নকশি পিঠার দেশে
মৃতু্যঞ্জয় রায়
পৌষ আমায় ডাক দিয়েছে। তাই আর ঘরে থাকতে না পেরে ঘরের কাছেই দু’পা ফেলতে চললাম গাজীপুরের এক গ্রামে নকশি পিঠার খোঁজে। জানতাম, গাজীপুরই হল নকশি পিঠার আসল দেশ, একবার ঈদের আগে এক বাড়িতে প্রচুর নকশি পিঠা তৈরি করতে দেখেছিলাম। তাই আর একটু খোঁজ নিয়ে নিশ্চিত হয়েই রওনা হলাম বাড়ীয়া ইউনিয়নের দিগধা গ্রামে। কুয়াশা আর রোদে পৌষের সকাল বেলাটা মাখামাখি করছে। টেকের উপর দিয়ে উঁচু নিচু মাটির রাস্তা ধরে চললাম ঁেহটে হেঁটে। দু’ পাশে নিচু, অনেক নিচু শুকনো নদীর মত জমি। ওগুলোকে ওখানকার লোকেরা বলে খন্দ। খন্দে খন্দে মেখে আছে বোরো ধানের কচি চারার ফালি ফালি সবুজ বীজতলা। ফাঁকে ফাঁকে অল্প অল্প জলের ভেতর থেকে বেঁচে থাকার আকুল প্রার্থনা জানাচ্ছে ঝাঁকে ঝাঁকে ফোটা রক্ত শাপলা আর পদ্ম পাতারা। শীতকে উপেক্ষা করেই কয়েকজন কৃষক ঠান্ডা পানিতে নেমে মরা কচুরিপানা আর টোপা পানার দল সরাচ্ছে, চলছে ধান লাগানোর জন্য জমি চাষের প্রস্তুতি। লাল বাদামি মাটির বুক ফুঁড়ে আহা কি তেজ নিয়ে রাস্তার দু’পাশে বাড়ির আঙিনাগুলোয় ধেয়ে চলেছে লাউ লতারা। বাড়ির উঠোনের এককোনে মাটির নিকানো চুলায় চলছে রান্না। ফাঁকা রাস্তা ধরে দূর থেকে হেঁটে আসছে চাদর গায়ে গুটিশুটি একজন লোক। গ্রামের এমন পৌষ সুন্দর কতকাল যে চোখে পড়েনি। পৌষ সকালের এমন প্রকৃতি দেখতে দেখতে তো প্রায় ভুলতেই বসেছিলাম বাঙলার ঐতিহ্য নকশি পিঠাকে। সঙ্গি মোতালেব আকন্দ সাহেবের ডাকেই সে ঘোর কাটলো। বুঝলাম এসে গেছি। পরিচয় হল গীতা দিদির সাথে। গীতা মলি্লক। বললেন, ‘আমরা তো বানাতে পারি না। তবে যারা বানায় তাদের বাড়িতে আপনাকে নিয়ে যাওয়ার ব্যবস্থা করেছি।’ অতএব তার সাথেই চললাম মুক্তামণি, মাসুদা আর হালিমাদের বাড়িতে। সেখানেই আয়োজন করা হয়েছে নানা রকম নকশি পিঠা বানানোর। চালের গুঁড়া থেকে কাই, কাই থেকে গুটি, গুটি থেকে রুটি, রুটি থেকে নকশা কেটে পিঠা বানানো এবং শেষে ভেজে চিনির সিরায় ভিজিয়ে মচমচ করে চিবিয়ে একখানা নকশি পিঠা খেয়ে তবেই চিনলাম নকশি পিঠাকে।
নকশি পিঠার আসল নাম পাকোয়ান, পক্কন বা ফুল পিঠা। অধিকাংশ গ্রামেই ফুল পিঠা নামে পরিচিত। কেননা, এ পিঠা দেখতে নকশাদার ফুল বা আলপনার মত। পিঠার মধ্যে সবচেয়ে সুন্দর ও আকর্ষনীয় পিঠা হল নকশি পিঠা। নকশি পিঠার মধ্যে ফুল নকশি, শাপলা বাহার, গোলাপ বাহার, পাতা বাহার, গেন্দা বাহার, পদ্মবাহার, কল্কে ফুল বাহার, জবা বাহার ইত্যাদি অন্যতম। আরও রয়েছে ঝিলিমিলি, মালা, জোড়া ময়ূর, পদ্মদীঘি, মেঘডুম্বুর, হিজল লতা, কাজল লতা, শঙ্খলতা, লতা বাহার, এলোকেশি, কুলাবাহার, কড়িকোমল, কইন্যাবরণ, কইন্যামুখি, জামাইমুখি, জামাই সুখ, জামাই মুছরা, জামাই ভুলানী, জামাইবরণ, সতীন মুছরা, সরপুস, সজনী বাহার, সজনে পাতা, সজনে ফুল, চিরল পাতা, ভেটফুল, উড়ি ফুল, ঝিংগা ফুল, কদম ফুল, ময়ূর পেখম, মইফুলি, ডালিম দানা, মোরগ ঝুটি, ঘর নকশা, জামদানী ইত্যাদি নামের নকশি পিঠা। একজন বললেন, ‘লাভ নকশি পিঠাও বানাতে পারি।’ সেটা আবার কেমন? জবাব এলো, যে যাকে পছন্দ করে নকশি পিঠার মধ্যে তার নামের প্রথম অক্ষরটা লিখে দেয়া হয়। যেমন, তার নাম যদি সেলিম হয় তাহলে নকশি পিঠার কারুকার্যময় নকশার মধ্যে হয়ত কোথাও লুকিয়ে থাকবে ইংরেজী ‘এস’ অক্ষরটি। ওটা যখন তাকে পাঠিয়ে দেয়া হবে বা খাওয়ার জন্য পরিবেশন করা হবে তখন একটা ভাব আসবে তাতে। এসব ভিন্ন ভিন্ন নামের নকশি পিঠার নকশার পার্থক্যের জন্যই এতসব নামকরণ হয়েছে। নকশি পিঠার সৌন্দর্য মূলতঃ প্রস্তুতকারির শিল্পবোধে, সে যা চায় সে নকশাই ফুটিয়ে তুলতে পারে। সে অনুযায়ী এক একটা নাম হয়ে যায়। নকশা তোলার জন্য ব্যবহার করা হয় তীক্ষ্ন খেজুর কাঁটা, বেলের কাঁটা ও বাঁশের ধারাল চাছ, ছিলা বা বাকল।
নকশি পিঠা তৈরি করা হয় আতপ বা অসিদ্ধ চাল থেকে। প্রথমে চালের গুঁড়া করা হয়। ঝরঝরে চালের গুড়াকে পানি দিয়ে মেখে রুটির কাইয়ের মত করা হয়। এতে সামান্য লবণ দেয়া হয়। এরপর গুটি করে সে গুটি বেলান দিয়ে বেলে রুটির মত গোল করা হয়। তবে নকশি পিঠার জন্য রুটি তৈরি করা হয় বেশ খানিকটা পুরু করে,পুরুত্ব হয় ডিজাইন বা নকশার ধরন অনুযায়ী আধা থেকে এক সেন্টিমিটার। অল্প একটু চালের কাই নিয়ে পুটুলি করে তাতে সয়াবিন তেল মাখানো হয়। তারপর সেই তেল মাখা পুটুলি নকশি পিঠার রুটির উপরে মাখিয়ে দেয়া হয়। এরপর শুরু হয় সেই রুটির উপর খেজুর কাঁটা দিয়ে নকশা তোলার কাজ। কখনো খেজুর কাঁটার সূঁচালো আগা দিয়ে কখনো বা কাঁটার গোড়া দিয়ে চলতে থাকে নকশা তোলার কারুকাজ। কাঁটা দিয়ে প্রথমে রুটির উপরে হালকা করে দাগ বা আঁচড় কেটে রেখা দিয়ে নকশার অবয়ব আঁকা হয়। তারপর সেই অবয়ব ধরে ধীরে ধীরে ধৈর্যের সাথে নরম রুটির মধ্যে তোলা হয় নানা রকমের কারুকাজ। কোনোটা গোল, কোনোটা চৌকা, কোনোটা তিনকোণা আবার কোনোটা তাঁরা মাছের মত। বিভিন্ন বিন্যাসে ও ডিজাইনে একটা সাধারণ চালের রুটিই মুহুর্তের মধ্যে পরিণত হয় এক অনন্য লৌকিক শিল্পকর্মে। খেজুরের কাঁটা, বেলের কাঁটা, সূঁচ, পাটশলা, নারিকেলের শলা ইত্যাদি দিয়ে কখনো কখনো প্রতিটি পিঠার কিনারা বা ধার বরাবর কাটা হয় নকশাদার ঝালর। চ্যাপ্টা রুটির কোথাওবা কেটে কখনো কখনো ফাঁকা করে নকশা তোলা হয়। কাটার জন্য ব্যবহার করা হয় বাঁশের ছিলকা বা চাঁছ। নকশি পিঠার সৌন্দর্য বা দেখনাই পুরোটাই নির্ভর করে প্রস্তুতকারিনীর শিল্পবোধ ও দক্ষতার উপর। যারা ভাল আঁকতে পারে তারা ভাল নকশার নকশি পিঠাও বানাতে পারেন। এর জন্য বয়স কোন বিষয় নয়, অভিজ্ঞতা ও কৌশলটাই আসল। গ্রামের অনেক শিশুদেরও বেশ ভাল ভাল ডিজাইনের নকশি পিঠা বানাতে দেখা যায়।
শীতের সকালে রোদে গা এলিয়ে গাঁয়ের বউ ঝিরা নকশি পিঠা তৈরিতে মেতে ওঠে। তবে নকশি পিঠা সবচে’ বেশি তৈরি করার প্রচলন রয়েছে গাঁয়ের মুসলিম সমাজে। তারা প্রধানতঃ ঈদের সময় নকশি পিঠা বানান। কোরবানির ঈদের চেয়ে অন্য ঈদেই বেশি নকশি পিঠা বানানো হয়। বানানোর পরপরই তেলে ভেজে চিনির সিরায় মেখে খাওয়া যায়। এ ছাড়া তেলে ভেজে ঠান্ডা করে কৌটায় ভাল করে মুখ বন্ধ করে মাসখানেক ঘরে রেখে ভাল রাখা যায়। এ ক্ষেত্রে পরে যখনই খাওয়া হোক না কেন, তেলে ভেজে মচমচে বা খাস্তা করে খেতে হয়। অনেক সময় নকশি পিঠা চিনির রসে বা সিরায় না দিয়ে গরম গরম তেলে ভাজা পিঠার উপর চিনির গুড়া ছিটিয়ে দিয়ে খাওয়া হয়। এমনকি কোন মিষ্টি না দিয়েও খাওয়া যায়। ঘিয়ে ভাজলে খুবই সুস্বাদু হয়। তবে তেলে ভাজার সময় সামান্য পরিমাণে ঘি তেলের সাথে মিশিয়ে দিলেও ঘিয়ে ভাজার ঘ্রাণটা পাওয়া যায়। ফলে স্বাদটাই অন্য রকম হয়ে যায়।
এ দেশে বাড়িতে যে কোন বিশেষ অতিথি ও নিকট জন এলে নকশি পিঠা ভেজে খাওয়ানোর প্রথা রয়েছে। কেউ বাড়িতে এলে সাথে সাথে এটা তৈরি করা কঠিন বলে অনেকেই নকশি পিঠা আগেভাগে তৈরি করে রাখেন। জামাই মেয়ে বাড়িতে বেড়াতে এলে নকশি পিঠা দিয়ে আপ্যায়ন করা গাজীপুর এলাকার এক অনিবার্য প্রথা। দেশের অনেক জায়গায় নকশি বা ফুল পিঠা থাকলেও এটা মূলতঃ ঢাকার কাছে গাজীপুর জেলাতেই বেশি তৈরি করার প্রচলন রয়েছে। এ অঞ্চলের প্রায় প্রতিটি মুসলিম পরিবারের মেয়েরাই এ কাজে বেশ পটু। নকশি পিঠা মেয়েলি ব্রত অনুষ্ঠানের উপজাত বলে ধারণা করা হলেও এটির আসলে মুসলিম নারীদের হাতেই উদ্ভব ও বিকাশ ঘটেছে। আবহমানকাল ধরে বাঙালি মেয়েরা বেশ কিছু মেয়েলি ব্রত পালন করে আসছে। এসব ব্রতের স্থানে চালের গুঁড়ি করে জলে গুলে আলপনা আঁকা হয়। মেয়েলি আঙুলের শিল্পকলার অপূর্ব সুষমা সেসব আলপনায় প্রতিভাত হত। ধারনা করা হয়, চালের গুঁড়া দিয়ে আঁকা আলপনার সাথে নকশি পিঠা তৈরির ইতিহাসটি গভীরভাবে সম্পর্কিত। নকশি পিঠাতেও এরূপ আলপনার অনুকরণ লক্ষনীয়। তবে শুধু আলপনা চিত্রই নয়, এর সাথে যুক্ত হয়েছে ফুল লতা পশু পাখি মায় হরফ পর্যন্ত। বিশিষ্ট ফোকলোরবিদ শামসুজ্জামান খানের মতে, ‘আশ্চর্যের ব্যাপার, এই মেয়েলি শিল্পটিতে হিন্দু রমণীদের নয়, মুসলিম রমণীকুলেরই স্বীকৃত শ্রেষ্ঠত্ব রয়েছে। কারণ হিসেবে বলা হয়েছে, চাল বা চালের গুঁড়ার দ্বারা রন্ধনকৃত সামগ্রী এঁটো বা মক্ড়ি বলে বিবেচিত হওয়ায় একে সংরক্ষণ করা হিন্দু সমাজে রীতি সিদ্ধ নয়।’ তবে ইদানীং পড়শি মুসলিম মেয়েদের কাছ থেকে অনেক হিন্দু মেয়েরাও ফুল পিঠা বানানো শিখছে ও বানাচ্ছে। গাজীপুর ছাড়া নোয়াখালী, ফেনী, মানিকগঞ্জ, দিনাজপুর ও রাজশাহী অঞ্চলেও পাকোয়ান এক অন্যতম জনপ্রিয় পিঠা। কুমিল্লায় এ পিঠার নাম ‘খান্দেশা’। রংপুর, দিনাজপুর ও বগুড়া অঞ্চলে এর নাম ‘ফুল পিঠা’। ময়মনসিংহ অঞ্চলের কোনো কোনো জায়গায় নকশি পিঠার নাম ‘মছমছিয়া পিঠা’।
এ দেশে শত রকমের পিঠা থাকলেও নকশি পিঠা হল সব পিঠার রাণী। স্বাদে যেমনই হোক না কেন, সৌন্দর্যে সে অপূর্ব সুন্দর। বিদেশে বাংলাদেশের কোন ঐতিহ্যবাহী লোক শিল্পের কথা উঠলেই যেমন চলে আসে নকশি কাঁথার নাম, তেমনি তার সাথেই উচ্চারিত হয় নকশি পিঠা ও নকশি পাখার নাম। দেশের নামের সাথে নকশি পিঠার নামটি জড়িয়ে আছে ঐতিহ্যগতভাবেই। বিশেষ বিশেষ পিঠা মেলাতেও দেখা মেলে ঐতিহ্যবাহী নকশি পিঠার।
নকশি পিঠা সম্পর্কে শিল্পী কামরুল হাসান বলেছেন, ‘খাদ্যবস্তু যা কেবল ক্ষুনি্নবৃত্তিই নিবৃত্ত করে, তার পেছনেও মানুষের সৌন্দর্যপ্রীতির নমুনা দেখলেও অবাক হতে হয়… গ্রাম্য বধূর রান্নাঘরের কাছে চালের গুঁড়ার পিঠা, গুড়ের রসে ভিজিয়ে দিলেই যেখানে চলে সেখানে নিবিষ্ট মনে খেজুর কাঁটা দিয়ে একের পর এক নকশা কেটে সময় নষ্ট করার কি কারণ থাকতে পারে।… কিন্তু গুড়ের রসেই যে চলবে না, এ কথা কে বোঝাবে আমাদের! গুড়ের রসে পিঠা মিষ্টি হবে, তাতে রসনা তৃপ্ত হবে। এটা ক্ষণিকের, কিন্তু প্রিয়জনেরা যখন সুদুরে যাবে তখন তার হৃদয়ের মণিকোঠায় কি ভরে নিয়ে যাবে?… তাই গ্রাম্য বধূ আপন মনে পিঠার ওপর নকশা কেটে চলে…।’ শিল্পীর এ কথারই যেন প্রতিধ্বনি শুনি নকশি বা ফুলপিঠা তৈরির সময় গ্রামীণ নারীদের গাওয়া একটা গানে:
‘কইন্যার মা রসিয়া
পাক্কোয়ান বানায় বসিয়া
এই না পাক্কোয়ান যাইবো
যাইবো, নবীন দোলার দেশেরে।
এই না পাক্কোয়ান যাইব
যাইব, নবীন বিয়াইর দেশেরে….।’
শিল্পাচার্য জয়নুল আবেদীনও ছিলেন নকশি পিঠার একজন মুগ্ধ শিল্পী। তিনি গ্রাম বাংলার এ পিঠার রূপে মুগ্ধ হয়ে বাংলা একাডেমির লোক সংগ্রহশালার জন্য নকশি পিঠার কিছু অনুকৃতি তৈরি করিয়ে দিয়েছিলেন। ফার্স্ট ফুডের আগ্রাসনে একদিন হয়ত বিদায় নেবে নকশি পিঠা। তখন ওই নকশি পিঠার অনুকৃতি বা মডেলগুলোই হয়ত বাংলার আগামী প্রজন্মকে জানাবে এ দেশের এই ঐতিহ্যবাহী লোকজ শিল্পটির কথা।
মন্তব্য করুন