপাড়া পেঁৗছাতে বেশিক্ষণ লাগল না। কাপ্রুপাড়ার নীলগিরি পাহাড়। জিপে করে নীলগিরিতে ওঠা হলো। তারপর জিপ থেকে নেমে চারপাশে তাকাতেই একটা অন্যরকম শিহরণ। আশপাশের সবচয়ে উঁচু পাহাড়ের উপর আমরা। চারপাশের পাহাড়গুলো কত নিচে! ওই তো মেঘেদের উড়ে যেতে দেখা যাচ্ছে। প্রায় মেঘের সতরের কাছাকাছি তখন আমরা। কিছু পাহাড় কালো, কিছু পাহাড় ঝলমলে। আবার কিছু পাহাড় মনে হচ্ছে কুয়াশায় ঢাকা। পাহাড়ের কত্তরূপ দেখা গেল নীলগিরি থেকে। কিন্তু পাহাড়ের এত রূপ কেন? বন্ধু বান্দরবান এসেছে আটমাস। এখানকার সবকিছু জানে। পাহাড়ের রূপের কথা জানতে চাওয়ার আগেই মনে হয় বুঝতে পেরেছে আমাদের প্রশ্ন। বলল, কালো পাহাড়গুলোর উপর কালো মেঘ আছে। উপর নিচে তাকিয়ে দেখলাম ঠিকই তো!
ঝলমলে পাহাড়ের উপর কোনো মেঘ নেই। আর কুয়াশার মতো যেসেব পাহাড়, সেগুলোতে এখন বৃষ্টি হচ্ছে।
নীলগিরিতে ঝলমলে রোদ শুরু হতে বেশি সময় লাগেনি। আমরা যখন আসি তখন কালো মেঘে ঢাকা ছিল নীলগিরির আকাশ। নীলগিরিতে দুটো কটেজ। কটেজদুটোর নামও চমৎকার। মেঘদূত আর আকাশলীনা। আমরা থাকবো আকাশলীনায়। আকাশলীনা হচ্ছে নীলগিরির পূর্ব দিকে আর মেঘদূত পশ্চিমে।
নীলগিরিতে আসার আগেই শুনেছিলাম এখানে মোবাইলের নেটওয়ার্ক পাওয়া যায়। বান্দরবানে মোবাইলের কোনো নেটওয়ার্ক নেই। এক ওয়াইজংশনে কিছুটা নেটওয়ার্ক পাওয়া গিয়েছিল। তবে কথা বার্তা স্পষ্ট শোনা যায়নি। কেমন ভাঙা ভাঙা ছিল। নীলগিরিতে নাকি পুরো নেটওয়ার্ক পাওয়া যায়। পকেট থেকে মোবাইল বের করে দেখলাম। কথাটা পুরোপুরি মিথ্যে মনে হলো। কারণ নেটওয়ার্কের কোনো ছিঁটেফোটাও দেখা গেল না। কথাটা জানাতেই দানিয়েল বলল, নীলগিরির সবজায়গায় তো নেটওয়ার্ক নেই। নেটওয়ার্ক আছে কেবল ওখানে।
ওখানে বলতে যে জায়গাটা দেখানো হলো সেটা হচ্ছে আকাশলীনার পশ্চিমপাশের মাঝখানের দেয়াল। ওখানেই গিয়ে দেখা গেল আসলেই সত্যি। মোবাইল সেটের নেটওয়ার্ক রেখাটা পুরো জায়গা দখল করে আছে। ওখান থেকে দুপা সামনে পিছনে বা ডানে বামে সরলেও নেটওয়ার্ক হাওয়া। রহস্যময় নেটওয়ার্কের জায়গায় দাঁড়িয়ে মোবাইলাপ সারলাম আমরা একে একে। ঢাকা ছেড়েছি দুদিন হয়। বান্দরবানে ঢোকার পর থেকে যোগাযোগ নেই কারো সঙ্গে। এবার ভালো মতো যোগাযোগ হলো।
একটু পরেই সূর্য ডুবে যাবে। সূর্যের ঠিক নিচে কিছু জায়গা চিক চিক করছে। মনে হচ্ছে ওখানে কোনো জলরাশি। কিন্তু সাঙ্গু নদীতো নীলগিরির পূর্ব দিক দিয়ে গিয়েছে। তাহলে?
একবার মনে হলো সাদা মেঘে উপর সূর্যের আলো পড়ে এমন চিক চিক করছে। এটাই ভেবে নিয়েছি। কিন্তু যতই হেলছে ততই একটা জলরাশির রেখা ফুটে উঠতে লাগল। এবং জানা গেল আসলে ওটা মেঘের উপর সূর্যের আলো প্রতিফলন নয়। ওটাই বঙ্গোপসাগর। এত দূর থেকেও দেখা যায় সাগর! দেখা তো যাবেই। সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে আড়াইহাজার ফুট উঁচু নীলগিরি। আর আমরা তখন নীলগিরির একেবারে উপরে_আকাশলীনার সামনে। নীলগিরির যেখানেই শেষ বিকেলের আলো পড়ছে, সেটাই সোনালি হয়ে গেল। ধীরে ধীরে সোনালি রঙ ফ্যাকাশে হয়ে গেল। একসময় অসত গেল সূর্য। নীলগিরি থেকে সূর্যাসত_অপূর্ব। সূর্য ডোবার অনেকক্ষণ পরেও আকাশের বেশ অনেক জায়গা রক্তিম আভা ছড়িয়ে রাখল।
সন্ধের পর রাত নামল ঝুপ করে। যতই অন্ধকার হতে লাগল, ততই আকাশে ফুটতে শুরু করল তারার ফুল। রাতের খাবারের ব্যবস্থা মুরগির বারবিকিউ আর পরোটা। বান্দরবান থেকেই দুটো মুরগি আনা হয়েছিল মশলা মাখিয়ে। সঙ্গে কয়লাও আনা হয়েছে।
রাতের খাবারের পর নীলগিরির উপর চেয়ার পেতে বসলাম সবাই। রাত বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে অন্ধকারও বাড়তে লাগল সেই সঙ্গে। সে রাতে আকাশে চাঁদ ছিল না। অমাবস্যার রাত। আকাশে তারারা যেন ঘেঁষাঘেষি করে আছে। এত তারা! ঢাকার আকাশে এত তারা দেখা যায় না। দেখা যায় না সাগর পাড়ের আকাশেও। আকাশের সঙ্গে নীলগিরির দূরত্ব সমতল থেকে আড়াইহাজার ফুট কম বলেই হয়ত এত তারা চোখে পড়েছে। খানিকপর একটা দুটো করে তারা উড়তে শুরু করল আমাদের চারপাশে। কিছু তারা যেমন মিট মিট করে জ্বলে, ঠিক তেমনি মিটমিট করে এই তারারা উড়তে লাগল আমাদের চারপাশে। আসলে এগুলো কিন্তু তারা নয়, এগুলো জোনাক পোকা। মনে হচ্ছে আকাশে যেসব তারা ঠাই পায়নি, সেগুলোই জোনাক পোকা হয়ে উড়ছে নীলগিরির উপর। আবার কখনো এত তারা দেখে মনে হয়েছে তারার সিঁড়ি বেয়ে হয়ত আমরা চলে যেতে পারবো তারার দেশে। নীলগিরির অপার সৌন্দর্য এতটাই কল্পনার জন্ম দিয়েছে।
এরমধ্যেই আমাদের বেশ ঠাণ্ডা লাগতে শুরু করেছে। ভাবছি কটেজের ভিতরে চলে যাবো। কিন্তু কটেজের ভিতরে গেলে তো নীলগিরির রাতের সৌন্দর্য দেখা হবে না। উপায়? চারজনের জন্য চারটা উইন্টার জ্যাকেটের ব্যবস্থা করা হলো। উইন্টার জ্যাকেট পরে আমরা বসে রইলাম আকাশের কাছাকাছি। আকাশ দেখতে লাগলাম। আকাশকে এতটা আপন আর কখনো মনে হয়নি। পূর্ণিমা থাকলে না জানি কেমন লাগত! আশপাশের পাহাড়ের সৌন্দর্য ধরা পড়ত অন্যরূপে।
মধ্যরাত পেরিয়ে গেছে অনেকআগেই। আগামীকাল বাংলাদেশ ভারতের প্রথম একদিনের ম্যাচ। বিশ্বকাপের পর ভারতের প্রথম বাংলাদেশ সফর। খেলা দেখতে হবে। তাই সকাল সকাল উঠতে হবে। কাজেই ঘুমতে চলে গেলাম সবাই।
নীলগিরিতে বিদু্যৎ নেই। প্রতিদিন দুঘণ্টা করে জেনারেটর ছাড়া হয়। আর জেনারেটর বন্ধ হয়ে গেলে সৌর বিদু্যতে বাতি জ্বলে। বাথরুম আর শোবার ঘরে সৌরবাতি জ্বলে।
অনেক রাতে ঘুমনোর জন্য ভোরে উঠতে পারিনি। সূর্য তখন বেশ তেতে উঠেছে। গরম পড়তে শুরু করেছে। কে বলবে গতরাতে লেপ গায়ে জড়িয়ে ঘুমতে হয়েছে!
সকালের নাসতা খেতে খেতেই বাংলাদেশের খেলা শুরু হয়ে গেল। নাসতা খেয়ে আমরা এবার গেলাম কাপ্রুপাড়ায়। এখানে মুরংদের বাস। উদ্দেশ্য মুরংদের গ্রাম দেখা আর ওদের পানির উৎস দেখা। মূল রাসতা থেকে প্রায় ৬০০ ফুট নিচ থেকে পানি নেয় মুরংরা। পাহাড়ী হাঁটা পথে নামতে সময় লেগেছে আধাঘণ্টার মতো। কিন্তু পানির উৎস দেখে মনটা দমে গেল। ছোট্ট একটু জায়গা। পাহাড়ী পাথর চুয়ে চুয়ে পানি এসে জমা হয় ওখানে। এই পানিই মুরংরা নিত্যকাজে ব্যবহার করে, পান করে। আমাদের সঙ্গে ছিলেন মুরং নেতা লঙ্কান। লঙ্কানের কাছেই জানা গেল তারা স্নান সারেন দুতিন দিন পর পর। আর পান করার জন্য যেটকুই পানিই দরকার, তা-ও এই উৎস থেকে নিতে হয়। এটিকে ওরা বলে ছড়া।
নিচে নেমে হাঁপিয়ে উঠেছি সবাই। হাঁপাননি কেবল লঙ্কান আর আমাদের সঙ্গে আসা সেনাবাহিনীর সদস্যরা। ওদের অভ্যাস আছে। পানির ছড়া দেখার পর এবার ওঠার পালা। লঙ্কান তর তর করে উঠে যাচ্ছেন। সেনাবাহিনীর সদস্যরাও উঠে যাচ্ছেন। আমরাও ওদের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে উঠতে গিয়ে বুঝতে পারলাম, নামাটা যত সহজ ছিল, ওঠা অতোটা সহজ হবে না।
সত্যি অতো সহজ হয়নি উপরে ওঠা। পাঁচ মিনিট উপরে উঠে দশ মিনিট জিরিয়ে নেই। যতই উপরে উঠতে থাকি ততই বুক ধড়ফড় করতে থাকে। উপরে তাকিয়ে দেখার চেষ্টা করি, আর কতখানি উঠতে হবে। একসময় মনে হয়, কখনো বুঝি উপরে উঠতেই পারবো না। উপরে উঠার কষ্টটা সেদিন দমে দমে বুঝেছি।
এর মধ্যেই কাপ্রুপাড়ার আকাশে কালো মেঘ জমেছে। লঙ্কান আকাশের দক্ষিণ দিকে তাকায় আর আমাদের দিকে তাকায়। একসময় আমাদের দিকে তাকানো বন্ধ করে এক দৌড়ে চলে যায় উপরে। উপরে উঠতে আরেকটু বাকি। এর মধ্যেই ঝম ঝম করে বৃষ্টি শুরু হলো। বৃষ্টি মাথায় নিয়েই উঠে বসলাম জিপে। মুরংদের পাড়ায় আর যাওয়া হলো না।
আবার নীরগিরিতে। টিভি ছেড়ে বাংলাদেশের ব্যাটিং দেখা। বাংলাদেশ যে টার্গেট দিয়েছে তাতে সবাই সন্তুষ্ট। গোসল সেরে দুপুরের খাবার সারা হলো। এবার ফেরার পালা। নীলগিরির কটেজ বুকিং দেয়া ছিল এক রাতের জন্য। সন্ধের আগেই ফিরতে হবে বান্দরবান। সন্ধের পর পাহাড়ী পথে যে কোনো যানবাহন চলাচল নিষিদ্ধ। বান্দরবান পৌঁছতে সময় লাগবে দুই-আড়াই ঘণ্টা। ভারতের ব্যাটিং দেখতে দেখতেই চলল ফেরার প্রস্তুতি। এর মধ্যেই চোখ বুলিয়ে নিলাম একটা বাঁধানো বইয়ের দিকে। আমার কৌতূহল কেড়ে নিয়েছে বইটি। পরিদর্শন বই। যারা নীলগিরি ঘুরতে আসেন তারা এই পরিদর্শন বইতে নিজেদের অভিজ্ঞতা আর স্মৃতিকথা লিখতে পারেন। পরিদর্শন বই ঘাটতে ঘাটতে কিছু চমৎকার মনতব্য পড়লাম। যেমন চট্টগ্রামের শুকরিয়া জসিম লিখেছেন_গতরাতটি ছিল চাঁদনি রাত। এখানে এসে চাঁদনিরাত পাওয়াও ভাগ্যের ব্যাপার। আমার কল্পনাকে ছাড়িয়ে গেছে নীলগিরির সৌন্দর্য। অপূর্ব, অভিভূত, বিমোহিত আমার স্মৃতিতে ভেসে বেড়াবে এর অপার সৌন্দর্যের মহিমা।
ক্যাপ্টেন মোহাম্মদ মোহসেনুল হক চৌরুরী লিখেছেন_জীবনের খুব ছোট্ট ছোট্ট সখের একটি ছিল মুক্তাকে নিয়ে নীলগিরি দেখার। অনেক বাধা পেরিয়ে, কষ্ট করে, কষ্ট সহ্য করে নীলগিরি এসে আমি মুগ্ধ।
মেজর এফ এম জসিমউদ্দিন তার অনুভূতি জানিয়েছেন এভাবে_ বান্দরবান এসেছিলাম রিক্রটমেন্টে। পরপর ২দিন সরকারি ছুটি হওয়াতে সপরিবারে চলে এলাম কাপ্রুপাড়া নীলগিরি হিল রিসোর্টে। যদিও এর সঙ্গে জড়িত ছিলাম নির্মাণের শুরুতেই। প্রাকৃতিক এই সৌন্দর্য দেখে মনে হলো এখানে না এলে পৃথিবীর অনেক কিছু থেকেই বঞ্চিত হতাম।
মেজর এস এম মনিরুজ্জামন লিখেছেন_ নীলগিরিতে পা দেবার কিছুক্ষণের মধ্যেই আমার স্ত্রীর প্রশ্ন হলো-এ রকম পাহাড় কি কিনতে পাওয়া যায়? একটা মেঘদূত তৈরি করে সারাজীবন সেখানে কাটিয়ে দেবার পরিকল্পনা এঁটে ফেলল সে। পাহাড় কেনার দুঃসাহসিক চিনতা না করলেও আমার কাছেও মনে হচ্ছিল সারাজীবন এমন জায়গায় কাটিয়ে দেবার পরিকল্পনা নেহাৎ মন্দ না…
ক্যাপ্টেন এনামের বন্ধু হিসেবে নীলগিরিতে এসেছিলেন ডাক্তার মিজানুর রহমান কলেস্নাল। মার্চের ৩০ তারিখে লেখা তার মনতব্য_ একদিন বড় সাধ ছিল আমার আকাশ ছুঁয়ে দেখার। স্বপ্নেও ভাবিনি নীলগিরি এসে আমি সেই আকাশ ছুঁতে পারব। একজীবনে মানুষের সবকিছু দেখা শেষ হয় না। তবু মনে হলো আমার আর অন্যজীবনের প্রয়োজন নেই। এখানে এসে আমি এই জীবনের সবকিছু দেখেছি।
আর বিয়ের পর নীলগিরিতে হানিমুনে এসেছিলেন যুক্তরাজ্য প্রবাসী কামরুল হাসান টিটু ও রোকসানা খান লোপা। নীলগিরির সৌন্দর্যে তারাও মুগ্ধ। বাংলাদেশেই এমন একটি চমৎকার জায়গা আছে, এখানে না এলে তাদের জানাই হতো না।
ডাঃ সামিয়া ছড়া নীলগিরির সৌন্দর্যে মুগ্ধ হয়ে পরিচিত সবাইকে নাকি আহ্বান জানাবেন এর সৌন্দর্য উপভোগ করার জন্য।
নীলগিরি থেকে ফেরার ঠিক আগে চারপাশে ভালোমতো আরেকবার চোখ বোলাতে ইচ্ছে হলো। কালো মেঘ হানা দিয়েছে নীলগিরিতে। যে কোনো সময় আবার বৃষ্টি শুরু হয়ে যেতে পারে। এদিকে আবার সন্ধের আগেই ফিরতে হবে বান্দরবান। জিপে চড়ে বসলাম সবাই। নীলগিরি বেয়ে জিপটা যখন পাহাড়ের অনেক নিচে নেমে এল, তাকালাম। কত উঁচু নীলগিরি। ওই তো অনেক দূরে দেখা যাচ্ছে কটেজ। অবাক হলাম ওই পাহাড়ের উপর ছিলাম আমরা! ভাবতেই অবাক লাগল।
সাগর নাকি মানুষকে টানে। তাই প্রতি বছর বেশিরভাগ মানুষ সাগরপাড়ে চলে যান সাগরের টানে। একবার গেলে বারবার যেতে চান। কেবল সাগর নয়, পাহাড়ও মানুষকে টানতে পারে। পাহাড়রাজ্য থেকে ঘুরে এলেই বুঝতে পারা যায়, পাহাড়ও মানুষকে কেমন করে টানে। নীলগিরি যে কাউকে টানবে। শুধু যে নীলগিরি নয়, আপনি যদি সৌন্দর্য পিপাসু মানুষ হয়ে থাকেন তাহলে বাংলার বর্ষার রূপে অবগাহনের জন্য যে কোনো পাহাড় আপনাকে টানবে। বান্দরবানের পাহাড় হলে তো কথাই নেই। আর যদি হয় নীলগিরি, তাহলে…
পাহাড়ের সৌন্দর্য অন্যরকম। কোনো পাহাড় উঁচু, কোনো পাহাড় নিচু। তবে পাহাড়ে ঘুরতে যাওয়ার উপযুক্ত সময় এই বর্ষাকাল। বর্ষায় পাহাড় সে অপার রূপ মেলে ধরে, আর কোনো ঋতুতে পাহাড়ের এই রূপ এতটা প্রস্ফুটিত হয়না। মেঘের সঙ্গে, বৃষ্টির সঙ্গে মিতালি পাতিয়ে চলে পাহাড়ের রূপের ডালি খেলা। বান্দরবানের পাহাড়ে যাওয়ার ঝক্কি ঝামেলা খুব একটা নেই। ঢাকা থেকে বান্দরবান যাওয়ার সরাসরি বাস আছে। সৌদিয়া সমপ্রতি এসি বাস সার্ভিস চালু করেছে। এস আলমের বাস তো আছেই। তবে একটু মজা করে যেতে চাইলে ট্রেনে চট্টগ্রাম, ওখান থেকে বান্দরবানের বাস অহরহ। কেবল রাত ছাড়া।
থাকার মতো পর্যটনের রেস্টহাউজ আছে বান্দরবান শহরের দুতিন কিলোমিটার আগেই। বান্দরবান শহরেও আছে থাকার মতো জায়গা। তবে পাহাড়ের কোলে মাথা রেখে বৃষ্টি ও বর্ষার মেঘ দেখার জন্য দারুণ জায়গা মিলনছড়ির হিলসাইড রিসোর্ট। চিম্বুকের পথে বান্দরবান শহর থেকে চার কিলোমিটার দূরে মিলনছড়িতে রয়েছে এই রিসোর্ট। এখানে থাকার জন্য রয়েছে বাঁশের তৈরি ঘর। আর রিসোর্টের যে রেসতোরা সেখান থেকে উত্তরদিকে তাকালে দেখা যাবে কেবল পাহাড় আর পাহাড়। পশ্চিমে তাকালে দেখা যাবে টাইগার হিল। নীলগিরি যাওয়ার সৌভাগ্য যাদের হয়না, তারা টাইগির হিলে গিয়ে দুধের স্বাদ ঘোলে মেটাতে পারেন। বান্দরবানে ঘুরতে হলে জিপের কোনো বিকল্প নেই। এছাড়া স্থানীয়রা চলাচল করে চান্দের গাড়িতে। চান্দের গাড়িতে চলাচলে অনেক সময় অপচয় হয়। আট-দশজন মিলে গেলে হিলসাইড রিসোর্ট থেকেই প্রতিদিনের জন্য জিপ ভাড়া নিলেই লাভ। খরচ একটু বেশি পড়লেও, পাহাড়ের সৌন্দর্য বাড়তি খরচ পুষিয়ে দেবে। জিপে করে দুদিন ঘুরলেই দেখা হয়ে যাবে বান্দরবানের পাহাড়ের সৌন্দর্য।
বান্দরবানে ঘোরার মতো অনেক জায়গা আছে। জায়গাগুলোর নামই আপনাকে টানবে। চিম্বুক, বেতছড়া, রাইক্ষংছড়া, মিলনছড়া, টংকাবতী, থানছি, রুমা, মেঘলা, শৈলপ্রপাত, কাপ্রুপাড়া…
আর আছে সাঙ্গু নদী। পুরো বান্দরবানে পাহাড়ের ভিতর দিয়ে পথ করে এঁকেবেকে চলেছে এই পাহাড়ী নদী। বান্দরবান শহরে দেখা পাবেন সাঙ্গু নদীর। তারপর ঘুরতে গেলেন বান্দরবান শহরে থেকে ৫০ কিলোমিটার দূরে কাপ্রুপাড়ায়, সেখানেও দেখা পাবেন এই পাহাড়ী নদীর। পাহাড়ী নদীর পাড় ঘেঁষে হাঁটার অনুভূতি অন্যরকম। এর সঙ্গে মেলানো যায় না আর দশটা সমতলের নদীর সঙ্গে। বৃষ্টির সময় পাহাড় থেকে নেমে আসা পানি প্রবাহ ঝরণার মতো ঝরে পড়ার দৃশ্য দেখা যায় শৈলপ্রপাতে। বমদের গ্রামে গিয়ে তাদের জীবনযাত্রাও দেখা যাবে শৈলপ্রপাতের ফারুক পাড়ায়। আদিবাসী ত্রিপুরাদের জীবনযাত্রার দেখা মিলবে হাতিয়াবান্ধায়। বান্দরবান শহরের আশপাশের এই দর্শনীয় জায়গাগুলো দেখার পর একটু দূর থেকে বেড়িয়ে আসা যায়। চিম্বুক। নামটাই যেন টানে। চিম্বুকে দেখা পাওয়া যাবে মুরংদের জীবনযাত্রা। জানা যাবে মুরংদের অনেক ইতিহাস আর ঐতিহ্য সম্পর্কে। চিম্বুক থেকে এরপর থানছি। আর রুমা যেতে হলে ফিরে আসতে হবে সেই ওয়াইজংশনে। এবার বামদিকের রাসতা ধরে রুমা। রুমা থেকে নৌকায় আবার ফিরে আসা যায় বান্দরবান শহরে। পথে দেখতে দেখতে আসা যায় পাহাড়ী নদীর সৌন্দর্য। পাহাড় আর জলরাশির এমন সৌন্দর্য বান্দরবান ছাড়া আর কোথায়? বান্দরবানে মশা থেকে সাবধান থাকতে হয় সব সময়। অডোভাস নামক ক্রিম মেখে নিলে ভালো। আর কামড়ানোর জন্য মশা যেহেতু পা বেছে নেয় তাই পায়ে সবসময় মোটা মোজা পরে থাকতে হয়। কোনোভাবেই মশা বসতে দেয়া যাবে না গায়ে। কারণ বান্দরবানে মশার কামড় খেলে ম্যালেরিয়া হওয়ার একটা ভয় থেকেই যায়। এমন কী নীলগিরির মতো অতি উঁচু পাহাড়েও মশা কামড়ে দিতে পারে। বেশি সাবধান থাকতে হয় সূর্যোদয় আর সূর্যাসতের সময়।
বান্দরবানে এখন আর শানতিবাহিনীর ভয় নেই। শানতি চুক্তির কারণে বেশ শানত হয়ে গিয়েছে বান্দরবান। তবু বান্দরবানে ঢোকার আগে কয়েকটা চেকপোস্ট ডিঙোতে হয়। এটা নিরাপত্তার জন্যই। কারণ নিরাপত্তাহীনতায় পরিপূর্ণ সৌন্দর্য উপভোগ করা যায় না। ভয়শূন্যই চিত্তই পারে যে কাউকে সৌন্দর্যের পুরো রসাস্বাদন করাতে।

ছবির ক্যাপশন
১. নীলগিরির পথে আমরা চারজন (বাঁ থেকে)_ রানা, দানিয়েল, আহমেদ রিয়াজ, সাইফুল।
২. আকাশে মেঘের ঘনঘটা, ঢেকে আছে চিম্বুক।
৩. বান্দরবানে এমন আলোছায়ার খেলা দেখা যায়
৪. পাহাড়ে জুম চাষ
৫. নীলগিরির পথে, দূরের ওই পাহাড়টাই নীলগিরি
৬. নীলগিরির উপরে আকাশলীনার বারান্দায়
৭. নীলগিরির দুটো গেস্টহাউস_ আকাশলীনা ও মেঘদূত
৮. অপরূপ সাঙ্গু নদী
৯. দানিয়েলের ক্যামেরায় আমরা তিন বন্ধু
১০. অবাক হয়ে তাকিয়ে থাকা- মেঘ না কুয়াশা!
১১. জুমচাষে ব্যসত্দ মুরংরা
১২. জুমচাষ
১৩. জুমচাষ
১৪. বিকেলের সোনারোদের আলোয় নীলগিরিতে
১৫. বিকেলের সোনারোদের আলোয় নীলগিরিতে-২
১৬. রাতে বারবিকিউ’র আয়োজন
১৭. মে মাসের প্রচণ্ড গরমেও নীলগিরিতে রাতে বেশ ঠাণ্ডা
১৮. নীলগিরি থেকে এমনই দেখা যায় আশপাশ
১৯. কাপ্রম্নপাড়ায় মুরংদের পানির উৎস দেখতে যাওয়ার সময়
২০. শৈলপ্রপাতের ঝর্ণা

ঠিকানা :
১. আহমেদ রিয়াজ
বাসা-২৯, রোড-২৫
পঞ্চম তলা (পশ্চিম পাশ)
রূপনগর আবাসিক এলাকা
পলস্নবী, মিরপুর, ঢাকা-১২১৬

২. আহমেদ রিয়াজ
সাব-এডিটর, দৈনিক নয়াদিগনত্দ
১৬৭/২-ই, ইনার সাকর্ুলার রোড ইডেন কমপেস্নঙ্
মতিঝিল, ঢাকা-১০০০
মোবাইল : ০১৬ ৭০১৯৯০৮০

অদেখা এক বনের পথে

অদেখা এক বনের পথে
মোকারম হোসেন

কোথাও বেড়াতে যাবার নিমন্ত্রণ উপেক্ষা করা কঠিন। কিন্তু আয়োজক সংস্থার কর্ণধার মশহুরুল আমিন মিলনের ভ্রমণ প্রস্তুতি ব্রীফ শুনে অনেকেই ভয়ে কেটেপড়ার কথা ভাবছিলেন। কারণ পাবলাখালী অভয়ারণ্যে নাকি হাতির উৎপাত আছে। সবশেষে তিনি আসল কথাটা পাড়লেন। সেই বনের ভেতর নাকি একটা রাতও কাটাতে হবে সবাইকে। আ্যডভেঞ্চার ট্যুর বলে কথা। সবার সঙ্গে আমিও সাহস সঞ্চয় করে বসে থাকলাম। শেষমেষ যাবার সিদ্ধান্ত হলো। রাঙামাটি জেলার মাইনি উপজেলায় অবস্থিত দেশের দ্বিতীয় বৃহত্তম অভয়ারণ্যে নতুন বছরের প্রথম সূর্য দেখতে যাব আমরা। ৩০ ডিসেম্বর রাতে গাড়িতে উঠতে গিয়ে দেখি এলাহি কান্ড। ১৩০ জনের একটা দল। নানান পথ, নানান মতের মানুষ। একদল সংবাদকর্মীও আছেন। চারচারটে গাড়ি দাঁড়িয়ে। সমস্ত কিছুই গোছাল। নওরোজ ইমতিয়াজ, মুসা ইব্রাহিম আর মশহুরুল আমিন মিলনকে ছুটোছুটি করতে দেখা গেল। আমার আগেই কথাশিল্পী ও নিসর্গী বিপ্রদাশ বড়ুয়া চলে এসেছেন। ১১টা ৪০ মিনিটে রাতের নিস্তব্ধতা ভেঙে রাঙামাটির উদ্দেশ্যে আমাদের যাত্রা শুরু হলো।
রাতভর কুয়াশার লুকোচুরি। পথের ওপরই যেন তাদের ঘরবাড়ি। আমাদের গাড়ি হঠাৎ করেই সেসব ঘরের ভেতর ঢুকে পড়ছে। তারপর আবার মুক্ত পথে। এভাবেই মধ্যরাত গড়িয়ে এলো। কুয়াশার চাদর যেন আদরমেখে আছে চারপাশে। কি মনে করে হঠাৎ থামল গাড়িটা। নষ্টটষ্ট হলো নাতো! বাইরে উঁকি দিয়ে বুঝলাম এখন চা বিরতি। অন্য গাড়িগুলোও এসে দাঁড়াচ্ছে। এটাও একটা চমক। জানতাম একছুটে একেবারেই চট্টগ্রাম। সবাই ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র দলে বিভক্ত হয়ে চা-গল্পে মেতে উঠল। অবশ্য বেশিক্ষণ এই গল্প চলল না, হ্যামিলনের বাঁশিঅলার (বাস) দিকে ছুটতে হলো।

পরিবেশ-প্রকৃতির নানান প্রসঙ্গে আমাদের নির্ঘুম রাত কাটল। ভোরের আলো ফোটার আগেই আমাদের গাড়ি চট্টগ্রাম শহর অতিক্রম করল। কুয়াশামোড়ানো ভোরে রাঙামাটি শহরের হোটেল সুফিয়াতে গাড়ি থামল। হোটেলে ঢুকে দেখি সবকিছু প্রথম গাড়ির বন্ধুদের দখলে। বাথরুমের সামনে দীর্ঘ লাইন। যেন টিকিট কেটে সবাই গাড়িতে ওঠার জন্য অপেক্ষা করছে। এটাই বাস্তবতা। সবার জন্যতো আর একটা একটা বাথরুম থাকবে না। বিপ্রদাশ বড়ুয়া আমার আগে আগেই নাস্তার টেবিলে এসে বসলেন। নাস্তা সেরে ফিশারি ঘাটে অপেক্ষমান কেয়ারি কর্ণফুলিতে চেপে শুরু হলো আমাদের চমকপ্রদ ভ্রমণ। বার কয়েক ভ্রমণের সুবাদে দু’পাশের প্রায় সব দৃশ্য আমার মুখস্ত। এই অঞ্চলের সবছিুই বিপ্রদার নখদর্পণে। পাহাড়গুলোতে কোন কোন জাতের গাছ থাকে, কোন কোন জাতের প্রাণী থাকে। মানুষের নির্মমতায় যেসব প্রাণী ইতোমধ্যেই বিলুপ্ত হয়ে পড়েছে তাদের কথাও জানা গেল। প্রসঙ্গত তিনি হাতির গল্পও বললেন। আমরা যেখানে যাচ্ছি সেখানে প্রায়শই হাতির দেখা মিলে। এসব বন্যহাতিরা যথার্থই বিপদজনক।
লঞ্চ ছাড়ার কিছুক্ষণের মধ্যেই এই দ্বিতল জলজানে উৎসব আমেজ ছড়িয়ে পড়ল। ক্রমেই দুর্গম হয়ে উঠছে পাহাড়। কোথাও খাড়া পাহাড়, কোথাও ঘনজঙ্গল, কোথাও পাহাড়ের গায়ে সময়ের বলিরেখা স্পস্ট। শাখামৃগ বানরের দল নেমে এসেছে লেকের কিনারে। এখানে তাদের বিরক্ত করার কেউ নেই। তারপর চোখে পড়ল শীতের হতশ্রী সুবলং ঝরনা। নানান কৃত্রিম স্থাপনায় এখানকার প্রাকৃতিক সৌন্দর্য বিঘি্নত হয়েছে। তারপর সুবলং বাজার। কাছাকাছি দূরত্বে পেদা তিং তিংয়ে পেটপুরে খাবার ব্যবস্থা। এদিকের পাহাড়গুলো ন্যাড়া। এরই ফাঁকে নওরোজ ইমতিয়াজের সঞ্চলনায় শুরু হলো আলোচনা পর্ব । মুসা ইব্রাহিম জানালেন অ্যাডভেঞ্চার আর পাহাড়ে ঘোরার গল্প ও করণীয়, বিপ্রদাশ বড়ুয়া বললেন এখানকার আদি ইতিহাস, জীববৈচিত্র আর প্রাকৃতিক সৌন্দর্য নিয়ে। আমি বললাম ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতার কথা। বিশ বছরের ব্যবধানে এখানে বদলে গেছে অনেক কিছুই। কিন্তু ততক্ষণে সবার চোখ দু’পাশের অপার সৌন্দর্যের কোলে সমর্পিত। জলচর পাখিদের সঙ্গে শীতের অতিথি পাখিরাও নেমেছে। কোথাও কোথাও পাহাড় অনেক দূরে সরে যাচ্ছে। মাঝে মাঝে পণ্যবাহী ট্রলার পাশকাটিয়ে চলে যায়। কিছু কিছু টিলা বিচ্ছিন্ন, দ্বীপের মতো। এমন কয়েকটি বাজারও চোখে পড়ল। সংখ্যায় আদিবাসীরা কম। বাসস্থান হারিয়ে তারা আরো গভীর পাহাড়ে ঠাঁই নিয়েছে। কাপ্তাই বাঁধের কারণে সরু নদীর পানি ফুলেফেঁপে লেকে পরিনত হয়েছে। তাতে এখানকার জীববৈচিত্রও মারাত্দক ক্ষতির সম্মুখীন হয়েছে। পৌষের সোনারোদ, পাহাড়, অরণ্য আর নীল জলরাশির মোহ সবাইকে যেন আচ্ছন্ন করে রাখল। এদিকে দুপুর গড়িয়ে এলো। তবুও ক্লান্তিহীন চোখ।
দুপুর আড়াইটার দিকে আমরা মাইনিমুখ বাজার পেঁৗছালাম। ছোট হোটেল, দুই পর্বে সারল খাবার। তারপর পাশ্ববর্তী রাবেতার কলেজের উদ্দেশ্য লঞ্চ মুখ ঘোরালো। সেখানেই আমাদের রাত যাপনের ব্যবস্থা। নিরাপত্তা ও বিবিধ কারণে পাবলাখালীতে রাতযাপনের সিদ্ধান্ত বাতিল। এতে ৪০ ভাগ অ্যাডভেঞ্চার কমে গেল। ব্যাগ-বোচকা রেখে সবাই ছড়িয়ে পড়লেও সুতার টানে আবার ৭টার দিকে লাগোয়া হ্যালিপ্যাড চত্বরে ফিরে এলো সবাই। কেউ কেউ ছুটলেন বছরের শেষ সূর্যকে বিদায় জানাতে। সেখানে পরিচয় পর্বের পর একজন সেনাকর্মকর্তা সবাইকে প্রয়োজনীয় পরামর্শ দিলেন। কলেজের মাঠেই রাতের রান্নার আয়োজন। ওদিকে প্রথম প্রহরের প্রস্তুতি। দলে দলে ভাগ হয়ে বসল সবাই। রঙিন কাগজ, সরা আর মোমবাতির সমন্বয়। একফাঁকে রাতের খাবারটা সেরে ফেলল সবাই। তারপর মধ্যরাতের আগেই সবাই লেকের ধারে জড়ো হলাম। সবার বয়েআনা মঙ্গল প্রদীপগুলো লেকের পানিতে ভাসিয়ে দেওয়া হলো। জিরো আওয়ারে রাতের আকাশ উজ্জ্বল করে জ্বলল ফ্লেয়ার। আর তখনি সবার হর্ষধ্বনি। তারপর আকাশে উড়ল ফানুস। প্রথম প্রহরের এই অনুষ্ঠানে যোগদিতে সপরিবারে এলেন মাইনির ২৫ বেঙ্গল রেজিমেন্টের জোন কমান্ডার লে. কর্ণেল মুস্তাফিজ। প্রথম প্রহরকে বরণ করার আনুষ্ঠানিকতা চলল অনেকক্ষণ। মধ্যরাতের এমন উৎসব এখানকার মানুষ কি আর কখনো দেখেছে।
এবার ঘুমোতে যাবার পালা। তাও মাত্র দু’ঘন্টার জন্য। রাত চারটায় আবার কেয়ারি কর্ণফুলির যাত্রা। উদ্দেশ্য পাবলাখালীতে গিয়েই বছরের নতুন সূর্যকে দেখা। কিন্তু আমাদের আশা নিরাশায় পরিনত হলো। ঘনকুয়াশায় যাত্রা স্থগিত। লেকের পানিতে কনকনে শীতের ভেতর সবার কাঁপাকাঁপি অবস্থা। অবশেষে ভোর ছয়টার দিকে লঞ্চ ছাড়ল। সেনাবাহিনীর একটি দলও আমাদের সঙ্গে ইঞ্জিন নৌকা নিয়ে চলল। অসংখ্য ডুবোচরে পথ হারিয়ে পাবলাখালী পেঁৗছুতে প্রায় দু’ঘন্টা সময় লাগল। তখনো দেখা নেই সূর্যদেবের। এই অরণ্যের রেস্টহাউস ‘বনসখীতে’ সকালের নাস্তার ব্যবস্থা। কিন্তু যে রসুই ঘরে তৈরি হলো আমাদের নাস্তা সে রসুইঘর নাকি কিছুদিন আগে বন্যহাতির দল গুড়িয়ে দিয়েছিল। এমন খবর শোনার পর সবার চেহারায় ফের আতঙ্কের ছাপ। রেস্ট হাউসের অদূরে গাছের ডালে বানর দেখে সেই আতঙ্ক আরো বদ্ধমূল হলো।
এবার বনে ঘোরাঘুরির পালা। কেউ কেউ থেকে গেলেন সূর্য বানাতে। আমরা চললাম বন দেখতে। বিচিত্র পাখির ডাক শোনা যাচ্ছে। ইতোমধ্যেই অনেক গাছ চোখে পড়েছে। চুন্দুল, কনকচূড়া, পাদাউক, আদি কাঁটা মেহেদী, আদি জারুল, শীলকড়ই, চাপালিশ, কাজুবাদাম, সেগুন ইত্যাদি। তারপর কিছু গর্জন, মুচকুন্দ, গুলগুলি লতা, শিমূল, নাগেশ্বর। অগভীর বনে এত অল্পকিছু দেখে মন ভরল না। নিরাপত্তার খাতিরে বেশি নিবিড়তায়ও যাওয়া গেল না। এখান থেকে মাত্র ৮/১০ কিমি. দূরে ভারতের মিজোরাম বর্ডার।
৪২ হাজার ৮৭ হেক্টর আয়তনের এই বনে আরো আছে রেসাস বানর, মুখপোড়া হনুমান, উল্লুক, বন্য শূকর, বনবিড়াল, উদবিড়াল আর বিচিত্র পাখি। হাতি আর বানর মোটামুটি সহজলভ্য। কিছুক্ষণের মধ্যেই আমরা রেস্টহাউজে ফিরে এলাম। বন্ধুদের প্রচেষ্টায় তৈরি হলো এক ঝলমলে সূর্য। তারপর তাকে মাটির শয্যায় সাজানো হলো। এবার নতুন সূর্যের পাশে দাঁড়িয়ে ছবি তোলার পালা। সূর্য উৎসবের আনুষ্ঠানিকতা এখানেই শেষ। ওদিকে দুপুর হয়ে এসেছে। আজকেই আমরা ফিরে যাব রাঙামাটি শহরে। সেখান থেকে ঢাকার গাড়িগুলো ছাড়বে। কিন্তু দুপুরের খাবার যে তখনো বাকি। সিদ্ধান্ত ছিল এখানে খাওয়া দাওয়া হবে, তারপর লঞ্চ ছাড়বে। কিন্তু সময় স্বল্পতার কারণে তা আর হলো না। বেছে নেয়া হলো এক অভিনব পদ্ধতি। খাবারগুলো একটা ছোট্ট নৌকায় তুলে কেয়ারি কর্ণফুলীর সঙ্গে বাঁধা হলো। ছেড়ে দিল লঞ্চ। পেছনে কাসালং, মাইনি আর কর্ণফুলী। আমাদের বিদায় জানাতে এসেছে গ্রামের শিশুরা। লঞ্চ ছেড়ে দেবার কিছুক্ষণের মধ্যেই খাদ্যতরী থেকে খাবার পরিবেশন শুরু হলো। সবাই সিটে বসেই খাবার খেয়ে নিল। এটাও একটা মজার অভিজ্ঞতা। আবার দু’পাশের সেই মনোহর দৃশ্য। ক্লান্ত হয় না চোখ।

দিনাজপুরের প্রত্ন-সম্পদ

দিনাজপুরের প্রত্ন-সম্পদ
ড. মাসুদুল হক

উত্তরবঙ্গের বরেন্দ্রভূমি ভৌগলিক দিক দিয়ে যেমন প্রাচীন, ইতিহাসের দিক দিয়েও তেমনি প্রাচীন। বরেন্দ্রভূমির উত্তরাঞ্চল নিয়ে গঠিত দিনাজপুর আর দক্ষিণাঞ্চল নিয়ে মালদহ ও রাজশাহী। বরেন্দ্রভূমির মৃত্তিকা অতি প্রাচীন শিলা দিয়ে গঠিত। গাঙ্গেয় বদ্বীপ অঞ্চলের মতো বরেন্দ্রভূমি সমতল নয়। দিনাজপুরে বরেন্দ্রভূমির উচ্চতা অপেক্ষাকৃত অধিক তবে কোনো স্থানই সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে একশত ফিটের বেশি উঁচু নয়। দিনাজপুর শহর থেকে কান্তনগর পর্যন্ত ভূ-খণ্ডটি জেলার সর্বোচ্চ স্থান। ক্ষুদ্র ও বৃহৎ নদী প্রবাহের জন্য এই জেলার সর্বত্র নিম্ন সমতল ভূমির সৃষ্টি হয়েছে। উত্তর বরেন্দ্রভূুমি বিশেষ করে দিনাজপুরের বিল ও জলাভূমির আকৃতি ছোট এবং পরিমাণে কম। দক্ষিণের বরেন্দ্র অঞ্চল অপেক্ষাকৃত কম উঁচু এবং সমতল ভূমির দ্বারা পরিবেষ্টিত। পূর্বে যমুনা অববাহিকা এবং পশ্চিম-দক্ষিণে গাঙ্গেয় অববাহিকার দ্বারা পরিবেষ্টিত। এছাড়াও দিনাজপুরের দক্ষিণ অঞ্চলের বরেন্দ্র ভূমিতে প্রচুর সংখ্যক বৃহদাকারের বিল ও জলাভূমি দেখা যায়।
দিনাজপুরের প্রায় সবটুকু ভূ-খণ্ড আইন-ই-আকবরি-তে উল্লেখিত সরকার তাজপুর, সরকার পিঞ্জরা এবং সরকার ঘোড়াঘাটের অন্তভর্ুক্ত ছিল। এই ৩টি সরকারের অন্তর্ভুক্ত মহলসমূহের মধ্যে দিনাজপুরের নাম দেখা যায় না। উল্লেখ্য যে তাজপুর, পিঞ্জরা এবং ঘোড়াঘাটের সদর দপ্তরসমূহ বৃহত্তর দিনাজপুরেই অবস্থিত। সরকার পিঞ্জরার অধিকাংশ অঞ্চল দিনাজপুর জেলার ভূ-খণ্ড নিয়ে গঠিত এবং সরকার পিঞ্জরার সদর দপ্তর দিনাজপুর শহরের নিকটেই অবস্থিত ছিল।১ সম্রাট শাহজাহানের রাজত্বকালের শেষভাগে উত্তরাধিকার সংগ্রামের সময় কামতা (কুচবিহার) ও কামরূপ (আসাম) রাজদ্বয় কর্তৃক উত্তরবঙ্গের উত্তরাঞ্চল আক্রান্ত ও অধিকৃত হয়। এর ফলে সংশ্লিষ্ট অঞ্চলে একটি রাজনৈতিক পরিবর্তন দেখা দেয়। উত্তরাধিকার সংগ্রাম শেষে বাংলার নব-নিযুক্ত সুবাদার মীর জুমলা দ্রুত আক্রমণ চর্ািলয়ে হারানো রাজ্য পুনরুদ্ধার করেন। পুনরুদ্ধারকৃত ভূ-খণ্ডের নামকরণ করা হয় বাদশাহ আওরঙ্গজেবের নামে আওরঙ্গাবাদ। নামের পরিবর্তন হলেও সরকারি কাগজপত্রে সরকার তাজপুর ও সরকার পিঞ্জরার ব্যবহার থেকেই যায়।
মুর্শিদকুলী খান সুবা বাঙালাকে যে ১৩টি চাকলায় বিভক্ত করেন তার মধ্যে দিনাজপুরের নাম নেই। তবে বর্তমান দিনাজপুরের অধিকাংশ অঞ্চলুচাকলা আকবর নগর এবং চাকলা ঘোড়াঘাটের অন্তর্ভুক্ত ছিল। এ থেকে ধারণা করা যায় যে, আঞ্চলিক নাম হিসেবে আওরঙ্গাবাদের প্রচলন বিলুপ্ত হয়ে যায় এবং তদস্থলে উপরোক্ত নামের চাকলা স্থানগ্রহণ করে। একটি বৃহৎ রাজস্ব অঞ্চল হিসেবে আকবর নগরের উল্লেখ উইলিয়াম হান্টারের বিবরণে দেখা যায়।২ ১৭২৮ সালে নবাব সুজাউদ্দিন খান রাজস্ব সংস্কার করলেও চাকলাসমূহের নামের কিংবা সীমানার বিশেষ কোনো পরিবর্তন করেছিলেন বলে মনে হয় না। ১৭৬৫ সালে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি কর্তৃক দেওয়ানী লাভের সময় সুবা বাঙালা অন্ততপক্ষে ২৮টি জেলায় বিভক্ত ছিল। সুবা বাঙালার এই জেলাওয়ারী বিভাগ মীর কাশিম কর্তৃক প্রবর্তিত হয়। এরমধ্যে দিনাজপুরের নাম পাওয়া যায়। সুতরাং ১৭২২ থেকে ১৭৬০ সালের মধ্যবর্তী কোনো এক সময় ‘দিনাজপুর’ নাম প্রচলন হয়।
নবাব মুর্শিদকুলী খান কর্তৃক সুবা বাঙালায় জমিদারি ব্যবস্থা প্রবর্তিত হয়। দিনাজপুরের জমিদার সেই সময় থেকেই জমিদারি সনদ প্রাপ্ত হন। দিনাজপুরের জমিদার (যিনি রাজা নামে অভিহিত হতেন) যে অঞ্চলের জমিদারি প্রাপ্ত হন সেই অঞ্চল ‘দিনাজপুর’ নামে পরিচিতি লাভ করে, অন্য কোনো নামে নয়। সুতরাং আঠারো শতকের দ্বিতীয় দশকে দিনাজপুর নামের প্রচলন হয়েছিল এরূপ অনুমান করা যায়।
দেওয়ানী শাসনামলের প্রারম্ভে দিনাজপুর জেলার আয়তন খুব বড় ছিল না। মীর কাশিমের শাসনামলে জমিদারদের অত্যন্ত চাপের মুখে থাকতে হতো। নবাবী আমল শেষে দেওয়ানী শাসনামলে দিনাজপুরের রাজা তার জমিদারির আয়তন বৃদ্ধি করতে সচেষ্ট হন। এরফলে পাশর্্ববর্তী কিছু কিছু বিচ্ছিন্ন অঞ্চল দিনাজপুর জমিদারির অন্তর্ভুক্ত হয়। জেমস রেনেলের মানচিত্র আলোচনা করলেই এটা বোঝা যায়। রেনেলের বিবরণ অনুসারে ১৭৮৪ সালে দিনাজপুরের আয়তন ছিল ৩৫১৯ বর্গমাইল। ওয়াল্টার হ্যামিলটনের বিবরণ অনুসারে রেনেলের বিবরণের পর থেকে বুকানন হ্যামিলটনের বিবরণ লেখা পর্যন্ত সময় দিনাজপুরের আয়তন ক্রমশঃই বৃদ্ধি পেয়েছিল। চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত প্রণয়নের সময় দিনাজপুরের আয়তন আরো বৃদ্ধিপ্রাপ্ত হয়। প্রায় সমগ্র ইদ্রকপুর জেলা, শিলবাড়ী জেলার কিয়দংশ, বর্তমান মালদহ জেলার অধিকাংশ দিনাজপুরের অন্তভর্ুক্ত হয়। দিনাজপুরের এই ভৌগোলিক অবস্থানের কালে বুকানন হ্যামিলটন দিনাজপুর জরিপ করেন। বুকানন হ্যমিলটনের বিবরণ অনুসারে দিনাজপুরের আয়তন ছিল ৫৩৭৪ বর্গমাইল এবং দিনাজপুর উত্তরবঙ্গের সর্ববৃহৎ জেলা ছিল। বুকানন হ্যামিলটনের মতে: রাজা দনুজ (রাজা গণেশের রাজকীয় উপাধি ছিল রাজদনুজমর্দন দেব) এর অধিকারভূক্ত অঞ্চল দিনাজপুর নামে পরিচিতি লাভ করে।৩
এ-কথা সুবিদিত যে, বাংলাদেশের বর্তমান প্রশাসনিক পরিবর্তনের কারণে ব্রিটিশ আমলের জেলাগুলি বেশ ক্ষুদ্র-ক্ষুদ্র জেলায় পরিণত হয়েছে। অবশ্য এর ফলে বাংলার আবহমানকালের অর্থনীতি, সামাজিক, সাংস্কৃতিক ধারাবাহিকতায় তেমন মারাত্মক কোনো বিঘ্ন ঘটেছে বলে মনে হয় না। ব্রিটিশ আমলের যে জেলাটি দিনাজপুর নামে পরিচিত ছিল, তা ১৯৪৭ সালে দেশ বিভাগের সময় পশ্চিম দিনাজপুর ও দিনাজপুর নামে পৃথক হয়ে পড়ে। পরবতর্ীকাল এ দু’টি জেলারও নানা প্রশাসনিক পরিবর্তন ঘটে, যার ফলে ভারতের পশ্চিমবঙ্গ ও পূর্ব পাকিস্তানের দিনাজপুর আরো ক্ষুদ্র প্রশাসনিক অঞ্চলে পরিণত হয়। বর্তমানে বাংলাদেশের দিনাজপুর জেলাটি ৩টি স্বতন্ত্র জেলায় বিভক্তুদিনাজপুর, ঠাকুরগাঁও এবং পঞ্চগড়। এগুলোকে সমষ্টিগতভাবে বৃহত্তর দিনাজপুর নামে আখ্যায়িত করা হয়।৪ আমাদের আলোচনা শুধুমাত্র বর্তমান দিনাজপুরে সীমাবদ্ধ থাকবে।
উপমহাদেশের বহু স্থানের মতো দিনাজপুর অঞ্চলেও অতি প্রাচীনকালে মানববসতি গড়ে উঠে। এরপর ধীরে ধীরে সভ্যতা-সংস্কৃতি এবং রাজনৈতিক বিকাশের সঙ্গে সঙ্গে এটি উত্তর ভারতীয় বৃহত্তর জনপদের ইতিহাস ও ঐতিহ্যের সঙ্গে সমপৃক্ত হয়ে পড়ে, ফলে এখানে আবির্ভাব ঘটে ভারতীয় সংস্কৃতির। এ অঞ্চলটি মৌর্য শাসন, গুপ্ত শাসন এবং পরবর্তী সর্বভারতীয় সাম্রাজ্যের অন্তর্ভুক্ত হয়। মহাস্থান ব্রাহ্মীলিপির প্রাপ্তি থেকে অনুমান করা হয়, দিনাজপুর মৌর্য শাসনের সুফল ভোগ করেছে। আবার গুপ্ত নামধারী রাজাদের বেশ কিছু তাম্রশাসন প্রমাণ করেছে দিনাজপুরে গুপ্তদের বিসতৃতির কথা। এভাবে দিনাজপুরে প্রশাসনিক কাঠামো, অর্থনৈতিক সমৃদ্ধি, নগরায়ন, যাতায়াত ব্যবস্থা বলতে গেলে সবকিছুরই বিকাশ ঘটেছে বৃহত্তর রাজশক্তির বা সর্বভারতীয় সাম্রাজ্যবাদী শক্তির ছত্রছায়ায়। দিনাজপুরে প্রাচীনকাল থেকেই আবির্ভাব ঘটে হিন্দু, বৌদ্ধ এবং জৈন ধর্মের। এরই ভিত্তিতে বিকশিত হতে থাকে স্থানীয় সমাজে নতুন দর্শন ও নতুন চিন্তা-ভাবনা। এ জনপদের অধিবাসীরা নতুন মত ও নতুন পথের সন্ধান পেয়েছে, সেগুলো গ্রহণ ও বর্জন করেছে এবং নানাভাবে সমৃদ্ধ হয়েছে। একই সাথে এ অঞ্চলে ঘটে উপ-মহাদেশের নানা ভাষা এবং নানা অঞ্চলের মানুষের অবির্ভাব। সংক্ষেপে বলতে হয় প্রাচীনকালে দিনাজপুর কোনো একটি বিচ্ছিন্ন জনপদ ছিল না; যদিও এ অঞ্চলে প্রবেশের ক্ষেত্রে ছিল নানাবিধ প্রাকৃতিক প্রতিবন্ধকতা। বরং বলা যায়, সর্বভারতীয় সভ্যতা ও সংস্কৃতির বাহক হিসেবে দিনাজপুরের পরিচয় পাই নানাবিধ ঐতিহাসিক নিদর্শন থেকে। মধ্যযুগে মুসলমানদের আগমনের ধারা ধরেই ১৩ শতকের প্রথমদিকে এ ভূ-খণ্ডে আগমন ঘটে মুসলমান অভিযানকারীদের। এরই পরিপ্রেক্ষিতে যেমন বদলে যায় এখানকার রাজনৈতিক জীবন তেমনি ইসলাম ধর্মকে কেন্দ্র করে গড়ে উঠে নতুন সমাজ ও সংস্কৃতি। এভাবেই মধ্যযুগে দিনাজপুর হয়ে উঠে হিন্দু, বৌদ্ধ ও ইসলাম এই ৩টি প্রধান সাংস্কৃতিক স্রোতধারার মিলন ক্ষেত্র। এই নানাবিধ জীবনবোধ সত্ত্বেও দিনাজপুর অঞ্চলের জনগণ তাদের পারস্পরিক ভালোবাসার বন্ধন এবং দেশপ্রেম দিয়ে অঞ্চলটির অগ্রযাত্রা অক্ষুণ্ন রেখেছে।৫
ইতিহাসের ধারায় শাসকবর্গের ব্যক্তিগত উদ্যোগ, আচরণ এবং শাসন ব্যবস্থা এ অঞ্চল এবং এর অধিবাসীদের নানাভাবে প্রভাবিত করেছিল, যার ফল ছিল ইতিবাচক। যেমন বিভিন্ন প্রশাসনিক কাঠামো, প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা, যাতায়াত ও জনকল্যাণমূলক কাজের মাধ্যমে এ অঞ্চলে শান্তি ও নিরাপত্তার প্রাতিষ্ঠানিক ব্যবস্থা নিশ্চিত করা হয়েছে। এর ফলে প্রাচীনকাল থেকে এখানকার অধিবাসীরা জীবন-যাপনের জন্য বিচ্ছিন্নভাবে হলেও পেয়েছেন শান্তিপূর্ণ পরিবেশ এবং উৎপাদনমুখী কর্মকাণ্ডেও সম্পৃক্ত করতে পেরেছেন নিজেদের । এর পাশাপাশি অনিবার্যভাবেই নানা ধরনের নেতিবাচক শক্তির প্রভাব-প্রতিক্রিয়া দেখা গেছে। যে কারণে এক গোষ্ঠী বা শ্রেণী কতর্ৃক অপর গোষ্ঠী বা শ্রেণীর উপর আধিপত্য বিস্তার এবং শোষণ ও নির্যাতনের দৃষ্টান্ত রয়েছে।
আধুনিককালের রাজনৈতিক পালাবদলে এই জনপদের শাসন ক্ষমতা চলে যায় অপর এক দল বিদেশীদের হাতে, যাদের আগমন সুদূর ইউরোপ থেকে। এ অঞ্চলের অধিবাসীদের জন্য এটিও এক নতুন অভিজ্ঞতা। তবে এ অভিজ্ঞতা ও ইংরেজ ঔপনিবেশিককাল ছিল এক মিশ্রিত সময়। এ সময় এক দিকে যেমন ধন-সম্পদ পাচারের ফলে এ অঞ্চলের অর্থনৈতিক মেরুদণ্ড দূর্বল হয়ে পড়ে, তেমনি ইউরোপ থেকে আগত নতুন ভাষা, নতুন শিক্ষারীতি, নতুন চিন্তা-ভাবনা, দর্শন ও সংস্কৃতি এ অঞ্চলের মধ্যযুগের সীমাবদ্ধতাকে ঠেলে দূরে সরিয়ে দেয়। জনপদের সকল মানুষের মধ্যে এক নতুন চেতনার জন্ম হয়ুযাকে সাধারণভাবে আমরা বলে থাকি এ অঞ্চলের পুনঃজাগরণ এবং গণতান্ত্রিক সমাজ প্রতিষ্ঠার পথযাত্রা। এই পাশ্চাত্য সভ্যতা ও সংস্কৃতিতে সমৃদ্ধ হয়ে দিনাজপুর আজ একবিংশ শতাব্দীর দ্বারপ্রান্তে উপস্থিত।
এই জনপদের সুদীর্ঘকালের ইতিহাসে দিনাজপুরের অধিবাসীরা তাদের সৃজনশীলতার ছাপ রেখেছেন শিক্ষা, সাহিত্য, সংস্কৃতি, সংগীত, ধর্ম, স্থাপত্য, প্রত্ম-সম্পদে। আর এ ক্ষেত্রে সর্বভারতীয় জনগণের অভিজ্ঞতার সাথে দিনাজপুরবাসীদের রয়েছে অপূর্ব সাযুজ্য।৬

২.
বৃহত্তর দিনাজপুর এলাকায় মানুষের বসতি কখন শুরু হয়েছিল স্পষ্ট করে বলা কঠিন। বাংলাদেশের উত্তরবঙ্গ এবং ভারতের বিহার ও পশ্চিমবঙ্গ রাজ্যের উত্তরাঞ্চল গঙ্গা উপত্যাকার উত্তরাংশ হিসেবে বিবেচ্য। এই বিস্তৃত অঞ্চলে প্রস্তর যুগ থেকে শুরু করে মধ্যবর্তী প্রস্তর যুগ পর্যন্ত কোনো প্রত্ন নিদর্শন আবিষ্কৃত হয় নি বলে গবেষকরা মনে করেন। তারা মনে করেন মানববসতির জন্য অনুকূল পুুরিবেশ, শিকার ও বসবাসের নিমিত্তে বিস্তৃত উঁচু ভূমি এবং হাতিয়ার তৈরির জন্য পর্যাপ্ত পাথর না থাকায় এই অঞ্চলে সম্ভবত তখন মানব বসতি গড়ে ওঠে নি। নব্য প্রস্তর যুগটি ভূ-তাত্তি্বক কালানুক্রমে হলোসিন পর্যায়ে পড়ত। হলোসিন যুগে প্রকৃতিতে বসবাস উপযোগী সহজতর পরিবেশ, প্রাচীন বড় প্রাণীর পরিবর্তে ছোট ছোট প্রাণীর আগমন এবং প্রায় সুনির্দিষ্ট নিয়মে বাৎসরিক ঋতুগুলোর আবর্তন লক্ষণীয়। প্রকৃতির এই আনুকূল্য একদিকে যেমন বিস্তৃত ও দূর অঞ্চলে মানুষকে পদচিহ্ন রাখার সুযোগ করে দেয়, অপরদিকে কৃষি ও পশুপালনের মতো নিশ্চিত পেশায় মানুষকে আকৃষ্ট করে। আর তাই গঙ্গা উত্তরাংশে বিহার থেকে উত্তরবঙ্গের দিনাজপুর পর্যন্ত বিস্তৃত অঞ্চলে প্রথমবারের মতো নব্য প্রস্তর যুগের মানুষের আগমন ঘটে।৭
নব্য প্রস্তর যুগে এ অঞ্চলে মানুষের জীবন ধারা কেমন ছিল বলা কঠিন। এ পর্যন্ত আবিষ্কৃত ৭টি প্রত্নস্থলের মধ্যে একটি পুনর্ভবা নদীর তীরে অবস্থিত এবং বাকী ৬টি তিস্তা নদীর তীরে অবস্থিত। সুতরাং মনে করা যেতে পারে যে, এ সময়ে মানুষেরা নদীর তীরবর্তী উঁচু সমতল ভুমিতে বসবাস করত। ভারতে নব্য প্রস্তর সংস্কৃতির পরবর্তীতে তাম্র প্রস্তর সংস্কৃতির আবির্ভাব ঘটেছিল। কিন্তু বৃহত্তর দিনাজপুর বা উত্তরবঙ্গ ও তার পাশর্্ববর্তী অঞ্চলে এখনও পর্যন্ত তা লক্ষ করা যায় নি। তবে উত্তরবঙ্গের উচু সমতলভূমি, অসংখ্য নদী-নালা, বিল এবং বন্য পশু-পাখির উপস্থিতি দেখে প্রাচীনকালে তাম্র প্রস্তর যুগ বিকাশের ক্ষেত্রে একটি উপযোগী পরিবেশ ছিল বলে গবেষকরা অনুমান করেন; যা একটি সঠিক জরিপের অপেক্ষায় এখনও মাটির গভীরে প্রথিত আছে বলেই ধরে নিতে হচ্ছে।৮
খ্রিস্টপূর্ব তিন শতকের দিকে উত্তরবঙ্গের মানববসতির প্রাথমিক ধারার প্রত্যক্ষ লিখিত প্রমাণ পাওযা যায় মহাস্থান শিলালিপি থেকে যা আমরা পূর্বে উল্লেখ করেছি। এই শিলালিপিটি মৌর্য শাসক অশোক কর্তৃক জারিকৃত একটি রাজকীয় আদেশ বলে অনুমান করেন প্রত্নতাত্তি্বক গবেষকগণ। এ শিলালিপিতে দুর্ভিক্ষজনিত কারণে এ অঞ্চলের প্রজাদের খাদ্য-শস্য ও অর্থ দিয়ে সাহায্যের কথা বলা হয়েছে এবং পরবতর্ীতে সুসময়ে এগুলো আবার পুনরুদ্ধার করার নির্দেশ দেয়া হয়েছে। এ লিপির আলোকে গবেষকগণ ধারণা করেন যে, উত্তরবঙ্গ তখন পুণ্ড্রনগর নামে পরিচিত ছিল এবং এটি মৌর্য শাসনামলে একটি প্রশাসনিক একক ছিল। সুতরাং প্রশাসনিক একক হিসেবে অবশ্যই মৌর্য পূর্ব যুগ থেকে এ অঞ্চলে মানববসতি ছিল। এই বিষয়টি ঐতিহাসিক ও প্রত্নগবেষকগণ বিশ্বাস করেন। মৌর্য যুগ থেকে মুসলিমপূর্ব যুগ পর্যন্ত সময়ে সর্বমোট ১৪৭টি প্রত্নস্থল আবিষ্কৃত হয়েছে। এর মধ্যে ১টি পাবনা, ১২টি রংপুর, ১৭টি রাজশাহী, ৭টি পঞ্চগড়, ৭টি ঠাকুরগাঁও, ৩৪টি দিনাজপুর এবং ১০৯টি বগুড়া জেলায় অবস্থিত বলে চিহ্নিত করেছেন প্রত্নতত্ত্ববিদ আ.কা.ম যাকারিয়া। প্রাচীন বসতির জন্য বন্যা ছিল একটি প্রাকৃতিক সমস্যা। যে কারণে বন্যা থেকে রক্ষা পাওয়ার জন্য বসতিগুলোর বেশির ভাগই পাদদেশীয় সমভূমি এবং প্লাইস্টোসিন উঁচু ভূমিতে অবস্থিত। কিন্তু কোনো অবস্থাতেই কৃষি-কার্যের সুবিধার্থে প্রত্নস্থলগুলো অল্প প্লাবিত অঞ্চল থেকে দূরে ছিল না। এখানে প্রাচীন বসতি স্থাপনকারী অধিবাসীরা শুধুমাত্র ধর্মীয় ও প্রশাসনিক-ভবনে ইটের ব্যবহার করেছিল এবং সাধারণ বসতির ঘরবাড়িগুলোতে স্থানীয়ভাবে প্রাপ্ত গাছপালা, নলখাগড়া, লতাপাতা ব্যবহার করেছিল বলে গবেষকরা মনে করেন।৯
দিনাজপুরের এই প্রত্নস্থলগুলো কোন কোন উপজেলায় আবিষ্কৃত হয়েছে এবং এগুলোর নির্মাণ বৈশিষ্ট কি? তাুআ.কা.ম যাকারিয়া অনুসরণে নিম্নে উল্লেখ করা হল১০:
ক্রমিক নং প্রত্নস্থলের নাম উপজেলা নির্মাণ বৈশিষ্ট্য
১. রাজাসন-সতিমনডাঙি সেতাবগঞ্জ মাটি ও ইটের সতূপের ধ্বংসাবশেষ
২. ভেলুয়ার মন্দির বীরগঞ্জ মন্দিরের ধ্বংসাবশেষ
৩. কাঠগড় ও ঢাকেশ্বরী মন্দির বীরগঞ্জ মাটির দূর্গ
৪. ঝলঝালির সতূপ বীরগঞ্জ সতূপের ধ্বংসাবশেষ
৫. কান্তনগর দূর্গনগরী দিনাজপুর সদর মাটির দূর্গ
৬. শ্রী চন্দ্রপুর সতূপ দিনাজপুর সদর মাটির দূর্গ
৭. গোয়ালডিহি খানসামা সতূপের ধ্বংসাবশেষ
৮. হিরা-জিরা বেশ্যার ভিটা পার্বতীপুর সতূপের ধ্বংসাবশেষ
৯. কিচক রাজার গড় পার্বতীপুর মাটির দূর্গ
১০. বেলাই চণ্ডি পার্বতীপুর মাটির দূর্গ
১১. দেউলি পার্বতীপুর মাটির দূর্গ
১২. পাঁচ পুকুরিয়া বদরগঞ্জ সতূপের ধ্বংসাবশেষ
১৩. দূর্গনগরী ফুলবাড়ী মাটির দূর্গ
১৪. দামোদরপুর ফুলবাড়ী তাম্রশাসন প্রাপ্তি স্থান
১৫. বামনগড় ফুলবাড়ী মাটির দূর্গ
১৬. পুকুরি ফুলবাড়ী স্থাপত্যের ধ্বংসাবশেষ
১৭. ভাঙ্গা দিঘি ফুলবাড়ী স্থাপত্যের ধ্বংসাবশেষ
১৮. চরকাই বিরামপুর মাটির দূর্গ
১৯. মির্জাপুর বিরামপুর স্থাপত্যের ধ্বংসাবশেষ
২০. চণ্ডিপুর-গড়পিঙলাই বিরামপুর মাটির দূর্গ
২১. চরকাই চোর চক্রবর্তী বিরামপুর মাটির দূর্গ
২২. বিবির ধাপ বিরামপুর সতূপের ধ্বংসাবশেষ
২৩. সিতাকোট বিহার বিরামপুর সতূপের ধ্বংসাবশেষ
২৪. নবাবগঞ্জ তর্পনঘাট নবাবগঞ্জ সতূপের ধ্বংসাবশেষ
২৫. হরিনাথপুর ভাদুরিয়া নবাবগঞ্জ মাটির দূর্গ
২৬. চকজুনিদ-দরিয়া নবাবগঞ্জ সতূপের ধ্বংসাবশেষ
২৭. দামোদরপুর নবাবগঞ্জ সতূপের ধ্বংসাবশেষ
২৮. জিকাগড় নবাবগঞ্জ মাটির দূর্গ
২৯. বেলোয়া ঘোড়াঘাট মাটির দূর্গ
৩০. পল্লী বা পাল্লরাজ ঘোড়াঘাট সতূপের ধ্বংসাবশেষ
৩১. বার পাইকের গড় ঘোড়াঘাট মাটির দূর্গ
৩২. বইগ্রাম হাকিমপুর তাম্র শাসন প্রাপ্তিস্থল
৩৩. টংগীশহর হাকিমপুর সতূপের ধ্বংসাবশেষ

বৃহত্তর দিনাজপুরে প্রাপ্ত অসংখ্য মাটির দূর্গনগরী ও প্রাচীন স্থাপত্যসমূহ একদিকে যেমন এখানে মানববসতির প্রাথমিক ধারার সাক্ষ্যবহন করছে, অন্যদিকে তেমনি এ অঞ্চলের অতীত ঐতিহ্য ও সমৃদ্ধিকেও প্রকাশ করেছে।
উপরের সারণি থেকে আমরা উপলব্ধি করতে পারছি যে, প্রাচীন বৌদ্ধ-হিন্দু যুগে দিনাজপুরের বিভিন্ন স্থানে বহু বৌদ্ধবিহার ও মন্দির নির্মাণ হয়েছিল। কিন্তু কালের বিবর্তনে বেশির ভাগ কীর্তিই সম্পূর্ণ নিশ্চিহ্ন হয়ে গেছে। তবে কিছু কিছু প্রাচীন কীর্তির ধ্বসাবশেষ মাটির নিচে চাপা পড়ে এখন ঢিবিতে পরিণত হয়েছে। আমরা এ-প্রবন্ধে দিনাজপুর জেলার বৌদ্ধ, হিন্দু ও মুসলমান আমলের প্রত্ন-সম্পদগুলো সম্পর্কে সংক্ষিপ্ত ধারণা স্পষ্ট করার চেষ্টা করব। এ পর্যন্ত দিনাজপুর জেলায় প্রাপ্ত সর্বপ্রাচীন প্রত্নতাত্তি্বক নিদর্শন হচ্ছে সম্রাট কুমার গুপ্তের বৈগ্রাম শিলালিপি। অবশ্য অবিভক্ত দিনাজপুর জেলার বানগড়ে যে সমস্ত নিদর্শন পাওয়া গেছে, তা থেকে প্রমাণিত হয় যে গুপ্ত ও মৌর্য যুগের অনেক আগে থেকেই এ অঞ্চলে জনপদ গড়ে উঠেছিল।
সেতাবগঞ্জ উপজেলার সদর থেকে প্রায় ৬ কিলোমিটার উত্তরে বীরগঞ্জ-পীরগঞ্জ রাস্তার ধারে হাটের কাছে রাস্তার পশ্চিম পাশে আবিষ্কৃত হয়েছে একটা বড় আকারের ঢিবি। স্থানীয় লোক এই ঢিবিকে সতিমন ডাঙি নামে চিহ্নিত করে থাকেন। বর্তমানে এই ঢিবির উচ্চতা ২ থেকে ৩ মিটারের বেশি নয়। ধারণা করা হয়, এই স্থানে একটি বৌদ্ধবিহার ছিল। এখানে সিংহের উপর উপবিষ্ট কাল পাথরে তৈরি বৌদ্ধমূর্তি ছিল বলে স্থানীয় জনগণ জানান। এ থেকে বৌদ্ধবিহারের অবস্থান সম্পর্কে নিশ্চিত হওয়া যায়।
বীরগঞ্জ-পীরগঞ্জ সড়কে পুনর্ভবা নদীর উপর যে পাকা ব্রিজ আছে সেটি পার হয়ে ৫কি.মি দক্ষিণে কাহারোল উপজেলার অন্তর্গত ভেলুয়া গ্রাম। এই গ্রামের সবচেয়ে প্রাচীন দীঘির নাম ভেলুয়া দীঘি। ভেলুয়া অর্থাৎ বেহুলার সঙ্গে জন-প্রবাদে জড়িত এ দীঘির অনতিদূরে প্রাচীন কালের ইট পাথরে পরিপূর্ণ প্রায় ৫ মিটার উঁচু মাঝারি ধরনের একটি ঢিবি রয়েছে। এ ঢিবির উপর থেকে ১ মিটার উঁচু মাথার উপরে ছত্র এবং দু’পাশে ২৪টি ছোট ছোট মূর্তিসহ একটি নগ্ন জৈন মূর্তি পাওয়া গেছে। এ থেকে ধারণা করা হয় যে, এক সময় এটি জৈন মন্দির ছিল। মূর্তির গঠন কৌশল দেখে পণ্ডিতগণ অনুমান করেন যে, এ মূর্তিটি পাল যুগের। মূর্তিটি বর্তমানে ঢাকা যাদুঘরে সংরক্ষিত রয়েছে।
তারপর দিনাজপুর জেলা সদর থেকে ২০ কি.মি. উত্তরে এবং কাহারোল উপজেলা সদর থেকে ৭ কি.মি দক্ষিণ-পূর্বে সুন্দরপুর ইউনিয়নে, দিনাজপুর-তেঁতুলিয়া মহাসড়কের পশ্চিমে ঢেপা নদীর তীরে টেরাকোটার অলংকরণের বৈচিত্র ইন্দো-পারস্য ভাস্কর কৌশলে ও শিল্প মহিমায় নির্মিত কান্তজীউ মন্দির অবস্থিত। শ্রীকৃষ্ণ বিগ্রহ অধিষ্ঠানের জন্য এ মন্দির নির্মিত। কান্তজীউ মন্দির যে স্থানে স্থাপিত তার নাম কান্ত-নগর। কান্তনগর সম্পর্কে বহু পৌরাণিক গল্প ও উপখ্যান প্রচলিত রয়েছে। কথিত আছে যে, মহাভারতে বর্ণিত বিরাট রাজার গো-শালা এখানে বিদ্যমান ছিল। প্রকৃতপক্ষে মন্দিরটি যেখানে তৈরি হয়েছে সেটি একটি প্রাচীন স্থান এবং প্রাচীন দেয়ালে ঘেরা দূর্গনগরেরই একটি অংশ। প্রত্নতাত্তি্বকগণ একে কান্তনগর দূর্গ হিসেবে চিহ্নিত করেছেন। প্রায় ১ মিটার উঁচু এবং প্রায় ১৮ মিটার বাহুবিশিষ্ট পাথর নির্মিত একটি বর্গাকার বেদীর উপর এই মন্দিরটির অবস্থান। শোনা যায় বেদীর পাথরগুলো আনা হয়েছিল অবিভক্ত দিনাজপুরের প্রাচীন বানগড় নগরের ভেঙ্গে যাওয়া প্রাচীন মন্দিরগুলো থেকে। পাথরের বেদীর উপর মন্দিরটি ইটের তৈরি। বর্গাকারে নির্মিত মন্দিরের প্রত্যেক বাহুর দৈর্ঘ্য ১৬ মিটার। মন্দিরের চারিদিকে আছে বারান্দা। প্রত্যেক বারান্দার সামনে আছে দুটি করে স্তম্ভ। স্তম্ভগুলো বিরাট আকারের এবং ইটের তৈরি। স্তম্ভ ও পাশের দেয়ালের সাহায্যে প্রত্যেক দিকে ৩টি করে খোলা দরজা তৈরি করা হয়েছে। বারান্দার পরই আছে মন্দিরের কামরাগুলো। একটি প্রধান কামরার চারিদিকে আছে বেশ কয়েকটি ছোট কামরা। তিনতল বিশিষ্ট এই মন্দিরে ৯টি চূড়ারত্ন ছিল। এজন্য এটাকে নবরত্ন মন্দির বলা হয়ে থাকে। ১৮৯৭ খ্রিস্টাব্দের ভুমিকম্পে মন্দিরের চূড়াগুলো ভেঙ্গে যায়। ইট দ্বারা তৈরি এই মন্দিরের গায়ে পোড়া মাটির চিত্র ফলকের সাহায্যে রামায়ণ ও মহাভারতের প্রায় সবকটি প্রধান কাহিনীই তুলে ধরা হয়েছে। সে সঙ্গে শ্রীকৃষ্ণের বিভিন্ন কাহিনী এবং সম্রাট আকবরের কিছু কিছু রাজকর্মের চিত্রকর্ম রয়েছে। মন্দিরের উত্তর দিকের ভিত্তিবেদীর শিলালিপি থেকে জানা যায় দিনাজপুরের জমিদার মহারাজা প্রাণনাথ রায় (মৃতু্য১৭২২ খ্রি.) তার শেষ জীবনে মন্দির তৈরির কাজ শুরু করেন এবং মৃতু্যর পর তাঁর আদেশ অনুসারে দত্তক পুত্র মহারাজা রামনাথ রায় এই মন্দির তৈরির কাজ শেষ করেন ১৭৫২ খ্রিস্টাব্দে। কান্তজীউ বা শ্রীকৃষ্ণর বিগ্রহ ৯ মাস এ মন্দিরে অবস্থান করেন এবং রাসপূর্ণিমায় তীর্থ মেলা বসে। উল্লেখ্য যে, বাকী ৩ মাস বিগ্রহ দিনাজপুর রাজবাড়ীর মন্দিরে রাখা হয়।
গবেষক মেহ্রাব আলীর লেখা থেকে জানা যায়, এই আমলেই কান্তমন্দিরের উদ্বৃত্ত মালমসলাদি দিয়ে মন্দিরের দক্ষিণে (অর্ধ কিলো.) নির্মিত হয় একটি মসজিদ। যেটি নয়াবাদ মসজিদ নামে পরিচিত।১১
ফুলবাড়ী উপজেলা থেকে প্রায় ৮ কি.মি. দক্ষিণ পশ্চিমে রয়েছে চিন্তামন নামক একটি প্রাচীন স্থান। সেখান থেকে ৫ কি.মি. পশ্চিমে রয়েছে পুকুরি নামক ১টি প্রাচীন গ্রাম। অসংখ্য প্রাচীন দীঘি ছাড়াও প্রায় ৮ বর্গ কি.মি. জুড়ে এখানে প্রাচীন ইট পাথর ও হাড়িপাতিলের নিদর্শন পাওয়া যায়। মাটি খুঁড়লে যেখানে সেখানে ইট এবং প্রাচীন ইমারতের ভিত্তি বেড়িয়ে পড়ে। প্রায় দেড় কি.মি. দীর্ঘ একটি প্রাচীন পাকা সড়কের চিহ্ন এখনও স্পষ্টভাবে দেখা যায়। এই এলাকা থেকে কাল ব্রহ্মার মূর্তি, গণেশ মূর্তি, বিষ্ণু মূর্তি এবং গুপ্ত আমলের কিছু স্বর্ণ মুদ্রা পাওয়া গেছে। এছাড়াও ফুলবাড়ী উপজেলার অন্যান্য প্রত্ন নিদর্শনগুলো হচ্ছে দূর্গ নগরী, দামোদরপুর, বামনগড়, ভাঙ্গা দীঘিুযেগুলো আমরা পূর্বে সারণিতে উল্লেখ করেছি।

নকশি পিঠার দেশে

নকশি পিঠার দেশে
মৃতু্যঞ্জয় রায়

পৌষ আমায় ডাক দিয়েছে। তাই আর ঘরে থাকতে না পেরে ঘরের কাছেই দু’পা ফেলতে চললাম গাজীপুরের এক গ্রামে নকশি পিঠার খোঁজে। জানতাম, গাজীপুরই হল নকশি পিঠার আসল দেশ, একবার ঈদের আগে এক বাড়িতে প্রচুর নকশি পিঠা তৈরি করতে দেখেছিলাম। তাই আর একটু খোঁজ নিয়ে নিশ্চিত হয়েই রওনা হলাম বাড়ীয়া ইউনিয়নের দিগধা গ্রামে। কুয়াশা আর রোদে পৌষের সকাল বেলাটা মাখামাখি করছে। টেকের উপর দিয়ে উঁচু নিচু মাটির রাস্তা ধরে চললাম ঁেহটে হেঁটে। দু’ পাশে নিচু, অনেক নিচু শুকনো নদীর মত জমি। ওগুলোকে ওখানকার লোকেরা বলে খন্দ। খন্দে খন্দে মেখে আছে বোরো ধানের কচি চারার ফালি ফালি সবুজ বীজতলা। ফাঁকে ফাঁকে অল্প অল্প জলের ভেতর থেকে বেঁচে থাকার আকুল প্রার্থনা জানাচ্ছে ঝাঁকে ঝাঁকে ফোটা রক্ত শাপলা আর পদ্ম পাতারা। শীতকে উপেক্ষা করেই কয়েকজন কৃষক ঠান্ডা পানিতে নেমে মরা কচুরিপানা আর টোপা পানার দল সরাচ্ছে, চলছে ধান লাগানোর জন্য জমি চাষের প্রস্তুতি। লাল বাদামি মাটির বুক ফুঁড়ে আহা কি তেজ নিয়ে রাস্তার দু’পাশে বাড়ির আঙিনাগুলোয় ধেয়ে চলেছে লাউ লতারা। বাড়ির উঠোনের এককোনে মাটির নিকানো চুলায় চলছে রান্না। ফাঁকা রাস্তা ধরে দূর থেকে হেঁটে আসছে চাদর গায়ে গুটিশুটি একজন লোক। গ্রামের এমন পৌষ সুন্দর কতকাল যে চোখে পড়েনি। পৌষ সকালের এমন প্রকৃতি দেখতে দেখতে তো প্রায় ভুলতেই বসেছিলাম বাঙলার ঐতিহ্য নকশি পিঠাকে। সঙ্গি মোতালেব আকন্দ সাহেবের ডাকেই সে ঘোর কাটলো। বুঝলাম এসে গেছি। পরিচয় হল গীতা দিদির সাথে। গীতা মলি্লক। বললেন, ‘আমরা তো বানাতে পারি না। তবে যারা বানায় তাদের বাড়িতে আপনাকে নিয়ে যাওয়ার ব্যবস্থা করেছি।’ অতএব তার সাথেই চললাম মুক্তামণি, মাসুদা আর হালিমাদের বাড়িতে। সেখানেই আয়োজন করা হয়েছে নানা রকম নকশি পিঠা বানানোর। চালের গুঁড়া থেকে কাই, কাই থেকে গুটি, গুটি থেকে রুটি, রুটি থেকে নকশা কেটে পিঠা বানানো এবং শেষে ভেজে চিনির সিরায় ভিজিয়ে মচমচ করে চিবিয়ে একখানা নকশি পিঠা খেয়ে তবেই চিনলাম নকশি পিঠাকে।

নকশি পিঠার আসল নাম পাকোয়ান, পক্কন বা ফুল পিঠা। অধিকাংশ গ্রামেই ফুল পিঠা নামে পরিচিত। কেননা, এ পিঠা দেখতে নকশাদার ফুল বা আলপনার মত। পিঠার মধ্যে সবচেয়ে সুন্দর ও আকর্ষনীয় পিঠা হল নকশি পিঠা। নকশি পিঠার মধ্যে ফুল নকশি, শাপলা বাহার, গোলাপ বাহার, পাতা বাহার, গেন্দা বাহার, পদ্মবাহার, কল্কে ফুল বাহার, জবা বাহার ইত্যাদি অন্যতম। আরও রয়েছে ঝিলিমিলি, মালা, জোড়া ময়ূর, পদ্মদীঘি, মেঘডুম্বুর, হিজল লতা, কাজল লতা, শঙ্খলতা, লতা বাহার, এলোকেশি, কুলাবাহার, কড়িকোমল, কইন্যাবরণ, কইন্যামুখি, জামাইমুখি, জামাই সুখ, জামাই মুছরা, জামাই ভুলানী, জামাইবরণ, সতীন মুছরা, সরপুস, সজনী বাহার, সজনে পাতা, সজনে ফুল, চিরল পাতা, ভেটফুল, উড়ি ফুল, ঝিংগা ফুল, কদম ফুল, ময়ূর পেখম, মইফুলি, ডালিম দানা, মোরগ ঝুটি, ঘর নকশা, জামদানী ইত্যাদি নামের নকশি পিঠা। একজন বললেন, ‘লাভ নকশি পিঠাও বানাতে পারি।’ সেটা আবার কেমন? জবাব এলো, যে যাকে পছন্দ করে নকশি পিঠার মধ্যে তার নামের প্রথম অক্ষরটা লিখে দেয়া হয়। যেমন, তার নাম যদি সেলিম হয় তাহলে নকশি পিঠার কারুকার্যময় নকশার মধ্যে হয়ত কোথাও লুকিয়ে থাকবে ইংরেজী ‘এস’ অক্ষরটি। ওটা যখন তাকে পাঠিয়ে দেয়া হবে বা খাওয়ার জন্য পরিবেশন করা হবে তখন একটা ভাব আসবে তাতে। এসব ভিন্ন ভিন্ন নামের নকশি পিঠার নকশার পার্থক্যের জন্যই এতসব নামকরণ হয়েছে। নকশি পিঠার সৌন্দর্য মূলতঃ প্রস্তুতকারির শিল্পবোধে, সে যা চায় সে নকশাই ফুটিয়ে তুলতে পারে। সে অনুযায়ী এক একটা নাম হয়ে যায়। নকশা তোলার জন্য ব্যবহার করা হয় তীক্ষ্ন খেজুর কাঁটা, বেলের কাঁটা ও বাঁশের ধারাল চাছ, ছিলা বা বাকল।

নকশি পিঠা তৈরি করা হয় আতপ বা অসিদ্ধ চাল থেকে। প্রথমে চালের গুঁড়া করা হয়। ঝরঝরে চালের গুড়াকে পানি দিয়ে মেখে রুটির কাইয়ের মত করা হয়। এতে সামান্য লবণ দেয়া হয়। এরপর গুটি করে সে গুটি বেলান দিয়ে বেলে রুটির মত গোল করা হয়। তবে নকশি পিঠার জন্য রুটি তৈরি করা হয় বেশ খানিকটা পুরু করে,পুরুত্ব হয় ডিজাইন বা নকশার ধরন অনুযায়ী আধা থেকে এক সেন্টিমিটার। অল্প একটু চালের কাই নিয়ে পুটুলি করে তাতে সয়াবিন তেল মাখানো হয়। তারপর সেই তেল মাখা পুটুলি নকশি পিঠার রুটির উপরে মাখিয়ে দেয়া হয়। এরপর শুরু হয় সেই রুটির উপর খেজুর কাঁটা দিয়ে নকশা তোলার কাজ। কখনো খেজুর কাঁটার সূঁচালো আগা দিয়ে কখনো বা কাঁটার গোড়া দিয়ে চলতে থাকে নকশা তোলার কারুকাজ। কাঁটা দিয়ে প্রথমে রুটির উপরে হালকা করে দাগ বা আঁচড় কেটে রেখা দিয়ে নকশার অবয়ব আঁকা হয়। তারপর সেই অবয়ব ধরে ধীরে ধীরে ধৈর্যের সাথে নরম রুটির মধ্যে তোলা হয় নানা রকমের কারুকাজ। কোনোটা গোল, কোনোটা চৌকা, কোনোটা তিনকোণা আবার কোনোটা তাঁরা মাছের মত। বিভিন্ন বিন্যাসে ও ডিজাইনে একটা সাধারণ চালের রুটিই মুহুর্তের মধ্যে পরিণত হয় এক অনন্য লৌকিক শিল্পকর্মে। খেজুরের কাঁটা, বেলের কাঁটা, সূঁচ, পাটশলা, নারিকেলের শলা ইত্যাদি দিয়ে কখনো কখনো প্রতিটি পিঠার কিনারা বা ধার বরাবর কাটা হয় নকশাদার ঝালর। চ্যাপ্টা রুটির কোথাওবা কেটে কখনো কখনো ফাঁকা করে নকশা তোলা হয়। কাটার জন্য ব্যবহার করা হয় বাঁশের ছিলকা বা চাঁছ। নকশি পিঠার সৌন্দর্য বা দেখনাই পুরোটাই নির্ভর করে প্রস্তুতকারিনীর শিল্পবোধ ও দক্ষতার উপর। যারা ভাল আঁকতে পারে তারা ভাল নকশার নকশি পিঠাও বানাতে পারেন। এর জন্য বয়স কোন বিষয় নয়, অভিজ্ঞতা ও কৌশলটাই আসল। গ্রামের অনেক শিশুদেরও বেশ ভাল ভাল ডিজাইনের নকশি পিঠা বানাতে দেখা যায়।

শীতের সকালে রোদে গা এলিয়ে গাঁয়ের বউ ঝিরা নকশি পিঠা তৈরিতে মেতে ওঠে। তবে নকশি পিঠা সবচে’ বেশি তৈরি করার প্রচলন রয়েছে গাঁয়ের মুসলিম সমাজে। তারা প্রধানতঃ ঈদের সময় নকশি পিঠা বানান। কোরবানির ঈদের চেয়ে অন্য ঈদেই বেশি নকশি পিঠা বানানো হয়। বানানোর পরপরই তেলে ভেজে চিনির সিরায় মেখে খাওয়া যায়। এ ছাড়া তেলে ভেজে ঠান্ডা করে কৌটায় ভাল করে মুখ বন্ধ করে মাসখানেক ঘরে রেখে ভাল রাখা যায়। এ ক্ষেত্রে পরে যখনই খাওয়া হোক না কেন, তেলে ভেজে মচমচে বা খাস্তা করে খেতে হয়। অনেক সময় নকশি পিঠা চিনির রসে বা সিরায় না দিয়ে গরম গরম তেলে ভাজা পিঠার উপর চিনির গুড়া ছিটিয়ে দিয়ে খাওয়া হয়। এমনকি কোন মিষ্টি না দিয়েও খাওয়া যায়। ঘিয়ে ভাজলে খুবই সুস্বাদু হয়। তবে তেলে ভাজার সময় সামান্য পরিমাণে ঘি তেলের সাথে মিশিয়ে দিলেও ঘিয়ে ভাজার ঘ্রাণটা পাওয়া যায়। ফলে স্বাদটাই অন্য রকম হয়ে যায়।

এ দেশে বাড়িতে যে কোন বিশেষ অতিথি ও নিকট জন এলে নকশি পিঠা ভেজে খাওয়ানোর প্রথা রয়েছে। কেউ বাড়িতে এলে সাথে সাথে এটা তৈরি করা কঠিন বলে অনেকেই নকশি পিঠা আগেভাগে তৈরি করে রাখেন। জামাই মেয়ে বাড়িতে বেড়াতে এলে নকশি পিঠা দিয়ে আপ্যায়ন করা গাজীপুর এলাকার এক অনিবার্য প্রথা। দেশের অনেক জায়গায় নকশি বা ফুল পিঠা থাকলেও এটা মূলতঃ ঢাকার কাছে গাজীপুর জেলাতেই বেশি তৈরি করার প্রচলন রয়েছে। এ অঞ্চলের প্রায় প্রতিটি মুসলিম পরিবারের মেয়েরাই এ কাজে বেশ পটু। নকশি পিঠা মেয়েলি ব্রত অনুষ্ঠানের উপজাত বলে ধারণা করা হলেও এটির আসলে মুসলিম নারীদের হাতেই উদ্ভব ও বিকাশ ঘটেছে। আবহমানকাল ধরে বাঙালি মেয়েরা বেশ কিছু মেয়েলি ব্রত পালন করে আসছে। এসব ব্রতের স্থানে চালের গুঁড়ি করে জলে গুলে আলপনা আঁকা হয়। মেয়েলি আঙুলের শিল্পকলার অপূর্ব সুষমা সেসব আলপনায় প্রতিভাত হত। ধারনা করা হয়, চালের গুঁড়া দিয়ে আঁকা আলপনার সাথে নকশি পিঠা তৈরির ইতিহাসটি গভীরভাবে সম্পর্কিত। নকশি পিঠাতেও এরূপ আলপনার অনুকরণ লক্ষনীয়। তবে শুধু আলপনা চিত্রই নয়, এর সাথে যুক্ত হয়েছে ফুল লতা পশু পাখি মায় হরফ পর্যন্ত। বিশিষ্ট ফোকলোরবিদ শামসুজ্জামান খানের মতে, ‘আশ্চর্যের ব্যাপার, এই মেয়েলি শিল্পটিতে হিন্দু রমণীদের নয়, মুসলিম রমণীকুলেরই স্বীকৃত শ্রেষ্ঠত্ব রয়েছে। কারণ হিসেবে বলা হয়েছে, চাল বা চালের গুঁড়ার দ্বারা রন্ধনকৃত সামগ্রী এঁটো বা মক্ড়ি বলে বিবেচিত হওয়ায় একে সংরক্ষণ করা হিন্দু সমাজে রীতি সিদ্ধ নয়।’ তবে ইদানীং পড়শি মুসলিম মেয়েদের কাছ থেকে অনেক হিন্দু মেয়েরাও ফুল পিঠা বানানো শিখছে ও বানাচ্ছে। গাজীপুর ছাড়া নোয়াখালী, ফেনী, মানিকগঞ্জ, দিনাজপুর ও রাজশাহী অঞ্চলেও পাকোয়ান এক অন্যতম জনপ্রিয় পিঠা। কুমিল্লায় এ পিঠার নাম ‘খান্দেশা’। রংপুর, দিনাজপুর ও বগুড়া অঞ্চলে এর নাম ‘ফুল পিঠা’। ময়মনসিংহ অঞ্চলের কোনো কোনো জায়গায় নকশি পিঠার নাম ‘মছমছিয়া পিঠা’।

এ দেশে শত রকমের পিঠা থাকলেও নকশি পিঠা হল সব পিঠার রাণী। স্বাদে যেমনই হোক না কেন, সৌন্দর্যে সে অপূর্ব সুন্দর। বিদেশে বাংলাদেশের কোন ঐতিহ্যবাহী লোক শিল্পের কথা উঠলেই যেমন চলে আসে নকশি কাঁথার নাম, তেমনি তার সাথেই উচ্চারিত হয় নকশি পিঠা ও নকশি পাখার নাম। দেশের নামের সাথে নকশি পিঠার নামটি জড়িয়ে আছে ঐতিহ্যগতভাবেই। বিশেষ বিশেষ পিঠা মেলাতেও দেখা মেলে ঐতিহ্যবাহী নকশি পিঠার।

নকশি পিঠা সম্পর্কে শিল্পী কামরুল হাসান বলেছেন, ‘খাদ্যবস্তু যা কেবল ক্ষুনি্নবৃত্তিই নিবৃত্ত করে, তার পেছনেও মানুষের সৌন্দর্যপ্রীতির নমুনা দেখলেও অবাক হতে হয়… গ্রাম্য বধূর রান্নাঘরের কাছে চালের গুঁড়ার পিঠা, গুড়ের রসে ভিজিয়ে দিলেই যেখানে চলে সেখানে নিবিষ্ট মনে খেজুর কাঁটা দিয়ে একের পর এক নকশা কেটে সময় নষ্ট করার কি কারণ থাকতে পারে।… কিন্তু গুড়ের রসেই যে চলবে না, এ কথা কে বোঝাবে আমাদের! গুড়ের রসে পিঠা মিষ্টি হবে, তাতে রসনা তৃপ্ত হবে। এটা ক্ষণিকের, কিন্তু প্রিয়জনেরা যখন সুদুরে যাবে তখন তার হৃদয়ের মণিকোঠায় কি ভরে নিয়ে যাবে?… তাই গ্রাম্য বধূ আপন মনে পিঠার ওপর নকশা কেটে চলে…।’ শিল্পীর এ কথারই যেন প্রতিধ্বনি শুনি নকশি বা ফুলপিঠা তৈরির সময় গ্রামীণ নারীদের গাওয়া একটা গানে:
‘কইন্যার মা রসিয়া
পাক্কোয়ান বানায় বসিয়া
এই না পাক্কোয়ান যাইবো
যাইবো, নবীন দোলার দেশেরে।
এই না পাক্কোয়ান যাইব
যাইব, নবীন বিয়াইর দেশেরে….।’
শিল্পাচার্য জয়নুল আবেদীনও ছিলেন নকশি পিঠার একজন মুগ্ধ শিল্পী। তিনি গ্রাম বাংলার এ পিঠার রূপে মুগ্ধ হয়ে বাংলা একাডেমির লোক সংগ্রহশালার জন্য নকশি পিঠার কিছু অনুকৃতি তৈরি করিয়ে দিয়েছিলেন। ফার্স্ট ফুডের আগ্রাসনে একদিন হয়ত বিদায় নেবে নকশি পিঠা। তখন ওই নকশি পিঠার অনুকৃতি বা মডেলগুলোই হয়ত বাংলার আগামী প্রজন্মকে জানাবে এ দেশের এই ঐতিহ্যবাহী লোকজ শিল্পটির কথা।

ফ্যান্টাসিময় অভিযান : নৌকা বানিয়ে ঢাকা টু সেন্টমার্টিন
মুসা ইব্রাহীম

তার কথা শুনলে মনে হবে ফ্যান্টাসি জগতটাই আসল, আর বাসত্দবটা ফুটো। ফ্যান্টাসিই যেন জীবন। তার মতে, শহুরে আটপৌরে জীবনের দাম কানাকড়িও থাকা উচিত নয়। যে জীবনে অ্যাডভেঞ্চার নেই, চ্যালেঞ্জ নেই_ সে জীবন পরজীবীর মতো। এই বয়স্ক মানুষটির দুঃসাহসিক কর্মকা-ও তার মতের সমার্থক। সেই সঙ্গে যে কোনো বিষয় বা কাজ নিজের মতো করে যে করা যায়, জীবনটাকে যে নিজের মতো করে পরিচালনা করা যায়, এ বিশ্বাসের পানে যে যাত্রা শুরম্ন করেছি, তাতে তার অবদান অসামান্য।
কাজেই বেশ কয়েকদিন ধরে তিনি যে বয়ান করে চলেছেন, ‘ফাইবারের একটা ছোট্ট ছিমছাম নৌকা করেছি চিটাগাং জাহাজ-ভাঙা শিল্প এলাকা থেকে। পুরোনো জাহাজের বয়া টাইপের নৌকা। সেখান থেকে শক্তিশালী ইঞ্জিনও কিনে এনেছি। এখন কামরাঙীর চর এলাকায় ওটাকে নিজের মতো করে আকার দেয়ার পর্ব চলছে। ভাবছি, যেকোনো দিন সদরঘাট থেকে এই নৌকায় করে সেন্টমার্টিন দ্বীপে রওয়ানা দিব। যাবেন না কি?’ শুনে একটুও অবাক হই না।

স্বপ্নদ্রষ্টার দেশে ফেরা
প্রশ্নটি কাজী হামিদুল হকের। বয়স পঞ্চাশ অতিক্রম করেছে। দীর্ঘদিন কেটেছে প্রবাসে। লেখাপড়া ভাস্কর্যের ওপর, আমেরিকায়। কিন্তু আগ্রহ ফটোগ্রাফিতে। সুতরাং ফাইন আর্টসের লেখাপড়ায় ঠিকুজি গড়া হয়নি। বরং পেশাদার ফটোগ্রাফিতেই তার সাবলীল পদচারণা বছরানত্দে স্থায়ী হয়। এ ছাড়াও তার সমুদ্রপাড়ে মাছ ধরার শখ। সেটাই তাকে টেনে নিয়ে চলে সমুদ্রতলের ছবি তোলার দিকে। এভাবেই সমুদ্রের সঙ্গে ২৫ বছরের দীর্ঘ সময় কাটান_ তলদেশের বিচিত্র জীবজন্তুর ছবি তোলার পেছনে। এ সময় স্কুবা ডাইভিংও চলত পাশাপাশি।
আমেরিকার এমন সৌখিন জীবনকে বিদায় জানিয়ে কাজী হামিদুল হক দেশে স্থায়ীভাবে ফিরে আসেন নব্বইয়ের দশকের মাঝামাঝি। তার সঙ্গে পরিচয় ২০০০ সালের শেষ দিকে।

ড্রিম মিশন-এর প্রস্তুতি
মানুষটির অপ্রচলিত ধারার কর্মকা-ের সঙ্গে পরের কয়েক বছরে বেশ পরিচিত হয়ে উঠেছি। সে সময়ে তার কাছ থেকে শোনা ফ্যান্টাসির মধ্যে ‘নৌকায় করে ঢাকা থেকে সেন্টমার্টিন দ্বীপে যাওয়ার পরিকল্পনা’টাই সর্বশেষ। তবে সদরঘাট থেকে সেন্টমার্টিন দ্বীপ? তাও আবার রূপানত্দরিত লাইফ-বোটে করে? এতো বড় ফ্যান্টাসি?
তাই সিদ্ধানত্দ নিতে বেশ ঝামেলায় পড়তে হলো। কারণ একদিকে অপরিচিত অ্যাডভেঞ্চারের আহ্বান। অন্যদিকে তীব্র মাত্রার ফ্যান্টাসি। কেউ তো এভাবে যায় নি, কেউ যায় না। ভাবতে বসলাম, এর কি কোনো বাসত্দবতা আছে? সুতরাং কি করব, যাবো, না কি যাবো না_ সিদ্ধানত্দ নিতে দোটানায় ক’দিন পার হল। এই ফাঁকে সেই ফ্যান্টাসিও ফিকে হয়ে এল।
দু’তিন সপ্তাহ পর কি একটা কাজে কাজী হামিদুল হকের আজিমপুরের বাসায় গিয়েছি। তার কণ্ঠে ফের একই আবাহন। তখন ব্যাপারটাকে গুরম্নত্বভরে নিতেই হল। একদিকে চাকরির চিনত্দা_ ছুটি পাওয়া যাবে তো? এমনিতে অফিস কামাই দেয়ার একটা সিল গায়ে পড়ে গেছে। কিন্তু রক্তেই যার অ্যাডভেঞ্চার, তার এত চিনত্দাভাবনা করলে চলে? এবার তাই চিনত্দা ডালপালা ছড়ানোর আগেই সিদ্ধানত্দ নিলাম_ যাবো।
তার বাসা থেকে বের হয়েই শুরম্ন হলো টেনশন_ অফিস ম্যানেজ করবো কিভাবে? অবশ্য ফিচার সম্পাদক আমার এই ‘অ্যাডভেঞ্চার ম্যানিয়া’ সম্পর্কে জানেন। তাই ‘ভ্রমণ’ পাতা চালানোর দায়িত্বটাও গছিয়েছেন। আমিও সমালোচনা ঠেকাই এই বলে যে_ আরে ঘুরে না বেড়ালে ভ্রমণ পাতার লেখা যোগাড় হবে কোত্থেকে?
সুযোগ বুঝে এক সময় ফিচার সম্পাদককে ‘নৌকা বানিয়ে ঢাকা টু সেন্টমার্টিন দ্বীপ অভিযান’-এর কথা জানালাম। শুনে তিনি আকাশ থেকে পড়লেন_ এও সম্ভব? তাকে কাজী হামিদুল হকের গল্প বলে আশ্বসত্দ করা গেল। বললাম, তিনি আসলেই নৌকাটা এমনভাবে বানিয়েছেন যাতে কমপৰে ১৫ জন আরোহী তাতে করে সদরঘাট টু সেন্টমার্টিন দ্বীপ পাড়ি দিতে পারে। চিনত্দাভাবনা শেষে তিনি যেতে দিতে সম্মত হলেন। তবে নিরাপত্তার ব্যাপারে সাবধানে থাকতে বললেন।
এর আগে নদীপথে বহুবার ঢাকা থেকে দৰিণাঞ্চলীয় জেলা, একবার সুনামগঞ্জ থেকে টাঙ্গুয়ার হাওর ইত্যাদি ভ্রমণের অভিজ্ঞতা ছিল। কিন্তু সেগুলোর সবই ‘পরিচালিত ভ্রমণ’। কিন্তু এবার নিজেরাই নৌকার সারেং-কাম-পরিচালক। তাই নৌকায় এ নদীভ্রমণের ব্যাপারে বারবারই চ্যালেঞ্জ অনুভব করছিলাম। সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ ছিল কাজী হামিদুল হকের জন্য। তিনি এর রূপকার, আয়োজক, দলনেতা সবই।
নৌকা আর ইঞ্জিন কেনার পর এর মধ্যে বছর দুয়েক সময় পার হয়ে গেছে। নানা উপকরণ পরীক্ষা-নিরীক্ষা করতে করতে আরও সময় লেগে যায়। নৌকাটা গোছানো যখন প্রায় শেষ, যাত্রার সময় যখন ঘনিয়ে এল_ সে সময়ে কাজী হামিদুল হকের বাসায় আলাপ চলতে থাকে_ ভূ-পৃষ্ঠে বা পাহাড়-পর্বতে আমাদের বিচরণ শুরম্ন হলেও প্রকৃত অর্থেই পানির নিচে সবকিছুই আমাদের অজানা। আমাদের ব্রজেন দাস ছিলেন, কিন্তু তার উত্তরসূরী কেউ উঠে আসল না। পানি বা সমুদ্র মাঝে আমাদের অ্যাডভেঞ্চার এখনো তীর অতিক্রম করেনি। পানির নিচের জগৎটা কেমন, তার বাসিন্দাদের প্রকৃতি কেমন, মানুষের সঙ্গে তাদের ‘ইন্টারঅ্যাকশন’ কেমন হয়_ এসব সম্পর্কে আমাদের জ্ঞান এখনো টেলিভিশনের পর্দা পর্যায়েই রয়ে গেছে। এ ব্যাপারে ‘ফার্স্ট হ্যান্ড’ অভিজ্ঞতা রয়েছে, এমন বাংলাদেশীর সংখ্যা কড়ায় গুণে ফেলা সম্ভব। সুতরায় নিজেরাই এ জগৎকে দেখব, নিজেদের মতো করে দেখব, এর কাছে যাব_ সে উদ্দেশ্যেই এ পরিকল্পনা।
সবাই একটা নীতিগত ব্যাপারে একমত ছিলাম যে, স্থলপথে বাংলাদেশকে চষে ফেলেছেন অনেকেই। কিন্তু জলপথে এ দেশ যে আরও মোহনীয়, তা এ প্রজন্ম ভুলে যেতে বসেছে। সুযোগটা তৈরি করা গেলে এদের জন্য চালু হবে অ্যাডভেঞ্চারের নতুন এক চ্যাপ্টার। তখন হয়তো প্রতি বছরই একটা করে দল ঢাকা থেকে উত্তরে তেঁতুলিয়া বা দৰিণে সেন্টমার্টিন অথবা এক প্রানত্দ থেকে আরেক প্রানত্দে নৌকাভ্রমণে বের হবে। বাংলাদেশকে আবিষ্কার করবে নতুন চেহারায়।
অবশ্য কাজী হামিদুল হকের আরেকটি সমানত্দরাল লৰ্য ছিল। তিনি ক্যালিফোর্নিয়া, ফ্লোরিডায় সমুদ্রতলে স্কুুবা ডাইভিং ও সঙ্গে ফটোগ্রাফি করেছেন। তিনি জানালেন, ওইসব এলাকার লোকজন তাদের সামুদ্রিক পরিবেশ রেখেছে সুন্দর করে। এর প্রকৃতিকে একটুও বদলাতে বা নষ্ট হতে দেয়নি। আর সেন্টমার্টিন দ্বীপে ১৫ বছর আগেও হাঁটুপানিতে শৈবাল দেখা যেত। দিনে দিনে সেসব নষ্ট হতে চলেছে। খাবারের মোড়কের পলিথিনে ছেয়ে যাচ্ছে সমুদ্রের তলদেশ। এভাবে সেন্টমার্টিন দ্বীপের প্রবাল-শৈবাল, অপূর্ব সুন্দর সমুদ্রতল এখন ধ্বংসপ্রায়। সেই সেন্টমার্টিনের সমুদ্র তলদেশের ছবি তোলার জন্যই মূলত তিনি এ অভিযান আয়োজন করেন।

অভিযাত্রী : সংখ্যায় ১৩
সবকিছু মিলিয়ে তার নৌকা যখন নদীপথে চলার সার্বিক উপযোগী হয়ে উঠল, সে সময়ে এ মতের বিশ্বাসী মোট ১৩ জন_ ফজলুল কবির সিনা, রফিকুল ইসলাম (রফিক), রবিউল হাসান মনা, মাহবুব, প্রলয় রহমান, তমাল, প্রিন্স, কামাল আনোয়ার বাবু, জাহাঙ্গীর, মুনতাসির মামুন ইমরান আর আমি কাজী হামিদুল হকের সঙ্গী হয়ে কিশোর মাঝির সহায়তায় বাংলাদেশের সেই রূপের খোঁজেই নৌকা নিয়ে বেরিয়ে পড়েছিলাম। যোগ দিলাম নতুন মাত্রার অ্যাডভেঞ্চারে। ঢাকা থেকে নৌ-পথে গিয়ে উঠতে হবে সেন্টমার্টিন।
দিনটি ছিল ২৩ ডিসেম্বর ২০০৪, বিকাল পাঁচটা। প্রয়োজনীয় কাপড়চোপড়, ক্যামেরা সরঞ্জাম ব্যাগে ভরে সবাই জড়ো হতে লাগলাম কামরাঙ্গীর চরে। সেখানেই নৌকা ঘাটে রাখা। নৌকা চলার পর্যাপ্ত জ্বালানি নেয়া হল। সঙ্গে খাবার। তবে পেঁৗছতে কত দিন লাগবে, কী হবে কারোরই জানা নেই। এ পথে শহুরে মানুষের টানা যাত্রা খুব সম্ভব এটাই প্রথম। তাই সবার ভেতর একটা রোমাঞ্চ।
যোগাড়-যনত্দর শেষ করে রাত বারটার সময় নৌকার কাছে গিয়ে থমকে যেতে হলো। ভাটায় পানি সরে গেছে। ফলে শুকনায় আটকা পড়েছে নৌকা। সুতরাং অপেৰা। এ ফাঁকে সবাই মিলে নুড্লস বানিয়ে খেয়ে নিলাম, কেউ কেউ বিস্কুট। কপালে জুটল মশার কামড়_ ‘ফ্রি’।

২৪ ও ২৫ ডিসেম্বর : স্বপ্নের অভিযান
রাত সাড়ে তিনটায় হালে পানি লাগল। কিন্তু ঠা-ায় ইঞ্জিন জমে গেছে। সেলফ স্টার্টার-এ চালু হলো না। খানিকটা সময় ইঞ্জিনের কারিকুরির পেছনে ব্যয় হল। তবে ইঞ্জিন বশে এল না কিছুতেই। সুতরাং সর্বশেষ উপায় ম্যানুয়াল পদ্ধতি_ হাতলের মাধ্যমে ঘুরিয়ে ইঞ্জিন চালু করা। উহু, ইঞ্জিন এবারও চালু হল না। মাঝি কিশোর_ পারলেন না। কামাল আনোয়ার বাবু_ চেষ্টা করে ব্যর্থ হলেন। তখন ভাবলাম_ দেখি না চেষ্টা করে চালু হয় কি না। এ ভেবে আমি একবার হাতল ঘোরাতেই চালু হয়ে গেল নৌকার ইঞ্জিন। মাঝি হাল ধরলেন। পরে বুঝলাম যে এতৰণ ধরে চেষ্টা করার কারণে ইঞ্জিন গরম হয়ে ছিল। তাই শক্তি দিয়ে একবার ঘোরাতেই ইঞ্জিন চালু হয়েছিল।
বুড়িগঙ্গার কোল ধরে নৌকা এগিয়ে চলে। যান্ত্রিক ঢাকা শহরে তখনও মিটমিট করে জ্বলতে থাকা বাতিগুলোকে বিদায় জানালাম। যে শহুরে অত্যাচারে নদীর ওপর কুয়াশা উধাও হয়ে গিয়েছিল, সদরঘাট পার হতেই কুয়াশার চাদরে জড়ানো ভোর ফিরে এল। তার মধ্যে ছোট্ট নৌকায় নেই পথ নির্দেশক বাতি। অনুমানে ভর করে বাতি ছাড়াই কুয়াশা কেটে সামনের দিকে নৌকা চালাতে লাগলেন কিশোর।
আবারও বিধি বাম। ঘন কুয়াশায় পথ হারিয়ে তুরাগ নদীর দিকে নৌকা যে প্রায় আধঘণ্টা পথ এগিয়ে গেছে_ টের পেলাম ইট-বালু বহন করা নৌকার মাঝিদেরকে জিজ্ঞেস করায়। ফের পথ ভুল হতে পারে_ এ দুশ্চিনত্দায় নৌকা নোঙর করে নদীর মাঝে বসে থাকলাম সকাল সাড়ে দশটা পর্যনত্দ। এ সময় দেখছিলাম বেশ কিছু বার্জ, ইট-বালু বহনকারী নৌকা কত সহজে এদিক-ওদিক চলে যাচ্ছে। যেন সাপের মতো বয়ে চলা নদীর পিঠ তাদের হাতের তালুর মতই পরিচিত। কুয়াশা কেটে যেতে দেখলাম একটা ইটের ভাটার পাশে নৌকা নোঙর করে রাখা হয়েছে।
এগারটার দিকে নৌকা ফের চলতে লাগল। এ সময় কখনো তুলে দেওয়া হল পাল। ১৩ জন যাত্রীর সবাই সবসময় কাজ-কর্মে ব্যস্ত। ফাঁকে ফাঁকে চলত হাসি-ঠাট্টা। দুপুরের পর মুন্সিগঞ্জ পেরিয়ে গোয়ালন্দের আগে মেঘনা নদীতে গিয়ে পড়ল নৌকা। সন্ধ্যার কিছু আগে চর ইদ্রিস, মোহনপুর এবং মেঘনা ও ডাকাতিয়া নদীর মিলনস্থল পার হয়ে চাঁদপুর পুরাতন ঘাটে থামলাম। এখানে বিরতি টানা হল প্রথম দিনের অভিযানের।
এখানে বাড়তি একদিন থাকার পরিকল্পনা। পরদিন ঘাট সংলগ্ন বাজার ঘুরে চাল-ডাল, নুন-তেল, সবজি ইত্যাদি কেনা হল। সবাই মোবাইল ফোনসেট চার্জ করে নিলেন। সারাদিন সব কাজ শেষে এল আরেকটা চমৎকার রাত। নৌকা দুলছে পানির ওপর। আকাশে চাঁদ উঠেছে। কুয়াশা যেন জাঁকিয়ে বসছে নদীর তীর ধরে। সস্নিপিং ব্যাগের মধ্যে ঢুকতেই দুলুনিতে গভীর ঘুমে তলিয়ে গেলাম। বাড়তি পাওনা থাকল পেলব চাঁদের কোমল আলো। সারা রাত জেগে সেই চাঁদ আলো বিলিয়ে গেল।

২৬ ডিসেম্বর : সমুদ্রের ডাক
ভোরের আলো ফোটার কিছুৰণ পরেই সেন্টমার্টিনের উদ্দেশ্যে ফের যাত্রা শুরম্ন হল। ঢাকা থেকে এ যাত্রা শুরম্নর মাত্র কয়েকদিন আগে নৌকায় রং করা হয়েছে। তাই সকালে নৌকার গলুই ধরে এগোতে গিয়ে হাতে ও কাপড়ে তেমন না শুকানো রং লেগে গেল। তাই সাবধানে বসে দেখছিলাম নদীর পারের অধিবাসীদের দিনের শুরম্নতে কর্মচাঞ্চল্য। কেউ মাঠে নিড়ানি দিচ্ছেন তো কেউ গরম্নটাকে ঘাস খাওয়াতে নিয়ে যাচ্ছেন। কেউ কেউ নদীতে এই সাতসকালেই নেমে পড়েছেন গোসল সারতে।
নৌকার গতি ঘণ্টাপ্রতি সর্বোচ্চ ৮ কিলোমিটার। খুব দ্রম্নত বা ধীর_ কোনোটাই নয়। আসলে নৌকার গড়নটাই দ্রম্নত গতিতে চলার পথে বাঁধা। কারণ এটি ছিল জাহাজের ‘লাইফবোট’ ঘরানার। তাকে রূপানত্দর করে ঢাকা-সেন্টমার্টিন দ্বীপ অভিযানে নামানো হয়েছে। তাই বলে পানি কেটে দ্রম্নত এগিয়ে যাওয়ার জন্য নৌকায় যে ধরনের নকশা থাকা প্রয়োজন, তা এতে অনুপস্থিত। সুতরাং মাঝেমধ্যেই আমাদেরকে অতিক্রম করে যাচ্ছিল কিছু মালবাহী নৌকা। আমরা যেমন চারপাশের প্রকৃতি দেখে অবাক হচ্ছিলাম, তেমনি আমাদের নৌকার গড়ন দেখে অবাক হয়েছেন ডাঙা বা পানির বুকে ছুটে চলা সব লোকজন। এমন অদ্ভুত নৌকা তারা আর দেখেছেন কি না সন্দেহ আছে। এসব দৃশ্য স্টিল ও মুভি ক্যামেরার স্মৃতিতে ধরে রাখছিলাম সবাই।
সবকিছুই তার গতিতেই এগোচ্ছিল। হাইমচর পার হয়ে নৌকা লক্ষ্মীপুর জেলায় পেঁৗছাতেই মেঘনা নদীর নাম বদলে গেল। তখন সেটা শাহবাজপুর নদী। এ নদী ধরেই কালুপুরা, হাজারী, চর লরেন্স, চর আলেঙ্ান্ডার, চর গজারিয়া, রামগতি, নলছিড়া পার হয়ে চর শ্রীজনী ও চর শাহবানির মাঝামাঝি পথে নৌকা সন্দীপে পেঁৗছাল। এখানে কেটে গেল নৌ-যাত্রার তৃতীয় দিন।

২৭ ডিসেম্বর : সুনামির ধাক্কা
ভোর সাড়ে চারটার দিকে ঘুম ভেঙ্গে গেল। উঠে দেখলাম কাজী হামিদুল হক নামাজ পড়ছেন। হঠাৎ দেখলাম নদীর ওপর চাঁদ। সেরাত ছিল পূর্ণিমার। নদীর ওপর থালার মতো বিশাল চাঁদ নীরব, নিশ্চুপ, একা। না কোনো মহাজাগতিক বস্তু, না কোনো পৃথিবীবাসী তাকে সঙ্গ দিচ্ছে। নদীর বুকেও কোনো জলযান না থাকায় সেও চাঁদের মৌনতার সঙ্গী। সন্দ্বীপের তীরের যে জায়গাটিতে আমাদের নৌকা নোঙর করা, সেই নদীপাড়ও স্থির। যেন নদীর বুকে পূর্ণিমার সমর্পণ দেখতে সবকিছুই সেই ভোরে ঠায় অপেৰা করছিল।
সন্দ্বীপের যে জায়গাটায় নৌকা নোঙর করা হয়েছিল, তার কোনাকুনিভাবে উত্তরে মাটি, দৰিণে পানি। গাছের ওপর দিয়ে সূর্যোদয়ের হালকা আভাষ পেলাম। আরেকদিকে পানির ওপর পূর্ণিমার চাঁদ ডুবছিল। একেই যেন বলে অপূর্ব মিলন। চাঁদ-সুরম্নজের মিলিত চেষ্টায় রাতের অাঁধার দূর করার এমন মিলিত চেষ্টা আর কবে হয়েছে, সে ইতিহাস জানার ইচ্ছে হল না। ভেবে নিলাম_ এটাই প্রথম, এটাই শেষ। আর একমাত্র সাৰী হয়ে আমি মহাসৌভাগ্যবান। পূর্ণিমার সেই জোৎস্ন্যা আর কোনোদিনও সেভাবে কুর্ণিশ হতে দেখিনি। আহ! অসাধারণ! সব কষ্ট যেন মুহূর্তে ভুলে গেলাম। সকাল হতেই নৌকার ইঞ্জিন চালু হয়ে গেল। এগিয়ে চললাম সেন্টমার্টিনের দিকে।
কিন্তু মাইটভাঙ্গা পার হওয়ার পর শাহবাজপুর নদী ও সাগরের মিলনস্থল_ হাতিয়া চ্যানেলে নদী দুপুরের দিকে হঠাৎ অশানত্দ হয়ে উঠল। এই বিসত্দীর্ণ মোহনায় চারদিকে অথৈ পানি। এখানে নদীতে সবসময় ঢেউ থাকে। ফলে প্রায়ই নৌকা পানিতে তলায়। সেদিন আমাদের নৌকাও টালমাটাল, চঞ্চু যেন আকাশ ছুঁতে চায়_ এমন আচরণ শুরম্ন করল। এটা কি প্রকৃতির ঠাট্টার কারণে মোহনার উন্মত্ততা, না কি অন্য কোনো তান্ডব_ শুরম্নতে কেউই তা বুঝতে পারলাম না। করণীয় কি, সে ব্যাপারেও কেউ নিশ্চিত নয়। তাই একেকজনের গলা আরেকজনকে ছাপিয়ে উঠতে চায়_ ‘সবাই শক্ত করে নৌকা ধরেন’ বা ‘নৌকার ছাদ থেকে নামা উচিত’ অথবা ‘ইঞ্জিন বন্ধ করবো কি?’ ইত্যাদি ইত্যাদি।
সবাই শক্ত হাতে নৌকা ধরে দাঁড়িয়ে রইলাম। কিন্তু নদীর পাগলামি বেড়ে যাওয়ায় সবাই হুড়মুড় করে জড়ো হলাম নৌকার পেছনে। কিন্তু নৌকার মাথা নাহলে পেছনদিক_ একেকবার আছড়াতে লাগল পানির ওপর। এর আগে শুধু টেলিভিশনে বা মুভিতে এরকম ঘটনা ঘটতে দেখেছি। এ ধরনের ঘটনার সঙ্গে সশরীরে পরিচয় এই প্রথম। তবে মুভির চরিত্রগুলো কিভাবে এ ধরনের পরিস্থিতি থেকে উদ্ধার পেয়েছিল, তা মনে পড়ল না। আর কোনো নৌকা থেকে যে কোনো সহায়তা পাব_ সে আশাও নেই। কারণ কাছে-পিঠে কোনো নৌকাই পাওয়া গেল না।
এ অবস্থায় কেউ কেউ লাইফজ্যাকেট গায়ে চড়ালেন। পরিস্থিতির ভয়াবহতায় অস্থির হয়ে পড়লাম। টানা ঘণ্টাখানেক উত্তাল চ্যানেলে এভাবেই নৌকা চলতে থাকল। দিকহারা ঢেউয়ের কারণে নৌকার কোর্স ধরে রাখা কঠিন হয়ে পড়ল।
নৌকা পতেঙ্গা চ্যানেলের কাছাকাছি পেঁৗছানোর পরপরই চোখে পড়ল আরেক অভাবনীয় দৃশ্য। দূর থেকেই দেখছিলাম পতেঙ্গার বহির্নোঙ্গরে থাকা গোটা পঞ্চাশেক সমুদ্রগামী জাহাজ দাঁড়িয়ে আছে। কিন্তু কাছে যেতেই বুঝলাম জাহাজগুলো দাঁড়িয়ে নয়, মিছিলের মতো করে এক সারিতে গভীর সমুদ্রে চলে যাচ্ছে। এতোগুলো জাহাজ একই সঙ্গে গভীর সমুদ্রে যাওয়ার অর্থ তখন স্পষ্ট না হলেও পরিস্থিতি যে সুবিধার নয় তা বেশ বুঝতে পারছিলাম। সবাই বলাবলি করছিলাম, যেকোনো কারণেই হোক সমুদ্রে কোনো সমস্যা হয়েছে। এজন্য এমন উত্তার ঢেউ নৌকায় আছড়ে পড়ছে এবং জাহাজ চলাচলের প্রকৃতিরও স্বাভাবিক নয়।
তবে কেন জানি মনে হচ্ছিল যে, এই অবস্থা সাময়িক। হঠাৎ হয়তো দেখব সবকিছু শানত্দ হয়ে গেছে। আলস্নাহ হয়তো সবার প্রার্থনা শুনলেন। ঢেউ শানত্দ হয়ে এলো_ ঠিক যেভাবে হঠাৎ করে শুরম্ন হয়েছিল। তখন সবাই জোশের সঙ্গে কাজে নেমে পড়লাম। নৌকা ফের পূর্ণ শক্তিতে ছেড়ে দিয়ে পেঁৗছে গেলাম পতেঙ্গা চ্যানেলে।

ভ্রমনে পাওয়া মুখ

ভ্রমনে পাওয়া মুখ

সেই কবে ভ্রমন বিষয়টি আমার বালক বেলায় তার সজ্ঞা বা সচেতনতার ধার না ধেরেই শুরু হয়েছিল সে দিনক্ষণ নির্দিষ্ট করে বলার আজ আর জো নেই। তবে কৈশোরে বাজার ঘুরতে যাওয়া কিংবা কারো ঘাড়ে গর্দানে চড়ে গরুদৌড়ের মাঠে হাজির হওয়ার ভ্রমণ স্মৃতি আজকাল হামেশাই মনে পড়ে। এক অখ্যাত গাঁয়ে নগরদাইর বিলের পাড়ে নয়াবাড়ির বাসিন্দা হিসাবে আশপাশের গাও গেরাম বিল, খাল, বাইদ ভ্রমণ আসলে বিচরণই ছিল ‘ঘর হইতে বাহির’ হওয়ার পয়লা ছবক। আর সে ছবকটি পেয়েছিলাম মূলত বাবার হাত ধরে কখনো বা বাড়ীর বয়সে সাবালক কারো সঙ্গী হয়ে। আর এভাবেই একদিন অবাধ বিচরণ বা ভ্রমণের সুযোগটির জন্য অপেক্ষা করে করে যখন কৈশোর উত্তীর্ণ প্রায় তখন বিদ্যালয় ছেড়ে মহাবিদ্যালয়ের পাঠ নিতে বাবার আগ্রহেই আক্ষরিক অর্থে অবাধ ভ্রমনের সুযোগটি এসে গিয়েছিল। সেই আশির দশকের গোড়ায় সামরিক আইনের জোয়ালটি যখন জাতির ঘাড়ে তখনকার কথা বলছি। ভাওয়াল সন্ন্যাসী রাজা রমেন্দ্র নারায়ন রায় আর স্বভাব কবি গোবিন্দ দাস এর স্মৃতি বিজড়িত জয়দেরপুরই সর্ব অর্থে আমার প্রথম দ্রষ্টব্য ভ্রমণভূমি। রাজবাড়ী, কালি বাড়ী, শিববাড়ী, ছায়াবীথি, জোড় পুকুর, শ্মশান ঘাট, রাজবাড়ী দীঘি, বাজবাড়ী রোডের দেবদারু ছায়ায় কতোই না এলোপাথারি বিচরণ। সেইসব বিচরণ বা ভ্রমণ ক্রমশই বিস্তৃত হয়ে কৃষি গবেষণা, ধান গবেষণা, মেশিন টুলস ফ্যাক্টরী, টাকশাল, সমরাস্ত্র কারখানার আশপাশে শিমুলতলী হয়ে সালনা, কালিয়াকৈর, টঙ্গী পর্যনত্দ বিস্তৃত হয়। কত অচেনা মুখ চেনা হয়ে যায় তখন। কত রাসত্দা-ঘাট, গাছ, পুকুর, রথতলা, রেল স্টেশন আমার ভ্রমণস্মৃতির অংশ হয়ে যায়। রথতলার বট অশ্বথের ছায়ায় যেমন ক্ষনিক তিষ্ঠানো হয়েছে তেমনি লাল মাটির বাওকুড়ানি হাওয়ায় কতবার সাময়িক আটকে দিয়েছে আমার ভ্রমন পথ।

সেসব ভ্রমণ বিনোদন ছিল না, ছিল না ছুটি কাটানো। কেবল কি যেন খুঁজে মরা। আজও খুঁজি। খুঁজতে খুঁজতে একদিন ইউরোপের শক্ত মাটিতে বসত হওয়া আমার। চলতে চলতে এ বিজাতীয় সংস্কৃতির হাওয়া এড়িযে পেছন পানে তাকালে ছাপ্পান্ন হাজার বর্গমাইলের এখানে ওখানে আতি পাতি খুঁজে মরার স্মৃতিগুলি আসন পাতে। কারণে অকারণে সেসব ভ্রমণ বিচরণেই খুঁজে পেয়েছি কত সব ষোল আনা খাঁটি বিষয় আশয়। পথ চলতে চলতেই পাওয়া পথের ইশারা। চলতে চলতেই চোখের দেখায়, বলতে বলতেই মুখের ভাষায় নানা অভিজ্ঞতা জমা হয়। সেসব টুকরো কথা স্মৃতির আদল হয়ে ওড়ে। তাতে আজও মাতাল হই। সেসব সামান্য কথা। সামান্য আয়োজন। সামান্যই রূপালংকার। বাংলার সহজ সরল যাপিত জীবনের সাধারণ্যে নানা মুখই আমার ভ্রমন সেরা সংগ্রহ। পথ চলতি সে সব মুখরাই ভেসে ওঠে পথের মানচিত্রে। সে পথ ধুলো মাখা। সে পথ বাংলার মানচিত্রের। সে মুখ যেন আমাদেরই প্রতিচ্ছবি।

চট্রগ্রাম, ঢাকা, শানত্দিনিকেতনের পথ ঘুরে আপাতত: পাশ দেয়ার পাঠ সাঙ্গ করে ফের ঢাকায় থিতু হওয়ার জোড় প্রচেষ্টা তখন আমার। চারুকলার নবীন শিক্ষকতা আর নয়া সংসার যাপনের চালচিত্রের ব্যসত্দতায় একদিন শিক্ষক শিল্পী সমরজিৎ রায় চৌধুরীর আমন্ত্রণে এক বিকেলে পরিবাগ মার্কেটের দোতলায় অবস্থিত হসত্দশিল্প বাজারজাত কারী প্রতিষ্ঠান কারিকা’য় এক সভায় হাজির হই। ‘ঐতিহ্যবাহী জাতীয় লোক ও কারুশিল্প প্রদর্শনী বাংলাদেশ’ আয়োজনের প্রস্তুতি সভা ছিল সেটি। আলোচনা ক্রমে সেদিন গঠিত কমিটির সদস্য হিসাবে আমিও নির্বাচিত হই। ক্রমেই এ সংক্রানত্দ আলোচনা পরিকল্পনায় অংশ গ্রহণ বাড়তে থাকে। সাড়া দেশ ব্যাপী হসত্দশিল্পজাত সামগ্রীর নমুনা সংগ্রহের প্রসত্দাব অনুমোদিত হয়। কমিটির সর্ব কনিষ্ঠ সদস্য হিসাবে এ জাতীয় ছোটাছুটির বিশেষ দায়িত্ব বর্তায় আমার উপর। আর সে সূত্রে ভ্রমণ বিচরণ সংক্রানত্দ দায়িত্ব পালনে আমার আগ্রহও ছিল সীমাহীন।

ঠিক হল প্রথমে ঢাকার আশপাশে কালিয়াকৈর ও ধামরাই অঞ্চলের মৃৎশিল্পীদের এলাকা ঘুরে নমুনা সংগ্রহ করার। তৎকালীন চারুকলা ইনস্টিটিউটের মৃৎশিল্প বিভাগের শিক্ষক প্রখ্যাত মৃৎশিল্পী মরনচাদ পাল এর সঙ্গী হব আমি। নির্দিষ্ট দিনে স্যারের সাথে সকাল সকালই রওনা হব ঠিক হল। চারুকলার গেটে সাক্ষাত শেষে আমরা রওনা হই কালিয়াকৈরের উদ্দেশ্যে। টঙ্গী হতে বাস বদল করে টাঙ্গাইল গামী বাসে চড়ি আমরা। যাত্রী ভীড়ে আমরা দুজন বিচ্ছিন্ন দুটি আসনে বসি। আমার সহযাত্রীটি শুরু থেকেই কেন জানি আমার আগ্রহের সৃষ্টি করে। তাঁর শীর্ন ছোট খাট দেহ। বয়স আনুমানিক ষাটোর্ধ। ছোট করে ছাটা দাড়ি যার অধিকাংশই পাকা। গায়ে পাঞ্জাবী। পরনে লুঙ্গী।

আমিই প্রথম কথা পাড়ি। চাচা কই যাইবেন? মৃদু স্বরে উত্তর আসে টাঙ্গাইল। বাড়ী টাঙ্গাইল শহরে? উত্তর আসে না, দেলদুয়ার। তারপর চোখ ফেলি জানালা দিয়ে। আমাদের বাস তখন আশুলিয়া পেড়িয়ে চন্দ্রামুখী। এরই মধ্যে বাস ভাড়া দিতে গিয়ে টাকা কিছু কম হওয়ায় কন্টাকটরকে মিনতি করতে দেখেছি সহযাত্রীকে। বয়োবৃদ্ধের চাহনিতে রাজ্যের দুশ্চিনত্দার ছাপ। আমার পাশে তার বসা মোটেই স্বাচ্ছন্দ্য মনে হচ্ছিলনা বোধ করি। কেননা যদি তার আচরণে অসাবধানতায় আমার মত সাহেবী সুরতধারী লোকের পাছে কোন অসুবিধা হয় গোছের। আবার ও আমিই কথা তুলি। ঢাকায় কই গেছিলেন জিজ্ঞেস করতে খুবই সংক্ষিপ্ত ছোট ছোট উত্তরে সব জানান দিচ্ছিলেন। একটি বিখ্যাত কারুপন্য বিপনীর নাম বলাতে আমার উৎসুক্য আরো বেড়ে যায়। কারন জানতে চাইলে আমাকে রীতিমত অবাক করে দিয়ে তার ভাষায় জানালেন তিনি আসলে একজন কর্মকার, মানে কারুশিল্পী। জেনে নিলাম আরো আগ্রহ করে তার কাজের ধরন ও তৎসংক্রানত্দ নানা কথা। স্যার পেছনের সীট থেকে ডেকে বললেন আমরা কালিয়াকৈরের কাছাকাছি চলে এসেছি। ভাবলাম চাচার ঠিকানাটা নিয়ে নেই। আমি খাতা কলম বের করে তার ঠিকানা চাইতেই কাঁদো কাঁদো হয়ে কান্না জড়ানো কন্ঠে বললেন, আমি যেন তাকে এইবারের মত মাফ করে দেই। তার সামান্য আয়ে সংসার চলে। কোন বিপদ হলে ছেলের বউ নাতি না খেয়ে মরবে ইত্যাদি ইত্যাদি। প্রায় আমার পা জাপটে ধরার জোগাড়। আমি তাঁকে আশ্বসত্দ করে বললাম, আমিও তার মতো কারিগর। স্যারকে দেখিয়ে বললাম তিনি আমার ওসত্দাদ। আপনার বাড়ী যাব কাজ দেখতে। ভালমন্দ কথা শুনতে। বেচারা কি বুঝলেন জানিনা এবার তিনি ঠিকানা বললে আমি তা চটপট টুকে নেই, জয়নাল আবদীন খান, গ্রাম- নলুয়া, বটতলা চৌরাসত্দা, দেলদুয়ার, টাঙ্গাইল। পাশে লিখে রাখি অলংকার শিল্পী। ততক্ষনে বাস কালিয়াকৈর স্টপেজে পেঁৗছালে চাচাকে বলি ‘আমারে চিনবেন তো আপনার বাড়ীত গেলে? তিনি সম্মতি দেন। আমার বিদায়ে বৃদ্ধ স্বসত্দি পেয়েছিলেন হয়তো কিন্তু তাঁর সঙ্গে ফের দেখা হবে সে সম্ভাবনার কথা তখন মোটেও ভেবেছিলেন কি?

ভ্রমন পথের এই কুড়িয়ে পাওয়া মুখই আরেকটি ভ্রমনের জন্ম দিয়েছিল তার কিছুদিন পরেই। এবার সে কথাই বলতে চাই। ‘ঐতিহ্যবাহী জাতীয় লোক ও কারুশিল্প প্রদর্শনী বাংলাদেশ’ এর পরবর্তী সভায় এই অলংকার শিল্পীর নাম উত্থাপিত হলে অনুমোদন পাওয়া যায়। পরের দফায় আমি একাই রওনা হই দেলদুয়ার। আমার মূল আগ্রহের বিষয়টি ছিল বংশ পরম্পরয়ায় এ মুসলিম জনগোষ্ঠির কর্মকার পেশা। তারা মূলত ঐতিহ্যবাহী রূপার অলংকার গড়েন। আমার একসময়ের সহপাঠি টাঙ্গাইলের তপেস বসাক কে সঙ্গে নিয়ে দেলদুয়ারে ঠিকানা মত এক পড়নত্দ বিকেলে হাজির হই। অনেক খোঁজাখুঁজির পর এক কিশোরের সহায়তায় পাড়ার এক বাড়ির আঙ্গিনায় তাসের আড্ডায় তাঁকে আবিস্কার করি। বৃদ্ধ বিস্মিত। সেদিনের বাসের সহযাত্রী তার সামনে দাঁড়িয়ে। আমাকে জড়িয়ে ধরেছেন। তার কৃতজ্ঞতার যেন শেষ নেই। দুচালা টিনের ঘরের গাদাগাদি সারির একটিতে গিয়ে বসি। তার হাতে গড়া চাদির অলংকার দেখাতে লাগলেন। আদুল গায়ের নাতিকে কোলে নিয়ে ছেলের বউ ও এসে যোগ দিয়েছে ততক্ষনে। এই অখ্যাত অলংকার শিল্পীর চোখের পর্দায় আর আগের মত দুপুরের আলো ফোটে না। ফলে কাজ আর আগের মত হয় কই বলে অনুতাপ করেন। আমার আর তপেসের আক্ষেপ হয়। পূর্বপুরুষের পেশা পরম্পরয়ায় ছেলেও নাম লিখিয়েছিল। কিন্তু আয় রোজগার ভাল নয়। ছেলে শহরে অন্য কাজের সন্ধান করছে। ভাল দিনের সন্ধান।

পেছনের সেদিনের কথা বললেন। যেদিন খরচ করে ঢাকায় গিয়েও মজুরী ছাড়াই ফেরত আসছিলেন সেদিনের কথা। আমি তাঁর স্কেচ করছি আর চোখে ভাসছিল কারুশিল্পীদের প্রমোট করার নামে ব্যবসায়ীদের ঝা চকচকে চেহারা। আর পক্ষানত্দরে অন্নের সংস্থান করতে না পেরে উঠা এ কারুশিল্পীর মুখ। চারদিকে তাদের অর্থ দৈন্যতা দাত খিঁচিযে আছে যেন। আর তাকে বার বার আড়াল করতে সচেষ্ট তাদের সুন্দর শৈল্পিক নকশার আলো। ততক্ষনে কবুতরের খোপে পায়রার ডাক বেসামাল হয়। আমরাও সব সামলে নিযে ঠিকানা দিয়ে কারুশিল্পী জয়নাল আবদীন কে ‘ঐতিহ্যবাহী জাতীয় লোক ও কারুশিল্প প্রদর্শনী বাংলাদেশ’ এ অংশগ্রহনের আমন্ত্রন জানাই। নমুনা হিসাবে সংগে নেই অলংকার শিল্পী জয়নাল আবদীনের নিজ হাতে গড়া রূপার তাজমহলের লকেট, হাসুলি, আংটি ইত্যাদি।

এই সুদূর প্রবাসে বয়ে আনা খেরো খাতায় ২০০৩ সালের কোন একদিন অাঁকা তাঁর মুখ, আর গয়নার মুখ যেন আলো ছড়ায়। সংগ্রহের হাসুলি মাদুলি দেলদুয়ার এর এক প্রবীন কারুশিল্পীর মুখ হয়ে, বাংলা ভ্রমনের মুখ হয়ে, আমার মায়ের মুখ হয়েই যেন এই প্রবাসে সোনা রঙে চিলিক দিয়ে উঠে।

শফিকুল কবীর চন্দন
মিলান, ইতালী
জানুয়ারি পয়লা সপ্তাহ, ২০০৯ খৃীস্টাব্দ

পবষষ ঢ়য- ০০৩৯ ৩৩৩৬৯ ৩৮১৮৭
ব-সধরষ ংশপযধহফধহ@যড়ঃসধরষ.পড়স
নধমধৎঃরংধহ@মসধরষপড়স
বিন- িি.িংশধনরৎ-ভরনবৎধৎঃ.পড়স

লেখক পরিচিতি

শফিকুল কবীর চন্দন
জন্ম-১৯৬৮, বাংলার বয়ন ঐতিহ্যের প্রাণভূমি নরসিংদিতে।
তন্তুকলা তথা বয়নচিত্র ও তন্তু ভাস্কর্য (ট্যাপেষ্ট্রি ও ফাইবার স্কাল্পচার) বিষয়ে স্নাতকোত্তর করেছেন কলাভবন, বিশ্বভারতী, শান্তিনিকেতন, ভারত থেকে।
২০০৪ সালে আকস্মিক সিদ্ধান্তে ইউরোপে প্রবাস জীবন শুরু করার আগ পর্যন্ত কারুশিল্প বিভাগ, চারুকলা ইনস্টিটিউট, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের খন্ডকালীন প্রভাষক ও বাংলাদেশ গার্হস্থ্য অর্থনীতি কলেজের বয়ন বিষয়ের অতিথি শিক্ষক হিসাবে কর্মরত ছিলেন।

রসময় রাসলীলা প্রত্যক্ষণ

আগামী ১৩ নভেম্বর রাসপূর্ণিমা। বাংলাদেশের বিভিন্ন প্রান্তের কৃষ্ণ, চৈতন্য ও বৈষ্ণবভক্ত মানুষের এই পূর্ণিমা উপলক্ষ্যে বিভিন্নভাবে রাসলীলা উদ্যাপন করে থাকে। রাসলীলা উদ্যাপনের সবচেয়ে সমৃদ্ধ ইতিহাস রয়েছে এদেশের মণিপুরী জনগোষ্ঠীর। রাসপূর্ণিমাকে শরণে রেখে বৃহত্তর পাঠক-ভক্তদের উদ্দেশ্যে অত্র প্রবন্ধটি মুদ্রণ করা হলো।

রসময় রাসলীলা প্রত্যক্ষণ
সাইমন জাকারিয়া

প্রথম কয়েক বছর মৌলভীবাজার জেলার কমলগঞ্জ থানার মাধবপুর গ্রামের জোড়মণ্ডপের মণিপুরি রাস উৎসবে যোগ দিয়ে হয়ে উঠেছিলাম একজন মুগ্ধ আর বিস্মিত দর্শকমাত্র। তবে, সেই বিস্ময় আর মুগ্ধতার আড়ালে লুকিয়ে থাকা বঙ্গীয় লীলার আনন্দ অনুভব করা প্রথম দর্শনে সত্যি দুষ্কর হয়ে পড়ে। তাই কেবলই মুগ্ধতা-বিষ্ময়ে বারবার ঘুরে ঘুরে দেখতে থাকি পাশাপাশি অবস্থান নেওয়া তিন তিনটি মণ্ডপের রাসনৃত্য। প্রথমদিকে মণিপুরী পল্লীর তেমন কারো সাথে পরিচয়ও ছিল না, এক শুভাশিস সিনহা আর তাদের পরিবারের সদস্য এবং কয়েকজন প্রতিবেশী ভিন্ন। পরবর্তীতে অনেকের সাথে ভাব জমে ওঠে, শুভাশিসদের বাড়ি হয়ে ওঠে নিজের আপন বাড়ি। আর মণিপুরীদের গ্রামগুলো যেন হয়ে যায় নিজের গ্রাম। সেই থেকে রাসের আসল রসাস্বাদন আমার পক্ষে একটুখানি সহজ হয়ে দেখা দেয়। বুঝতে পারি রাসলীলা আসলে মানুষের প্রতীকে পরম পুরুষের সঙ্গে প্রকৃতির চিরন্তন লীলা। অন্যদিকে রাসের নাটকীয় গুণসমুহও আমার চোখের সামনে স্পষ্ট হয়ে ওঠে। আর এটা ঘটে কয়েক বছর ধরে অত্যন্ত ঘনিষ্ঠভাবে রাসলীলা পর্যবেক্ষণ করার পর। পরবর্তীতে আরো দুই বছর আদমপুর গ্রামে মৈতৈ মণিপুরিদের রাস পর্যবেক্ষণ করে পুরো মণিপুরি জনগোষ্ঠীর রাসলীলার বৈচিত্র্য আরো স্পষ্টভাবে প্রত্যক্ষ করি। বর্তমান প্রবন্ধটিতে বিষ্ণুপ্রিয়া রাসলীলা ও মৈতৈ রাসলীলার বর্ণনা আলাদা আলাদাভাবে উপস্থাপন করা হলো।

বিষ্ণুপ্রিয়া রাসলীলা
বৃন্দাবনে কী প্রকারে শিশু ভগবান তার গোষ্ঠলীলা সম্ভব করেছিলেন দেখিনি, কিন্তু ঢের দেখা হলো এ দেশের মণিপুরি শিশুদের গোষ্ঠলীলা। কীভাবে, কেমন করে মণিপুরি শিশুরা গোষ্ঠের জন্য সাজে, নাচে, গান করে এবং অভিনয়ে অংশ নেয়, একবারে তার সবটা দেখা সম্ভব নয়। ফলে মণিপুরিদের রাস উৎসব দেখতে বেশ কয়েকবার মৌলভীবাজার জেলার কমলগঞ্জ থানার আদমপুর, মাধবপুর, ঘোড়ামারা প্রভৃতি গ্রামে যেতে হয়েছে। প্রতিবারই আশ্রয় নিয়েছি লালমোহন সিংহের স্নেহের নিচে। এ যাত্রার একদিন আগেই পেঁৗছে গেলাম তার উঠানে, কারণ গোষ্ঠলীলার রাখালদের এবারে আমি একেবারে সকাল থেকেই চোখে চোখে রাখতে চাই। উপরি হিসেবে রাতের উঠানে মণিপুরী ভাষায় নাটকের মহড়া দেখে মনে মনে শুভাশিস সিনহাকে ধন্যবাদ দিই। সে রাতেই এবারের শীতের প্রথম লেপ উঠল গায়ে।
সকালে ধলাই নদীর পাড় ধরে ঘোড়ামারা থেকে হেঁটে রাখালনৃত্যের গোষ্ঠক্ষেত্র মাধবপুর শিববাজার কদমতলায় এসে দেখি কলাগাছের ঘের দিয়ে রাখালনৃত্যের জন্য তিনটি মণ্ডলাকার উঠান তৈরি করে রাখা হয়েছে। প্রতিটি উঠানের কেন্দ্রস্থলে একটি করে কদমগাছ, তাই স্থানটির নাম বলি কদমতলা। আমার সঙ্গী কেউ নেই, আমি একা, হঠাৎ সুমন সিংহের সাথে দেখা। সুমনকে সঙ্গে নিয়ে একজন রাখালের বাড়ি যেতে চাইলাম।
কবিতা লেখার স্বভাব আছে বলে সুমন আমাকে পাত্তা দিয়ে বেশ কিছুদূর উত্তরে হেঁটে ধানক্ষেতের পাশ দিয়ে যে বাড়িতে নিয়ে গেল, দেখি সেটা এবারকার রাসের কৃষ্ণ প্রসেনজিৎ সিংহের বাড়ি। আমি তো অবাক, সুমনকে বললাম_’এটা কি একটু বেশি পাওয়া হয়ে গেল না? যেতে চেয়েছিলাম কৃষ্ণের রাখাল বন্ধুদের বাড়ি, আর তুমি স্বয়ং কৃষ্ণের বাড়ি নিয়ে এলে!’ সুমন মৃদু হাসল।
লক্ষ্মী সিনহার মাংকোলে বা ঘরের বারান্দার রাখাল বা রাখোয়াল সাজানো হচ্ছে প্রশান্ত সিংহকে। আর কৃষ্ণ সাজানো হচ্ছে প্রসেনজিৎ সিংহকে। একে একে তাদের মাথায় দেওয়া হলো ময়ূরের বহুবর্ণ চূড়া, তার নিচে লাল রঙের লেট্রেং, কপনাম, আর মাথার চূড়া থেকে নামিয়ে দেওয়া হয়েছে জোড়াফুল, জুড়া বা চুল, গলায় ফুলদান বা মালা পরিয়ে পাঙপঙ বেঁধে দেওয়া হচ্ছে দুই বাহুতে; এরপর একে একে থাবেরেত, থবল, ঘুঙুর, খাড়ু, আঙটি আর পিছনদারীতে তাদের রাজকীয় ভঙ্গিমায় সাজানো হচ্ছে। তাদের এই সাজ-উদ্যোগ শুরু হয়েছে আরো আগে থেকে, তাদের হাতের নখে মেহেদির রঙ দেখে বুঝতে পারি। সকালে তাদের পায়ে আলতা দেওয়া হয়েছে, হাতের তালুও সূর্যের মতো গোল করে আলতা রাঙানো।
সাজ শেষ হলে কৃষ্ণ মণ্ডপে যাবার আগে হাতে বাঁশি তুলে নেন। তারপর বাড়ির ভেতর উঠানের উত্তর-পুব কোণের ছোট ভিটা-বাঁধানো তুলসী গাছের কাছে গিয়ে তিনি ষাষ্ঠাঙ্গে প্রণাম করেন।
গোষ্ঠের জন্য ঢের বেলা হয়েছে। সূর্য প্রায় কপাল অতিক্রম করতে চাইছে। কৃষ্ণের পায়ে তাই অনেক তাড়া, কৃষ্ণ গোষ্ঠের জন্য বাঁশি হাতে মায়ের হাত ধরে হাঁটছে বেশ দ্রুত। সে দ্রুততায় আমাকে দৌড়ে পথ চলতে হয়। তবুও পিচঢালা পথ দিয়ে শিশুকৃষ্ণের খালি পায়ে হেঁটে পোষাল না, সে উঠে বসল রিকশায়। আমি মনে মনে হাসি, ‘হালের কৃষ্ণ রিকশায় উঠেছে!’ সে হাসির মধ্যে কৃষ্ণ আমাকে ফাঁকি দিয়ে জোড়মণ্ডপে গিয়ে হাজির হয়, আমি পড়ি-মরি করে তার কয়েক মুহূর্ত পরে জোড়মন্দিরে গিয়ে পেঁৗছাই।
জোড়মণ্ডপে গিয়ে কৃষ্ণ তার আসনে গিয়ে বসে। পাশে মৃদঙ্গ-করতাল বাদক এবং মা যশোদারূপী দুজন নারী। এর মধ্যে লক্ষ করা যায়, আরেকজন কৃষ্ণ এসে আমাদের কৃষ্ণের পাশে বসে। এবার পূর্ণ হলো জোড়মণ্ডপের দুজন কৃষ্ণ এবং দুজন যশোদা মায়ের আত্দপ্রকাশ। তার আগে থেকেই বাদ্যকর-গাহকেরা বন্দনায় কৃষ্ণকে ডেকে চলছিল আকুল হয়ে_’এসো হে কানাই এসো। বলি বারে বারে\\’
পুরুষবাদ্যকর গাহকদের এমন রাগালাপ বন্দনার আকুতির মাঝখানে মৃদঙ্গ ও করতাল ভিন্ন একটি তান খুঁজে নিলো এই বন্দনার বাকি কথা_ ‘নন্দেরও নন্দ। কৃপা করে আইসো যত সঙ্গী সঙ্গে। তোমায় ছাড়া কেহ নাই। কাকে ডেকে কাকে পাই
না আসিলে তুমি বিনে কানাই মরণদশা হয়ে যায়\\’
এমন বন্দনাগীতে কোনো কোনো নারী কান্নার আবেগে আসরে ছুটে এসে শিশু কৃষ্ণদ্বয়ের পায়ের কাছে লুটিয়ে পড়ে। আসর থেকে অন্য কেউ এসে তাকে উঠিয়ে ভক্তদের মধ্যে নিয়ে যায়।
এবারে বন্দনাগীত শেষে বাঁশি হাতে দুই-দুইজন করে মোট চারজন সখা এসে কৃষ্ণ ও যশোদার সামনে হাঁটু গেড়ে বসে শিশুদের ভাঙা ভাঙা কণ্ঠে বাদ্যের সঙ্গে বলতে থাকে_’চলো গোষ্ঠে। চলো গো কানাই…।’
তাদের কথায় কৃষ্ণদ্বয় বাদ্যের সঙ্গে সঙ্গেই উত্তর দেয়_ ‘আর যাবো না গোষ্ঠে। মাতার কথার বোল বলে। পিতার কথার বোল বলে। বলি আমি গোষ্ঠে আর যাবো না।’
কৃষ্ণের এ কথার সঙ্গে কৃষ্ণকে গোষ্ঠে নিয়ে যাওয়ার জন্য ডাকতে আসা সখাদের উদ্দেশে এবারে মা যশোদাও গেয়ে ওঠেন_ ‘তোমরা যাও হে। আর গোপাল দিবো না গোষ্ঠে। গোপাল গেলে গোষ্ঠে কানু যাবে তোদের সাথে। কানু বিনে কি করিমুরে। তোমরা যাও হে। কানু বিনে রইমু কেমনে?’
মা যশোদা কৃষ্ণের সখাদের ফিরিয়ে দিতে চাইছে, প্রিয়পুত্র কৃষ্ণকে নিজের কাছে আগলে রাখার জন্য। কিন্তু সখারা তো ফিরতে আসেনি, তারা কৃষ্ণ ছাড়া গোষ্ঠে যাবে কীভাবে? গোষ্ঠের মূল যে স্বয়ং ভগবান কৃষ্ণ। অতএব কৃষ্ণ বিনা কি গোষ্ঠে যাওয়া যায়? সখারা তাই মা যশোদার মিনতিতে পাল্টা গেয়ে উঠল_ ‘শোনো বলি এবার। কানাই বিনা কেমনে যাই। গোষ্ঠে যেতে মোরা সবাই। কানাই সঙ্গে নিতে চাই। গোষ্ঠে কানাই বাঁশি বাজায়। আমরা সবাই ধেনু চরাই। কানাই বিনে গোষ্ঠ কেমনে হয়। কানাই বিনে কেমনে মোরা যাই…!’
সখাদের এমন দাবির প্রতু্যত্তরে মা যশোদা এবারে মাতৃত্বের যুক্তি দেখাতে চাইছেন_ ‘তোরা গোষ্ঠে যাবি যা। যারে সবাই যা। কানুকে আর দেবো না আমি গোষ্ঠে যেতে। মরি মরি বিরহের ভাবনায়। তাই বলি শোনরে সবাই। মায়ের কানু দূরে গেলে। অন্তর কেঁদে মরে। কানুকে তাই দেবো না আর গোষ্ঠে আমি যেতে…।’
এতক্ষণ যশোদা মায়ের সঙ্গে কৃষ্ণসখাদের কথা চলছিল। এবারে কৃষ্ণ কথা বলে উঠল। সখাদের আকুতি আর গোষ্ঠের স্মৃতি এবার তাকে জাগিয়ে দিয়েছে, তাই সে গেয়ে উঠল_ ‘মাগো মা তোর চরণ ধরি। গোষ্ঠে যাইতে বিদায় দে মা জননী
এই মিনতি করি গোষ্ঠে আমি যাবো মাগো। সত্য আমি যাবো শ্রীদাম ও সুধাম সঙ্গে ধেনু চরাবো।’
কৃষ্ণের এমন কথায় মা যশোদা পরম আকুতিতে কান্নার সুরে গেয়ে ওঠেন_ ‘বাছা কী কথা শুনাইলে আমারে। বিনা মেঘে বজ্রা ঘাত হয়েছে অন্তরে। কানাইরে কী কথা শুনাইলে আমারে…\\
মায়ের এমন কান্না মেশানো কথা ও গানের মধ্যে কৃষ্ণের চোখের জল গড়িয়ে পড়ার কথা। তাই সে সময় মা যশোদা কৃষ্ণকে গোষ্ঠে না যাবার পক্ষে পুরাণ কাহিনী থেকে দৃষ্টান্ত টেনে গাইতে শুরু করেন_ ‘না কাইন্দো না কাইন্দো বাপও। পূর্বের কথা করগো স্মরণ। পূর্বে তো দশরথও নামে ছিলেনও রাজন। মাতারও বাক্যে পুত্র পাঠায়ে কানন\\ পুত্র শোকে দশরথও ত্যাজিলও জীবন। রামকে মাতা বনেতে দিয়ে। ওই দশরথও মইলো শোকে। পূর্বের সেই কথা হইলো আমারও মনে \\’
তবুও মায়ের পক্ষে কৃষ্ণকে গৃহে আগলে রাখা সম্ভব হয় না। তাই তিনি কৃষ্ণকে মনের মতো করে সাজিয়ে দিতে থাকেন। এক্ষেত্রে একটি বর্ণনাত্মক গীতের ভেতর দিয়ে বাদ্যযন্ত্রী-গায়কগণ আখ্যানকে গোষ্ঠের দিকে এগিয়ে নিয়ে যান_ ‘ওই কান্দিয়া কান্দিয়া মা রে ওই বেশর সাজাইল। ওই মস্তকে পরাইল চূড়া গলে বনমালা \\ ওই হস্তেতে মোহনও বাঁশি ওই চরণে নূপুরও \\ ওই ললাটেতে পরাই চন্দনও ওই নয়ানে কাজলও \\ ওই শ্রীচরণে পরাইল ওই সোনারও নূপুরও \\ ওই রূপ হেরি রূপ দেখি নাচিতে লাগিল \\ নবীনও কালো কেশে রাঙতা লাগাইল \\
এ পর্যায়ে আসর থেকে বেশ কয়েকজন নারী এসে কৃষ্ণের পায়ের কাছে কান্নায় গড়িয়ে পড়ে। তাদের আবেগ তারা নিজেরাই নিয়ন্ত্রণ করে কাঁদতে কাঁদতে ভক্তদের আসনে ফিরে যায়। মা যশোদা কৃষ্ণের কথায় এবং তার সখাদের দাবিতে শেষ পর্যন্ত কৃষ্ণকে গোষ্ঠে যাওয়ার অনুমতি দেন। এ পর্যায়ে গায়কগণ মাতৃ স্বরূপা দুই নারীর কণ্ঠের সঙ্গে কণ্ঠ মিলিয়ে বাদ্য বাদন ছাড়াই টানা টানা গদ্যে রক্ষমন্ত্র পাঠ করেন। উল্লেখ্য, রক্ষমন্ত্রের মধ্যে এক সময় বাদ্য বাদন ও সুর-গীত শুরু হয়। আর লক্ষ করার বিষয় এক্ষেত্রে গীতটি হয়ে ওঠে আখ্যান বর্ণনামূলক। নিচে রক্ষমন্ত্রের সঙ্গে বর্ণনাত্মক গীতটি উদ্ধৃত করা হলো_ ছিনু মম বল ভাই কানু বাল কানাই পরিচয় \\
এ পর্যায়ে গায়কদের গীতের মধ্যে বাদকগণ তাল প্রয়োগ করেন এবং সে তালের লয় ক্রমাগত বাড়তে থাকে। আর তার মধ্যে কৃষ্ণসহ সকল রাখালের আনন্দনৃত্য শুরু হয়। কেননা, কৃষ্ণকে মা যশোদা গোষ্ঠে যাবার অনুমতি দিয়েছে। রাখালদের আনন্দনৃত্যের মধ্যে মা যশোদা রূপধারিনী সুমধুর স্বরে গেয়ে ওঠেন_ অঞ্চলে ধরি ধরি মাও মাও বলিয়ে। প্রাণ রতন বলিয়ে নবীনও শিশু যেন ঘুরে\\
এমন গীতি-কথার মধ্যে রাখালনৃত্যকরদের মুখে মা যশোদা-রোহিনী মিষ্টান্ন তুলে দেন। এরপর রাখালগণ কৃষ্ণ-বলরামকে সঙ্গে নিয়ে জোড়মণ্ডপ থেকে বেরিয়ে পড়েন গোষ্ঠক্ষেত্রের দিকে।
গোষ্ঠলীলার জন্যে শিববাজার কদমতলার মাঠ আগে থেকে প্রস্তুত ছিল। তিনটি জোড়মণ্ডলের তিনজন কৃষ্ণ ও তিন দল রাখাল আলাদাভাবে ছুটে গিয়ে কদমতলার তিনটি গোষ্ঠক্ষেত্রে গোষ্ঠলীলার নৃত্য শুরু করেন।
তাদের নাচের মধ্যে গোষ্ঠক্ষেত্রে নারদ ঋষির আবির্ভাব ঘটে। তার এক হাতে থাকে পীতলের ঘটি ও জল, অন্য হাতে জপমালা, মুখে থাকে পাটের দাঁড়ি-গোঁফ, গায়ে হরিনামের উত্তরীয়, কাঁধে ভিক্ষার ঝোলা, মাথায় চূড়া এবং গলায় মালা। তিনি মনশিক্ষা গান পরিবেশন করেন। আর তার মনশিক্ষার গান শেষ হতেই রাখালনৃত্যের মধ্যে তরবারি হাতে কালো পোশাকে ভয়ঙ্কর রূপ ধারণ করে গোষ্ঠক্ষেত্রে আসেন কংসের যোদ্ধা তৃণাবর্ত। শুরু হয় কংসের যোদ্ধা তৃণাবর্তের সঙ্গে কৃষ্ণ-বলরামের অস্ত্রযুদ্ধ। অস্ত্রযুদ্ধে কৃষ্ণ ও বলরামের হাতে থাকে তীর-ধনুক আর কংসের যোদ্ধা তৃণাবর্তের হাতে থাকে তরবারি। মৃদঙ্গ ও ঝাঝ বাদ্যের মধ্যে বেশ কিছুক্ষণ অস্ত্রযুদ্ধ চলতে থাকে। বাদ্যের তালে তালে কৃষ্ণ ও বলরামের সঙ্গে কংসের যোদ্ধা তৃণাবর্তের বাহুযুদ্ধ চলতে থাকে। বাহুযুদ্ধেও কৃষ্ণ-বলরামের কাছে কংসের যোদ্ধা তৃণাবর্ত পরাস্ত হন। এভাবেই কংসের যোদ্ধা তৃণাবর্ত কৃষ্ণ-বলরামকে হত্যা করতে এসে শেষপর্যন্ত পরাস্ত হয়ে তাদের চরণে প্রণাম করেন। গোষ্ঠক্ষেত্রে কৃষ্ণ-বলরামকে প্রণাম করে কংসের যোদ্ধা তৃণাবর্ত চলে যেতেই রাখালদের গতিশীল আনন্দ নৃত্য শুরু হয়। তার মধ্যে এবার আসে দইওয়ালা। তিনি এসে রাখালদেরকে দধি-দুগ্ধ খাইয়ে যান। এর পর পরই গোষ্ঠলীলার পূর্ণাঙ্গ রাখালনৃত্য চলতে থাকে।
রাখালনৃত্যের মধ্যে দেখা যায়, রাখালগণ প্রথমে বাম ও ডান পায়ে তাল ঠুকে ঠুকে কদমগাছকে কেন্দ্র করে বৃত্তাকারে নৃত্য পরিবেশন করতে থাকেন। এ ধরনের নৃত্যে পায়ে পায়ে তাল ঠোকার সাথে রাখালদেরকে কোমর থেকে দেহের উপরের অংশ দুই দিকে বাঁকাতে দেখা যায়। এমনভাবে বেশ কিছুক্ষণ নৃত্য করার পর রাখালগণ ভিন্ন প্রকৃতির আরেকটি নৃত্যের সূচনা করেন।
এবার রাখালগণ তাদের এক হাত উন্মুক্ত রেখে অপর হাতটি পরষ্পরের কাঁধে স্থাপন করে সার বেঁধে এঁকে বেঁকে ঘুরে নৃত্য পরিবেশন করেন। এই নৃত্যের মধ্যে মৃদঙ্গের তালের সঙ্গে দেহ তুলে রাখালদেরকে লম্ফ দিতে দেখা যায়।
এ ধরনের রাখালনৃত্যের মধ্যে গোষ্ঠক্ষেত্রে উপস্থিত অনেক ভক্ত মুঠো মুঠো বাতাসা ছুঁড়ে দিয়ে রাখালদের দিকে মুখ করে জোড় হাতে চোখ বন্ধ করে মনে মনে মনষ্কামনা করেন। সাধারণত কম বয়সী নারী ও কিশোরীদেরকেই গোষ্ঠলীলায় বাতাসা ছুঁড়ে দিয়ে মনষ্কামনা করতে দেখা যায়।
কিশোরীদের সেই মনষ্কামনার মধ্যে পাশাপাশি তিনটি কদমতলায় নিরবচ্ছিন্নভাবে সন্ধ্যা পর্যন্ত রাখালনৃত্য চলে। নৃত্যের বিচিত্র বিচিত্র ভঙ্গিমা এবং একই সঙ্গে গোষ্ঠলীলায় সখাগণ সঙ্গে কৃষ্ণ যে প্রকারের লীলায় মগ্ন হয়েছিলেন পুরাণ কাহিনীতে_তা-ই আজও মণিপুরি সমাজে যথারীতি মেনে পালিত হতে দেখে পুরাণ এবং বাস্তবের মধ্যে বিভেদ হারিয়ে ফেলি। আসলে, রসাস্বাদন করি পুরাণকথার বাস্তব দৃশ্যরূপ। কেননা, রাখালনৃত্যের মধ্যেই দেখি কৃষ্ণ-বলরাম কতর্ৃক তৃণাবর্ত নিধন এবং নারদ ঋষি ও দইওয়ালা সঙ্গে কৃষ্ণ-বলরামের নাট্যাভিনয়।
রাখালনৃত্যে সন্ধ্যা হয়ে এলে গোষ্ঠক্ষেত্রে মা যশোদা-রোহিনীর প্রদীপ আরতি শুরু হয় রাখালদেরকে বাড়ি ফিরিয়ে নেবার জন্যে। আর এ আরতিতেই গোষ্ঠলীলায় রাখালনৃত্য শেষ হয়। ঠিক সন্ধ্যায় মা যশোদারূপী একজন নারী একটি কাশার থালায় প্রদীপ জ্বেলে আরতি করতে আসেন গান গাইতে গাইতে_
‘আরতি করে তো নোনদো রানী
ও যে ভানুকও মুখও চায়া
আনন্দে গোপালো মুখ হেরি
আরতি করে তো যশোদা রুহিনী।’
এই গানে মা যশোদার আরতিতে খুশিবাক্য লেগে থাকে, তাতে কৃষ্ণ ও তার যত সখা আরতির আলোয় সন্ধ্যায় মায়ের ঘরে ফিরে যায় নৃত্যের ভঙ্গিমাগুলোকে আস্তে আস্তে দেহের সঙ্গে মিলিয়ে দিয়ে। সন্ধ্যা এ রকমই, সেই তো দিবা আর রাত্রিকে জোড়া লাগায়। রাখাল বালকেরা ছুটে যায় শিবমন্দিরে। তারা সাত বার শিবমন্দির প্রদক্ষিণ করে গোষ্ঠের পূর্ণাঙ্গ আয়োজন সমাপ্ত করে।
এরপর রাত্রি ১২টার দিকে মাধবপুর গ্রামে পাশাপাশি অবস্থানের তিনটি জোড়মণ্ডপে প্রায় একসঙ্গে মণিপুরীদের রাসলীলার মূলপর্বের সূচনা হয়। সূচনাতেই থাকে প্রতিটি মণ্ডপের প্রবেশপথ ঘেঁষে বাদ্যকর ও গায়েন-দোহারদের সম্মিলিত বাদ্যের ঐক্যতান। তারপর থাকে সম্মিলিত কণ্ঠে একটি রাগিনী বা রাগাশ্রিত ভক্তিমূলক গান। যার ঠিক পর পরই শুরু হয় রাসলীলার প্রথম অঙ্ক। প্রথমে থাকে আগমনী। আর এই আগমনীতে একটি কিশোরী নাচের পোশাকে সেজে এসে মণ্ডপ প্রণাম করে নৃত্য শুরু করে। আমার পাশে বসা প্রবীণ ও অভিজ্ঞ মণিপুরী ভাগিন্দ্র সিংহ বললেন_’এই মেয়েটি শ্রীরাধার দূতি বৃন্দা।’ বৃন্দা ততক্ষণে তার দুই হাতে নৃত্যের বহুবিধ ভঙ্গিমা করে চলেছে। তার সে হস্ত-নৃত্যের ভঙ্গিমার মধ্যে রাসলীলার গায়েনবৃন্দ আগমনীর সুরে একটি গান গাইতে থাকেন_
‘জয় বৃন্দাবন চিন্তামণিধাম। সাজি আইলা বৃন্দাদেবী অতি মনোহর। প্রবোধ দিয়া কই হে বৃন্দা শুন বৃক্ষলতা। জাগি রহ আজু কৃষ্ণ আসিবেন হেথা। কাল বিকাল তোরা না কর বিচার। গোবিন্দ সেবার লাগি প্রকাশ সম্ভার\\
বৃন্দাদেবী আইলা জ্বালায়ে দেউতি। রতন প্রদীপ লইয়া জ্বালায়ে মোমের বাতি\\ ধ্রু’
বৃন্দার এমত আগমনী নৃত্য-গীতির মধ্যে মণ্ডপ ঘরে বসা ভক্তেরা তাদের সঙ্গে আনা মিঠাই ছুড়ে মারে মণ্ডপ কেন্দ্রের নৃত্য-কিশোরীর দিকে। কেউ ছুটে গিয়ে সে মিঠাই কুড়িয়ে নিতে থাকে। আর একজন ভক্ত নারী আকুল কান্নায় মণ্ডপে প্রবেশ করে মাটিতে লুটিয়ে ভেউ ভেউ করে কাঁদতে শুরু করে। অন্য একজন এসে কিছুক্ষণ পর তাকে টেনে তুলে নিয়ে যায়। এরমধ্যে বৃন্দার আগমনী গীতি-নৃত্য শেষ হয়। এবারে শুরু হয় বৃন্দার প্রদীপ আরতি।
প্রদীপ আরতিতে বৃন্দা দূতির হাতে ধরা প্রদীপের আলোতে চমৎকার এক ঢেউ খেলে যায়। বৃন্দা সে আলোকের ঢেউ খেলানো নৃত্যে ঘুরতে থাকে মণ্ডপ মধ্যবর্তী ছোট একটি গাছকে কেন্দ্র করে। বৃন্দার হাতে প্রদীপের পাত্র হিসেবে কাশার থালা ব্যবহৃত হয়েছে। থালার উপরে প্রদীপ হিসেবে বিভিন্ন বর্ণের মোমবাতি এবং কাদার উপর লোবানকাঠির মতো বাঁশের কাঠি সংযুক্ত করে তাতে আগুন লাগিয়ে প্রদীপ বানানো হয়েছে। বৃন্দার ধেই ধেই মাত্রার নৃত্যের মধ্যে প্রদীপের শিখাগুলোও স্বমহিমায় নৃত্যরত হয়ে ওঠে গায়েনদের গানের সঙ্গে_
‘আমি কৃষ্ণের প্রেমে কাঙালিনী। বৃন্দাবনে বৃন্দা দুর্ভাগিনী। এ সুখনিশীথে যমুনা পুলিনে। শ্রীরাসমণ্ডলে আমি যুগল চরণ সেবা করিব। যুগল রূপ নেহারিব জীবন সফল করিব। জনমে জনমে জীবনে মরণ। তনুমনপ্রাণ সপিলু চরণ। অন্তে দিও নাথ ঐ রাঙাচরণ। এ দাসিনী ভিক্ষা মাগি শ্রীচরণ।’
এমত গান শেষে প্রদীপের থালা রেখে বৃন্দা এবারে আবার কিছুক্ষণ তার মুক্ত হাতের নৃত্য করে নেয়। এরপর বাম হাতে একটি কাচের স্বচ্ছ গ্লাস তুলে নেয়। গ্লাসের মধ্যে গোলাপী রঙের পানিতে সুগন্ধি দৃশ্যমান। মুহূর্তের মধ্যে দেখা গেল বৃন্দার ডান হাতে একটি পাতা-বাহারের পাতা সমেত ডাল এবং বৃন্দা সেই ডালটিকে নৃত্যের মাঝে সুগন্ধি ছেটানোর কাজে ব্যবহার করতে শুরু করে। মণ্ডপের চারিদিকে ঘুরে ঘুরে সে অপরূপ নৃত্যের ভঙ্গিমায় সুগন্ধি ছেটাতে থাকে পাতাবাহারের বিচিত্রবর্ণের পাতা সমেত শাখা দিয়ে। যেন বৃন্দা এস্থলে অপরূপ এক সুগন্ধিকরী। এরপর সুগন্ধি রেখে বৃন্দার ফুল সংগ্রহ পর্ব। বৃন্দা ফুলের থালা হাতে এবারে যেন নৃত্যের মাঝে ফুল সংগ্রহে বের হয়েছে, সে মণ্ডপের কেন্দ্রে রাখা ফুলগাছ হতে কয়েকটি কাগজের ফুল সংগ্রহ করে। শুধু তা-ই নয়, এবারে বৃন্দা মালা গাঁথবে। তার আগে বৃন্দা ফুলের থালা হাতে কিছুক্ষণ আনন্দ নৃত্য করে নেয়। এক্ষণে সে মণ্ডপ জুড়ে কিছুক্ষণ ঘুরে ঘুরে এই নৃত্য করে নিয়ে এক স্থানে একটুখানি বসে অভিনয়ের মাধ্যমে সত্যি সত্যি মালা গাঁথে। বৃন্দার এমন মালা গাথার মধ্যে গায়েনরা গান গেয়ে চলেন_ ‘তুলি ফুল নানা জাতি। চাম্পা ফুল তুলি আনি। গাথব মালা সারাবেলা।’ এইগানের সঙ্গে মালা গাঁথবার পর বৃন্দা যখন তার হাতে একটি বর্ণিল আসন তুলে নেয়। তখন গায়েনরা গেয়ে ওঠে একটি সহজ সুর_ ‘শ্রীরাসমণ্ডলী শোভা অপূর্ব হইলরে। গন্ধে আমোদিত হইল নানা জাতি ফুলরে\\ সুখে বৃন্দা সজ্জা করে বনমালা\\’
বৃন্দা আসন নিয়ে নৃত্যাভিনয় করে করে এক পর্যায়ে মণ্ডপের একস্থানে আসনটি পেতে দেয় এবং আসনে সুগন্ধি ছিটিয়ে নিজে প্রস্থান করে। রাসের প্রথম অঙ্ক বৃন্দার নৃত্যাভিনয় এখানেই শেষ।
এবারে মণ্ডপে বালকরূপী এককৃষ্ণের আগমন ঘটে। শুরু হয় দ্বিতীয় অঙ্ক। দ্বিতীয় অঙ্কের শুরুতে দেখা যায় কৃষ্ণ আসন করে ঘুমিয়ে আছে। তার একহাতের মুঠোর মধ্যে জরি দিয়ে সজ্জিত একটি বাঁশি। সাজ-সজ্জার দিক দিয়ে আমাদের কৃষ্ণও পিছিয়ে নেই। তার মাথায় ময়ূরের বহুবর্ণ চূড়া, চূড়ার নিচের দিকে লাল রঙের লেট্রেং, কপনাম, শুধু তা-ই নয় মাথার চূড়া থেকে আরো নেমে এসেছে জোড়াফুল, জুড়া বা চুল, গলায় ফুলদান বা মালা। কৃষ্ণের দুই বাহুতে পাঙপঙ বাঁধা; এছাড়া তার আরো আভরণে থাবেরেত, থবল, ঘুঙুর, খাড়ু, আঙটি আর পিছনদারীর রাজকীয় ভঙ্গিমা সব আছে ঠিক ঠিক। ঠিক যেন এই কৃষ্ণ এই কলিতে প্রকৃতপক্ষে সেই সে দ্বাপর থেকেই উঠে এসেছে।
কৃষ্ণের আর ঘুমিয়ে থাকা হয় না সে বাঁশরি হাতে চিন্তা করে_ ‘যাইতাম কি-না যাইতাম।’ তারপর সে উঠে দাঁড়ায় এবং বাঁশরি হাতে তা ব নৃত্য শুরু করে। সাথে সাথে গায়েনদের কণ্ঠের গানও বদলে যায়_ ‘উঠিতে কিশোরী বসিতে কিশোরী। কিশোরী নয়নতারা। কিশোরী ভজন কিশোরী সাধন। কিশোরী গলার মালা\\’
এমন গানের কথার মধ্যে আপনার মনের কথার অনুসন্ধান পেয়ে কৃষ্ণ এবারে নেচে ওঠে। তার নাচের মধ্যে মৃদঙ্গ-করতালে নব আনন্দ জাগে। একসময় কৃষ্ণ তার নৃত্য সাঙ্গ করে বৃন্দার রেখে যাওয়া আসন অধিকার করে। এভাবে কৃষ্ণ আসনে আসীন হলে রাসের দ্বিতীয় অঙ্কের সমাপ্তি হয়।
রাসের তৃতীয় অঙ্ক থাকে রাধা ও তার সখিদের দখলে। আগের অঙ্কে কৃষ্ণ আসনে আসীন হলে সখিগণ দল বেঁধে রাধাকে নিয়ে গীতি-নৃত্যে মণ্ডপে প্রবেশ করে। এটা এক মনোরম দৃশ্য। গায়েনদের সঙ্গে এই অঙ্কে যেন-বা নৃত্যরতা প্রতিটি সখির কণ্ঠেই সুরের গান গীত হতে থাকে। বলা হয়ে থাকে এটি হচ্ছে_’রাধা ও তার সখিদের আগমন গীত।’ এই গীতের মধ্যে অসংখ্য সখির সঙ্গে রাধার নৃত্য-গীত চলতে থাকে দীর্ঘক্ষণ। রাসলীলার পঞ্চাঙ্কের মধ্যে সময় ও রসের হিসেবে সবচেয়ে দীর্ঘস্থায়ী এবং আকর্ষণীয় অঙ্ক হচ্ছে এই রাধা ও তার সখিদের আগমন অঙ্ক। এই অঙ্কে সখিদের এক একটি দল আলাদা আলাদাভাবে এবং শেষ পর্যায়ে একসঙ্গে রাধাকে ঘিরে ধরে নৃত্য-গীত করতে থাকে। রাধাকে ঘিরে তাদের মুখে একাধিক গান গীত হয়। রাধাকে নিয়ে সখিদের মণ্ডপে আগমনের নৃত্যানন্দ দিয়ে রাসের তৃতীয় অঙ্কের সমাপ্তি হয়।
এবারে চতুর্থ অঙ্কে মণ্ডপে আগত সখিগণ রাধাকে কৃষ্ণের সঙ্গে তার সাক্ষাতের কথা বোঝায়। রাধিকার তখন কৃষ্ণের কথায় ব্যাকুলতা প্রকাশ করে এবং সখিদের সঙ্গে কৃষ্ণের উদ্দেশ্য নৃত্যে সম্মুখযাত্রার সূচনা করেন। এই সম্মুখযাত্রায় রাধা যখন কৃষ্ণ বিরহে ব্যাকুল হয়ে দ্রুতপদে যাত্রা শুরু করতে চায়। সখিদের সঙ্গে রাধাকে তাই ব্যাকুলতা পরিহার করে পথে ধীরে চলতে হয়। কিন্তু খুব বেশিক্ষণ তাকে আর কৃষ্ণ ব্যাকুল হয়ে পথ চলতে হয়নি। সখিদের সঙ্গে রাধার ধীরে ধীরে পথ চলতে চলতে সখিদের দলীয় নৃত্যে রাসের চতুর্থ অঙ্ক সমাপ্ত হয়।
এবারে আসে পূর্ণাঙ্গ রাসলীলার শেষ অঙ্ক মানে পঞ্চম অঙ্ক। এই অঙ্কের শুরুতেই রাধা যখন সখি সঙ্গে কৃষ্ণের সামনে এসে দাঁড়ায় তখন কৃষ্ণ তাকে প্রশ্ন করে_’কোন কারণে আইছো বৃন্দাবনে। গভীর-নিঘোর রাতে।’ উত্তরে রাধারাণী লজ্জা পেয়ে যায়। আর সখিগণ রাধার হয়ে কৃষ্ণের কাছে ক্ষমা ভিক্ষা চায়। কৃষ্ণ তাদেরকে ক্ষমা করে দিয়ে প্রসন্ন বদনে এবারে রাধার দিকে দৃষ্টি দেয়। রাধারাণী সে দৃষ্টিতে আনন্দিত হয়ে ওঠে। সঙ্গে সঙ্গে তারা তখন যুগল মূরতিতে প্রকাশ পায়। আর এমন যুগল মূরতিতে রাধা-কৃষ্ণ নিজেরা দু’জনে যেমন আনন্দিত হয়, তেমনি আনন্দিত হয় মিলন সংঘটনের সঙ্গী সখিগণ। তারা আনন্দ নৃত্যে রাধা-কৃষ্ণকে ঘিরে ধরে সম্মিলিতভাবে গীত করে_ ‘জয় যুগল কিশোরী। আরতি করি গাওত ব্রজনারী। এই সেন যুগল আরতি করত। জয় যুগল কিশোরী\\’
এই আনন্দ গীতি-নৃত্যের মধ্যে রাধা-কৃষ্ণ যুগল মূর্তি ধারণ করে। আর আসরের শত শত ভক্ত এসে তাদের পায়ে প্রণাম দিয়ে যেতে থাকে। ততক্ষণে সারারাত্রি সকালের আকাশ পানে তাকিয়ে আলোকে নিজেকে হারাতে শুরু করে এবং সমাপ্ত হয় একটি রাতের পূর্ণাঙ্গ বিষ্ণুপ্রিয়া রাসলীলা।

মৈতৈ রাসলীলা
একই দিন একই রাতে মাধবপুরের কাছেই অবস্থিত আদমপুর গ্রামে অনুষ্ঠিত হয় মৈতৈ রাসলীলা। মৈতৈদের আদমপুর গ্রামে গিয়ে পরিচয় হয় থোঙাম সঞ্জীবের সঙ্গে। তার বাড়িতে গিয়ে দেখি_সুমাঙে বা উঠানে তখন গোপ ভোজনের প্রস্তুতি চলছে। সারা সুমাঙে সার ধরে পেতে দেওয়া হয়েছে লা (কলার পাতা)। তারপর লা’র উপর একে একে সাজিয়ে দেওয়া হলো চাক (ভাত), সিনজু, আমেটপা, নঙঠঙ, খামেন বাজা (বেগুন ভাজা), সাগুলাই (মাসকালাই), মটর থোঙবা, মাঙগম ক্ষীর (পায়েস) ইত্যাদি। এভাবে ভোজনপাত্র লা সাজানো হলে ঘর থেকে লাই লেঙনাঙকপা বা গোপালের মূর্তি বের করে আনা হয়। এরপর হাইরুক পেইসা (ফুল-পয়সা), ইসিঙ তেঙগৎ (পানি পাত্রে পানি) এনে গোপাল মূর্তিকে একটি কাপড়ের উপর রেখে আরতি দেওয়া হয়। এ সময় শ্রীকৃষ্ণের আরতি গান পরিবেশন করা হয়।
গোপ ভোজনের আগে আরতিতে বাজানো হয় বাদ্যযন্ত্র মাঙগঙ (বড় করতাল), কাঙসি (কাসা) ও পুঙ (মৃদঙ্গ)। এইসব বাদ্য বাদন ও আরতি গান পরিবেশনের জন্যে নিমন্ত্রণ করে আনা হয়েছে চিঙথাম নাতেক শিল্পীসমপ্রদায়কে।
দলের ইসাইসাকপা বা মূলগায়ক নাতেক-এর নাম অনুযায়ী এই শিল্পীসমপ্রদায়ের নাম। এই দলের অন্যান্য সদস্যরা হলেন_দোহার (দ্বিতীয় গায়ক) শৈবম সামদেন, খমবাঙতম (তৃতীয় গায়ক) ঙওবি বা নৌবি, পুঙজেইবা (মৃদঙ্গবাদক) চন্দ্রমোহন। এই শিল্পীসমপ্রদায়ের বাদ্য বাদনের মধ্যে আইগা (ঠাকুর) ফুল, জল, আগরবাতি দিয়ে গোপাল বা কৃষ্ণপূজা করেন। পুরো এই পর্বটির নাম আরতি। আরতির সমাপ্তি ঘটে প্রার্থনার ভেতর দিয়ে। এবার বিভিন্ন গ্রাম ও পাড়া আগত রাখালরা লাতে সাজানো ভোজন সামগ্রী ভোজন করেন। তাদের সঙ্গে এই ভোজনপর্বে গ্রামের শিশু, বৃদ্ধ-বৃদ্ধা ও রাখালদের অভিভাবকেরা ভোজনে অংশ নেন। গোপ ভোজনের পুরো দায়ভার বহন করেন গৃহস্বামী থোঙাম ব্রজগোপাল। তিনিই এবার গোপ বালকের ভূমিকায় নৃত্য করেন।
গোপ ভোজন শেষে গৃহস্বামী থোঙাম ব্রজগোপালকে নিয়ে ব্যস্ত হয়ে পড়েন বাড়ির মেয়েরা। তারা তাকে বিচিত্র পোশাকে ও সাজে গোপ বালক কৃষ্ণরূপে সাজাতে থাকেন। প্রথমে তাকে ফাইজম বা ধূতি পরিয়ে দেওয়া হয়। তারপর দুই কাঁধ থেকে বর্ণিল খাওউন নামিয়ে দিয়ে কোণাকুণি করে ধূতির সঙ্গে বেঁধে দেওয়া হয়। শুধু এখানেই শেষ নয়, গোপ বালকের সাজে একে একে তাকে মাঙডা, ঢরা, চূড়া, কোপনাম, লৌট্রেং, পামবমজায়, খুতনাপ, চেগিলেই, চেলেই, নপুর, নাচোম ইত্যাদি পরিয়ে দেওয়া হয়। এই সাজে যখন তিনি পুরোপুরি গোপ বালক হয়ে ওঠেন তখন তার হাতে তুলে দেওয়া বাঁশের বর্ণিল বাঁশরি। আর এভাবে তিনি পূর্ণাঙ্গরূপে গোপ বালক হয়ে উঠলে সাংসারিক জীবনের স্ত্রী এসে তার পা মুছিয়ে দেন। এরপর তিনি বাড়ির ভেতরের উঠানে দাঁড়িয়ে থাকা তুলসীগাছকে প্রণা করে ও ভক্তি জানিয়ে গোষ্ঠক্ষেত্রে রাখালনৃত্য পরিবেশনের জন্যে নয়াপত্তন (সমাঙ লৈকাই) থেকে আদমপুর (মনিঙ লৈকাই)-এর মদনমোহন আখড়া বাড়ির পথে রউনা দেন।
নয়াপত্তন থেকে আদমপুরের পথটি বেশি দীর্ঘ না হলেও ছেলে থোঙাম সঞ্জীব মোটরসাইকেলে করে গোপ বালকরূপী বাবা ব্রজগোপালকে এগিয়ে দেন। গ্রাম পেরিয়ে ধানক্ষেতের ভেতর দিয়ে আকাবাঁকা পথে মোটরসাইলে গোপ বালকের গোষ্ঠলীলার পথযাত্রাকে পদযাত্রা মনে না হলেও মদনমোহন আখড়া বাড়িতে তাকে গোষ্ঠলীলাই করতে দেখা যায়।
দুপুর তিনটার দিকে মদনমোহন আখড়া বাড়িতে রাখাল নৃত্যের আয়োজন শুরু হয়। এসময় নৃত্যস্থানের বাইরে দক্ষিণ পাশে নন্দ মহারাজের ভূমিকায় আমুথই শর্মা নামের এক বয়ষ্ক চেয়ারে বসে থাকেন। তার পাশে রাজার দোহারি সেজে ব্রজধন দাঁড়িয়ে। নৃত্য শুরু আগে দুইজন নারী মা হিসেবে দু’জন রাখালকে নিয়ে মঞ্চে আসেন। আসেন রাম নামের একজন সাধু। এসময় উপস্থিত ভক্তরা চিৎকার দিয়ে বলেন_’হরি বোল হরি বোল।’ শুধু তাই নয়, ভক্তরা মঞ্চে এসে তাঁকে প্রণাম করে তার পায়ের কাছে প্রণামি হিসেবে টাকা রেখে যান।
মুনির ভূমিকায় পাটের অাঁশ দিয়ে মুখে দাঁড়ি-গোঁফ ও মাথায় লম্বাচুলের জটা লাগিয়ে ধূতি পরে হরি নামের উত্তরী গায়ে পেঁচিয়ে মঞ্চে আসেন জয়চন্দ্র শর্মা। হাস্যরসাত্মক অভিনয়ে বালবাসুরের ভূমিকায় হামোম অজিত দর্শকদের হাসিয়ে মারেন। এতসব ঘটনার পর শুরু হয় রাখালনৃত্যের মূল পর্ব।
শুরুতে বাদকদলে বসা পুরুষ গায়কদের একজন উচ্চকণ্ঠে টেনে বাংলা ও মৈতৈ ভাষার মিশেলে বলেন_
‘হেনকালে যশোমতি নন্দরাণী বাসল্য প্রেমেতে লনি হাতকরি গুরি গুরি দাকয়ে সগন।’ তাঁর বর্ণনার পর মা যশোদার ভূমিকা গ্রহণকারী একজন নারী গেয়ে ওঠেন গান_
‘আও গোপাল আও মায়ের কুলে। কোথা লইল নীলমণি। মায়ের হইল চিন্তা মণি। সরলনী দিব মুখে। আইসো আইসো গোপাল। ধনী লনী লইয়া যাও হে। গোপাল তোমার নীলমণি\\ মায়ের কি হিয়া জানে মায়ে হইয়ে চিন্তামণি। গুনি গুনি হৃদয় মাঝে; অন্তরে দাহন করে\\ হেনকালে নারদ গোসাই ব্রহ্মপুর হইতে হস্তেতে দশুর হাতে করি। মুখে হরি নাম সকুতন করি আইল নন্দের ভুবনে।’
মায়ের এই গীতের মধ্যে কৃষ্ণ বলেন_ হাই মুণি গোসাইঝি দরহি গাভি লাদ মারে গা\\
এ সময় নারদ ঋষির আবির্ভাব ঘটে। তিনি এসে সুরে সুরে আসরে ঘুরে মণিগীত পরিবেশন করেন_ হরি বল হরি বল হরি হরি বল রে বল\\ গধু হন তানা মতি রুহিনী নন্দ।
নারদ ঋষির এই গানের মধ্যে কৃষ্ণ চরিত্র তাকে উদ্দেশ্য করে বলেন_ হা হা পিতা মহারাজ প্রাণ রক্ষা করে। গধু হন তানা মতি যশোদা নন্দন নন্দন। (জয় জয় যশোদা নন্দকী)।
এ পর্যায়ে গায়ক রাসধারী গোষ্ঠলীলার আখ্যান বর্ণনা করেন। তার এ বর্ণনার প্রথম অংশ গদ্যের আশ্রয়ে করা হলেও দ্বিতীয় অংশে গীত পরিবেশন করতে দেখা যায়।
কথা ও গানের মধ্যে সিদাম-সুধাম মা যশোদা-রোহিনীর কাছ থেকে কৃষ্ণকে ভিক্ষা নিয়ে গোষ্ঠে চলে যায়। এক্ষেত্রে রাখাল দল বৃত্তাকারে মন্দির প্রদক্ষিণ করে এসে গোষ্ঠে যাবার পথকে বিশ্বাসযোগ্য করে তোলে। আর রাখাল গোষ্ঠক্ষেত্র মনে করে আগের স্থানে ফিরে এসে বৃত্তাকারে যখন নৃত্য করতে থাকে তখন ভক্ত সঙ্গে ঢোল-করতাল-মন্দিরা বাজিয়ে ত্রিশূল হাতে মহাদেব এসে কৃষ্ণ-বলরামকে চিনতে পেরে ষষ্ঠাঙ্গে প্রণাম করে চলে যান।
এরপর গোষ্ঠক্ষেত্রে আবির্ভূত হন কংসের যোদ্ধা তৃণাবর্ত। শুরু হয় তার তাণ্ডব এবং কৃষ্ণের সঙ্গে তার মরণপণ যুদ্ধ। এক সময় যুদ্ধে তৃণাবর্ত পরাস্ত হন।
এ পর্যায়ে দধি-দুগ্ধ-ঘৃত-মধু নিয়ে এক ভক্তের আগমন ঘটে। তিনি এসে সকল রাখালকে সঙ্গের দধি-দুগ্ধ পান করাতেই রাখালদের নৃত্য নতুন গতি খুঁজে পায়। তাদের নাচ এবার আরও অধিক গতিময় ও বৈচিত্র্যময় হয়ে ওঠে।
এর মধ্যে সন্ধ্যা হয়ে আসে। তাই তো মা যশোদা-রোহিনী প্রদীপ জ্বালিয়ে আরতি করে রাখালদেরকে গৃহে আমন্ত্রণ জানান_ ‘অপরাহ্ন কালে শ্রীকৃষ্ণচন্দ্র তার দাদা বলরাম সনে চাহিয়া বলে_দেখ দেখ দাদা হলধর গগনেতে অবসান হইল দিনমণি, সিদাম-সুধাম সব সখাগণ ধবলী-সেওয়ালী-কালি-সুরভি-ধেনু বৎসগণ ফিরাও নিজ নিজ গৃহে চলি যাই।’
এই রাখালনৃত্য পর্বে যারা যন্ত্র ও কণ্ঠ সঙ্গত করেন তারা হলেন_মৃদঙ্গে চন্দ্রমোহন ও নীলধরজ, করতাল ও কণ্ঠে নাতেকসিংহ, সামদেন ও আমুসানা। আর যশোদা ও রোহিনী চরিত্রে রূপ দান করেন খামদি ও বদে।
রাখালনৃত্যের পর মৈতৈ মণিপুরীদের মহারাসের প্রধান আকর্ষণ রাসলীলার মূলপর্বের দিকে যাত্রা শুরু হয়। কিন্তু তখনও রাসলীলার অনেক বাকি। কেননা, গোপ ভোজনের মতো মৈতৈ রাসের ক্ষেত্রে গোপী ভোজনের কৃত্যাচার প্রচলিত আছে। এছাড়া, থাকে নিপা পালার আয়োজন। সবশেষে থাকে রাসলীলা। প্রতিটি কৃত্যাচার যথাযথভাবে পালন করার বিধান আছে। আর তা ঠিকমতো পালিত না হলে রাসলীলা পূর্ণাঙ্গ হয না। এবারে রাসলীলার বিভিন্ন পর্বের বিবরণ যথাক্রমে নিম্নে প্রদান করা হলো।
গোপী ভোজন : সন্ধ্যা সাড়ে সাতটার দিকে মদন মোহন আখড়াতে রাসলীলা পরিবেশনের জন্য নির্বাচিত নারীদেরকে গোপী ভোজন করানো হয়। গোপী ভোজনের শুরুতে থাকে আরতি। এরপর নৃত্য মণ্ডপে কলার পাতা বিছিয়ে তার উপর যথাক্রমে ভাত, ডাল, আলু, চাটনী, পেঁপে, পান-সুপারি, পানির পাত্র ইত্যাদি খাবার সামগ্রী সাজিয়ে দেওয়া হয়। গোপীরা সাধারণ পোশাকে এসে সেই খাবারগুলো সামনে নিয়ে বসেন। এবার নিয়ম অনুযায়ী গোপী ভোজন প্রদানকারী খাবার সামনে নেওয়া গোপীদেরকে খাবার গ্রহণের অনুরোধ করলে গোপীগণ ভোজন শুরু করেন। উল্লেখ্য, এক্ষেত্রে গোপীদের ভোজনের সাথে রাসের জন্যে প্রস্তুত বাদ্যকর-গায়কগণও একই সঙ্গে খাবার গ্রহণ করে নেন।
নিপা পালা : রাত দশটার দিকে শুরু হয় নিপা পালা। এর শুরুতে বাদ্যকর-গায়কগণ গাছমণ্ডল ঘিরে বৃত্তাকারে বসে যেতেই দুইজন পূজারী এসে ফুল, পানি, পান-সুপারি ও পয়সা দিয়ে তাদেরকে বরণ করে নেন। এই বিবরণ পর্বে তারা বাদ্যকর-গায়কদের কাঁধে একটা করে গামছাও তুলে দেন। এরপর তারা বাদ্যকর-গায়কদেরকে নিপা পালা পরিবেশনের জন্য আহ্বান করেন।
তাদের সে আহ্বানের পর পরই শুরু হয় করতাল ও মৃদঙ্গের সম্মিলিত বাদ্য বাদন। কিছুক্ষণ কয়েকটি গানের সুরে ও বাণীতে বাদ্য বাদন শেষ হলে দুইজন নারী এসে নিপা পালা পরিবেশনকারী বাদ্যকর-গায়কদেরকে প্রণাম করেন। অবশ্য, পরে আরো দুইজন নারীকে মঞ্চে আসতে দেখা যায়। এ পর্যায়ে বাদ্য বাদন থেকে মৃদঙ্গ বাদক ছাড়া অন্যান্য বাদকেরা মঞ্চ ত্যাগ করেন।
শুরু হয় মৃদঙ্গ ধ্বনি এবং মৃদঙ্গ বাদকদের নৃত্যের সঙ্গে নারী চতুষ্টয়ের বৈচিত্র্যময় নৃত্য। তাদের নৃত্যে হাতের কারুকাজ এবং পায়ের লম্ফন লক্ষ করা যায়। আর মৃদঙ্গ বাদকদেরকে মাঝে মাঝে নৃত্যের ঘুর্ণন সহযোগে শূন্যে আবর্তিত হতে দেখা যায়।
নিপা পালা পরিবেশনায় মৈতৈ মণিপুরী নারীদের মধ্যে দেবযানী, সানাহাণ্ডি, গন্ধমণি ও মৈরাঙ ইয়াইমতি এবং বাদ্য বাদন ও সঙ্গীতে নৎ সমপ্রদায় সংকীর্তন দলের জয়চন্দ্র শর্মা, সামদেন সিংহ, নিকুঞ্জ সিংহ, ধীরেন, বীরেন, জীতিন্দ্র ও সঞ্জয় অংশ গ্রহণ করে থাকেন।
রাসলীলা : রাসলীলার মূলপর্ব শুরু হয় মধ্যরাতে, অর্থাৎ রাত্রি বারোটার দিকে। শুরুতে বাদ্যকর ও গায়কগণ প্রথমে লীলা-মণ্ডপ প্রণাম করেন। একই সঙ্গে তারা চারদিকে বসা ভক্তদের দিকে ঘুরে ঘুরেও চোখে চোখ রেখে প্রণাম সেরে নেন। সে সময় কৃষ্ণ চরিত্রের জন্যে নির্বাচিত শিশুকে কৃষ্ণ রূপে সাজিয়ে এনে অভিভাবকদের একজন তাকে মণ্ডপে বসিয়ে দেন। এরমধ্যে বৃন্দাদূতি এবং রাধার বেশে আরেকটি নারী শিশু হেঁটে এসে মণ্ডপ প্রাঙ্গণ প্রণাম করেন। আর বাদ্যকরগণ মৃদঙ্গ-করতালে বাদন শুরু করতেই রাধা-কৃষ্ণ রূপী শিশুদ্বয়, রাধাসখী বা কৃষ্ণের গোপীরা এবং আসরে বসা সকল ভক্তমণ্ডলী যে যার অন্তরে বিরাজিত ভগবান কৃষ্ণকে জোড় হাত করে প্রণাম করে নেন।
শুরু হয় রাসলীলার বন্দনাপর্ব। এ পর্বে প্রথমেই থাকে রাসধারী পুরুষ গায়কদের কণ্ঠে রাগালাপ। মৃদঙ্গ ধ্বনির সঙ্গে বেশ কিছুক্ষণ ধরে সেই রাগালাপ চলার পর রাসধারী তিনজন নারী গায়ক আসরে দাঁড়িয়ে বন্দনা পরিবেশন করেন। মৈতৈ মণিপুরীদের রাসের বন্দনাতে সাধারণত শিক্ষাগুরু, দীক্ষাগুরুসহ অপরাপর গুরু ও গুরুজনদেরকে প্রথমে বন্দনা করা হয়। তবে, মৈতৈ মণিপুরী রাসলীলার বন্দনা পরিবেশনের একটি রীতি বিশেষভাবে লক্ষ করা যায়। যেমন_ বন্দনাগীত পরিবেশনে একজন নারী গায়ক কয়েকটি বাক্যে বন্দনাগীতের প্রথম অংশ পরিবেশন করলে গীতের দ্বিতীয় অংশ পরিবেশন করেন দ্বিতীয় নারী গায়ক এবং দ্বিতীয় গায়কের গীত পরিবেশন শেষ হতেই তৃতীয় গায়ক গীতের তৃতীয় অংশ গেয়ে থাকেন। এরপর আবার প্রথম গায়ক বন্দনাগীতের অপর অন্তরার পরিবেশন শুরু করেন এবং পূর্বের নিয়মে অন্যান্য গায়ক সেই অন্তরাটির অপর অংশের গীত সমাপ্ত করেন। বন্দনাপর্বের শেষে নারী গায়ক ত্রয়ী রাধা-কৃষ্ণ লীলা বিষয়ক একটি সম্মিলিত সঙ্গীত পরিবেশন করেন।
এরপর বৃন্দাদূতি সখীগণ সঙ্গে ‘এসো রাধা’ বলে রাধার নামে একটি আগমনী গান পরিবেশন করেন। এক্ষেত্রে আগমনী গীতের সঙ্গে বৃন্দাদূতি প্রদীপ জ্বেলে কৃষ্ণ ও রাধার আগমন কামনা করে থাকেন। শুধু তাই নয়, প্রদীপের প্লেট হাতে বৃন্দাদূতিকে আরতি-নৃত্য পরিবেশন করতে দেখা যায়।
আরতি নৃত্য-গীতির পর বৃন্দাদূতি গ্লাসে রঙিন পানি নিয়ে পাতাবাহারের পাতা সমেত ডাল দিয়ে আসরে কৃষ্ণের আগমন কামনা করে রঙ ছেটাতে থাকেন। এই রঙ ছেটানোর ক্রিয়া একই সঙ্গে সুগন্ধি ছেটানোর অর্থ তৈরি করে। বৃন্দাদূতির নৃত্যাভিনয়ে তাকে ফুলের ডালা হাতে নিয়ে ফুল তোলা ও মালা গাথার আঙ্গিক অভিনয় করতে দেখা যায়। মালা গাথা শেষ হলে বৃন্দাদূতিকে মালা নিয়ে নৃত্য করতে দেখা যায় বেশ কিছুক্ষণ। ততক্ষণে রাসধারীদের কণ্ঠে মালা গাথার গীতি ধ্বনিত হতে থাকে। সবশেষে বৃন্দাদূতি কৃষ্ণের জন্যে আসরে আসন বিছিয়ে দিতে ব্যস্ত হয়ে পড়েন। এক্ষেত্রে তিনি নৃত্য সহযোগে বর্ণিল আসনটি নিয়ে আসর প্রদক্ষিণ করে এক সময় আসরের এক পাশে আসন বিছিয়ে দেন। আসন বিছিয়ে দেবার পর তিনি এবার রঙিন পানি ও ফুলপাত্র হাতে নিয়ে আসনের চারদিকে ফুলচন্দন ও সুগন্ধি ছিটিয়ে দেন। আর এভাবেই ফুলচন্দন ছেটানো ও আসন বিছানোর মধ্যে দিয়ে বৃন্দাদূতির আগমনীগীত সমাপ্ত হয়।
রাসধারী গায়কগণ এবার কৃষ্ণের আগমনী গীত পরিবেশন শুরু করতেই এক শিশু কৃষ্ণকে আরেকটি আসন হাতে আসরে প্রবেশপথে আসতে দেখা যায়। শিশু কৃষ্ণ আসরের প্রবেশপথে তার হাতের আসনটি বিছিয়ে মণ্ডপ প্রণাম করেন এবং আসনে শুয়ে পড়ে নিশি-নিদ্রার মতো একটুখানি অভিনয় করেন। এ সময় গায়কদের গান চলছিল। গানের কথার এ পর্যায়ে কৃষ্ণের জাগরণ প্রসঙ্গ আসতেই শিশু কৃষ্ণ ঘুমভাঙার অভিনয় করে আসনের উপর উঠে বসে এবং গোষ্ঠে যাবার জন্য নূপুর পরার অভিনয় করেন। এরপর বাঁশের বাঁশি হাতে উঠে দাঁড়িয়ে বাদ্য তালের মধ্যে নৃত্য করতে থাকে। বিভিন্ন ধরনের কয়েকটি নৃত্য পরিবেশনের পর বংশিধারী শিশু কৃষ্ণ বৃন্দাদূতির বিছিয়ে যাওয়া আসনে গিয়ে দাঁড়ান। সঙ্গে আসরে উপস্থিত নারী ভক্তগণ উলুধ্বনি দিয়ে ওঠেন। তাদের সে উলুধ্বনির মধ্যে কৃষ্ণ চরিত্র কিছুক্ষণ বাঁশি হাতে আসনে দাঁড়িয়ে থাকেন। এভাবেই বৃন্দার পাতা আসনে কৃষ্ণের অধিষ্ঠান হলে রাধা ও রাধাসখীদের আগমনগীত শুরু হয়।
এক বালিকা রাধা রূপে সঙ্গে বেশ কিছু গোপী নিয়ে আসরে প্রবেশ করেন। এটাকে শ্রীরাধার অভিসার যাত্রা বলা যেতে পারে। বৃত্তাকারে ঘুরে প্রায় বিশজন গোপী যুগলে যুগলে রাধার এই অভিসার যাত্রার ভাব প্রকাশক নৃত্য পরিবেশন করে থাকেন। গোপীগণ বেশ কিছুক্ষণ ধরে নৃত্য পরিবেশন করার পর এক সময় রাধারাণীকে কেন্দ্রে নিয়ে নৃত্য করেন। এ সময় যুগল নৃত্য ভেঙে গিয়ে প্রতি চারজন আলাদা আলাদা দল করে নাচে। এ ধরনের দলীয় নৃত্যের বৈচিত্র্যকে ধারণ করে এই অভিসার নৃত্য শেষ পর্যন্ত রাধারানীকেই সবার সামনে পাওয়া যায়। অবশ্য এক সময় যুগলে যুগলে গোপীরা এসে রাধার সামনে গিয়ে নৃত্য করেন। এ সময় ‘জয় জয় রাধা-গোবিন্দ’ নামে একটি গান পরিবেশিত হতে দেখা যায়। সকল গোপীর যুগলনৃত্য সমাপ্ত হলে আবার রাধাকে সঙ্গে নিয়ে সম্মিলিত নৃত্য চলতে থাকে ‘কৃষ্ণ বিনা চলে না’ গানের সাথে। সম্মিলিত সে নৃত্যে পর গোপীদের মধ্যে চারজন গোপী সাদা রঙের চামর দুলিয়ে রাধাকে ঘিরে নৃত্য পরিবেশন করেন।
এক সময় এই অভিসার-নৃত্যের মধ্যে কৃষ্ণের সঙ্গে রাধার মিলন হয়। তারা যুগলে মুরলি হাতে মণ্ডপে দাঁড়াতেই উলুধ্বনি ওঠে আসরে। গোপীরা এবার যুগলে যুগলে রাধা-কৃষ্ণের সামনে এসে তাদের যুগলমুরতি বন্দনা করেন।
রাধা-কৃষ্ণের মিলন উপলক্ষে গোপী যুগলদের বন্দনাগীত শেষ হলে রাধা-কৃষ্ণকে ঘিরে সখীদের সম্মিলিত নৃত্য শুরু হয়। রাসধারী গায়কগণ গান পরিবেশন করেন_’ঝলমল ঝলমল ঝলমল করে/বাঁশের বাঁশি বাজে সুরে…\\’
রাধা-কৃষ্ণের মিলনের মধ্যে গানের বাণী ছাড়াও কিছুক্ষণ বাদ্য বাদন চলে। এ সময় সবাই হাতে হাত ধরে বৃত্তাকারে মণ্ডপে দাঁড়ান। এক্ষেত্রে রাধা-কৃষ্ণ থাকেন বৃত্তের মাঝখানে। আনন্দধ্বনিমুখর বাদ্য বাদন শেষে গায়কগণ আবার গানের সুর ধরেন_’থামা রাকো থাহো হো। জয় জয় রাধে। এ নয় অভিসার।’ শুরু হয় ধীর লয়ে গোপিনীদের নব নৃত্য।
এবার অভিসারের মধ্যে রাধা শ্রীকৃষ্ণের বাঁশরি চুরি করেন। কৃষ্ণের তো আবার বাঁশি ছাড়া চলে না। তাই তিনি বিনয় করে রাধার কাছে বাঁশি ফেরত চান। রাধা একপর্যায়ে কৃষ্ণকে বাঁশরি ফেরত দেন_’বাঁশরি লেহ লেহ নাগর হে’। এই গানের মধ্যেই রাধা তার প্রাণের পুরুষ কৃষ্ণের বাঁশি ফেরত দিলে কৃষ্ণ আনন্দিত হয়ে নৃত্য করেন।
আবার সম্মিলিত নৃত্য শুরু হয়। এক্ষেত্রে সকল গোপী সঙ্গে রাধা ও কৃষ্ণ বৃত্তাকারে নৃত্য করেন। আর নৃত্য শেষে সকলে বসে হাত দিয়ে মাটি স্পর্শ করতেই যন্ত্রীদল থেকে গান শুরু হয়। সাথে সাথে আরেকটি নাচের পর্ব শুরু হয়। নতুন গানের সুরে যন্ত্রীরা নতুন নাচের জন্যে শিল্পীদেরকে সহযোগিতা করেন। কাঁধে এক হাত রেখে অন্য হাত মুক্ত রেখে যে নৃত্য পরিবেশিত হয়, তাতে মুক্ত হাতের নৃত্য ঘুরে ঘুরে চলতে থাকে। ক্রমাগত এ নাচের গতি ও লয় পরিবর্তন করা হয়। তারপর তিনবার বসে নাচের গতি ও লয় পরিবর্তন করা হয়। দাঁড়িয়ে বৃত্তাকারে ঘুরে হাতের কাজের নৃত্য চলে। বসে হাত দিয়ে নৃত্যের বিচিত্র মুদ্রা করতে করতে শিল্পীরা এক সময় মাটি স্পর্শ করলে গান ও লয় পরিবর্তন করা হয়_নতুন গতি প্রয়োগ হয় নাচে। উল্লেখ্য, মৈতৈ মণিপুরীদের রাসলীলানৃত্যের ধারাবাহিকতার এ পর্যায়ে চারজন নারীকে থালা হাতে থালানৃত্য পরিবেশন করতে দেখা যায়। থালানৃত্যের পর্বটি শেষ হতেই আবার কৃষ্ণলীলার রাসনৃত্য শুরু হয়। এক্ষেত্রে সম্মিলিত নৃত্য পরিবেশন করতে এক সময় রাধা-কৃষ্ণ দল থেকে বের হয়ে যান। এবার শুধু গোপীগণ নৃত্য-গীত করতে থাকেন। এক সময় তারাও মঞ্চ ত্যাগ করেন। এবার রাধার কাছ থেকে কৃষ্ণ চলে যান। এবার রাধার আকুতি শুরু হয়। রাধার সে আকুতি নিয়ে বৃন্দাদূতি একটি গীতিনৃত্য পরিবেশন করেন এবং আরতি দিয়ে রাসলীলা সমাপ্ত করেন।
রাসলীলার আসরে রাধার ভূমিকায় একজন শিশুকে অংশ নিতে দেখা গেলেও অন্যান্য গোপীদের ভূমিকায় কিশোরীদের অংশ নিতে দেখা যায়। আর রাসনৃত্যের প্রথম থেকে শেষ পর্যন্ত অধিকাংশ সময় বাদ্যের সঙ্গে গীত পরিবেশিত হতে দেখা যায়।

রাসলীলার ব্যাখ্যা ও উৎপত্তি সম্পর্কে কিছু তথ্য
রস থেকেই রাস কথাটির উৎপত্তি। আর রসাস্বাদনের জন্য যে ক্রীড়া বা লীলা তা-ই রাসলীলা। এই রাসলীলা সর্বপ্রথম প্রবর্তন করেন স্বয়ং ভগবান শ্রীকৃষ্ণ। সেটি দ্বাপর যুগের ঘটনা এবং তার সংঘটন স্থান ছিল শ্রীব্রজধাম। কিন্তু বর্তমান যুগের ভারত ও বঙ্গে যে রাসলীলা কেন্দ্রিক রাস উৎসব হয়ে আসছে_তার প্রচারক হচ্ছেন প্রখ্যাত মণিপুরী রাজা ভাগ্যচন্দ্র। মণিপুরীদের মাঝে লোক-কথা আছে যে_কয়েক শতাব্দী পূর্বে এই মণিপুরী রাজা ভাগ্যচন্দ্র-ই স্বপ্নাদৃষ্ট হয়ে ভারতের মণিপুরীদের মাঝে নতুনভাবে রাসলীলার প্রচলন শুরু করেন। তৎপরবর্তীতে মনিপুর যুদ্ধের কারণে স্বভূমি থেকে মণিপুরীরা উপমহাদেশের বিভিন্ন অঞ্চলে ছড়িয়ে পড়েন ঠিকই কিন্তু স্বভূমির ধর্ম-সংস্কৃতি ও সাংস্কৃতিক পরিচয় থেকে তারা কখনোই নিজেদেরকে বিচ্ছিন্ন রাখেননি। উপমহাদেশের বিভিন্ন অঞ্চলে অবস্থান নিয়ে মণিপুরীরা তাদের বংশ পরম্পরায় বিভিন্ন ধর্ম-সংস্কৃতি ও সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডের সঙ্গে প্রতিবছর রাসপূর্ণিমার তিথিতে তাদের রাস উৎসব অব্যহত রেখেছেন। উল্লেখ্য, মণিপুরী প্রবীণেরা এই উৎসবকে রাসলীলা বলতেই অধিক পছন্দ করেন।
অষ্টাদশ শতকের প্রথম পাদে বাংলাদেশের সিলেট, মৌলভীবাজার, হবিগঞ্জ ও সুনামগঞ্জ জেলায় বসতি স্থাপনকারী মণিপুরীরা আজ থেকে প্রায় দেড় শতাধিক বছর পূর্বে ১৮৪২ খ্রিস্টাব্দে প্রথম এই দেশে তাদের ধর্ম-সংস্কৃতির প্রধান উৎসব রাসলীলার সূচনা করেন। সেই থেকে দু’একটি ব্যতিক্রম ভিন্ন মৌলভীবাজার জেলার কমলগঞ্জের আদমপুর-মাধবপুরের মণিপুরীরা প্রায় প্রতিবছর নিয়মিতভাবে রাস উৎসব করে আসছেন।
মণিপুরীদের রাসলীলার উৎসবের পোশাক-পরিচ্ছদে, নৃত্যে-গীতে এবং মঞ্চ-অলঙ্করণে যে রাজকীয় গাম্ভীর্য দৃষ্ট হয় তা আমাদের দেশের অন্য কোনো সাংস্কৃতিক পরিবেশনার কোথাও দেখা যায় না। এ দেশের শিকড় পর্যায়ের অন্যান্য সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডকে অনিবার্যভাবেই যেক্ষেত্রে কেবলমাত্র সাধারণের সংস্কৃতি বলে মনে হয়, রাসলীলার উৎসব মণিপুরী জন-সাধারণের একান্ত ধর্মীয় সংস্কৃতি হলেও তাকে রাজদরবারের পরিবেশনা বলেই ভ্রম হয়। আসলে, রাসলীলার প্রচারণ ইতিহাস বা লোক-কথাতেই এমন ভ্রমের উত্তর পাওয়া যাবে। কেননা, লোক-কথায় বলা হয়েছে_আধুনিককালে রাস প্রচলন করেন মণিপুরী রাজা ভাগ্যচন্দ্র আর রাজা ভাগ্যচন্দ্র নিজেও নাকি রাসের পোশাক পরে নেচে ছিলেন। অতএব, রাসের জন্ম হয়েছে রাজদরবারে। কিন্তু তাকে গ্রহণ করে নিয়েছেন সাধারণ মণিপুরী জনগণ। ধর্ম-সাংস্কৃতিক ইতিহাসে এমন ঘটনা খুব কমই ঘটেছে যে, রাজদরবারের বস্তু সাধারণে স্বতঃস্ফূর্তভাবে গ্রহণ করে নিয়েছে। কিন্তু মণিপুরীদের রাসলীলার ক্ষেত্রে এমনটি ঘটেছে। রাসলীলা এখন আর কোনো রাষ্ট্রপ্রধানের সংস্কৃতি হয়ে নেই, তা হয়ে আছে সাধারণের সংস্কৃতি।
মণিপুরী রাসলীলা আজ সাধারণের কৃত্য হলেও এর পোশাক-আশাক ও গীতি-নৃত্য দৃষ্টে মনে হতে থাকে যে_রাজদরবার থেকে উদ্ভূত রাসের প্রাচীন গাম্ভীর্য এখনও বোধ হয় ঠিক ঠিক মণিপুরী রাসে অক্ষুন্ন রয়ে গেছে।

রাসলীলার প্রকারভেদ
মণিপুরী ঐতিহ্যে সাধারণত পাঁচ প্রকার রাসলীলা ও রাসনৃত্য প্রচলিত আছে, যথা_মহারাস, বসন্তরাস, কুঞ্জরাস, দিবারাস ও নিত্যরাস। কার্তিক পূর্ণিমাতে মহারাস অনুষ্ঠিত হয়ে থাকে। এই রাসে ভাগবত পুরাণের রাস-পঞ্চ-অধ্যায় অবলম্বনে কৃষ্ণ অভিসার, রাধা-গোপী অভিসার, মণ্ডল সাজন, গোপীদের রাগালাপ, কৃষ্ণ-রাধা নর্তন, গোপিনীদের নর্তন, রাধা কতর্ৃক কৃষ্ণের বাঁশি চুরি, কৃষ্ণের অন্তর্ধান, রাধা বিরহ ইত্যাদি কয়েকটি পর্বে মহারাস অনুষ্ঠিত হয়ে থাকে। চৈত্রপূর্ণিমাতে বসন্তরাস অনুষ্ঠিত হয়। এই রাসে হোলিখেলা, কৃষ্ণ ও চন্দ্রাবলীর নৃত্য, রাধার ঈর্ষা, ক্রোধ ও প্রস্থান, কৃষ্ণ কতর্ৃক রাধার অনুসন্ধান, ললিতা ও বিশাখাসহ কৃষ্ণের রাধাকুঞ্জে গমন, মানভঞ্জন ইত্যাদি ঘটনা নৃত্যাভিনয়ের মাধ্যমে পরিবেশন করা হয়। আশ্বিনের অষ্টম দিবসে কুঞ্জরাস অনুষ্ঠিত হয়ে থাকে। এই রাসের রাধা, কৃষ্ণ ও গোপিনীদের অভিসার ও কুঞ্জে আগমন অংশ অভিনীত হয়। সাধারণত মধ্যাহ্নকালে দিবারাস অনুষ্ঠিত হয়ে থাকে। আর সারা বছরের যে কোনো সময়েই নিত্যরাস অনুষ্ঠিত হতে পারে। নিত্যরাস অংশে সাধারণত রাধা-কৃষ্ণের অভিসার ও রাসলীলার মূখ্য বিষয় রাধা-কৃষ্ণের মিলন প্রসঙ্গ নৃত্য-গীতাকারে অভিনীত হয়ে থাকে। এছাড়া, বাংলাদেশের বৈষ্ণবপন্থী মণিপুরী জনগোষ্ঠী বিবাহ অনুষ্ঠানেও এক ধরনের রাসলীলা করে থাকেন।

পূণ্যভুমি সিলেটে কয়েকদিন

পূণ্যভুমি সিলেটে কয়েকদিন
আফসানা কিশোয়ার

এ কথা খুবই প্রচলিত আমরা যারা তথাকথিত শহুরে তাদের মাঝে যে নাগরিক জীবন আমাদের প্রায়শঃই ক্লান্ত করে তোলে। তা থেকে সাময়িক মুক্তির জন্যে আমরা ছুটিছাটা পেলেই পরিকল্পনা করি শহর থেকে দূরে কোথাও যাবার। যদিও আমি ব্যক্তিগতভাবে খুব একটা বুঝি না এসব ভ্রমণ আদতেই আমাদের ক্লান্তিহীন করে তোলে কি না। কারণ তিনদিন বা চারদিনের ভ্রমণে দেখা যায় আমাদের অনেক জায়গা দেখার ইচ্ছা থাকে। যেখানে ছুটির দিনে আমরা নয়টা দশটার আগে ঘুম থেকে উঠি না সেখানে বেড়াতে গেলে দেখা যায় ভোর সাতটা থেকে ছোটাছুটি শুরু হয়ে গিয়েছে। আমার এসব যুক্তি শুনে বন্ধুরা বলে উঠে ‘ থাক্ তোর যাওয়ার দরকার নেই’ । আমি তো যাব বন্ধুদের সাথে কয়েকটা দিন থাকার লোভে। হাসিমুখে ওদের বাক্যবাণ মেনে নিয়ে ঠিকই অফিস থেকে তাড়াতাড়ি বের হয়ে মালিবাগ সোহাগ বাস কাউন্টারে পৌঁছে যাই বিকেল চারটার আগেই। আমার পরে বরং অন্য বন্ধুরা আসে।

আমাদের পাঁচজনের গ্রুপটা সবার দৃষ্টি আকর্ষণ করেছে তা আমরা মানুষের তাকানো দেখেই বুঝতে পারি। আমরা সেই বাস কাউন্টারে বসে সমানে খেয়ে যাচ্ছি। একে তো বৃহস্পতিবার, সবার ফুল অফিস কোনমতে পড়িমড়ি করে এসেছি আমরা, তার উপর আমাদের সাথে কোন ছেলে নেই পাঁচজনই বঙ্গনারী। চারটার বাস ছাড়বে পৌনে পাঁচটায়। বসে বসে খাওয়া ছাড়া আর কি করার আছে!

ঢাকা থেকে বের হওয়া

প্রাক্তন অর্থমন্ত্রী সাইফুর রহমানের বদৌলতে সিলেট যাবার রাস্তা বেশ ভালো। এর আগে যখন গিয়েছি তখনই আমি দেখেছি। আমার হিসেবে বড়জোর সাড়ে পাঁচঘণ্টা লাগবে আমাদের খাদিমনগর জাস্টেট রিসোর্ট পর্যন্ত পেঁৗছতে। তিনদিনের ছুটিকে সামনে রেখে মানুষ দলে দলে ঢাকা ত্যাগ করছে। কাঁচপুর পেরোতেই আমাদের সাতটা বেজে গেল। এর মধ্যে মাবরুকা সিঙ্গেল সিটে বসেছে। ঐটা কি যেন বিজনেস ক্লাস না কি সিট যেন। ওকে বিস্কুট আর পানির পাশাপাশি জুসও দেয়া হয়েছে। সেটা নিয়ে কাকলী, তুলি, শাবানা আপু কৃত্রিম ভঙ্গীমায় ক্ষুব্ধ। অথচ খাবারের ব্যাগে মাত্র সাড়ে তিন লিটার ম্যাংগো জুস তাও ন্যাকটারের। মাবরুকা বাসে দেয়া জুস পেয়েই খেয়ে ফেলেছে ছোঁচার মতো, সেটা নিয়ে ওকে বেশ খ্যাপানো হলো। ত্রিশোধর্্ব আমরা সবাই আমাদের বয়স ভুলে তুচ্ছ সব বিষয় নিয়ে আনন্দে মেতে উঠছি টু্যরের আমেজ পেতে।

ভৈরব পর্যন্ত যেতেই সাড়ে আটটা। বাস অল্প কিছুক্ষণের জন্যে উজানভাটি রেস্টুরেন্টে থামলো। আমরা হালকা কিছু খেয়ে আবার বাসে উঠলাম। এদিকে রাত হয়ে যাচ্ছে। আমরা একটু চিন্তিত। মাঝিরঘাটে আমাদের জন্যে মাইক্রো ঠিকঠাকমতো থাকবে কি না তা কনফার্ম করতে আমাদের শাবানা আপু মোটামুটি বীরাঙ্গনা বিক্রমে মোবাইলের উপর ঝাঁপিয়ে পড়লো। ঐদিকে তুলি মোবাইলের উপর হামলে পড়লো আমরা জাস্টেটে পৌঁছে রাতের খাবার পাব কি না সেটা ঠিক রাখতে।

জাস্টেটে গিয়ে আশাভঙ্গ

সুন্দরবন, কিছু অনুভূতি, এবং একটি গল্পো

সুন্দরবন, কিছু অনুভূতি, এবং একটি গল্পো।।
এ.এইচ.এম. আলী রেজা

আচছা, লোকটা কি বাতিকগ্রস্ত নাকি? কেন ? কোন কিছু চিন্তা-ভাবনা না করেই এই যে উনি ঘোষনা দিলেন, আমাদের এই অভিযানে যদি আমরা গোলবনের হাঁস (গধংশবফ ঋরহভড়ড়ঃ) দেখতে পারি তাহলে আমাদের এই পুরো দলের বান্দরবন ভ্রমনের ব্যবস্থা করবে গাইড টুরস। আর যে অভিযাত্রী প্রথম ঐ পাখীটিকে দেখবে তার জন্য দুটো ভ্রমনই একদম ফ্রি। আরে না, উনি কি কোন চিন্তা-ভাবনা ছাড়া এই ঘোষনা দিয়েছেন নাকি গাধা ? আমার তো তাই মনে হচ্ছে। কারনটা তো আমি বুঝতে পারছিনা। একটু বুঝিয়ে বলতে পারবি ? তাহলে শোন, প্রকৃতি প্রেমিক হাসান মনসুর সাহেব বিলুপ্তপ্রায় ঐ গোলবনের হাঁস পাখীটাকে পৃথিবীর বুকে টিকে থাকা নিশ্চিত করতেই ঘোষনাটা দিয়েছেন। এই যেমন ধর ঘোষনার কারনেই কিন্তু আমরা এই জাহাজের প্রায় ৬৫ জন মানুষ পাখিটার বর্তমান অবন্থা স¤পর্কে জানতে পেরেছি। আমাদের মধ্যে খুব অল্প পরিমান হলেও পাখিটাকে পৃথিবীর বুকে তার প্রকৃত আবাসভুমিতে টিকিয়ে রাখার ইচ্ছা জন্মেছে।

এবং …….. কথোপকথোন চলছিল পৃথিবীর বৃহত্তম স্রোতজ বনভুমি সুন্দরবনের সুপতি খালের মধ্যদিয়ে চলমান জাহাজ ‘এম.ভি. অবসর‘ এর একটি কামরায়। আলোচনায় অংশগ্রহনকারীরা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাণিবিদ্যা বিভাগের চতুর্থ বর্ষের কয়েকজন ছাত্র-ছাত্রী। ওরা ছাড়াও জাহাজে আছে একই বর্ষের প্রায় ৬০ জন ছাত্র-ছাত্রী। সপ্তাহব্যাপী এক শিক্ষাসফরে তারা এখন সুন্দরবনের আনাচে কানাচে ঘুরছে। সাথে রয়েছে বিভাগের দলনেতা ছাড়াও বেশ কয়েকজন শিক্ষক-শিক্ষিকা এবং তাদের গাইড সুন্দরবন বাঘ গবেষক জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের এক তরুণ শিক্ষক। শিক্ষার্থীদের সর্বোত্তম সেবা প্রদানের লক্ষ্যে দলের সঙ্গে যোগ দিয়েছেন গাইড টুরস এর ব্যবস্থাপনা পরিচালক জনাব হাসান মনসুর সাহেবের সহধর্মিনী মিসেস তপতী মনসুর। যাত্রার দিন। পূর্বনির্ধারিত সময় বিকাল ৩ টার মধ্যে ছাত্র-ছাত্রীরা বিভাগের সামনে পৌঁছে গেছে। কি যেন এক ভীষণ অস্থিরতায় ছটফট করছে সবাই। স্বপ্নীল সেই বনভূমিতে কখন পৌঁছাবে, অজানা-অনাবিস্কৃত সেই জগতকে কিভাবে দেখবে, কিংবা প্রিয়জন বা প্রিয়স্থান ত্যাগের বেদনায় অবশ হয়ে যাচ্ছে অভিযাত্রীদের তনু-মন। সদরঘাটে অপেক্ষামান এম.ভি. অবসরে পৌঁছতে প্রায় পাঁচটা। জাহাজের আকৃতি, ডিজাইন এবং অন্যান্য সুবিধাদি দেখে সবাই একেবারে মুগ্ধ। এতটা আশা করেনি কেউই। যেন ছোট-খাটো একটা টাইটানিক! সন্ধ্যার ঘনায়মান অন্ধকার নেমে আসার আগেই অবসর, ভেঁপু বাজিয়ে যাত্রা শুরু করল আগামী সাত দিনের স্বপ্নময় অভিযাত্রায়। মাষ্টার ব্রীজ থেকে ইঞ্জিনরূমে পাঠানো টুং টাং শব্দে আপার ডেকে ভীড় করা অভিযাত্রীদের সবাই যেন স্বপনপাড়ের ডাক শুনতে পেল। সহসা তাদের মনে প্রশ্ন জাগল, স্বপ্নলোকের সোনার চাবি কি তারা খুঁজে পাবে? জবাব পেল ভেতর থেকে, ‘নিশ্চয় পাবে‘।

তীব্র এ বিশ্বাস বুকে নিয়ে মোহময় আবেশ জড়িয়ে অভিযাত্রীরা এগিয়ে চলল অজানার উদ্দেশ্যে। সেদিন রাতে আলোচনা হলো পরবর্তী দিনগুলোতে তাদেরকে কি কি করতে হবে এবং কোথায় কোথায় যেতে হবে ইত্যাদি। রাতের খাবার শেষে সবাই ভীড় করল জাহাজের ডেকে। অন্ধকারের বুক চিরে জাহাজের সার্চ লাইট তার পথ খুঁজে নিচ্ছে। দূরে চলমান বা নোঙ্গরকরা যানগুলোর স্তিমিত আলো, জাহাজের গায়ে পানির ছলাৎ ছলাৎ শব্দ, ইঞ্জিনের ধুক ধুক আওয়াজ, বি¯তৃত আকাশে হীরের টুকরোর মত দ্যুতিময় অসংখ্য তারা, মুক্ত বাতাস – এমনই এক মোহময় আবেশ সৃষ্টি করেছে যেন সেটাকে আর জাগতিক কোন বাহন মনে হয়না। এ যেন অনন্ত নক্ষত্র বীথির কোন একটাতে মহাজাগতিক, অপার্থিব কোন এক বাহন। নিয়ে যাবে কোন এক স্বপ্নলোকে। পরেরদিন। ভোরে সবার ঘুম ভাঙলো সূর্যোদয়ের অনেক আগে। জাহাজ চলছে মেঘনা নদী দিয়ে, সোজা দক্ষিণে। ঘুম ভাঙতেই জাহাজের উপরের ডেকে চলে এলো অনেকেই। দেখল বিশাল থালার মত সূর্য পূর্বাকাশে ক্ষণে ক্ষণে তার রূপ বদল করছে। কি দ্রুততায় জ্বলন্ত এই বস্তুটি একটি দিনের আগমন বার্তা জানাচ্ছে। শহরের অপরিকল্পিত এবং অসামসঞ্জস্যপূর্ণ বিল্ডিং আর চুরি হয়ে যাওয়া আকাশে তারা কখনোই এটা প্রত্যক্ষ করেনি বা হয়ত করতে পারেনি। বাকি সারাদিন কেটে গেল ডেকে বসে চারপাশের পরিবেশ আর সেসব বিষয় নিয়ে গল্প করতে করতে। দূরে, বহু দূরে যত, দূর দৃষ্টি যায়; অনন্তকাল যেন ক্লান্তিহীনভাবে সেদিকে তাকিয়ে থাকা যায়। এ যেন স্বর্গের অনুভূতি, কি অপূর্ব, কি অকৃত্রিম। অভিযাত্রীদের মনে কে যেন চুপি চুপি বলে: ভালোবাসি, ভালোবাসি, ভালোবাসি, প্রাণভরে ভালোবাসি টকটকে লাল সূর্য, নীল আকাশ, বসন্তের হাওয়া, ছোট ছোট ঢেউ খেলে যাওয়া এ নদী – তোমাদের সত্যিই খুব ভালোবাসি। সহসা তারা উপলব্ধি করল, এই প্রকৃতি কত প্রানবন্ত, কত বিশ্বস্ত, কত অকৃত্রিম। মানুষের স্বেচ্ছাচারী মনোভাব আর কার্যকলাপে বিপন্ন এই প্রকৃতির কথা ভেবে হাহাকার জাগে তাদের হৃদয়ে।

তারা কাতর মিনতি করে ‘আমাদের কাছ থেকে তোমরা কখনো হারিয়ে যেও না‘। প্রকৃতি যেন কথা বলে ওঠে ‘এই সুন্দর পৃথিবীকে আমরা পর করতে চাই না, কিন্তু তোমাদের অদূরদর্শী আর স্বেচ্ছাচারী কার্যকলাপে আজ আমার প্রাণ ওষ্ঠাগত। জেনে রেখো তোমরা না থাকলেও আমি ভালো থাকব। কিন্তু আমি ভালো না থাকলে তোমরা শান্তিতে থাকতে পারবে না‘। সন্ধা সাড়ে সাতটা। মাস্টার ব্রীজ থেকে ঘোষনা এল ‘জাহাজ সুন্দরবন নামের স্বপ্নময় জগতে প্রবেশ করছে‘। জাহাজ চলছে দক্ষিণ-পূর্ব দিকে। উদ্দেশ্য সুপতি ফরেস্ট অফিস। যেখান থেকে বনে ঢোকার অনুমতি নিতে হবে। রাতের প্রাত্যহিক আলোচনায় সুন্দরবনের পরিচয়, এর ইতিহাস, বাস্তুতন্ত্র, সংরক্ষণ প্রয়োজনীয়তা, ইত্যাদি বিষয়ে বিস্তারিত আলোচনা করলেন তরুণ গবেষক জাবির শিক্ষক, সুন্দরবন যার গবেষণার ক্ষেত্র। মন্ত্র-মুগ্ধের মত সবাই শুনল এবং মনে মনে মিলিয়ে দেখার চেষ্টা করল যা শুনছে এবং যা দেখছে তার মধ্যে সামঞ্জস্য কতটুকু। কি আশ্চর্য ? পুরোটাই মিলে যাচ্ছে। প্রকৃতি এবং প্রাণী নিয়ে গবেষণার সার্থকতা খুজে পেল তারা। রাতের খাওয়া ও আলোচনা শেষে অভিযাত্রীরা আবার চলে গেল জাহাজের খোলা ডেকে। এক অপার্থিব সৌন্দর্যে বুঁদ হয়ে রইল সবাই। ডেকে চিৎ হয়ে শুয়ে আকাশের দিকে তাকিয়ে পলকহীন চোখে চেয়ে রইল কেউ কেউ। জাহাজ চলেছে নদীর বুক চিরে, পানিতে ফেনা তুলে। চারিদিকে দিগন্ত বিস্তৃত মেঘমুক্ত আকাশ। কৃঞ্চপক্ষ রাতের মোহনীয় সৌন্দর্য আপ ুত সবাই। সপ্তর্ষী, কালপুরূষ, ক্যাসিওপিয়া, স্করপিয়ন সহ অসংখ্য নক্ষত্রপুঞ্জের সমন্বয়ে গড়ে ওঠা আকাশ যেন অসংখ্য বিরহীর অশ্রƒজলে সাজানো। শীতের হিমেল হাওয়া আর আকাশের বিশাল বি¯তৃতির পটভুমিতে মাঝে মাঝেই কেঁপে কেঁপে ওঠে অভিযাত্রীদের চঞ্চল তনু-মন। সে এক অসীম অব্যক্ত ভালোলাগা। রাত সাড়ে দশটা। সুপতি ফরেষ্ট অফিস। বনে ঢোকার অনুমতি নিতে দলনেতা এবং জাবির শিক্ষক যাচ্ছিলেন ফরেস্ট অফিসে। উপস্থিত অভিযাত্রীদেরকে জানতে চাওয়া হল, ‘কে কে যাবে‘? অমনি যে যে অবস্থায় ছিল লাফ দিলো ¯িপড বোটে। ছাত্র-ছাত্রীদের কেউ এর আগে কখনো সুন্দরবনে আসেনি, অথচ কারো কোন ভয় বা সংকোচ নেই। হয়ত এরা বিপদের তীব্রতাটাই আঁচ করতে পারেনি অথবা এরাইতো কলম্বাস, স্যাপিলাল, কুক, লিভিং ষ্টোন, ইবনে বতুতা, পার্কো পোলোর উত্তরসুরী। এদের মত মানুষেরাই তো হাতের মুঠোয় মৃত্যু নিয়ে পৃথিবীকে, পৃথিবীর মানুষকে দিয়েছে অসামান্য জ্ঞান কিন্তু নিজেরা হয়েছেন নিঃশেষ। আর তাইতো এদের মতো মানুষের দৃপ্ত পদক্ষেপের কথা ভেবেই কবিগুরু লিখেছেন : আমরা যাব যেখানে কোনো যায় নি নেয়ে সাহস করি। ডুবি যদি তো ডুবি-না কেন। ডুবুক সবি, ডুবুক তরী। প্রথমে ¯িপড বোট, পরে কাঠের নৌকা দিয়ে তারা ফরেস্ট অফিসের জেটিতে পৌঁছল।

প্রথমে অফিসে না গিয়ে, হঠাৎ কি যেন ভেবে গহীন অন্ধকারে রাওনা দিল সবাই। টর্চের অর্পযাপ্ত আলোয় সবার আগে জাবির শিক্ষক, একদম পেছনে একজন ফরেস্ট গার্ড এবং মাঝখানে দলনেতা এবং অন্যান্য অভিযাত্রী। অসাধারণ রোমাঞ্চকর এবং ভয়ঙ্কর অভিযান। ফরেষ্ট গার্ডদের ভাষ্যমতে দুই/তিন দিন আগেও বাঘ এসেছিল এখানে। যে কোন মুহুর্তে পৃথিবীর সবচেয়ে বিষাক্ত রাজগোখরা সাপসহ যে কোন সাপের সাথে দেখা হতে পারে। সামনে পড়তে পারে পৃথিবীর বিখ্যাত শিকারী প্রাণি ’বাংলার বাঘ’। নিকষ কালো বনের মধ্যদিয়ে এগিয়ে যাচ্ছে আট-দশ জনের একটি দল। সুন্দরী ও অন্যান্য স্রোতজ বৃক্ষের শ্বাসমুলের ফাকে পা বাঁচিয়ে নিঃশব্দে হাটা একেবারে সহজ কাজ নয়। অল্পদুর যেতেই হঠাৎ দেখা গেল বাঘের একেবারে টাটকা পায়ের ছাপ। মাত্র কয়েক ঘন্টা আগেই এখানে এসেছিলো আমাদের সবার আকাংখিত ‘বাঘ মামা‘। টর্চ বাহকরা এদিক ওদিক আলো ফেলছে নিজেদের নিরাপত্তার কথা ভেবে। কিন্তু এ বনে মামাকে দেখা কি এতই সহজ যে ’এলাম, দেখলাম এবং চলে গেলাম’। সুন্দরবনে কাজ করে এমন অনেক মানুষ আছেন যারা ২০/২৫ বছর জঙ্গলে থেকেও কখনো মামার মুখোমুখি হননি। দেড়-দুই ঘন্টা পর শেষ হলো নিশি অভিযান। জাহাজে ফিরলো সবাই। এরই মধ্যে অভিযানের কথা রাষ্ট্র হয়ে গেছে। দলের যারা এই নিশি অভিযানে যাওয়ার সুযোগ পায়নি তারা আগে থেকে সিদ্ধান্ত নিয়ে রেখেছে ‘বয়কট করো ওদেরকে‘। মান ভাঙ্গালেন দলনেতা, অনেক কষ্টে। পরবর্তী দিন। অভিযাত্রীদের জন্য অপেক্ষা করছে অভুতপূর্ব সব অভিজ্ঞতা। ঘুম ভেঙে কেবিন ছেড়ে বের হতেই দুই পাশের চোখ জুড়ানো, মন ভুলানো অপূর্ব সবুজ বন-বনানী। ভোর পাঁচটা। রাতের অন্ধকার তখনো কাটেনি। আকাশের দিগন্তরেখা লাল হতে শুরূ করেছে মাত্র। জঙ্গলে তখনো গভীর ঘুম। রাতের অন্ধকার ও হালকা কুয়াশার চাদরে আবৃত সবুজ। মুগ্ধ নয়নে অভিযাত্রীরা তাকিয়ে আছে মায়া মাখানো প্রকৃতির দিকে। মনে মনে ভাবছে নাগরিক জীবনের যান্ত্রিক ব্যস্ততায় আর কখনো হয়ত এমন সকাল তাদের জীবনে আসবে না। কিছুক্ষণের মধ্যেই সবুজের ফাঁকে ফাঁকে সোনালী আলোর ছটা সূর্যোদয়ের বার্তা জানালো। জাহাজের ডেকে দাঁড়ানো মানুষগুলো দু‘চোখে শিশুর সরলতা ও বিস্ময় নিয়ে অবলোকন করছে নব প্রভাতের রাঙা আলো। নদীর সোনালী পানি কেটে, দু‘পাশের নিচ্ছিদ্র সবুজ চিরে এম.ভি. অবসর চলেছে সোজা দক্ষিণে।

এ যেন পাহাড়ী খরস্রোতা নদীর ব্যগ্র হয়ে সাগরের সাথে মিলিত হবার আনন্দে সামনের দিকে ছুটে চলা। এই চলা যেন শুধুমাত্র যাত্রীদেরকে জীবনের শ্রেষ্ঠ অভিজ্ঞতাকে আবিস্কার করার। ভোর ছয়টা। জাহাজ এগিয়ে চলেছে সুন্দরবনের অন্যতম আকর্ষন ‘কটকা‘ জেটির উদ্দেশ্যে। অপেক্ষার প্রহর গুনছে সবাই। কখন নামতে পারবে তাদের সেই অতি প্রিয়, অতি প্রতিক্ষিত জঙ্গলে। ছোট চিকন কটকা খাল। জাহাজ চলছে মন্থর গতিতে। অলস সময়। হটাৎ একটি কালো রঙের অতি সাধারণ পাখি তাদের জাহাজের খুব সামনে দিয়ে উড়ে গেল। পাখিটা কিছুদুর উড়ে গিয়ে খালের ওপারে তীরের খুব কাছাকাছি পানিতে বসল। কেউ কেউ বাইনোকুলার দিয়ে চেনার চেষ্টা করল। পারল না। পরে দলনেতা এবং শিক্ষকদের মাধ্যমে জানা গেল পাখিটির নাম গোলবনের হাঁস, যেটাকে তারা হন্যে হয়ে খুজছে। অমনি শুরু হলো চিৎকার চেঁচামেচি। তাদেরকে শান্ত করলেন তপতী মনসুর। প্রতিশ্র“ত হল বান্দরবন ভ্রমণ। কটকা জেটি। নিঃশব্দে জঙ্গলে নামলো সবাই। এ এক অবর্ণনীয় রোমাঞ্চকর অনুভূতি, জঙ্গলে এত কাছ থেকে প্রকৃতি, বন্য জীবন এবং পশু-পাখি দেখা। পৃথিবীর সবচেয়ে সুন্দর হরিণগুলোর একটা, চিত্রা হরিণ, এই বনের স্থায়ী বাসিন্দা। এই মায়াবতী হরিণের দুষ্টু ও চতুর চাহুনি সবাইকে এই স্রোতজ বনের প্রেমের বাঁধনে আকড়ে ফেলল। সহসা তাদের মনে হল ‘এখান থেকে তারা আর কখনো নগরে ফিরে যাবেনা, কক্ষনো না‘। হরেক রকমের পরিযায়ী এবং স্থানীয় পাখির মনোরম সৌন্দর্য তাদেরকে পাগল করে তুলল। বিশেষজ্ঞদের কাছ থেকে তারা সেগুলোর নাম জেনে নোট বুকে লিখে নিল। ঘন্টা তিনেকের অভিযান শেষে জাহাজে ফিরল সবাই। সকালের নাস্তা ও সামান্য বিশ্রাম নিয়ে আবার বের হল সবাই। গন্তব্য কটকার সমুদ্রপাশের বনাঞ্চল। এখানে তারা এ এলাকার প্রকৃতি পর্যবেক্ষণ এবং কিছু নমুনা সংগ্রহ করবে। ঘন গরাণ আর সুন্দরীর জঙ্গল। গাছের ভিড়ে জঙ্গলের মাটির সাথে সূর্যের সখ্যতা খুবই কম। প্রায় এক থেকে দেড় ফুট লম্বা শ্বাসমুলের ভেতর দিয়ে সতর্কতার সঙ্গে নিঃশব্দে হাটতে হয়। ছন্দপতন হলেই ঝপ্পাস। নতুন হলেও অভিযাত্রীদের বেশীর ভাগ সদস্যই বেশ সাচ্ছন্দে, দ্রুতই এগিয়ে যাচ্ছে। যারা এখানে পুরানো, তাদের হাতে লম্বা লাঠি। এই লাঠি শ্বাসমুলের ভেতর দিয়ে হাটতে খুবই সাহায্য করে। যাই হোক, কটকার জঙ্গলে বাহারী প্রজাপতি অভিযাত্রীদের আনন্দ দেবার জন্যই কখনো তাদের খুব নিকটে এসে আবার দ্রুত দূরে সরে যায়। যেন ছোটদের কানামাছি খেলা। সে এক অপূর্ব পরিবেশ, অকল্পনীয় দৃশ্য। দৃশ্যটা আরো অবর্ণনীয় হয়ে ওঠে যখন জংলী পথ চলতে চলতে হঠাৎ আবিস্কার করল তাদের সামনে বিশাল সমুদ্র – শুধু সমুদ্র নয়, এটাই তো আমাদের বঙ্গোপসাগর। আসলে অভিযাত্রীরা কখনো কল্পনাও করেনি তারা হঠাৎ এতটা সামনে বঙ্গোপসাগরকে দেখবে। আর তাই খুশীর মাত্রাটা ছিল আরো একটু বেশী। হাটতে হাটতে আকস্মিক একটা শব্দ শুনে দুজন অভিযাত্রী দাড়িয়ে সেটা বোঝার চেষ্টা করল। কিছুক্ষন থেমে থেমে আসছে শব্দটা। যদিও তারা কখনো জঙ্গলে বাঘের ডাক শোনেনি, কিন্তু তারপরও এ ডাক তাদের ভুল হবার নয়। হ্যাঁ, এটা মামার ডাক, একটু থেমে থেমে আসছে, এবং তারা যেদিক থেকে এসেছে সেদিক থেকেই। বেশ কিছুক্ষন শোনার পর তারা যখন আবিস্কার করল শব্দটা আস্তে আস্তে তাদের দিকেই আসছে তখন তাদের তো জ্ঞান হারাবার জোগাড়।

ঠিক তখনই উৎঘাটিত হল সত্যিটা, বাঘরূপী প্রাণীটা হল তাদের দলের অন্য আর একজন সদস্য। দলের সদস্যদের সাহসের মাত্রাটা পরীক্ষা করার জন্য এই পরিকল্পনা। এভাবে পুরো একটা দিন তারা বনের সৌন্দর্য এবং বিভিন্ন ধরনের জীব বৈজ্ঞানিক বিষয় বুঝতেই কেটে গেল। দুপুরে খাবার পর্ব শেষ। আবার রওনা হল অভিযাত্রীরা। উদ্দেশ্য সমুদ্র সৈকত। কটকা সৈকতে এসে কেউ কেউ এত খুশী ও উদ্বেলিত হল যে কোনভাবেই তাদেরকে সমুদ্রে নামা থেকে বিরত রাখা গেল না। ছাত্র-ছাত্রীদের স্বাধীনতা থাকায় যারা সমুদ্রে নামতে আগ্রহী না তারা দু‘ভাগে ভাগ হয়ে একভাগ গেল জাবি শিক্ষকের সঙ্গে আমডাহুর গাছের ফল ও ফুলের ছবি তুলতে, অন্য দল থাকল দলের বয়োজষ্ঠ সদস্য এবং তাদের শিক্ষকদের সঙ্গে। তারা কটকা সৈকতে তাদের সুন্দর স্মৃতির সবচেয়ে উপভোগ্য সূর্যাস্তটা কাটাল। মনে মনে ভাবল জীবনে প্রতিটি সূর্যাস্ত যদি এমন হতো। ইস! তাহলে না কত মজাই হত। এমন সুন্দর স্মৃতি নিয়ে সন্ধার পর অভিযাত্রীদের পুরো দলটা জাহাজে ফিরল। রাতে খাবার পর ছাত্র-ছাত্রীরা নিজেদের উদ্যোগে এক ঘন্টার একটি সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান উপহার দিল। স্বল্প সময়ের প্রস্তুুতিতে এত সুন্দর উপভোগ্য অনুষ্ঠান যা দেখে মুগ্ধ না হয়ে পারা যায় না। রাত সাড়ে দশটার দিকে জাবি শিক্ষকের নেতৃত্ব লাইন ধরে টর্চ লাইট হাতে অভিযাত্রীরা রওনা দিল কটকা রেস্ট হাউজের সামনে হরিণ দেখতে। দলের নেতা সবার সামনে গিয়ে উজ্জল টর্চের আলো ফেলল রেস্ট হাউজের সামনে পাতা খেতে আসা হরিণ গুলোর উপর। আহা ! আকাশের মিটিমিটি তারা যেন মাটিতে নেমে এসেছে। মায়াময় আর রহস্যে ঘেরা জঙ্গল আরো বেশী রহস্যময় হয় যখন চোখের সামনে সেই তারার মেলা দ্রুত গতিতে জঙ্গলের ভেতর একে একে হারিয়ে যায়। যেন বুঁদ হয়ে সৌন্দর্য গিলছে সবাই। সে এক অবর্ণনীয় অনুভূতি। এ দৃশ্য উপভোগ করা যায়, বর্ণনা করলে কার্পণ্য হয়। অভিযান শেষে যখন পুরো দল জাহাজে ফিরল তখন ঘড়ির কাটায় মধ্য রাত পার হয়ে গেছে। পরদিন সকাল। জাহাজ চলছে ‘মান্দারবাড়ী‘। যাওয়ার পথে আবার আলোচনা। বিষয় সুন্দরবনের বাঘ ও তার জীবনবৃত্তান্ত। আলোচক জাবির শিক্ষক। চলল দুপুর পর্যন্ত। দুপুর একটা। খোলা লাউঞ্জে দুপুরের খাওয়া চলছে। হঠাৎ যেন কিসের শক্ত একটা ধাক্কা খেয়ে থেমে গেল ‘অবসর‘। জায়গাটা নীল কমলের খুব কাছে হবে। সাধ্যমত চেষ্টার পর অবসরের নাবিক জাহিদ সাহেব জানালেন, ‘আমরা চরে আটকা পড়েছি। পরবর্তী জোয়ার না আসা পর্যন্ত এখানেই থাকতে হবে‘। পাক্কা ছয় ঘন্টা। নিঃসন্দেহে দুঃখজনক খবর। কিন্তু অধিকাংশ সদস্যই এই ঘটনাকে আশীর্বাদ হিসাবে নিল। চারিদিকে অনন্ত সমুদ্র অভিযাত্রীদেরকে এমনই মোহাবিষ্ট করেছিল যে ভবিষ্যতে কি হবে না হবে সে কথা তাদেরকে ভাবিত করেনি। বরং অতি মনোরম প্রাকৃতিক পরিবেশ, ফুরফুরে হওয়া, ঢেউয়ের শব্দ, পাখির কলতান, দূরের আবছা-আবছা বনের প্রান্ত তাদেরকে এতটাই আনন্দিত করেছিল যে সেখানেই তারা তাদের বাকি জীবনটা কাটিয়ে দিতে রাজি। জাহাজ চরে আটকা পড়ায় পূর্বনির্ধারিত পরিকল্পনার কিছুটা পরিবর্তন করতে হলো। কাছেই সমুদ্র সৈকত। সিদ্ধান্ত হলো বিকালটা সেখানেই কাটানো হবে। বিকালে সৈকত অভিযান। বিস্মিত সবাই। মন্তব্য করল ‘এমন সুন্দর সৈকত এর আগে কখনো দেখিনি‘। এখানকার দিগন্ত বিস্তৃত সাগর, তার কোলে অভিযাত্রীদের স্বাগত জানালো ঝিরঝির বাতাস আর ছোট ছোট ঢেউ দিয়ে। পিছনে সুন্দরবন, সামনে মুক্ত অসীম আকাশের ছায়া বুকে নিয়ে বঙ্গোপসাগর। অভিযাত্রীরা সম্মোহিত। তাদের নিষ্পাপ আচরণ, উদ্বেলিত হৃদয়, যেন সাগরকেও ¯পর্শ করেছিল। তাইতো সে মাথায় ফেনার ফুল তুলে, প্রবল কলেবরে ঢেউ হয়ে তাদের পায়ের কাছে লুটিয়ে পড়ছিল। কখনোবা তাদের গায়ে নিজেকে আছড়িয়ে ফেলছিল। এ যেন অবনত ভঙ্গিতে কোন এক দেবতার কাছে তাঁর ভক্তবৃন্দের শ্রদ্ধার্ঘ্য। সৈকতের অভিযান শেষে ফুরফুরে মেজাজে জাহাজে ফিরতে ফিরতে সন্ধ্যা পার হয়ে গেছে। রাতে খাবার দেওয়া হয়েছে লাউঞ্জে। বেশীরভাগ সদস্য খওয়া-দাওয়া শুরু করেছে। হঠাৎ কয়েকজন ছাত্রীর চিৎকারে সচকিত হয়ে উঠল সবাই। অনেকে চিৎকারের উৎসস্থলের সন্ধান করতে ব্যস্ত। একজন ছাত্রী বিশাল একটা প্রজাপতির মতো প্রাণীকে দুই হাতের মাঝের ফাঁকে নিয়ে দৌড় দিচ্ছে জাহাজের নিচতলায় স্থাপিত সাময়িক লাইব্রেরী কক্ষে। উদ্দেশ্য বই-এর ছবির সঙ্গে মিলিয়ে মথটিকে সনাক্ত করা। অনেকক্ষণ ঘাটাঘাটির পর সনাক্ত করা সম্ভব হল। হ্যা, এটি পৃথিবীর বৃহত্তম মথগুলোর একটি, যার নাম ’এটলাস মথ’। সনাক্ত করার পর এটিকে ল্যাবরটরিতে জমা দেবার উদ্দেশ্যে ক্লোরোফর্ম দিয়ে অচেতন করে সংরক্ষণের ব্যবস্থা করা হলো। এর আগেই জাবির শিক্ষক তাঁর ক্যামেরাতে বন্দী করে রাখলেন মথটির বাহ্যিক গঠন ও আকৃতি। এভাবে হাসি আনন্দ আর কৌতুহলে কেটে গেল আরও একটা দিন। পরবর্তী দিন। সূর্য উঠার আগেই জাহাজ পৌছে গেল সুন্দরবনের সবচেয়ে দক্ষিন-পশ্চিমের দ্বীপ ‘মান্দারবাড়ি‘।

অভিজ্ঞদের মতে, জগত বিখ্যাত এই স্রোতজ বনের সবচেয়ে সুন্দর এবং মোহনীয় জায়গা এটি। এখানকার বিশেষত্ব হলো জায়গাটা একদম বন্য, আদি, অকৃত্রিম। জনমানুষের চিহ্ন লাগেনি। বছরের বেশীরভাগ সময় থাকে মানুষ যাতায়াতের অনুপযোগী। শীতকালে যখন নদী খুব শান্ত থাকে তখনই শুধু বেশ কিছু বড় নদী পার হয়ে মান্দারবাড়ী পৌঁছনো সম্ভব। সেখানে পৌঁছামাত্রই সবাই জাহাজ থেকে নেমে সুশৃংখলভাবে সৈকত ধরে হাটা শুরু করল। এখানে বাঘের সংখ্যা মোটামুটি ভালো, কদাচিৎ মানুষখেকোর সন্ধানও পাওয়া যায়। আর তাই এখানে অতিরিক্ত সাবধানতার কথা আগে থেকেই অভিযাত্রীদেরকে জানানো হয়েছিল। সৈকত ধরে হাটতে থাকার সময় অভিযাত্রীরা মেছো বাঘ এবং আরো কিছু ছোট বিড়াল গোত্রীয় প্রাণীর পায়ের ছাপ দেখল। হাটতে হাটতে একসময় সৈকত ছেড়ে অভিযাত্রীরা ঢুকে পড়ল জঙ্গলে। ঘন জঙ্গলে অসংখ্য শ্বাসমুলের মাঝে নিঃশব্দে পা ফেলে এলাকার একমাত্র মিঠা পানির পুকুরের দিকে এগিয়ে চলল সবাই। উদ্দেশ্য ‘যদি মামার দেখা পায়‘। চারপাশে অনেক বড় আর ঘন হুদো বন। দেখলেই সন্দেহ হয়, হয়ত ওখানেই লুকিয়ে আছে মামা। এই হুদো বনগুলো দেখতে এমন যে মামা যদি এর আড়ালে লুকিয়ে থাকে তবে কয়েকফুট দূর থেকেও তাঁকে খুঁজে পাওয়া যাবে না। আর সে কারণেই বাঘ এই হুদো বনের আড়াল থেকে শিকার ধরতেই সবচেয়ে বেশি পছন্দ করে। যে কোন মুহুর্তে অভিযাত্রীদের দল বাঘের শিকার হতে পারে – এমন আশংকা একেবারে উড়িয়ে দেওয়া যায় না। যদিও অস্ত্রধারী ফরেস্ট গার্ড সারাক্ষণই তাদের নিরাপত্তায় ব্যাস্ত। আর তাই, সবাই ভীরু পায়ে, চারপাশে সর্তকদৃষ্টি রেখে এগিয়ে চলছে। একসময় নিরাপদে পুকুর পাড়ে পৌছে গেল সবাই। পুকুর পাড়ে মামার দেখা না মিললেও অসংখ্য নতুন-পুরনো পায়ের ছাপ দেখা গেল। সময় হলো জাহাজে ফেরার। ঘন ঝানা গাছ এবং তার উর্দ্ধমুখী শেকড়ের মধ্যদিয়ে আলো-আঁধারি ঘেরা জঙ্গলে প্রতি মুহুর্তে বাঘের আক্রমনের আশংকায় প্রান হাতের মুঠোয় নিয়ে অভিযাত্রীরা ফেরার পথে এগিয়ে চলছে। জানিনা কখন শেষ হবে এই প্রানান্ত যাত্রা। কিছু বুঝে উঠার আগেই হটাৎ সবাই জঙ্গল থেকে সমুদ্র সৈকতে পৌছল। সবাই জানে সৈকত বিপদমুক্ত এলাকা। সুতারং এখন হাটায় সর্তকতা কম। অভিযাত্রীদের একজন সৈকতে একটি মরা সামুদ্রিক কচ্ছপ আবিস্কার করল। জানা গেল ওটা একটা সামুদ্রিক কাছিম। নাম জলপাইরঙ্গী কাছিম (ঙষরাব জরফষবু ঞঁৎঃষব)। জাবির শিক্ষক জানালেন সমুদ্রে মাছ ধরার জালে ঞঊউ (ঞঁৎঃষব ঊীপষঁফবৎ উবারপব) ব্যবহার না করায় প্রতিবছর এভাবে অসংখ্য সামুদ্রিক কাছিম মারা যাচ্ছে আমাদের সমুদ্রসীমায়। তিনি আরো জানালেন খুব শীঘ্রই ব্যবস্থা না নিলে আমাদের সমুদ্রসীমানায় সামুদ্রিক কাছিম আশংকাজনক হারে কমে যাবে। মান্দারবাড়ীর অভিযান শেষে জাহাজে ফেরা মাত্রই জাহাজ রওনা দিল হিরন পয়েন্টের উদ্দেশ্যে। নামার আগেই কারো কারো মন্তব্য ‘এখানে না এসেই জায়গাটার নাম এত শুনেছি যে এখানে না এলে সুন্দরবন অভিযান পরিপূর্ণ হতনা‘। অল্প সময়ের মধ্যেই জাহাজ হিরন পয়েন্ট পৌছে গেল। কৌতুহলী দল দ্রƒত সেখানে নামল বিস্ময়কর কিছু দেখার আশায়। এমন নামকরা জায়গায় নিশ্চয় কত রোমাঞ্চকর অভিজ্ঞতা অপেক্ষা করছে তাদের জন্য। বিপুল উৎসাহ-উদ্দীপনা নিয়ে তারা তন্ন তন্ন করে ঘুরলো হিরন পয়েন্টের প্রতিটি প্রান্ত। শেষমেশ তারা সুন্দরবনকে ‘বিশ্ব ঐতিহ্য এলাকা‘ হিসাবে ঘোষনার ফলক এবং তাতে মুদ্রিত লেখা পড়ে ব্যর্থ মনে জাহাজে ফিরে এলো। দ্রুত জাহাজে উঠে অভিযাত্রীদের স্থান ত্যাগের তাড়নাই বোঝা গেল জায়গাটার উপর তারা খুব একটা সন্তুষ্ট নয়। হিরন পয়েন্ট থেকে জাহাজ এবার চলছে উত্তর-পশ্চিম বরাবর। এদিকে দুপুরের খাওয়া শেষ করে অভিযাত্রীরা জাহাজের উপরের ডেকে উচ্চ কন্ঠে গানের জমজমাট আসর বসিয়েছে। তাদের আলোচনায় বোঝা গেল পরবর্তী গন্তব্য ‘দুবলার চর‘ নিয়ে তারা বেশ আশাবাদী। গান শেষ হতে না হতেই জাহাজ পৌছে গেল নির্দিষ্ট গন্তব্যে। দুবলার জেটিতে জাহাজ ভেড়ানোর সঙ্গে সঙ্গে নেমে পড়ল সবাই। তাদেরকে আগে থেকেই এখানকার শুটকি মাছের দুর্গন্ধ স¤পর্কে একটা ধারনা দেওয়া হয়েছিল। আর তাই কাউকে কাউকে দেখা গেল রুমাল বা খন্ড কাপড় দিয়ে তৈরী বিশেষ ধরনের মাস্ক ব্যবহার করতে। জেলে পল ীতে গিয়ে অভিযাত্রীরা কিছুটা বিস্মিত হলো। শুটকির প্রাচুর্যতা খুবই কম যদিও দেশে প্রস্তুতকৃত শুটকির একটা বড় অংশই আসে দুবলা থেকে। চরের জেলে-মহাজনদের সাথে আলোচনায় বোঝা গেল এ মৌসুমের অধিকাংশ শুটকি আগেই বাজারজাত করা হয়ে গেছে।

অভিযাত্রীদের মাঝে যারা মাৎস্যবিদ্যায় আগ্রহী তাদেরকে দেখা গেল জেলেদের সঙ্গে কথা বলতে। তাদের জীবনযাত্রা, পারিবারিক ও প্রাত্যহিক জীবন, শুটকি তৈরীর প্রক্রিয়া, বাজারজাতকরণ, ইত্যাদি বিষয় ছিল ক্ষুদে জ্ঞান পিপাসুদের জানার বিষয়বস্তু। শুটকির পরিমান কম থাকলেও তাদের শিক্ষকদের ইচ্ছায় এবং জেলেদের আন্তরিকতায় দলের সদস্যরা প্রায় ২০/২৫ রকমের শুটকির নমুনা সংগ্রহ করতে পারলো। প্রায় দু‘ঘন্টার অভিযান শেষে ফেরার পথে তারা জবা জাতীয় গাছ দেখতে পেল। গাছটিতে একই ডালে দু‘রঙের ফুল দেখে বিস্মিত সবাই। জানা গেল এটি বাগানে চাষ করা জবা ফুলের বন্য প্রজাতি। এলাকার লোকেরা একে বোলা বা ভোলা নামে ডাকে। অভিযান শেষে জাহাজ রওনা দিতে দিতে সূর্য পশ্চিম আকাশে ঢলে পড়েছে। পরিকল্পনা অনুযায়ী সন্ধ্যা এবং পরবর্তী রাতটা কাটানো হবে কচিখালি ফরেস্ট অফিসের কাছে। কারন এই পথ দিয়েই জাহাজ ফিরে যাবে ঢাকার রাস্তায়। কচিখালির আরেক নাম ‘টাইগার পয়েন্ট‘। সঙ্গী জাবির শিক্ষক জানালেন তিনি যে কয়েকবার বাঘ দেখেছেন এবং বাঘের ছবি তুলেছেন তার বেশীর ভাগই এই এলাকা থেকে। সুতারাং অভিযাত্রীদের মনে সেই পুরনো বাঘ দেখার চিন্তাটা নতুন করে আবার মাথাচাড়া দিল। সন্ধ্যার বেশ কিছুক্ষণ আগেই জাহাজ কচিখালী পৌঁছল। জাহাজ জেটিতে নোঙ্গর করা মাত্র নেমে পড়ল সবাই, বাঘ দেখতে। যেন বাঘ খাঁচায় ভরা আছে, ওরা যাবে এবং তাড়াতাড়ি শুধু একটু দেখে ফিরে আসবে। অভিযাত্রীরা সবাই খুবই নিঃশব্দে এবং সুশৃংখলভাবে কচিখালি মাঠের পুকুর পর্যন্ত পৌছে গেল। এ কয়দিনের নিয়মতান্ত্রিক জীবন যাপনে তারা এখন বেশ সুশৃংখল। পরিকল্পনা অনুযায়ী ওখানেই তাদেরকে নিঃশব্দে বসে থাকতে হবে সন্ধ্যা পার হয়ে যাওয়া পর্যন্ত। উদ্দেশ্য যদি মামা আসে তাহলে তার সঙ্গে একটা সৌজন্য সাক্ষাৎ!!! পড়ন্ত বিকাল। শব্দহীন ৬৫ জোড়া চোখ বিরামহীনভাবে খুঁজে চলেছে সেই একটি প্রাণীকে। হঠাৎ তাদের মনে প্রশ্ন এল সুন্দরবনে এসে কেন তারা শুধু বাঘের দেখা পাওয়ার চিন্তায় মগ্ন? বাঘ ছাড়া কি অন্য কিছু দেখা বা উপভোগ করার নেই এই বনে? এই যে সুন্দর এই পড়ন্ত বিকালে তাদের সামনে ঘাস খাচ্ছে কমপক্ষে শ‘দুয়েক চিত্রা হরিণ এবং তাদের বাচ্চা-কাচ্চারা। অল্পদূরেই দেখা যাচ্ছে কয়েক জোড়া বন্যশুকর বনের প্রান্ত জুড়ে মাটি খুড়ে তার খাদ্যদ্রব্য খুজছে। গাছের পাতা ও ডালের ফাঁকে মাঝেমাঝেই উকি দিয়ে শয়তানি করছে আমাদের জাত ভাই, সুন্দরবনের একমাত্র বানরগোত্রীয় প্রাণি ‘রেসাস বানর‘। প্রকৃতির এই অপূর্ব সৌন্দর্যের কি কোন মূল্য নেই? কিন্তু আমরা তাকে সেই মূল্য দিতে শিখিনি। শিখিনি কিভাবে তাকে সুন্দরভাবে আমাদের নিজেদের কাজে লাগানো যায় তার সুচিন্তিত উপায়সমূহকে। ব্যবহার করতে শিখিনি আমাদের সুস্থ্য বুদ্ধিবৃত্তিকে। আর যার ফলে আমাদের এই দুরবস্থা। ভাবতে ভাবতে তারা অনেক দূর চলে যায়। হঠাৎ চিন্তায় ছেদ পড়ে, আবার ভাবে: হ্যাঁ, এইতো…….তাদের চিন্তা অনেক দূর এগিয়েছে। তারা পারবে আগামী দিনের সমস্যা সঙ্কুল পথের হাল ধরতে। সন্ধ্যার পর এসব ভাবতে ভাবতে কখন যে তারা জাহাজে ফিরে এসেছে মনে নেই। আগামীকাল সকালে জাহাজ রওনা দেবে ঢাকার উদ্দেশ্যে। আবার ফিরে যেতে হবে সেই পরিচিত গন্ডিতে, যেখানকার মানুষ চিন্তা করে কাজ করেনা। সুন্দরবনের এই মায়াময় প্রাকৃতিক পরিবেশে এসে অভিযাত্রীরা এটুকু বুঝতে শিখেছে যে তাদের পরিচিত মানুষগুলোর অপরিকল্পিত কার্যকলাপে আজ তাদের অতি প্রিয় এই বনভুমি হুমকির সম্মুখীন। এসব চিন্তা নিয়ে ব্যথা ভরা মন নিয়ে পরদিন সন্ধ্যায় সদরঘাটে জাহাজ থেকে নামার সময় দলের সবচেয়ে কম কথা বলা ছেলে মাসুম তার সহপাঠি সাথীকে বলল, ‘বাঘ না দেখে ভালোই হয়েছে, কারণ বাঘ দেখলে এই চিন্তাগুলো করতে শিখতাম না………‘