Feeds:
পোস্ট
মন্তব্য

Archive for জুলাই, 2008

অবনি অনার্য

অবনি অনার্য
স্বদেশ অন্বেষা

কবি রুদ্র মোহাম্মদ শহীদুল্লাহর প্রিয়তম জায়গার একটি ছিলো মংলা। কবির ভীষণ অনুরাগী বলেই হয়তো বার তিনেক মংলায় গিয়েছি। ওখানে গেলেই রুদ্রর কথা ভেবে মন খারাপ হতো খুব। একাএকা সেই মন খারাপটা কারো সঙ্গে ভাগাভাগি করতে পারতাম না, উপায় কেবল একটাই, ওঁর বিখ্যাত সেই গানটি গাওয়াÑ ভালো আছি ভালো থেকো/ আকাশের ঠিকানায় চিঠি লিখো… আনন্দ ভাগাভাগি করলে সেটা বিস্তৃত হয়, আর দুঃখ ভাগাভাগি করলে বিভাজিত হয়ে ছোট হয়ে আসে। সেই তাড়না থেকেই ভ্রমণের জন্য চারজনের একটা ছোট্ট দল গড়া হলো আমাদের, বাকি তিনজন তখন বুয়েটের ছাত্র, এখন সবাই পুরোদস্তুর ইঞ্জিনিয়ার। ২০০২ সালের জুলাই মাসে লম্বা একটা ট্যুর করার সিদ্ধান্ত নেয়া হলোÑ ফয়’জলেক-পতেঙ্গা-কক্সবাজার-সেন্টমার্টিন-ছেঁড়াদ্বীপ-বান্দরবান-চিম্বুক-রুমা-রাঙামাটি। ভ্রমণের পরিকল্পনা অনুযায়ী সবার একইরকম টিশার্ট কেনা হলো। সাম্য পড়তো আর্কিটেকচারে, আঁকাআঁকির হাত নিয়ে বলবার কিছু নেই।

ও বসে পড়লো টিশার্টে কিছু একটা আঁকা বা লেখার জন্য। শেষমেশ লেখারই সিদ্ধান্ত হলো, এখন ট্যুরটার একটা নাম দেয়া চাই। তখন সদ্য ড. আহমদ শরীফের স্বদেশ অšে¦ষা পড়ে শেষ করেছি। নামটা ভ্রমণের সঙ্গেও যায় বলে প্রস্তাব করলাম, সবাই রাজি। টিশার্টের পেছনে লেবেল সাঁটা হলোÑ স্বদেশ অšে¦ষা। সবই ঠিক আছে, মাসটা শুধু জুলাই। বৃষ্টি চলছে। ট্যুরের যাই হোক, রেলভ্রমণ জমবে এটা নিশ্চিত জেনে কমলাপুরের সুবর্ণ এক্সপ্রেস-এর টিকেট কাটা হলো। সুবর্ণ চেপে চট্টগ্রামে। বন্ধু রাজুর মেসে। রাজু তখন চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে বিবিএ পড়ছে, এখন এমবিএ শেষে চাকুরি করছে একটা ব্যাংকে। পরদিন সকালে ফয়’জ লেক (ফয়েজ সাহেবের নয়, মি. ফয়’র লেক) এবং বিকেলে পতেঙ্গা সৈকত ভ্রমণ। এটা ছিলো মূলত ওয়ার্মআপ টাইপের। বৃষ্টি হচ্ছিলো গুঁড়িগুঁড়ি, তাতে আমাদের কী! তার পরদিন কক্সবাজারের উদ্দেশে যাত্রা। রাজু যাবে না, ওর পরীক্ষা। পথে রামুতে মন্দির দেখবো বলে বাস থেকে নেমে পড়লাম। রাখাইনদের পুরাতন মন্দিরসহ চার পাঁচটা মন্দির দেখা হলো। ওখানে প্রায় ১৫/২০টির মতো মন্দির আছে বলে জানালেন পুরোহিত। পালি ভাষায় বান্তে সে-কা-চা-রা মন্দিরের শিল্পকর্ম-স্থাপত্য দেখে মাইক্রো চেপে কক্সবাজার। হোটেলের রুম ভাড়া বিষয়ে আমাদের কারোরই কোনো পূর্বঅভিজ্ঞতা নাই। রুমের ভাড়া শুনে আমরা মোটামুটি সৈকতেই থাকার সিদ্ধান্ত নিলাম। পরে একটা হোটেলে গিয়ে ডাবল রুমের ভাড়া জিজ্ঞেস করলাম। ওটাতে চারজন থাকা যাবে কি-না জিজ্ঞেস করতেই ভদ্রলোক বুঝতে পারলেন আমাদের নিরস মুখগুলোর পেছনের ঘটনা।

জানতে পারলেন আমরা ছাত্র, আর তেমন কথা বাড়ালেন না। একটা রুমে সবার ব্যাগ রেখে টিশার্ট-শর্টস পরে সোজা সৈকতে। পড়ন্ত বিকেল। সমুদ্রের গর্জন, পর্যটকদের গাদাগাদি। ক্লান্ত-বিধ্বস্ত হবার আগ পর্যন্ত দাপাদাপি চললো। হোটেলে ফিরে পোশাক পাল্টে বৈকালিক নাস্তা সেরে ফের সৈকতে। আঁধার নেমেছে ততক্ষণে, সূর্যাস্তের আগেকার জনসমাবেশের বিরক্তিকর অনুপভোগ্য পরিবেশটি আর নেই। ক্ষুব্ধ সমুদ্রের বহমানতার স্বাক্ষরকে বুঝি আরো নিজের করে পেলাম। সৈকতের পাশে কটে শুয়ে সবাই নিশ্চয়ই হারিয়ে গিয়ে থাকবে সেই জগতে, যেখানে দ্বিতীয় সত্বার প্রবেশাধিকার নিশ্চতরূপেই নিষিদ্ধ। দৃষ্টি আকাশমুখী, ওপরে এক প্রকৃতি অন্ধকার। ক্যামেরায় ধরার চেষ্টা চালিয়েছিলো সাম্য। কিন্তু ক্যামেরায় অন্ধকার কতোটা ধরা যায়, কতোটা ধরা যায় রাঙামাটির সুবলং ঝরনার পরিপার্শ্বের পাহাড়ি প্রেক্ষাপটের অশরীরি ভয়াল নৈঃশব্দ। চোখের লেন্সকেই তাই ভরসা মেনেছি আমি। কক্সবাজার সৈকতে রাতের আঁধারে দূর আকাশের তারাগুলির উঁকি বড্ড শূণ্যতার জানান দিচ্ছিলো। সব হারানোর কষ্টগুলি আরো তীব্র আরো প্রকট হয়ে উঠেছিলো কি! হারানোর অনুভবকে আমরাও কি খুঁজিনি অন্ধকারের দুর্ভেদ্য অবয়বের বিশালত্বকে অতিক্রম করা কী দুঃসাহসী অথচ কী নিষ্পাপ তারাগুলোতে! অবচেতনেই আমার ভেতরেও কি রচিত হয়নি কোনো গান! কেবল সমুদ্রেরই তো বুঝবার কথা ছিলো এইসব। কিন্তু সমুদ্রের কি বিস্মৃতিরোগ হয়েছে! সমুদ্রও তো দাগ রেখে যায় বালুকাবেলায়। কুলে ঝিনুক রেখে ওই দূরে চলে যায় ঢেউÑ যায় কি? আমরা কী রেখে যাই?

[[ একটি গানের কয়েকটি পংক্তি মনের ভেতর গুণগুণ করছিলোÑ চাঁদটাকে ভালোবাসি তাই বলে/ চাঁদ কভু নেয়নিকো বুকে তুলে/ নীলাকাশ ভালোবাসি প্রতিদানে/ ভাসিয়েছে রাশিরাশি দুখ ঢেলে/ ভাসিয়েছে রাশিরাশি দুখ ঢেলে/ ভাসিয়েছে সে দুখ ঢেলে ॥// আদিবাসী ঝরনাটা পাখা মেলে/ যায় চলে ওই দূরে বহুদূরে/ ঢেউয়ের সাক্ষী ঝিনুক কুলে/ আর আমরা তো হেসেখেলে যাই চলে/ আমরা তো হেসেখেলে যাই চলে/ আমরা তো যাই চলে॥// সাগরের ওংকার ছুঁতে গেলে/ চকিতে পালিয়ে মিটিমিটি হাসে/ যাযাবর মন যেই ছুটে চলে/ অচিনসুতোটা কে যে টেনে ধরে/ অচিনসুতোটা কে যে টেনে ধরে/ অচিনসুতোটা টেনে ধরে॥// আমি তো সঁপেছি মালা আগুণেরে/ আগুণ বলেছে শেষে ছাই পাবো/ বলেছি দিয়েছি যারে সব দেবো/ ছাই হবো নয় পুড়ে খাঁটি হবো/ ছাই হবো নয় পুড়ে খাঁটি হবো/ ছাই হবো নয় খাঁটি হবো॥]]

সমুদ্রকে আরো আপন করে পেয়েছিলাম পরদিন, সেন্টমার্টিনে। সেন্টমার্টিনে আমাদের কটেজ ছিলো সৈকতের সবচেয়ে কাছাকাছি, হুমায়ূন আহমেদের সমুদ্রবিলাসের পাশেই। এখানকার জল পতেঙ্গা-কক্সবাজারের মতো ঘোলাটে নয়, লোভনীয় স্বচ্ছতা প্রেয়সীর মতো টানে। রাতে কটেজ থেকেই সমুদ্রের গান শুনতে পাই, আর আমরা বাংলায় গান গাই… অদেখা-প্রকৃতির এমনতর বিস্ময়কর বাস্তবতায় নিরূপায় এ-মনটা যদি দু’একবার বল্গাহীন হয়ে সব ছেড়েছুঁড়ে পালাতে চায়, তবে সে-খেয়ালীপনার অপরাধ কেবল আমার একলা নয়, দায় কিছুটা এ-প্রকৃতিরও, কিছুটা অতৃপ্ত-চিত্তের নির্মম-কাতর আকুলতারও। এও জানি, এতে তৃপ্ত হই বটে, কিন্তু সঙ্গী করবার সাধ্য কিংবা দুঃসাহসিকতা নেই। পতিতা আর কবির মতো। পতিতার দেহ কাম নেভায়, তারপর ভুট্টা ছাড়িয়ে নেয়ার পর মাঝখানে অবশিষ্ট দণ্ডের মতো, ডাস্টবিনেই যার চূড়ান্ত অবস্থান। কবির কবিতা অনুরণন ঘটায়, কিন্তু অতঃপর… কবিকে কে সঙ্গী করেছে কবে? পেরেছে? কবিরা বুঝি পতিত! সেন্টামার্টিনে ঝিনুক আর প্রবাল কুড়িয়েছি অজস্র। অদ্ভুত সব রঙয়ের বিচিত্র সমন্বয়ের বিস্ময় নেশা ধরিয়ে দেয়। আমাদের ভ্রমণের মূল লক্ষ্য কিন্তু সেন্টমার্টিনও নয়, ছেঁড়াদ্বীপ। কিছুদিন আগেই একুশে টেলিভিশনে ছেঁড়াদ্বীপ নিয়ে একটা প্রতিবেদন দেখিয়েছিলো, সেটা দেখেই আমাদের মূল লক্ষ্য দাঁড়ালো ছেঁড়াদ্বীপ। পরদিন ভোরবেলা ঝোড়ো তারুণ্য পায়ে হেঁটেই রওয়ানা করলো ছেঁড়াদ্বীপের উদ্দেশে। সঙ্গী হিসাবে পেলাম স্থানীয় এক স্কুল শিক্ষক। তিনি নিজেও কখনো ওখানে যাননি। আমাদের কথা শুনে তাই রাজি হয়ে গেলেন।

তখনও পর্যন্ত সেন্টমার্টিন তেমন একটা জমে ওঠেনি। মনে আছে, আমাদের ক্যামেরার ফিল্ম শেষ হয়ে গেলে সেই ফিল্ম পেতেই ঘণ্টা দুয়েক লেগেছিলো। একরকম দৌড়াতে শুরু করলাম, কারণ সকালের জোয়ার শেষে ভাটা শুরু হবে বারোটার দিকে, এরপর ফের জোয়ারের পালা। এরই মধ্যে বিচ্ছিন্ন সেই দ্বীপে গিয়ে ফেরত আসতে হবে। ফেরত আসতে না পারলে সলিলসমাধি। মাস্টার সাহেব আমাদেরকে ট্রলার নিতে বললেন। সেটা নেয়া যেতো, সময় তাতে কম লাগবে নিঃসন্দেহে। কিন্তু তাতে সৈকতের অজানা রহস্য অজানাই থেকে যেতো। ছুটতে শুরু করলাম সৈকত ধরে। ধারালো সব পাথর, সমুদ্রের বিরতিহীন ঢেউয়ের আঘাতে বালি থেকে এসব পাথরের সৃষ্টি। লাফ দিয়ে দিয়ে পার হচ্ছি। মাঝে মধ্যে পা ফসকে খানিকটা কেটেও যাচ্ছে। যাক, সেটা পায়ের ব্যাপার। মুশকিল হচ্ছে একদিকে তাড়াতাড়ি পৌঁছানোর দায়, অন্যদিকে অনন্যসাধারণ সব ঝিনুক-প্রবালের সমারোহ। আমি শুভ আর কনক নেমেছি প্রতিদ্বন্দ্বীতায়, কে কতোটা অপূর্ব প্রবাল বা ঝিনুক কুড়োতে পারে। যে-সৈকতের প্রধান বিস্ময়ই হচ্ছে বৈচিত্র্য, সেখানে সংগ্রহ করার মতো ঝিনুক-প্রবালের অভাব হয় না। যা দেখি সবই নিতে ইচ্ছে করে। সবাই দৌড়ে গিয়ে হুমড়ি খেয়ে পড়ছে। সাম্য ব্যস্ত ছবি ওঠানো নিয়ে, আমরা তাতে খুশি, একজন প্রতিদ্বন্দ্বী কমে গেলো। ও কিন্তু আমাদের এসব দেখে বিরক্ত হচ্ছে, সময় নিয়ে দুশ্চিন্তা হয়তো এটার কারণ। কিন্তু সে-দুশ্চিন্তা তো আমাদেরও ছিলো। হতে পারে ক্যামেরা হাতে থাকার কারণে ও ঝিনুক-প্রবাল কুড়াতে পারছে না বলে ওর ঈর্ষা হচ্ছিলো। আমাদের সবার হাতে ব্যাগ।

কাপড়-চোপড় সব কটেজে রেখে এসেছি, ব্যাগ ভরছে ঝিনুক-প্রবালে। ছেঁড়াদ্বীপ থেকে ফিরে পড়েছি বিপদে, ব্যাগ যে ভিজে যাবে, বালিতে একশা হয়ে যাবে, সেটা কারোরই মনে ছিলো না। আঁকাবাঁকা সৈকতের ধার দিয়ে অদূরেই ঝোপ, অধিকাংশই সম্ভবত কেয়া গাছ, আর আছে অজস্র নারকেল গাছ। মাঝে মধ্যে দু’একটা ঘর দেখা যায়। একটা বাড়িতে গিয়ে আমরা মাথাপিছু দুটো করে ডাব খেয়েছি। কিন্তু মাথা ছাড়াও শরীরের একটা হিসেব আছে, সে-হিসেবে শুভ একটা ডাব বেশি খেয়েছে। বিচিত্র সব ঝিনুক-প্রবালের সঙ্গে যুক্ত হলো বিশালাকৃতির সাপের মরদেহ, বড় বড় কংকাল (সম্ভবত সামুদ্রিক মাছের), সুবিশাল কচ্ছপের খোল। কিন্তু এসবের সঙ্গে যখন অতিপ্রাকৃতিক কিছু যোগ হয় তখন আমাদের আর যাত্রা বন্ধ না রেখে উপায় থাকে না। আমরা সবাই পাথরের উপর লাফিয়ে লাফিয়ে এগুচ্ছি সৈকত ধরে। হঠাৎ করেই চোখে পড়লো, কুল থেকে বিশ-পঁচিশ হাত দূরে পাথরের উপর বসে আছে একজন মহিলা। সমুদ্রের ঢেউ আছড়ে পড়ছে তাঁর গায়ে, অথচ কী অদ্ভুত! তিনি মোটেও টলছেন না। অবাক কাণ্ড! প্রথমে আমিই দেখলাম, সবাইকে দেখালাম। মাস্টার সাহেব সবার আগে পেছন দিকে পালাতে শুরু করলেন। আমরা খানিকটা পেছনে এসে খুব ভালো করে লক্ষ্য করলামÑ সবই ঠিক আছে সেই নারীদেহ, মাথা, গ্রীবা, উন্মুক্ত পিঠ, কোমর, নিতম্ব অবধি। বাকিটুকু পানিতে। কিন্তু সমুদ্রের এই উত্তাল ঢেউয়ে এভাবে বসে থাকা অসম্ভব। একেবারেই নড়ছে না দেখে আমরা কিছুটা কাছাকাছি যাবার চেষ্টা করলাম। মাতাল ঢেউ আমাদেরকে তেমন উৎসাহ দেয়নি। সাম্যর মাথায় এলো ক্যামেরার লেন্স দিয়ে পরখ করা যেতে পারে। শেষমেশ ধরা পড়লো, না এটা আসলে পাথরের মূর্তি। খেয়ালি প্রকৃতির কী বিস্ময়কর বাসনা! ছবি তুললাম বেশ কয়েকটা। ফের এগুতে থাকলাম , যেন আবিষ্কারের আনন্দে বিভোর। সৈকতের গলিপথ ধরে কখন যে চৌদ্দ-পনেরো কিলোমিটার হেঁটেছি জানি না। তিনটি বিচ্ছিন্ন দ্বীপ।

জোয়ারের সময় বিচ্ছিন্ন হয়ে যায় দ্বীপগুলো, ভাটার সময় হাঁটুপানি পার হয়ে পৌঁছানো যায়। মানুষের পক্ষে সম্ভাব্য শেষবিন্দুতে পৌঁছে ক্যামেরায় ক্লিক। ভাটাও তখন ভাটার দিকে, ফের জোয়ারের পালা শুরু হবে। অগত্যা তড়িঘড়ি ছেঁড়াদ্বীপ ছাড়লাম। এবার পুরোপুরিই অবসন্ন। একবার সিদ্ধান্ত হলো এক রাত না হয় থেকে যাই, শরীর আর পারছে না। বসে পড়লাম, সঙ্গে নিয়ে আসা রুটি-কলা-পানি দিয়ে রিচার্জ করলাম নিজেদের। বালিময় সৈকতে শুয়ে পড়লাম। হঠাৎই কনকের চোখে পড়লো দূরে একটা ট্রলার। অবসন্ন পা দু’খানি নিয়ে কোনোমতে দৌড়াতে থাকলাম সেদিকে। শার্ট খুলে উড়াতে লাগলাম। ট্রলারের যাত্রিরা নেমেছে, বেশ ভালো। আমরা দৌড়াতে দৌড়াতে কাছাকাছি গেলে আমাদেকে দেখতে পেলো ট্রলারের মাঝি-যাত্রীরা। আমাদেরকে সঙ্গে আনতে রাজি হলেন। আমাদের কাছ থেকে ভ্রমণবৃত্তান্ত শুনলেন ওঁরা। বিনিময়ে আমরা চড়ে বসলাম। একেবারে কুলে ভিড়তে পারে না ট্রলার, ট্রলারে উঠতে হলে নৌকাই ভরসা। ওখানকার ঢেউয়ের শক্তি অবিশ্বাস্য। যাহোক ছোট্ট নৌকায় চাপলাম চারজন। নৌকার পানি সরানো হয় মাথাকাটা ড্রামে করে। সাম্য পণ্ডিতি দেখানোর জন্য নিজে একটা ড্রাম নিয়ে পানি সরানোর দায়িত্ব নিলো। যথারীতি কিছুদূর যেতেই পানি ছুঁড়তে গিয়ে ড্রামসুদ্ধ সাগরে। অন্য একটা ড্রাম দিয়ে মাঝি পানি সরাচ্ছেন। পানি বেড়েই চলছে নৈৗকার ভেতর। মাঝিরা চিৎকার করে ট্রলার ডাকলো, আমরা মৃত্যুর কয়েক ইঞ্চি দূর থেকে ট্রলারে উঠতে পারলাম। সোজা সেন্টমার্টিন। আমাদের ভ্রমণের শুরুতেই সবার কাছ থেকে সমান অংকের টাকা নিয়ে একজনের কাছে রাখা হতো, তাঁর হাতেই থাকতো যাবতীয় খরচের ভার। সেন্টমার্টিনে এই দায়িত্ব আমার উপর ছিলো। সৈকতে টাকা নিয়ে যাওয়া বোকামি, তাই বুদ্ধি(!) করে কটেজের তোষকের নিচে টাকাগুলো রেখে গিয়েছিলাম। এদিকে আমাদের ওইদিনই আবার সেন্টমার্টিন ছাড়তে হবে, শেষ ট্রলারের সময় হয়ে গেছে (তখনো পর্যন্ত ট্রলারই ছিলো একমাত্র ভরসা)। তড়িঘড়ি ব্যাগ গুছিয়ে ট্রলার ধরলাম। ওইদিন সাগরের অবস্থা বেশ বেসামাল। আধঘন্টা পরই শুরু হলো সাগরের জিকির। অবস্থা এমনই দাঁড়ালো যে, আমাদের বেঁচে থাকবার কোনো সম্ভাবনাই নেই। সবাই আক্ষরিক অর্থে শেষ বিদায় নিলাম। মহিলারা নিজেদের বাচ্চাদের বুকে চেপে ধরে কাঁদতে শুরু করলেন, আর ঝগড়া শুরু করলেন কর্তাদের সঙ্গে। একজন বললেন, তোমাকে এতো করে বললাম এখন আসার দরকার নেই। উত্তরে কর্তা বললেন, আরে তুমিই তো পীড়াপীড়ি করছিলে! গিন্নী তখন বললেন, আমি বললেই তোমাকে আসতে হবে! নিজের কোনো বিবেচনা নাই? অগত্য চোখ বন্ধ করে বসে থাকলাম, বমিবমি ভাবও হচ্ছে। যাহোক এতোসবের মধ্যেও আমরা শেষমেশ টেকনাফ পৌঁছলাম, আবার কোলাকুলি, কান ধরলাম আর কখনো সেন্টমার্টিন আসবো না। ট্রলার ছেড়ে হাঁটতে শুরু করলাম, এখানেই হোটেলে থাকতে হবে, কারণ চট্টগ্রাম যাবার আর কোনো বাহন তখন নেই।

একটা হোটেলে উঠলাম, যথারীতি ডাবলরুমে চারজন। রাতে প্রথামোতাবেক হিসেবে বসলাম, কত খরচ হলো জানতে। আর তখনই টের পেলাম, আমার কাছে রাখা টাকাগুলো সেন্টমার্টিনেই ফেলে এসেছি। আমার পালস বন্ধ হয়ে গেলো, বাকিদেরও বোধহয়। তাড়াতাড়ি সামলে নেবার জন্য বললাম, ভয় নেই, কাল সকালে আমি ফের সেন্টমার্টিন গিয়ে নিয়ে আসবো। রাতে কনক বোধহয় বললো, একজন আমার সঙ্গে যাওয়া উচিত। কিন্তু কে সেই একজন? একটু ইতস্তত করে সাম্য বললো ও যাবে। কিন্তু শুভ আমার খাঁটি ভক্ত। সেও তখন বললো, না আমি যাবো। কনক সব সময়ই একটু ভীতু কিছিমের। কিন্তু এহেন মুহূর্তে সেও বললো, আমিও যাবো। আমি কিন্তু একাই যেতে চেয়েছিলাম। সকালে দেখি সিদ্ধান্ত পাল্টালো, সবাই যাচ্ছি, মৃত্যুকে নিশ্চিত জেনে। এবার কিন্তু আগে থেকেই আমাদের মৃত্যুর প্রস্তুতি ছিলো। সেটা বুঝতে পেরেই বোধহয় আমাদেরকে অবাক করার জন্যে সাগর ঠিক শান্ত-পুকুরের মতো আচরণ করলো। আমরা নিরাপদে প্রত্যাবর্তন করলাম। ওইদিনই কক্সবাজার হয়ে চট্টগ্রাম, সোজা রাজুর মেসে। গভীর রাত হয়ে গেলো। আরসি লেমনের সঙ্গে ডাবের পানি মিশিয়ে আমরা যে-পানীয় প্রস্তুত করেছিলাম সেটার কিছুটা ইচ্ছে করেই রেখে দেই। রাজুকে বললাম, ওয়াইন নিয়ে এসেছি। বেচারা এর আগে কখনো খায়নি। বেশ আয়োজন করে খেতে বসলো। এবং দুই চুমুক দিয়েই বললো, মালটা বেশ, ভালোই ধরেছে। বেচারা! পরদিন বান্দরবান গেলাম বাসে। উদ্দেশ্য চিম্বুক-রুমায় যাবো। বিকেলে আর যাত্রা করা সম্ভব না। পরের দিন চাদের গাড়িতে [পাহাড়ী পথে চড়ার জন্য বিশেষভাবে প্রস্তুতকৃত জিপ] যেতে হবে। একটা গাড়ি ঠিক করে ফেললাম। বিকেলটা স্থানীয় জায়গাটা ঘুরে দেখা হলো, আদিবাসীদের মার্কেট দেখলাম, লুঙ্গি কিনলাম সেলাই ছাড়া। সেই লুঙ্গি পরে তামাক টানবো এই আশায় তামাক এবং কলকি কিনলাম। খবরের কাগজে মোড়া তামাক বের করে কল্কিতে রাখলাম, আগুণ ধরাচ্ছি বারবার, সেটা কেবলই কয়লা হয়ে যাচ্ছে, ধোঁয়া আর হয় না। এরকমই চলছে, হঠাৎই দেখলাম যে-কাগজটা (সদ্যলুপ্ত আজকের কাগজ) দিয়ে তামাক মোড়ানো ছিলো সেটাতে তালিকা দেয়াÑ এ-বছর প্রদর্শিত নাটকসমূহ। খবরটি শিশুকিশোর নাট্য-উৎসব নিয়ে। ওইবার আমি নিজেও একটা নাটকের স্ক্রিপ্ট পাঠিয়েছিলাম বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্র, রংপুরের পক্ষ থেকে। আমাকে অবাক করে দিয়ে ওই খবরে বলছে, আমার স্ক্রিপটি মনোনীত হয়েছে, এবং মঞ্চস্থও হয়ে গেছে। মোবাইলের যুগ ছিলো না সেটা, আমি জানতেই পারিনি। নাটক নিয়ে দারুণ নাটকীয়তা হলো দেখছি! রামু-চিম্বুক ঘুরে ফের বান্দরবান হয়ে চট্টগ্রাম। এরপর রাঙামাটি। প্রকৃতি যে কতোটা প্রাকৃতিক তা রাঙামাটি না গেলে বোঝা যায় না। ভ্রমণের সর্বজনস্বীকৃত পদ্ধতি হচ্ছে ট্রলার ভাড়া করে চুক্তিতে ঘোরা। বিভিন্ন প্যাকেজ আছে, তিন/চার/পাঁচটি স্পট। আমরা সব কয়টি স্পটে যাবার সিদ্ধান্ত নেই। এর মধ্যে আছে সুবলং ঝরনা, বৌদ্ধমন্দির, পেদাতিংতিং, ডিসির বাংলো, আর ঝুলন্ত ব্রিজ। বৃষ্টিতে পিচ্ছিল হয়ে আছে সুবলং ঝরনায় চারধার। তবু ধীরে ধীরে উঠলাম, অনেকটাই। কিন্তু নামবার সময় টের পেলাম অভিকর্ষ বল কাকে বলে। পাহাড়ে ওঠা সত্যিই অনেক সহজ, অন্তত নামবার সঙ্গে তুলনা করলে। পাহাড় থেকে নিচে নামার পথ ভীষণ ভীষণ কঠিন। পাহাড়ের মতো ব্যক্তিত্ব থাকলে বোধহয় মানুষের ক্ষেত্রেও সেটা পুরোমাত্রায় প্রযোজ্য হবে।

Read Full Post »

ভ্রমণ: সুন্দরবন-কুয়াকাটা সূর্যোদয় ও সূর্যাস্তের গল্প
শাকুর মজিদ

এমণ ভট ভট করে ভদ্র লোক কখনো দরোজা ধাক্কায় না। হাতের কাছে মোবাইল নিয়ে দেখি ভোর মাত্র সাড়ে ছয়টা। এমনিতে প্রায় সারারাত আড্ডা পিটিয়ে শেষ রাতের দিকে জাহাজের চিকনা চাকনা কেবিনের এক বিছানায় শরীর এলিয়ে দিয়েছিলাম। অন্তত: ৫ ঘন্টা ঘুমালেও সকাল ৯ টায় আমাকে ডাকার কথা। কিন্তু দরোজার ওপাশে যে ভদ্রলোক দরোজা ধাবড়াচ্ছেন তার গলার আওয়াজ শুনে দরোজা না খুলে পারিনা। দরোজা যখন খুললাম তখন লাভলু ভাই। চোখ খুলতে পারি না। আস্তে আস্তে চোখের পাতা ফাঁক করার চেষ্টা করি। লাভলু ভাই আমাকে ধরে কেবিনের ওপাশের দিকে নিয়ে যান। “দ্যাখ দ্যাখ, দেখেছিস কখনো?” আমি ভাল করে তাকাতে পারি না। তারপরও দেখি। ডিমের কুসুম যেনো বিরাট এক পানির থালার উপর থেকে উঠে আসছে। দূরে কাউখালীর গ্রাম। ফেব্র“য়ারীর কুয়াশা। কুয়াশার ভেতরে এক ধরণের ধূয়াসার আবরণ। বাংলাদেশের অনেক সুন্দর প্রকৃতির দেখা আমার মিলেছে। পানির উপর ভাসতে ভাসতে চিকন চিরল গাছের ডগা দিয়ে সূর্য উঠার এমন দৃশ্য আমার দেখা হয়নি কখনো। চোখের ক্লান্তি গেলো সরে। কেবিনের খাটের তলায় আমার ক্যামেরা যুগল।

একবার ভাবলাম ওগুলো নিয়ে এসে এই দৃশ্য বন্দি করি। পরে মনে হলো,-না থাক, কিছু কিছু দৃশ্য থাকে যা একান্তই নিজের। সব কিছু সবাইকে দেখাতে নেই। তারচেয়ে বরং আমি নিজেই এর স্বাদ নেই। তেতলার ডেকে বসে বসে সূর্য উঠা দেখি। এরকম বসে থাকা আমার স্বভাবে নেই। চুপচাপ একটা চেয়ারে বসে থাকবো, ঘন্টার পর ঘন্টা কেটে যাবে, এটা আমার ধাতে নেই। কিন্তু কাল সন্ধ্যা থেকে দেখছি এ জিনিসটা আমি করতে পারছি এবং বেশ অবলীলায়। আমার বোর লাগছে না। তার কারণ চলচ্চিত্রের মতো, প্রতি মুহূর্তে আমার সামনের দৃশ্য বদল হচ্ছে। চলমান দৃশ্য আমাকে ক্লান্ত করেনা। কিন্তু একুশে ফেব্র“য়ারী তারিখের এই সকালটি আমার কাছে আজীবন অন্য কারণে স্মরণীয় হয়ে থাকবে। আগের রাতেই কানাঘুষা শুনেছি। আমাদের ৪ রজনীর এই নৌ বিহারের আয়োজক, ‘বেসটেক গ্র“প’ এর দুই প্রধান ব্যাক্তি স্থপতি তারিকুল ইসলাম লাভলু আর এনায়েত কবীর বারবার তাদের অফিস ষ্টাফের কাছে ফুল, ফুলের ডালি, শহীদ মিনার এসবের কথা বলছিলেন। তখন আকাশে কাচির ফলার মতো সিকিখানা চাঁদ। সপ্তর্ষী। ছায়াপথ। দূরে, বহু বহু দূরে টিম টিমে জ্বলে ওঠা বাতি। ওসব ছেড়ে ফুল পাতার দিকে ওতো মনোযোগীই বা হয় কে? কিন্তু মনোযোগ কেড়ে গেল তেতলার পেছনের ডেক-এ গিয়ে। বেসটেক গ্র“পের প্রায় ৮০জন কর্মী ও কর্মকর্তা, জাহাজের কর্মচারী, খালাসী, বাবুর্চি মিলে প্রায় শ’খানেক লোক। খালি পা, পাঞ্জাবী পরা। পাঞ্জাবীর বুক পকেটে কালো কাপড়ের স্ট্রীপ পিন দিয়ে আটকানো। প্রায় প্রত্যেকের হাতে ফুল। কেউ হাতে নিয়েছেন রজনী গন্ধার স্টিক, কেউ বা গোলাপের ডাল। এর মধ্যে মহড়ার অংশ হিসাবে শুরু হয়েছে গান। আমার ভাইয়ের রক্তে রাঙ্গানো একুশে ফেব্র“য়ারী- আমি কি ভুলিতে পারি। মিনিট দশেক পর শুরু হয় মিছিল।

ডান দিকের করিডোর দিয়ে শুরু করে বাম দিকের করিডোর মাতিয়ে যেখানে এসে তারা মিশলেন- সেখানে একটা জ্যান্ত শহীদ মিনার। কঠের ফ্রেমে লাল ও কালো কাপড় দিয়ে দু’টো উচ্চতায় দাঁড় করানো দু’টো ব ক। অনেকটা বুয়েটের শহীদ মিনারের একটা ছোট ভার্ষণ। দু’টোকে দাঁড় করানো হয়েছে একটা মোটা শোলা বোর্ডের প ্যাটফর্মের উপর। একুশে ফেব্র“য়ারীতে শহীদ মিনারে গান গাইতে গাইতে বাঙ্গালী ফুলের তোড়া এসে রাখবে, এটা খুব স্বাভাবিক একটা ঘটনা। দেশের এমন কোনো শহীদ মিনার পাওয়া হয়তো যেতোনা যেখানে এই প্রভাতে ফুলের প্রলেপ তার গাড়ে লাগে নি। কিন্তু এই যে, ঝালকাঠির কসাই নদীর উপর বয়ে চলা জাহাজ এম.ভি এমদাদা এর ডেকের উপর বানানো অস্থায়ী শহীদ মিনারে নদীর উপর প্রভাত ফেরীর কোন ঘটনা ঘটেছে কিনা আমি কোনো দিন শুনিনি। জাহাজ ছুটে চলে কসাই নদীর বুক চিরে মংলার দিকে। আর আমরা নদীর উপরে প্রভাত ফেরী করি। বিকেল আড়াইটায় জাহাজ পৌঁছে মংলা বন্দর। এখানে এক ঘন্টার বিরতী। বিরতী মূলত: মংলা শহর হেঁটে দেখা, জাহাজের বাবুর্চির জন্য বাজার সওদা আর পানি কেনার জন্য। মংলা থেকে দু’জন পাইলট উঠানো হলো জাহাজে। তাদের কাজ ছিলো সারেংকে দিক নির্দেশনা দিয়ে আমাদেরকে কটকা পর্যন্ত পৌছানে। মংলা থেকে জাহাজ ছাড়ার পর সুন্দরবন এলাকার প্রবেশমুখে জাহাজের অনুমতি নিতে হয়। সে বেশ ঝামেলার কাজ। জাহাজের ফী, পর্যটকের প্রবেশ ফী, এসব দিতে দিতে এবং অনুমতি নিতে নিতে প্রায় সন্ধ্যা হয়ে যায়। জাহাজ ছাড়লো বটে, কিন্তু অনেকটা পথ চলে আসার পর, হঠাৎ জাহাজটি থামিয়ে দেয়া হয়।

আমাদের বিশেষজ্ঞ পাইলট যুগল জানালেন যে, অন্ধকারে তারা ঠিক দিক নির্দেশনা দিতে পারবেন না। আমাদের মধ্যে কিছু বিশেষজ্ঞ পর্যটকও ছিলেন, যারা আগে একবার হয়তো এসেছেন এই পথে। তারা আশংকা করলেন, এভাবে মোহনার মাঝখানে জাহাজ আটকে থাকলে ডাকাতদের পক্ষে আমাদেরকে আক্রমন করা সহজ হয়। যদিও অস্ত্র সহ ছয় জন আনসার আছে আমাদের সঙ্গে। তাতেও ভরসা হচ্ছে না। পাইলট যুগলকে নেয়া হলো রিমান্ডে। জাহাজের ডেকে দাঁড় করিয়ে নানা রকম জিজ্ঞাসাবাদ। ‘পথে রাত হবে তুমি জানতে না?’ ‘যদি রাতে পথ চেনাতে না পারো তবে এসেছো কেন?’ ‘এ্যাকবারে চ্যাংদোলা করে পানিতে ফেলে দেবো”, এসব। কিছুক্ষন পর জাহার চলতে শুরু হলো। সারেং এর সাথে কথা ছিলো হিরণ পয়েন্টে এসে জাহাজ থামবে। ভোর হলে সেখান থেকে রওয়ানা হবো দুবলার চরের দিকে। দুবলার চরে আমরা এসে পৌছি বেলা প্রায় বারোটায়। আমাদের জাহাজ পুরোপুরি ভিড়ে না তীরে। হাঁটুপানি ডিঙ্গিয়ে তীরে উঠে পড়ি। বছরে ৭ মাস এই চরে মানুষ থাকে না। মানুষ থাকে ডিসেম্বর থেকে এপ্রিল, এই ৫ মাস। ৫ মাসের কাজের চূক্তি নিয়ে শুটকী-জীবিরা এখানে আসেন, থাকেন। মজার তথ্য হচ্ছে এই দ্বীপে কোন মহিলা নেই। নারীহীন দ্বীপ। থরে থরে সাজানো নানা রকমের গাছ। এদের মধ্যে আগ্রহ দেখলাম হাঙ্গরের শুটকী নিয়ে। আমাদের সহ পর্যটকেরা অস্থির হয়ে হাঙ্গরের শুটকীর ছবি তুলছেন। বেশ ক’জন সর্দার থাকেন এখানে। প্রত্যেক সর্দারের আওতায় ৪০-৫০ জন শ্রমিক। তাদের কেউ কেউ থাকে সমুদ্রে।

তারা শুধু মাছ ধরেন। কারো কারো কাজ ট্রলার নিয়ে এসে মাছ এখানে রাখা। বাকীরা মাছ শুকানোর কাজ করেন। সবচেয়ে বেশী বেতন পান ট্রলারের ক্যাপ্টেন। তার বেতন ৫ মাসে ৫০ হাজার টাকা। ৫ মাসের চূক্তিতে ১০-১২ হাজার টাকাও কাজ করেন কিছু জেলে। থাকা-খাওয়ার যোগান দেন সর্দার। দুবলার চরে ঘন্টা খানেক থাকার পর আমাদের জাহাজ ছুটে চলে কটকার দিকে। কটকা অভয়ারণ্য। এখানে একটা রেস্ট হাউজ আছে। রেস্ট হাউজের দুটো কামরা ভাড়া করা হলো। মূল কারন, দু’ কামরার দুটো বাথরুমের শাওয়ার ব্যবহার করা। দু’দিনে কারো গোসল করা হয়নি। এসিসট্যান্ট কনজারভেটর অব ফরেস্ট মহোদয় সেদিন কটকায় এসেছিলেন কি যেনো এক কাজে। আমার প্রতি যথেষ্ট সদয় হয়ে একজন কোস্ট কার্ড সঙ্গেঁ দিয়ে দিলেন। ওর নাম রাজু। বি.এ পাশ। ৩ মাস হলো চাকরী নিয়েছেন। জঙ্গঁল ওর খুব প্রিয়। ঢাকা থেকে টুরিস্ট এলে তাদের নিয়ে গহীন অরণ্যে ঢুকে যায়। আমাকে নিয়ে গেলো মাইল খানেক ভেতরে। এর মধ্যে হরিণকে ডেকে আনল। ওর ডাক শুনে এক পাল হরিণ চলে এলো কাছে। বলে, ‘দাঁড়ান ভাগ্য ভাল থাকলে আপনি বাঘও দেখে ফেলতে পারেন’। আমি বলি, ‘থাক ভাগ্য ভালো করতে চাইনা। তুমি কি ভাগ্য ভাল করেছ?’ রাজু বলে, ‘না। তবে বাঘের চিহ্ন দেখেছি। আমাদের কোয়ার্টারের পেছনে একটা মিঠা পানি পুকুর আছে। ওখানে ওরা মাঝে মাঝে পানি খেতে আসে। এই কটকায় ৫০টির মতো বাঘ আছে। এমনিতে বাঘেরা খুব ভাল। মানুষ জন ভয় না দেখালে ওরা আক্রমণ করে না। এখানকার সাপগুলোও খুব ভদ্র। আপনাকে দেখলে সমীহ করে চলে যাবে। সাপখোপ আমরা ভয় পাই না।’ রাজুর কথাবার্তা আমার সুবিধার মনে হলো না। আমি রাজুকে নিয়ে জঙ্গলের বাইরে চলে আসি। বলি সূর্য ডোবা দেখবো। কটকায় সুন্দরবনের তীর জুড়ে বালিয়াড়ি। চর জেগেছে উপকূল জুড়ে। কতগুলো গাছ পড়ে আছে। কোনোটার ডাল পালা নাই। কোনোটা উপড়ানো। কোনোটা বা কোন মতো মাটির সাথে তার জীবনের শেষ সংযোগ করে রেখেছে আধশোয়া হয়ে আছে। এগুলোর ফাঁক দিয়ে দেখা হয় সূর্যকে। ধীরে ধীরে সূর্যের তেজ কমে আসে। সকালের সূর্য উঠে তখন তার তেজ বাড়ে, আর বিকেলের সূর্য যখন ডোবে তারটা কমে। কমে কমে ¤ ান হতে হতে এক সময় অন্ধকারে মিশে যায়। কটকার জঙ্গঁলটা কালো হয় আসে। ওখানে বিদ্যুৎ নাই। রাতে জোনাকী জ্বলে। জঙ্গঁলের মধ্যে থাকা হয় না। আমরা রাতের অন্ধকার দেখার জন্য জাহাজের ডেকে আশ্রয় নেই। কাল আমরা কুয়াকাটা যাবো। কুয়াকাটার একটা যায়গা থেকে সূর্যোদয় আর সূর্যাস্ত দেখা যায়। আমরা কুয়াকাটার জন্য উদগ্রীব হয়ে যাই।

Read Full Post »