Feeds:
পোস্ট
মন্তব্য

কাঁসালং – এর বাঁকে – সূর্য উৎসব ২০০৮

কাঁসালং – এর বাঁকে – সূর্য উৎসব ২০০৮

একলা পথিক

াত প্রায় ১০টা। শাহাবাগ ছবির হাটে অন্যান্য সাধারণ দিনের চেয়ে লোক সমাগম আজ বেশ বেশি। প্রায় দেড় শতাধিক লোকের সমাগম জায়গাটাকে বেশ উৎসবমুখর করে তুলেছে। আমি যখন পৌঁছলাম তখন লম্বা কিউ নজরে পড়লো। কাঁধে হ্যাভারস্যাক, ¯ি পিং ব্যাগ আর আপাদমস্তক গরম কাপড়ে ঢাকা লোকগুলোকে দেখলেই বোঝা যায় কোন অভিযানে যাওয়ার জন্য প্রস্তুত সকলে। এগিয়ে গিয়ে দেখলাম সূর্য-উৎসবের অভিযাত্রিরা সবাই নিজেদের আইডি কার্ড, ফুড-কুপন বুঝে নিচ্ছেন সেই সাথে জেনে নিচ্ছেন বাসে তার অবস্থান। কিছুক্ষণের মাঝেই ১৩৬ জন অভিযাত্রির দল নিয়ে ৪টি বাস ছুটবে রাঙ্গামাটির উদ্দেশ্যে। সূর্য-উৎসব ২০০৮-এ এবারের গন্তব্য বাংলাদেশের দ্বিতীয় বৃহত্তম জঙ্গল, পাবলাখালী। এর আগে এখানে যাওয়াতো দূরের কথা অভিযাত্রীদের কেউ এর নাম ও শুনেনি, তাই এ যাত্রায় সকলেই রোমাঞ্চিত ও শিহরিত নিজ দেশে নতুন ভূ-খন্ড আবিস্কারের আশায়।

বিগত সাত বছর যাবত বাংলাদেশ অ্যাস্ট্রোনমিকেল এসোসিয়েশন বাংলাদেশের বিভিন্ন অংশে সূর্য-উৎসব পালন করে আসছে। প্রথম সূর্য উৎসব পালন করা হয়েছিল বাংলাদেশের সর্ব দক্ষিণের সর্বশেষ ভূ-খন্ড সেন্টমার্টিন দ্বীপের ছেড়া দ্বীপে। পরবর্তীতে অংশগ্রহণকারীদের বিপুল আগ্রহের কথা বিবেচনা করে নিয়মিতভাবে এ উৎসব আয়োজনের সিদ্ধান্ত নেয়া হয়। সেই থেকে শুরু। পরবর্তী বছরগুলোতে এ উৎসব পালিত হয় – পৃথিবীর সর্ববৃহৎ ম্যানগ্রভ বন ‘সুন্দরবন’, দেশের সর্বোচ্চ শৃঙ্গ ‘কেওক্রাডং’ সৌন্দর্যের বেলাভূমি ‘নিঝুম দ্বীপ’, বাংলাদেশের উত্তরের সর্বশেষ সীমানা পঞ্চগড়ের ‘বাংলাবান্দা’, গাড়ো পাহাড়ের পাদদেশে প্রবাহিত সোমেশ্বরী নদীর তীরে ‘বিরিশিরি’ এবং গত বছর উজ্জাপিত হয় সুনামগঞ্জের “টাঙ্গুয়ার হাওর” – এ, আর এ বছর স্থান নির্ধারণ করা হয় “পাবলাখালী অভায়ারণ্য”। ৪২ হাজার ৮৭ হেক্টরের এই অভায়ারণ্যে বন্য হাতি ছাড়াও রেসাস বানর, মুখপোড়া হনুমান, উল ুক, কাঠবিড়ালি, সাম্বার হরিণসহ নানান রকম বন্যপ্রাণী ও পাখির বাস। পার্বত্য বনভূমির মেেধ্য এটাই সবচেয়ে সমৃদ্ধ তবে পাহাড়ের মাঝ দিয়ে বয়ে চলা জলরাশিও, কম গুরুত্ব বহন করে না। রাঙ্গামাটি শহর থেকে ১১২ কি.মি. দূরে কাপ্তাই হ্রদের একদম উত্তরে কাসালং নদীর পাশে ১০০ থেকে ৩০০ মিটার উচু পাহাড়ি এলাকায় এই পাবলাখালী আর কাসালং নদী বিভিন্ন ধারায় পাহাড়ি পথে প্রবাহিত হ্রদ সৃষ্টি করেছে গুরুত্বপূর্ণ জলাশয়। ১৯৬২ সালের জুনে একে গেইম অভয়ারণ্য হিসাবে প্রতিষ্ঠা করা হয় আর ১৯৮৩ সালে ঘোষণা করা হয় বন্যপ্রাণী অভয়ারণ্য হিসাবে। সূর্য-উৎসবের জায়গা নির্ধারণের ঘটনাটাও কিন্তু কম মজার না। সূর্য-উৎসব মানেই হলো এ্যাডভেঞ্চার এবং উৎসবের এক অপূর্ব মিশেল।

আর এবার উৎসব ব্যবস্থাপনায় বেসরকারি পর্যটন সংস্থা “ইনসাইটা ট্যুরিজম” যুক্ত হয়ে উৎসবে এনেছে নতুন মাত্রা। সে যাই হোক স্থান নির্ধারণের ঘটনাটা বলি – পূর্ববর্তী উৎসবের স্থানগুলো পর্যালোচনা করে দেখা গেল, সমুদ্র, নদী, পাহাড়, বন এমনকি হাওড়-এও উৎসব করা হয়ে গেছে। তাই এমন একটা জায়গার খোঁজ করতে হবে যেখানে অন্যবারের চেয়ে একটু বেশি কিছু পাওয়া যায়। নানান জনের কাছ থেকে নানান প্রস্তাবও আসতে লাগলো কিন্তু কোনটাই মনমত হচ্ছে না। সে সময় উৎসবের অন্যতম পরিচালক নওরজ ইমতিয়াজ ‘নিসর্গ’ থেকে একটি বই সংগ্রহ করেন যেখানে বাংলাদেশে সব বনাঞ্চলগুলোর বর্ণনা দেয়া আছে। অন্যান্য বনগুলোর নাম পরিচিত ঠেকলেও পাবলাখালী নামটা সকলের কাছে একদম নতুন, সেই সাথে বনের বর্ণনা আগ্রহের মাত্রা আরও বাড়িয়ে দিল, কারণ এখানে একই সাথে আছে – নদী, পাহাড় ও বন। এযে একের ভিতর তিন। সেই সাথে আছে বন্যপ্রাণীর পর্যাপ্ততা; কাজেই ঠিক করা হল এখানেই হবে এবারের সূর্য-উৎসব। কিন্তু সমস্যা হল এখন পর্যন্ত শুধু কাগজে-কলমেই জায়গাটা আমাদের পরিচিত স্বশরীরে আমাদের কেউই এর ত্রিসীমানায় যায়নি।

এমন অপরিচিত জায়গায়তো আর হুট করে এক দল লোক নিয়ে হাজির হওয়া যায় না। আর দলের সদস্য সংখ্যা যদি শতাধিক হয়, যার মধ্যে বৃদ্ধ থেকে শুরু করে শিশু পর্যন্ত রয়েছে সে ক্ষেত্রে তো প্রশ্নই ওঠে না। বিশাল ম্যাপ বিছিয়ে শুরু হলো গবেষনা । কি করে যাওয়া যায় এই জায়গায়। অনেক আলোচনা-পর্যালোচনা পর্যবেক্ষণ শেষে মোটামুটি একটা ধারণা পাওয়া গেল জায়গাটার অবস্থান সম্পর্কে। ঠিক হল আমি এবং মাহবুবুল আলম প্রধান (জুয়েল) রেকি করতে যাবো। ম্যাপ দেখে মনে হলো খাগড়াছড়ি দিয়ে গেলেই কাছাকাছি হবে। নির্ধারিত দিনে সায়দাবাদ বাস স্ট্যান্ড থেকে রাতের বাসে আমি আর জুয়েল রওনা দিলাম অজানার উদ্দেশ্যে। পরিচিত পথ ধরে বাস ছুটলো অপরিচিতের পথে। জানালা দিয়ে দ্রুত সরে যাওয়া ল্যাম্পপোস্ট দেখতে দেখতে আর বাসের ঝাকুনিতে কখন যে ঘুমিয়ে গেছি জানি না। যখন চোখ খুলে া তখন আধার ফিকে হয়ে ভোরের আলো ফুটতে শুরু করেছে। আশে পাশের দৃশ্যপট পাল্টে গেছে, বাস ছুটে চলছে আকাঁবাকা পাহাড়ি পথ ধরে, চারিধার কুয়াশার চাদরে মোড়ানো। দূর পাহাড়ের গা ঘেষে বয়ে চলছে ঘন মেঘ। সকাল আটটায় পৌঁছলাম খাগড়াছড়ি কলেজ রোড বাস স্টেশনে। এখান থেকে বাস বদল করে যেতে হবে মারিশ্যা। সাথে সাথেই বাস পেয়ে যাওয়ায় নাস্তার পিছনে সময় নষ্ট না করে আবার বাসে চেপে বসলাম। সাড়ে দশটা নাগাদ মারিশ্যা পৌঁছলাম। কিন্তু এরপর! বিপত্তি বাঁধলো তখন যখন স্থানীয় কেউই পাবলাখালীর কোন হদিশ দিতে পারলো না। তারা যেন আমাদের মুখেই এই নাম প্রথম শুনেছে। পরে আমরা দু’জন ঠিক করলাম বনবিভাগের অফিসে গেলেই আসল তথ্য পাওয়া যাবে। আমাদের দৃঢ় বিশ্বাস বইয়ে যেহেতু উলে খ আছে তখন এ বনও অবশ্যই আছে। অনেক খোঁজাখুজি করে পেয়ে গেলাম বন বিভাগের অফিস। বন কর্মকর্তারা আন্তরিকতার সাথেই আমাদের সহায়তা করলেন।

বাৎলে দিলেন পাবলাখালী যাওয়ার পথ, ট্রলারও ঠিক করে দিলেন যাওয়ার জন্য; সেই সাথে দিয়ে দিলেন প্রয়োজনীয় নির্দেশনা। প্রায় আড়াই ঘন্টা নদী পথ পেড়িয়ে অবশেষে পৌনে তিনটায় পৌঁছলাম পাবলাখালী ফরেস্ট রেঞ্জের ঘাটে যা স্থানীয়ভাবে আমতলী ঘাট হিসাবে পরিচিত। ফরেস্ট রেঞ্জার খলিলুর রহমান গাজী এবং গেইম অভয়ারণ্য রেঞ্জার এ.এফ.জি মোস্তফা আমাদের যথেষ্ট সমাদর করলেন। তাদের জানালাম আমাদের আগমনের হেতু এবং জানতে চাইলাম আমাদের পরবর্তী করণীয় বিষয়াদি। সৌজন্য সাক্ষাৎ শেষ করতে করতে প্রায় সাড়ে তিনটা। পেট অনেক আগেই জানান দিয়ে দিয়েছে যে সকাল থেকে ওখানে কিছু পড়েনি। তাই দু’জন রওনা হলাম কাছের বাজারে গিয়ে পেট পুজোটা সেরে নিতে। মনিরের হোটেলে খেয়ে আমরা মুগ্ধ এমন প্রত্যন্ত অঞ্চলে এমন রান্না পাব আশা করি নি। ভাত, মাছ, মাংস, সব্জি সবই আছে এবং রান্নাও অপূর্ব। খেতে খেতেই জানতে পারলাম কাছের বনে বন্য হাতির পাল এসেছে। এমন সুযোগতো আর হেলায় হারানো যায় না; তাই দুজন ঠিক করলাম খাওয়া সেরে হাতি দেখতে যাব। মনিরকে বলতেই সে ব্যবস্থাও করে দিল। সামসুদ্দিন নামে এক বয়জষ্ঠকে আমাদের সাথে দিল বনে নিয়ে যাবার জন্য। যেতে হবে নৌকায়, আমরা সামসু চাচার সাথে রওনা হলাম যেখানে তার নৌকা বাঁধা আছে। তার ছোট্ট নৌকায় রওনা হলাম পাহাড়েরর মাঝ দিয়ে আকাঁবাকা বয়ে চলা জলপথ দিয়ে। চারিধার অদ্ভুত নিস্তব্ধতা। নানান যান্ত্রিক আওয়াজে অভ্যস্ত আমাদের এই কানে প্রকৃতির এই নিস্তব্ধতাকে অপার্থিব বলে মনে হচ্ছিল। নাম না জানা পাখির গান, গাছের শুকনো পাতার উপর দিয়ে বয়ে চলা শীতের বাতাসের শব্দ আর পানিতে বৈঠা পড়ার শব্দ মিলে তৈরি হয়েছে এক অদ্ভুত সিম্ফনী। আমরা কেউ কোন আওয়াজ করছি না পাছে ছন্দ পতন ঘটে। পাহাড়গুলো লতা গুল্মো ছাওয়া, তারই ছায়া পড়েছে স্বচ্ছ জলাধারে। দূরে আরও দুটি মাছ ধরার নৌকা চোখে পড়লো যারা নিজ মনে জাল টানছে। প্রায় ঘন্টা দেড়েক চলার পর হঠাৎ কানে এলো হাতির ডাক, সচিকিত হয়ে নড়ে চড়ে বসলাম সকলে। উত্তেজনায় নৌকাটাও দুলে উঠলো খানিকটা। সামসু চাচা আঙ্গুল তুলে দেখালেন ওই পাহাড়েই আছে মামারা। স্থানীয়রা হাতিকে মামা ডাকে। আমরা নৌকা ভিরালাম বিপরীত দিকের টিলায়। একেবারে বন্য হাতির মুখোমুখি হবার ইচ্ছে আমাদের কারুরই নেই। পাহাড়ের মাথায় যখন উঠলাম ততক্ষণে হাতির দল সরে যাচ্ছে আরও ভিতরের দিকে।

শেষতক একটি বড় হাতির আর একটি হস্তিশাবকের অবয়বই চোখে পড়লো শুধু। বাচ্চাটার মাই হবে হয়তো। ফিরে এলাম বন বিভাগের অফিসে। রাতটা তাদের এখানেই কাটালাম। পরদিন ভোরে একটি ছোট লঞ্চে করে রওনা হলাম রাঙামাটির উদ্দেশ্যে। পাবলাখালী থেকে মাইনী, লঙ্গদু, বর্ণছড়ি, শুভলং পাড় হয়ে রাঙামাটি পৌঁছতে দুপুর গড়িয়ে গেল। যাই হোক ফিরে আসা যাক মূল কাহিনীতে, ছবির হাট থেকে বাস ছাড়লো ১১টা ৪০ মিনিটে, শুরু হলো অ্যাডভেঞ্চার পাবলাখালী। আমাদের এই দলে ছাত্র, শিক্ষক, চিকিৎসক, প্রকৌশলী, চাকুরীজীবি, ব্যবসায়ী, সাংবাদিক, মিডিয়াকর্মী, সমাজকর্মী সহ নানান পেশার মানুষ রয়েছে। সেই সাথে আমাদের আতিথ্য গ্রহণ করেছেন বিশিষ্ট কথা সাহিত্যিক এবং প্রকৃতিবিদ বিপ্রদাশ বড়–য়া এবং নিসর্গী মোকারম হোসেন। মাঝরাতে যখন কুমিল ার ময়নামতিতে পৌঁছলাম তখন দেখি কৃষ্ণপক্ষের অষ্টমির চাঁদও আমাদের সাথে হাজির হয়েছে উৎসবে যোগ দিতে।

জ্যেৎস্না-কুয়াশায় মিশেল আবরণে ঢাকা চারিধার। দল-বল নিয়ে ডলি রিসোর্টে ঢুকে পুরো জায়গাটা সরগরম করে তুল াম। বয়-বেয়ারা সব ব্যস্ত হয়ে পড়লো একসাথে এত লোককে সামাল দিতে। সব্জি-পরটা আর চা খেয়ে সকলে বেশ চাঙা হয়ে উঠলো। সকলের হাসি-ঠাট্টা আর গান রাতের নিস্তব্ধতা ভেঙে পরিবেশটাকে উৎসবমুখর করে তুলেছে। চট্টগ্রাম শহর ছাড়িয়ে রাঙ্গামাটি যখন পৌঁছলাম রাত তখন শেষ হয়ে গেছে, কিন্তু সূর্যের দেখা নেই। বছরের এই সময়টাতে সূর্যের এই লুকচুরি খেলা হরহামেশাই চলে। তা চলুক ওতে আমাদের আনন্দে কোন ভাটা পরবে না। রাঙ্গামাটির কর্ণফুলি নদী লাগোয়া হোটেল সুফিয়া ইন্টারন্যাশনালে উঠে সবাই প্রাতরাশ এবং নাস্তা পর্ব শেষ করে ছুট দিল ফিশারিজ ঘাটে যেখানে রিজার্ভ লঞ্চ কেয়ারী কর্ণফুলি আমাদের অপেক্ষায় তীরে ভাসমান। প্রথম গন্তব্য মাইনি। আমাদের শুভেচ্ছা জানাতে ডিস্ট্রিক ফরেষ্ট অফিসার উত্তম কুমার সাহা ঘাটে এলেন। তার সাথে সৌজন্য সাক্ষাৎ শেষে সাড়ে ১০টায় আমারা যাত্রার দ্বিতীয় ধাপ শুরু করলাম। এর মাঝে অভিযাত্রী দল নিজেদের মধ্যে আলাপ পরিচয় সেরে নিলেন। নওরজ ইমতিয়াজের পরিচালনায় শুরু হলো উৎসব ব্রিফিং। বাংলাদেশের অন্যতম মাউন্টেনিয়র মুসা ইব্রাহিম (বাংলাদেশ থেকে যে ক’জন সৌভাগ্যবান এখন পর্যন্ত হিমালয় পর্বতে গিয়েছেন তিনি তার মধ্যে একজন) অভিযাত্রীদের অ্যাডভেঞ্চার সম্পর্কে নানান তথ্য দিলেন সেই সাথে ভাগাভাগি করে নিলেন নিজের অভিজ্ঞতা। ঘুড়ি প্রেমী বেনু ভাই অভিযাত্রীদের দিলেন ঘুড়ি সম্পর্কে নানান মজার তথ্য। বিপ্রদাশ বড়–য়া যিনি যৌবন থেকে আজ অব্দি চড়ে বেড়িয়েছেন এখানকার পাহাড়, নদী আর অরণ্য; তার কাছ থেকে জানলাম নানান রমাঞ্চকর অজানা তথ্য। আঙ্গুল দিয়ে দেখিয়ে দিলেন শুভলং ঝর্ণার বিপরীতে ওই দূর পানির নিচেই তলিয়ে গেছে চাকমা রাজার বাড়ি। জানতে পারলাম এখানকার সব পাহাড়াই নাকি উত্তর-পূর্বমুখী। নিসর্গী মোকারম হোসেন জানালেন এখানকার পরিবেশ বিপর্যয়ের কথা। কথার ফাঁকে বেনুভাই কখন যে তার আমনীকৃত চীনা চড়কি আর ঘুড়ির পসরা খুলে বসেছেন খেয়ালই করি নি। আমরা ক’জন তার কাছে থেকে কয়েকটা চরকি নিয়ে হাওয়ার বিপরীতে ঘুড়াতে লাগলাম আর উনি উড়াতে লাগরেন ডাউস সাউজের ঘুড়ি।

কখনো বেসাতি, কখনো অক্টোপাস, আমরা ঘুড়ি না ওড়ালেও কনটিকি আঁকা বাইশ ফুটের একটা পাল কেয়ারীর মাথায় উড়িয়ে দিয়েছিলাম সেই সকালেই। হাওয়ার তোরে পালটাও উড়তে লাগলো পতপত করে। দুপুর আড়াইটা নাগাদ পৌঁছলাম মাইনি বাজারে। নেমেই পালা করে পেট পুজা শুরু করে দিল। পালা করে কারণ একবারে এত লোক বসার ব্যবস্থা এখানে নেই। অভিযাত্রীদলও শৃঙ্খলার সাথে খাওয়ার পর্বটা শেষ করে আবার লঞ্চে গিয়ে উঠলো। লঞ্চ ঘুরিয়ে সকলকে নিয়ে আসা হলো রাবেতা হাসপাতালের ঘাটে। আমাদের অভ্যর্থনা জানাতে অপেক্ষায় ছিলেন রাবেতার কর্মকর্তারা। পরিচয় পর্ব শেষ করে রওনা হলাম দুই কিলোমিটার দূরে অবস্থিত রাবেতা কলেজ ক্যাম্পাসে। পথের একধারে ফল-ফুলের বাগান আর অন্যধারে পাহাড়ের কোল ঘেষে লেক। আশেপাশের সৌন্দর্য পাহাড়ি পথে দুই কিলোমিটার হাটার ক্লান্তি অনেকটা কামিয়ে দিল। রাবেতা কলেজে ব্যাগ-ট্যাগ রেখেই স্থানীয় ছাত্র-শিক্ষক এবং অভিযাত্রীদের মধ্যে শুরু হলো বলিভল খেলা, দলের কিছু অংশ সারা দিনের ক্লান্তি ঝেড়ে ফেলতে ঝাপ দিল পাশের লেকে। ভলেন্টিয়াররা সবাই লঞ্চ হতে প্রয়োজনীয় সরঞ্জাম নামাতে ব্যস্ত। এর মধ্যেই এক জন ‘গেল গেল’ বলে চিৎকার করে পাহাড় কাপিয়ে তুলে া। বছরের শেষ সূর্য অস্ত যাই যাই করছে। সবাই ছুটলো কলেজের পাশেই একটা পাহাড়ের উপর সেনাবাহিনীর হেলিপ্যাডে। সেখান থেকে পুরো এলাকাটা চমৎকার দেখা যায়। সকলের চোখের সামনে পাহাড়ের ফাঁক গলে টুপ করে ডুবে গেল বছরের শেষ সূর্যটা। আলো-আধাঁরিতে ছাওয়া চারিধার আধ-খাওয়া চাঁদটা উঁকি দিচ্ছে আকাশে। পাহাড়ি এলাকায় মশার প্রকোপ বেশি এবং মারাত্মকও বটে। একবার ম্যালেরিয়া হলে আর রক্ষা নেই। কাজেই হাত-পায় আর শরীরের খোলা অংশে মশারোধক ক্রিম ওডোমস মাখতে ব্যস্ত হয়ে পড়লো সবাই। সন্ধ্যা সাতটা। সকলে গোল হয়ে বসে আছি হেলিপ্যাডে। শুরু হয় রাতের উৎসব প্রস্তুতির প্রথম অংশ। মেজবা আজাদের পরিচালনায় পরিচয়পর্ব এবং উৎসব ব্রিফিং শেষ করে সকলে ফিরে এলাম কলেজ ক্যাম্পাসে। ছোট ছোট দলে ভাগ হয়ে সকলে ঝাপিয়ে পড়লো প্রস্তুতি কর্মে। কেউ বানাতে লাগলো মঙ্গল প্রদীপ, কেউ ফানুস, কেউ বা রঙিন লণ্ঠন। কলেজের মাঠে সেলিম ভাইয়ের নেতৃত্বে একদল লাকড়িতে আগুন জ্বালিয়ে শুরু করলো বিভিন্ন আঞ্চলিক গান। খাবার আয়োজনে আমাদের ফুড মিনিস্টার জুয়েলের সজাগ দৃষ্টি। সকলে যখন যার যার কাজে ব্যস্ত তখন সে ব্যস্ত খাবার আয়োজনে। রাত নয়টায় জুম চাষের ভাত, মুরগির মাংস, ডিম, ডাল আর টমেটোর সালাদ দিয়ে অভিযাত্রী দল খাবার পর্বটা সেরে নিলেন পরম তৃপ্তির সাথে। খাবারের পর এমন ঠান্ডায় এক কাপ গরম চা যদি পাওয়া যেত তবে খাওয়ার ষোলকলা পূর্ণ হতো। তবে এমন পাহাড়ি এলাকায় যার ত্রিসীমানায় কোন লোকালয় নেই সেখানে এমন বিলাসী ইচ্ছাটাকে অনেকেই যখন বুকের মাঝেই কবর দিতে যাচ্ছিলেন তখনই ফুড মিনিস্টার এসে গম্ভিরস্বরে ঘোষণা দিলেন, আপনাদের জন্য চা পানের আয়োজন করা হয়েছে। যে যত কাপ ইচ্ছা খেতে পারেন। সকলে লক্ষ্য করলেন মাঠের এক কোনে বেঞ্চির উপর চা বানানোর সরঞ্জাম নিয়ে দুটি লোক বসে আছে।

এরই মাঝে কত্থেকে যেন সে চাওয়ালা যোগার করে ফেলেছে। এই না হলে কি আর ফুড-মিনিস্টার; বলার আগেই সব বুঝে ‘লক্ষ্মি ছেলে’! রাত ১১টায় যার যার মতো মঙ্গল প্রদীপ, লণ্ঠন আর ফানুস হাতে ক্যান্টনমেন্টের লেকে ছুটলো সবাই। হেলিপ্যাড থেকে লেক পর্যন্ত পুরো পথটাকে সাজানো হলো রঙিন কাগজে মোড়া লণ্ঠন দিয়ে, কিছু লণ্ঠন ঝুলিয়ে দেয়া হলো গাছের ডালে। অল্প অল্প কুয়াশার মধ্যে লাল-নীল-হলুদ-সবুজ কাগজে মোড়া লণ্ঠনগুলো পুরো এলাকাকেই আচ্ছাদিত করলো এক অলৌকিক অবরণে। সূর্য উৎসবে যোগ দিতে মাইনির ২৫ বেঙ্গল রেজিমেন্টের জোন কামান্ডার লেঃ কর্ণেল মুস্তাফিজ সপরিবারে চলে এলেন। ঠিক জিরো আওয়ারে রাতের আকাশ আলো করে জ্বলে উঠলো ফ্লেয়ার। লেকের জলে ভাসানো হলো মঙ্গল প্রদীপ। দূর থেকে দেখে মনে হচ্ছিল পুরনো বছরের সকল জীর্ণতা-গ ানি মুছে নতুন বারতা নিয়ে ধীর গতিতে এগিয়ে চলছে কোন আলোর মিছিল। অভিযাত্রীরা প্রত্যেকে নতুন বছরের শুভেচ্ছা বিনিময় করলো। ফানুস স্পেশালিস্ট নূর মোহাম্মদ এরই মধ্যে ফানুস ওড়ানোর সকল আয়োজন সম্পন্ন করে ফেলেছে। বাতাসের বাড়াবাড়িতে প্রথম দু’টি উড়ার আগেই পুড়ে খাক হলেও পরের দু’টি দিব্যি উড়ে গেল উচুতে। নীচ থেকে অবাক হয়ে দেখতে লাগলাম সকলে এই সফল উৎক্ষেপন। উচুতে ফানুসগুলোতে আগুন ধরে যাওয়ায় তৈরি হল অদ্ভুত এক আলোর খেলা। তারপর হেলিপ্যাডে সেনাবাহিনীর আতিথীয়তা গ্রহণ করলাম। শীতের রাতে সেনাবাহিনীর আয়োজনে চা-পর্ব উৎসবে এনে দিল নতুন মাত্রা।

প্রদীপ দিয়ে হেলিপ্যাডটাকেও সাজানো হলো। সীমান্ত লাগোয়া দুর্গম সেই পাহাড়ি এলাকায় মধ্যরাতের এই উৎসব সমতলের বাসিন্দারা নিশ্চয়ই অনেকদিন মনে রাখবে। তাছাড়া পাহাড়ের ওপর হেলিপ্যাডে নববর্ষ উৎযাপনের অভিজ্ঞতাও নিশ্চয়ই কোন অভিযাত্রীর নেই। রাত ১টা নাগাদ সবাই ঘুমাতে চলে গেলাম। আমাদের পরবর্তী গন্তব্যের উদ্দেশ্যে রওনা দেয়ার জন্য ভোর ৪টায় উঠতে হবে তাই সারা দিনের কর্ম ক্লান্ত শরীরটাকে খানিকটা আরাম দেয়া প্রয়োজন। ভোর ৪টায় সবাইকে টেনেটুনে ওঠানো হল ঘুম থেকে। ব্যাগগুছিয়ে সকলে লঞ্চে উঠে বসলো। অভিযাত্রীদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে সেনাবাহিনীর একটা পেট্রোল বোটও ঘাটে হাজির। কিন্তু ঘন কুয়াশার কারণে লঞ্চ ছাড়া যাচ্ছে না। ক্যাপ্টেন একদমই নড়তে সাহস পাচ্ছে না। অবশেষে ভোর ছয়টায় অন্ধকার ফিকে হয়ে আসার পর লঞ্চ চলতে শুরু করলো। পূব আকাশে এরই মাঝে বছরের প্রথম সূর্যটা হয়তো উঠে গেছে কিন্তু কুয়াশার বৈরীতায় তার সাথে আর দেখাই হল না। মাইনী থেকে পাবলাখালীর এক ঘন্টা পথ পার হতে আমাদের আড়াই ঘন্টা সময় লাগলো। যে ডুবো পাহাড়ের ভয়ে দেরীতে লঞ্চ ছাড়া হলো ঘুরে ফিরে একের পর এক সেই ডুবো পাহাড়েই লঞ্চ আটকাতে লাগলো। ডুবো পাহাড় এড়াতে গিয়ে পথ ভুল হলো একবার। এর মধ্যে যে কত মাঝিকে পটানো হলো লঞ্চের সাথে থেকে দেখিয়ে দেয়ার জন্য কিন্তু লাভ কিছুই হলো না। তাদের বাতলে দেওয়া পথেও চোরা পাহাড় থেকে বাচা গেল না।

লঞ্চ যখন নানান ডুবো পাহাড়ে গোত্তা খাচ্ছিল তখন বিপ্রদাস বড়–য়া ব্যস্ত ছিলেন অভিযাত্রীদের এই নদীপথ সম্পর্কে নানান তথ্য দিতে। লঞ্চ যাচ্ছে কাসালং নদী দিয়ে। আর এই পুরো ব কে রয়েছে কর্ণফুলী, মাইনী এবং চেংরি নদী। এই ফাঁকে স্বর্ণা সকলের মাঝে টি-সার্ট ও সূর্য মুকুট বিলিয়ে দিল। সমস্ত প্রতিবন্ধকতা পার করে অবশেষে সকাল ৯টায় লঞ্চ পৌঁছলো আমাদের বহুল প্রতিক্ষিত পাবলাখালীর ঘাটে। সদলবলে আমরা উঠলাম জঙ্গলের রেষ্টহাউজ ‘বনসখী’তে। এখানেই হবে আমাদের পরবর্তী কার্যক্রম। মনিরকে আগেই বলাছিল দেড়শ লোকের নাস্তার আয়োজন করে রাখতে এবং সে তার দায়িত্ব দক্ষতার সাথেই পালন করেছে। অভিযাত্রী দল লাইনে দাড়িয়ে যার যার খাবার সংগ্রহ করলেন। যে রান্না ঘরটা থেকে খাবার পরিবেশন করা হচ্ছিল রেকি করতে এসে সেটা আধ-ভাঙ্গা দেখেছিলাম। না ঝড়ে ভাঙ্গেনি ভেঙ্গে দিয়েছিল বন্য হাতি। এ খবর শুনতেই অভিযাত্রীদের কারো কারো মধ্যে আতঙ্ক, কারো কারো মধ্যে উত্তেজনা দেখা গেল। নাস্তা সেরে তাই দলবল নিয়ে বেড়িয়ে পড়লাম জঙ্গল দর্শনে। পুরো দলের নেতৃত্ব দিচ্ছিলেন বিপ্রদাশ বড়–য়া, মোকারম হোসেন। সাথে কয়েকজন বনকর্মকর্তা ও নিরাপত্তারক্ষিও ছিল। তারা জানালেন, কাসালং রিজার্ভের অংশ বিশেষ এই বন চারটি ব ক নিয়ে গঠিত-শিশক পশ্চিম, শিশক পূর্ব, সর্বাতলী পূর্ব এবং মাইখ্যা ব ক। মিয়ানমার আর ভারতের সীমান্ত ঘেসা এই পাবলাখালী বনের পুরোটাই পাহাড়ী জঙ্গলবিশেষ মাঝ দিয়ে বয়ে চলা ছোট ছোট খাল সৃষ্টি করছে ছোট ছোট দ্বীপের। বড়–য়া মশাই অভিযাত্রীদের ধরে ধরে চেনালেন চাম্ভুল, লোহাকাঠ, কাননচূড়া, পদাউক, আদি কাটা মেহেদী, শীলকড়ই, কাজুবাদাম, সেগুন ইত্যাদি। বনের ভিতর একটু ঢুকতেই গাছের ফাঁকে কিছু একটা নড়েচড়ে উঠতেই থমকে দাড়ালাম সকলে। শীতল শিহরণ নেমে গেল মেরুদন্ড বেয়ে। হাতি নয়তো! আমাদের অবাক করে দিয়ে এক ছুটে গাছে উঠে গেল এক বানর ছানা। আরও কিছু দূর যেতে চোখে পড়লো নরম মাটিতে হাতির তাজা পায়ের ছাপ। হয়তো গত রাতেই চড়ে বেড়িয়েছে হাতির দল।

পাশে পরে আছে হাতির লেদা। হাতির হজম শক্তি খুব খারাপ, যা খায় তার অল্পই হজম করতে পারে। চ্যানেল আইয়ের রহমান মোস্তাফিজ দেখালেন সাপের ফেলে রাখা খোলস। দূরের গাছটাতে ছুটাছুটি করছে কয়েকটা কাঠবিড়ালি। হঠাৎই তীক্ষè ডাক দিয়ে হলুদ ডানা ঝাপটে উড়ে গেল একটি পাখি। বড়–য়া মশাই বললেন, এর নাম ‘বেনে বৌ’। নিরাপত্তার খাতিরে জঙ্গলের বেশি ভেতরে আমাদের যেতে দেয়া হল না। অগত্তা জঙ্গল পরিভ্রমণের ইতি টেনে ফিরে এলাম রেষ্টহাউজে। ফিরে দেখি অবাক কান্ড! রেষ্টহাউজের সামনে উঠছে চলি শ ফিট লম্বা বিশাল এক রঙিন সূর্য। বেনীআসহকলা সূর্যের এই সাত রঙের মিশেলে বানানো হয়েছে কাপড়ের এই সূর্য। মাঝখানে লাল হলুদ কমলা ১৫ ফুট ব্যসের এক বৃত্ত। তার চারপাশে সাত রঙের সাতটি ডানা। টান টান করে বেঁধে দেয়া হয়েছে গাছের সাথে। সকালের সূর্য না দেখার কষ্টটাকে ভুলতেই বুঝি এই আয়োজকদেও এই আয়োজন। চারদিকে বাঁশে মাথায় উড়িয়ে দেয়া হল সাত রঙা পতাকা। অভিযাত্রী বনকর্মকর্তা, সেনাকর্মকর্তাসহ স্থানীয় সকলে এর মাঝে দাড়িয়ে ছবি তুললো। এখানকার স্কুলের শিশুরাও চলে এসেছিল উৎসবে যোগ দেয়ার জন্য। তাদের জন্য আগে থেকে কিছু খেলনা নিয়ে এসেছিলাম- বাশি, টুমটুম গাড়ি, বেলুন পেয়ে তো তারা মহা খুশি। তাদের নিয়ে আরও কিছু অনুষ্ঠান করার ইচ্ছা ছিল, তবে সময়ের অভাবে করা সম্ভব হলো না। সন্ধ্যের আগেই আমাদের ফিরতে হবে রাঙ্গামাটি। দুপুর নাগাদ লঞ্চ ছুটলো রাঙ্গামাটির উদ্দেশ্যে। সেই সাথে ছুটলো মনিরের খাবারের ট্রলার। মনির দুপুরের খাবার ট্রলারে করে নিয়ে এসেছিল। ট্রলার থেকে খাবার বেড়ে পে ট লঞ্চে দিচ্ছে আর হাতে হাতে পৌঁছে যাচ্ছে অভিযাত্রীদের হাতে।

প্রকৌশলী মঞ্জুর ভাইয়ের দুই ছেলে চমৎকার ভলেন্টিয়ারী কাজ করলো। মনির খাবার শেষ করে মাইনী মুখ থেকে সকলের কাছ থেকে বিদায় নিয়ে ফিরে গেল পাবলাখালী। আর অন্যরা যোগ দিল সেলিম ভাইয়ের গানের আসরে। সেলিম ভাইয়ের গান সকলকে মাতিয়ে রাখলো সাড়াটা পথ। এক ফাঁকে আমি সকলের হাতে ফ্রেন্ডশীপ ব্যান্ড পরিয়ে দিলাম। বন্ধুত্ব করার এই তো সুযোগ। ঘোর সন্ধ্যায় ফিরে এলাম রাঙ্গামাটির ফিশারিজ ঘাটে। মাঝে অবশ্য শুভলং থেমেছিলাম সবুজ পাহাড়ের ছায়া ঘেরা লেকটাকে পাহাড়ের উপড় থেকে দেখার জন্য, এই ফাঁকে অনেকে শুভলং বাজারে হালকা নাস্তাও সেরে নিলেন। সুফিয়াতে রাতের খাবার শেষ করে বাস ছেড়ে দিল ঢাকার পথে। দু’দিনের টানা সফরে ক্লান্ত শহুরে মানুষগুলো আবার ফিরে যাচ্ছে যান্ত্রিক জীবনে এক টুকরো মায়াময় স্মৃতি আর আকাশে শুক্লপক্ষের চাঁদ নিয়ে। ঢুলু ঢুলু চোখে সবাই যখন বাসের নরম গদিতে শরীর এলিয়ে দিয়েছে, কারো কি মনে পড়েছিল পাশের চোরাখালী গ্রাম থেকে আসা সেই চাকমা শিশুটির কথা? এই প্রচন্ড শীতেও উদোম গা আর খালি পায়ে এসেছিল আমাদের কাছে। আবাক নেত্রে চেয়েছিল আমাদের দিকে। গরম কাপড়ে মোড়া এই মানুষগুলোকেই হয়তো তার কাছে সবচেয়ে অদ্ভুত দর্শনীয় বস্তু বলে মনে হয়েছিল।

অদেখা এক বনের পথে

অদেখা এক বনের পথে

মোকারম হোসেন

কোথাও বেড়াতে যাবার নিমন্ত্রণ উপেক্ষা করা কঠিন। কিন্তু আয়োজক সংস্থার কর্ণধার মশহুরুল আমিন মিলনের ভ্রমণ প্রস্তুতি ব্রীফ শুনে অনেকেই ভয়ে কেটেপড়ার কথা ভাবছিলেন। কারণ পাবলাখালী অভয়ারণ্যে নাকি হাতির উৎপাত আছে। সবশেষে তিনি আসল কথাটা পাড়লেন। সেই বনের ভেতর নাকি একটা রাতও কাটাতে হবে সবাইকে। আ্যডভেঞ্চার ট্যুর বলে কথা। সবার সঙ্গে আমিও সাহস সঞ্চয় করে বসে থাকলাম। শেষমেষ যাবার সিদ্ধান্ত হলো। রাঙামাটি জেলার মাইনি উপজেলায় অবস্থিত দেশের দ্বিতীয় বৃহত্তম অভয়ারণ্যে নতুন বছরের প্রথম সূর্য দেখতে যাব আমরা। ৩০ ডিসেম্বর রাতে গাড়িতে উঠতে গিয়ে দেখি এলাহি কান্ড। ১৩০ জনের একটা দল। নানান পথ, নানান মতের মানুষ। একদল সংবাদকর্মীও আছেন। চারচারটে গাড়ি দাঁড়িয়ে।

সমস্ত কিছুই গোছাল। নওরোজ ইমতিয়াজ, মুসা ইব্রাহিম আর মশহুরুল আমিন মিলনকে ছুটোছুটি করতে দেখা গেল। আমার আগেই কথাশিল্পী ও নিসর্গী বিপ্রদাশ বড়–য়া চলে এসেছেন। ১১টা ৪০ মিনিটে রাতের নিস্তব্ধতা ভেঙে রাঙামাটির উদ্দেশ্যে আমাদের যাত্রা শুরু হলো। রাতভর কুয়াশার লুকোচুরি। পথের ওপরই যেন তাদের ঘরবাড়ি। আমাদের গাড়ি হঠাৎ করেই সেসব ঘরের ভেতর ঢুকে পড়ছে। তারপর আবার মুক্ত পথে। এভাবেই মধ্যরাত গড়িয়ে এলো। কুয়াশার চাদর যেন আদরমেখে আছে চারপাশে। কি মনে করে হঠাৎ থামল গাড়িটা। নষ্টটষ্ট হলো নাতো! বাইরে উঁকি দিয়ে বুঝলাম এখন চা বিরতি। অন্য গাড়িগুলোও এসে দাঁড়াচ্ছে। এটাও একটা চমক। জানতাম একছুটে একেবারেই চট্টগ্রাম। সবাই ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র দলে বিভক্ত হয়ে চা-গল্পে মেতে উঠল। অবশ্য বেশিক্ষণ এই গল্প চলল না, হ্যামিলনের বাঁশিঅলার (বাস) দিকে ছুটতে হলো। পরিবেশ-প্রকৃতির নানান প্রসঙ্গে আমাদের নির্ঘুম রাত কাটল। ভোরের আলো ফোটার আগেই আমাদের গাড়ি চট্টগ্রাম শহর অতিক্রম করল। কুয়াশামোড়ানো ভোরে রাঙামাটি শহরের হোটেল সুফিয়াতে গাড়ি থামল। হোটেলে ঢুকে দেখি সবকিছু প্রথম গাড়ির বন্ধুদের দখলে। বাথরুমের সামনে দীর্ঘ লাইন। যেন টিকিট কেটে সবাই গাড়িতে ওঠার জন্য অপেক্ষা করছে। এটাই বাস্তবতা। সবার জন্যতো আর একটা একটা বাথরুম থাকবে না।

বিপ্রদাশ বড়–য়া আমার আগে আগেই নাস্তার টেবিলে এসে বসলেন। নাস্তা সেরে ফিশারি ঘাটে অপেক্ষমান কেয়ারি কর্ণফুলিতে চেপে শুরু হলো আমাদের চমকপ্রদ ভ্রমণ। বার কয়েক ভ্রমণের সুবাদে দু’পাশের প্রায় সব দৃশ্য আমার মুখস্ত। এই অঞ্চলের সবছিুই বিপ্রদার নখদর্পণে। পাহাড়গুলোতে কোন কোন জাতের গাছ থাকে, কোন কোন জাতের প্রাণী থাকে। মানুষের নির্মমতায় যেসব প্রাণী ইতোমধ্যেই বিলুপ্ত হয়ে পড়েছে তাদের কথাও জানা গেল। প্রসঙ্গত তিনি হাতির গল্পও বললেন। আমরা যেখানে যাচ্ছি সেখানে প্রায়শই হাতির দেখা মিলে। এসব বন্যহাতিরা যথার্থই বিপদজনক। লঞ্চ ছাড়ার কিছুক্ষণের মধ্যেই এই দ্বিতল জলজানে উৎসব আমেজ ছড়িয়ে পড়ল। ক্রমেই দুর্গম হয়ে উঠছে পাহাড়। কোথাও খাড়া পাহাড়, কোথাও ঘনজঙ্গল, কোথাও পাহাড়ের গায়ে সময়ের বলিরেখা স্পস্ট। শাখামৃগ বানরের দল নেমে এসেছে লেকের কিনারে। এখানে তাদের বিরক্ত করার কেউ নেই। তারপর চোখে পড়ল শীতের হতশ্রী সুবলং ঝরনা। নানান কৃত্রিম স্থাপনায় এখানকার প্রাকৃতিক সৌন্দর্য বিঘিœত হয়েছে। তারপর সুবলং বাজার। কাছাকাছি দূরত্বে পেদা তিং তিংয়ে পেটপুরে খাবার ব্যবস্থা। এদিকের পাহাড়গুলো ন্যাড়া। এরই ফাঁকে নওরোজ ইমতিয়াজের সঞ্চলনায় শুরু হলো আলোচনা পর্ব । মুসা ইব্রাহিম জানালেন অ্যাডভেঞ্চার আর পাহাড়ে ঘোরার গল্প ও করণীয়, বিপ্রদাশ বড়–য়া বললেন এখানকার আদি ইতিহাস, জীববৈচিত্র আর প্রাকৃতিক সৌন্দর্য নিয়ে। আমি বললাম ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতার কথা। বিশ বছরের ব্যবধানে এখানে বদলে গেছে অনেক কিছুই। কিন্তু ততক্ষণে সবার চোখ দু’পাশের অপার সৌন্দর্যের কোলে সমর্পিত। জলচর পাখিদের সঙ্গে শীতের অতিথি পাখিরাও নেমেছে। কোথাও কোথাও পাহাড় অনেক দূরে সরে যাচ্ছে। মাঝে মাঝে পণ্যবাহী ট্রলার পাশকাটিয়ে চলে যায়। কিছু কিছু টিলা বিচ্ছিন্ন, দ্বীপের মতো। এমন কয়েকটি বাজারও চোখে পড়ল।

সংখ্যায় আদিবাসীরা কম। বাসস্থান হারিয়ে তারা আরো গভীর পাহাড়ে ঠাঁই নিয়েছে। কাপ্তাই বাঁধের কারণে সরু নদীর পানি ফুলেফেঁপে লেকে পরিনত হয়েছে। তাতে এখানকার জীববৈচিত্রও মারাÍক ক্ষতির সম্মুখীন হয়েছে। পৌষের সোনারোদ, পাহাড়, অরণ্য আর নীল জলরাশির মোহ সবাইকে যেন আচ্ছন্ন করে রাখল। এদিকে দুপুর গড়িয়ে এলো। তবুও ক্লান্তিহীন চোখ। দুপুর আড়াইটার দিকে আমরা মাইনিমুখ বাজার পৌঁছালাম। ছোট হোটেল, দুই পর্বে সারল খাবার। তারপর পাশ্ববর্তী রাবেতার কলেজের উদ্দেশ্য লঞ্চ মুখ ঘোরালো। সেখানেই আমাদের রাত যাপনের ব্যবস্থা। নিরাপত্তা ও বিবিধ কারণে পাবলাখালীতে রাতযাপনের সিদ্ধান্ত বাতিল। এতে ৪০ ভাগ অ্যাডভেঞ্চার কমে গেল। ব্যাগ-বোচকা রেখে সবাই ছড়িয়ে পড়লেও সুতার টানে আবার ৭টার দিকে লাগোয়া হ্যালিপ্যাড চত্বরে ফিরে এলো সবাই। কেউ কেউ ছুটলেন বছরের শেষ সূর্যকে বিদায় জানাতে। সেখানে পরিচয় পর্বের পর একজন সেনাকর্মকর্তা সবাইকে প্রয়োজনীয় পরামর্শ দিলেন।

কলেজের মাঠেই রাতের রান্নার আয়োজন। ওদিকে প্রথম প্রহরের প্রস্তুতি। দলে দলে ভাগ হয়ে বসল সবাই। রঙিন কাগজ, সরা আর মোমবাতির সমন্বয়। একফাঁকে রাতের খাবারটা সেরে ফেলল সবাই। তারপর মধ্যরাতের আগেই সবাই লেকের ধারে জড়ো হলাম। সবার বয়েআনা মঙ্গল প্রদীপগুলো লেকের পানিতে ভাসিয়ে দেওয়া হলো। জিরো আওয়ারে রাতের আকাশ উজ্জ্বল করে জ্বলল ফ্লেয়ার। আর তখনি সবার হর্ষধ্বনি। তারপর আকাশে উড়ল ফানুস। প্রথম প্রহরের এই অনুষ্ঠানে যোগদিতে সপরিবারে এলেন মাইনির ২৫ বেঙ্গল রেজিমেন্টের জোন কমান্ডার লে. কর্ণেল মুস্তাফিজ। প্রথম প্রহরকে বরণ করার আনুষ্ঠানিকতা চলল অনেকক্ষণ। মধ্যরাতের এমন উৎসব এখানকার মানুষ কি আর কখনো দেখেছে। এবার ঘুমোতে যাবার পালা। তাও মাত্র দু’ঘন্টার জন্য। রাত চারটায় আবার কেয়ারি কর্ণফুলির যাত্রা। উদ্দেশ্য পাবলাখালীতে গিয়েই বছরের নতুন সূর্যকে দেখা। কিন্তু আমাদের আশা নিরাশায় পরিনত হলো। ঘনকুয়াশায় যাত্রা স্থগিত। লেকের পানিতে কনকনে শীতের ভেতর সবার কাঁপাকাঁপি অবস্থা। অবশেষে ভোর ছয়টার দিকে লঞ্চ ছাড়ল। সেনাবাহিনীর একটি দলও আমাদের সঙ্গে ইঞ্জিন নৌকা নিয়ে চলল। অসংখ্য ডুবোচরে পথ হারিয়ে পাবলাখালী পৌঁছুতে প্রায় দু’ঘন্টা সময় লাগল। তখনো দেখা নেই সূর্যদেবের। এই অরণ্যের রেস্টহাউস ‘বনসখীতে’ সকালের নাস্তার ব্যবস্থা।

কিন্তু যে রসুই ঘরে তৈরি হলো আমাদের নাস্তা সে রসুইঘর নাকি কিছুদিন আগে বন্যহাতির দল গুড়িয়ে দিয়েছিল। এমন খবর শোনার পর সবার চেহারায় ফের আতঙ্কের ছাপ। রেস্ট হাউসের অদূরে গাছের ডালে বানর দেখে সেই আতঙ্ক আরো বদ্ধমূল হলো। এবার বনে ঘোরাঘুরির পালা। কেউ কেউ থেকে গেলেন সূর্য বানাতে। আমরা চললাম বন দেখতে। বিচিত্র পাখির ডাক শোনা যাচ্ছে। ইতোমধ্যেই অনেক গাছ চোখে পড়েছে। চুন্দুল, কনকচূড়া, পাদাউক, আদি কাঁটা মেহেদী, আদি জারুল, শীলকড়ই, চাপালিশ, কাজুবাদাম, সেগুন ইত্যাদি। তারপর কিছু গর্জন, মুচকুন্দ, গুলগুলি লতা, শিমূল, নাগেশ্বর। অগভীর বনে এত অল্পকিছু দেখে মন ভরল না। নিরাপত্তার খাতিরে বেশি নিবিড়তায়ও যাওয়া গেল না। এখান থেকে মাত্র ৮/১০ কিমি. দূরে ভারতের মিজোরাম বর্ডার। ৪২ হাজার ৮৭ হেক্টর আয়তনের এই বনে আরো আছে রেসাস বানর, মুখপোড়া হনুমান, উল ুক, বন্য শূকর, বনবিড়াল, উদবিড়াল আর বিচিত্র পাখি। হাতি আর বানর মোটামুটি সহজলভ্য। কিছুক্ষণের মধ্যেই আমরা রেস্টহাউজে ফিরে এলাম। বন্ধুদের প্রচেষ্টায় তৈরি হলো এক ঝলমলে সূর্য। তারপর তাকে মাটির শয্যায় সাজানো হলো।

এবার নতুন সূর্যের পাশে দাঁড়িয়ে ছবি তোলার পালা। সূর্য উৎসবের আনুষ্ঠানিকতা এখানেই শেষ। ওদিকে দুপুর হয়ে এসেছে। আজকেই আমরা ফিরে যাব রাঙামাটি শহরে। সেখান থেকে ঢাকার গাড়িগুলো ছাড়বে। কিন্তু দুপুরের খাবার যে তখনো বাকি। সিদ্ধান্ত ছিল এখানে খাওয়া দাওয়া হবে, তারপর লঞ্চ ছাড়বে। কিন্তু সময় স্বল্পতার কারণে তা আর হলো না। বেছে নেয়া হলো এক অভিনব পদ্ধতি। খাবারগুলো একটা ছোট্ট নৌকায় তুলে কেয়ারি কর্ণফুলীর সঙ্গে বাঁধা হলো। ছেড়ে দিল লঞ্চ। পেছনে কাসালং, মাইনি আর কর্ণফুলী। আমাদের বিদায় জানাতে এসেছে গ্রামের শিশুরা। লঞ্চ ছেড়ে দেবার কিছুক্ষণের মধ্যেই খাদ্যতরী থেকে খাবার পরিবেশন শুরু হলো। সবাই সিটে বসেই খাবার খেয়ে নিল। এটাও একটা মজার অভিজ্ঞতা। আবার দু’পাশের সেই মনোহর দৃশ্য। ক্লান্ত হয় না চোখ।

 

রাঙ্গামাটির প্রাকৃতিক মনোমুগ্ধকর সৌন্দর্য্য উপভোগ করবেন কিভাবে
সত্রং চাকমা, সাংবাদিক, দৈনিক সমকাল

রাঙ্গামাটির রঙে চোখ জুড়ালো সাম্পান মাঝির গানে মন ভরালো………। আসলে গানের মতোই রাঙ্গামাটির পথ। পাহাড়ের আকা বাকাঁ পথ, উচুনিচু পাহাড়-পর্বত বেষ্টিত সবুজ অরন্যে ঝর্ণা ঘেরায় অপরুপ প্রাকৃতিক সৌন্দর্য্য আপনার মনকে সহজেই আকৃষ্ট করবে। বন্দর নগরী চট্টগ্রাম থেকে মাত্র ৭০ কিলোমিটার দুরবর্তী পশ্চিমে বৃহত্তর চট্টগ্রাম জেলা, পূর্বে ভারতের মিজোরাম রাজ্যে, উত্তরে পার্বত্য খাগড়াছড়ি এবং দক্ষিণে পার্বত্য বান্দরবান জেলার অবস্থানে প্রাকৃতিক সৌন্দর্য্যরে শহর রাঙ্গামাটি। রাঙ্গামাটির মোট আয়তন হচ্ছে ৬ হাজার ৪শ ৮১ বর্গকিলোমিটার। জলবিদ্যূৎ উৎপাদনের জন্য ১৯৬০ সালে কর্ণফূলী নদীর ওপর বাধঁ দিয়ে কাপ্তাইয়ে নির্মিত হয় ২৫৬ বর্গমাইল এলাকা বি¯তৃত কৃত্রিম জলধারা(কাপ্তাই হ্রদ)। এ জলধারে তলিয়ে গেছে ৫৪ হাজার একর প্রথম শ্রেনীর আবাদী জমিসহ পূরনো রাজবাড়ি, বহু পূরণো অনেক বৌদ্ধ মন্দির, বাজার,শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, অসংখ্য ঘরবাড়ি এবং বিস্তীর্ন সবুজ বনবনানী। এ বাধেঁর ফলে উদ্ধাস্তু হয়েছিল প্রায় এক লাখের বেশী লোক। কৃত্রিম কাপ্তাই হ্রদ সৃষ্টি হওয়ার কারণে রাঙ্গামাটিতে গড়ে উঠে আকর্ষনীয় পর্যটন স্পট। ৭০ দশকের শেষের দিকে সরকার রাঙ্গামাটি জেলাকে পর্যটন এলাকা হিসেবে ঘোষনা করে এবং পর্যটন কর্পোরেশন পর্যটকদের সুবিধার্থে আকর্ষনীয় স্পট স্থাপন করে। পর্যটন কর্পোরেশন স্পটে হোটেল, অফিস এবং মনোরঞ্জনের জন্য দুই পাহাড়ের মাঝখানে একটি আকর্ষনীয় ঝুলন্ত সেতু স্থাপন করে।

 

এ ঝুলন্ত সেতুর পূর্বের দিকে তাকালে দেখা যাবে অপূর্ব জলরাশিসহ ছোটবড় বি¯তৃণ সবুজ পাহাড়। নৈসর্গিক সৌন্দর্যের অপরূপ লীলা ভুমি ও মনোলোভা আকর্ষণীয় পর্যটন স্থানগুলো উপভোগ করতে চাইলে আপনি এক্ষুনি ঘুরে আসতে পারেন রাঙ্গামাটির অপরুপ প্রাকৃতিক সৌন্দর্য্য। কি কি দেখার রয়েছেঃ পর্যটনের ঝুলন্ত সেতু, সুভলং ঝর্ণা ও প্রাকৃতিক সৌন্দর্য্য,ে পেদা টিং টিং, সাংফাং রেস্টুরেন্ট, চাকমার রাজার রাজ বাড়ি, রাজ বন বিহার, উপজাতীয় যাদু ঘর, জেলা প্রশাসনে বাংলো, বীর শ্রেষ্ঠ মুন্সি আব্দু রউফের সমাধি সৌধ এবং আদিবাসীদের গ্রাম ও জীবনযাত্রার দৃশ্য। এখানে আদিবাসীদের জীবন যাত্রা সর্ম্পকে বিশেষভাবে জানার ইচ্ছা থাকলে স্থানীয় উপজাতীয় সাংস্কৃতিক ইনষ্টিটিউট এ গিয়ে জানা যায়। প্রতিবছর এপ্রিলে আদিবাসীরা “বিজু-সাংগ্রাই-বৈসুক উৎসব বা চৈত্র সংক্রান্তী উৎসব” হয় ব্যাপক উৎসাহ-উদ্দীপনা ও জাকজমকভাবে। অর্থাৎ প্রতি বছর এপ্রিল মাসের দ্বিতীয় সপ্তাহের দিকে এ উৎসব পালিত হয়ে থাকে। এটি পার্বত্য চট্টগ্রামে আদিবাসীদের প্রধান সামাজিক উৎসব। দর্শনীয় স্থানগুলোতে কিভাবে যাবেন ঃ রাজবাড়ী, উপজাতীয় যাদুঘর, জেলা প্রশাসন বাংলো, রাজ বন বনবিহার ইচ্ছে করলে আপনি একটি সিএনজি বা বেবী টেক্সী ভাড়া করে ঘুরে আসতে পারেন। কারণ এগুলো একেবারেই শহরের মধ্যেই অবস্থিত। বলে রাখা ভাল, চাকমা রাজ বাড়ীতে অতীত চাকমা রাজ বংশের বেশ কিছু নিদর্শন রয়েছে।

চাকমা রাজ বাড়ী, পুরনো একটি কামান, রাজ দরবার দেখার মতো। চাকমা রাজা আদিবাসী পাহাড়িদের কাছে অত্যন্ত সন্মানীত। রাঙ্গামাটির আরেকটি দর্শনীয় স্থান হচ্ছে রাজ বন বিহার। রাজ বন বিহার বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বীদের জন্য একটি তীর্থস্থান হিসাবে পরিগনিত। বৌদ্ধ ধর্মের বেশ কিছু নিদর্শনও রয়েছে এখানে। পার্বত্য বেীদ্ধ ধর্মীয় গুরু বনভন্তে এ বিহারে তাঁর অবস্থান। উপজাতীয় যাদুঘরে রয়েছে পার্বত্য চট্টগ্রামের উপজাতীয়দের কৃষ্টি,সংস্কৃতির প্রাচীন নিদর্শন। উপজাতীয় সাংস্কৃতিক ইনিষ্টিটিউটে এ যাদুঘর নির্মিত হয়েছে। রাঙ্গামাটির আরেকটি প্রধান আকর্ষন হচ্ছে পর্যটন কমপেক্সে। এ পর্যটন কমপে ক্সের ঝুলন্ত ব্রীজটি দেখার মতো। দুটি পাহাড়ের মধ্যে সংযোগ ঘটিয়ে কাপ্তাই হ্রদের উপর ঝুলে আছে এ সেতু। বছরের দু,এক মাস অবশ্য এ সেতু হ্রদের পানিতে ডুবে থাকে। তবে শীতের মৌসুমে কাপ্তাই হ্রদের পানি কমে যাওয়ায় সেতুর উপর পানি থাকে না। পিকনিক করতে আসা লোকজন খুব আনন্দ নিয়ে সেতু পার হয়ে পাহাড়ের চুড়ায় পিকনিক করে থাকে। রাঙ্গামাটির ঝুলন্ত সেতু দেততে হলে আপনাকে পর্যটন কর্পোরেশনকে মাথাপিছু ৫টাকা দিতে হবে। এছাড়া সুভলং ঝর্ণা বা সুভলংএর প্রাকৃতিক দৃশ্যে,নানিয়ারচরের বুড়িঘাট এলাকায় বীর শ্রেষ্ঠ মুন্সি আব্দুর রউফ এর স্মৃতি সৌধ,পেদা টিং টিং, সাংফাং রেস্টুরেন্ট, ইকো টুক টুক ভিলেজএর পর্যটন স্পট দেখতে হলে আপনাকে অবশ্যই ইঞ্জিন চালিত নৌকা ভাড়া করতে হবে। এখানে মনে করিয়ে দেয়া ভাল সুভলং এর প্রাকৃতিক ঝর্ণা খুবই উপভোগ করার মতো ও সুভলং এর প্রাকৃতিকদৃশ্য অত্যন্ত মনোমুগ্ধকর। তবে বর্ষা মৌসুমেই ঝর্নাগুলো জীবন্ত থাকে। শীতে ঝর্ণা গুলোতে খুব একটা পানি থাকে না। নানিয়ারচরের বুড়িঘাটে রয়েছে বীর শ্রেষ্ঠ শহীদ ল্যান্স নায়ক মুন্সি আব্দুর রউফের স্মৃতিসৌধ। বীর শ্রেষ্ঠ ল্যান্স নায়ক মুন্সি আব্দুর রউফ মুক্তিযুদ্ধের সময় নানিয়ার চরের বুড়িঘাটে শহীদ হন। স্থানীয় এক আদিবাসী তাঁকে ওই স্থানে কবর দিয়েছিলেন। রাঙ্গামাটির বি ডি আর ওই স্থানে এ স্মৃতিসৌধ নির্মান করেছেন। তবে এসব স্থান পরিদর্শনের সময় সারাদিনের জন্য নৌকা ভাড়া করলে এক সঙ্গে রাজবাড়ি, বন বিহার, পর্যটনের ঝুলন্ত সেতু ও জেলা প্রশাসকের বাংলোও দেখতে পারবেন। ইঞ্জিন বোটে করে যাওযার সময় কাপ্তাই হ্রদের স্বচ্ছ জলরাশির বুক ছিড়ে যখন সুভলং এ দিকে এগোবেন তখন প্রথমে একটি সবুজ দ্বীপের মাঝে চোখে পড়বে বেসরকারী পর্যটন স্পট পেদা টিং টিং রেস্টরেন্ট ও পর্যটন স্পট। পেটাটিং টিং শব্দটি চাকমা ভাষায় নামকরণ করা হয়েছে। এর অর্থ হল পেট ভরে খাওয়া। ১৯৯৭সালে পার্বত্য শান্তি চুক্তির পরবর্তী সময়ে রাঙ্গামাটি শহরের অদূরে বালুখালীতে গড়ে উঠেছে এ বেসরকারী পর্যটন পেদা টিং টিং। পুরো একটি সেগুন বাগানকে পর্যটন কেন্দ্রে পরিনত করা হয়েছে।

সারি সারি সেগুন গাছের সাথে রয়েছে কিছু বনের পশু পাখি। এখানে উপজাতীয় ঐতিহ্যের খাবার সহ রকমারী খাওয়ার জন্য রয়েছে রেষ্টুরেন্ট ও থাকার জন্য রয়েছে উপজাতীয় ঐতিহ্যের টং ঘর। তাছাড়াও পেদাটিং টিং পর্যটন স্পটের একট অদুরে মনোরম প্রাকৃতিক পরিবেশে গড়ে উঠেছে পর্যটন বা পিকনিক স্পট সাংফাং ও ইকো টুক টুক ভিলেজ। এখানেও আদিবাসীদের ঐতিহ্যের খাবারসহ রকমারী খাওয়ার জন্য রয়েছে রেষ্টুরেন্ট। পেদা টিং টিং ফেলিয়ে সবুজ পাহাড়ের বুক ছিড়ে যখন সুভলং উদ্দেশ্যে এগোতে থাকবেন তখন দেখতে পাবেন কিছূ আদিবাসী গ্রাম। সেখানে রয়েছে নির্মল পাহাড়ি সরলতা ও জীবনযাত্রা। আপনি ইচ্ছে করলে সে সব গ্রাম ঘুরে দেখতে পারেন। আর এসব গ্রামের পাহাড়ের মাঝে মধ্যে দেখতে পাবেন জুমক্ষেত(পাহাড়ের চূড়ায় চাষাবাদ)। এভাবে মনোমুগ্ধকর পরিবেশে যেতে যেতে এক সময় পৌঁছে যাবেন নয়নাভিরাম সুভলং। সুভলং এর ঝর্ণার কাছাকাছি পৌঁছতে দেখতে পাবেন দু’দিকে সুউচ্চ পাহাড়। এক সময় এখানে কাপ্তাই বাঁধ নির্মানের জন্য পরিকল্পনা নেয়া হয়েছিল কিন্তু বাঁধ নির্মান করা হলে ভারতের কিছু এলাকা জলমগ্ন হয়ে যায়। তাই সে কারণে পরিকল্পনা বাতিল করা হয়েছিল। এর পর দেখতে পাবেন পাহাড়ের কোল থেকে নেমে আসা কয়েকটি ঝর্না। তবে এর মধ্যে সব চেয়ে বড় ঝর্ণাটিতে দেখলে সত্যিই মনের মধ্যে ভালো লাগবে। এসব ঝর্ণাতে পাহাড়ের ওপর থেকে নেমে আসা ঝর্ণার পানির পাথুরে মাটিতে আছড়ে পড়ার অপূর্ব দৃশ্য। এখানে আপনি ইচ্ছে করলে গোসল করতে পারবেন ও আপনার সাথে ক্যামরা থাকলে পছন্দ মত ছবিও নিতে পারেন। এখানে মনে করিয়ে দেয়া ভালো ঝর্ণার পানি সাধারণত বর্ষার মওসুমে সময় সচল থাকে। শুস্ক মওসুমে একেবারেই পানি থাকে না। তবে এ ঝর্ণাটি দেখতে হলে আপনাকে প্রবেশ ফি হিসেবে পাঁচ টাকার টিকিট কাটতে হবে। এরপর ঝর্ণা দেখা শেষ হলে আপনি কিছুক্ষনের জন্য সুভলং বাজারে ঘুরে আসতে পারেন। সেখানে সেনাবাহিনীর একটি মনোরম ক্যান্টিনও রয়েছে। ইচ্ছে করলে সেখান থেকে হালকা নাস্তা, চা খেতে পারেন। কারণ এখান থেকে সোজাসোজি আপনাকে রওনা দিতে হবে শহরে দিকে। এছাড়াও রাঙ্গামাটি শহরের অদুরে বালুখালীতে হট্টিকালচার নার্সারীর বিশাল এলাকা জুড়ে যে উদ্যান রয়েছে তার সৌন্দয্যও পর্যটকদের দৃষ্টি আকৃষ্ট করেছে। প্রায় সব সময় এ উদ্যানে পিকনিক হচ্ছে। হর্টিকালচার নার্সারীটি পরিণত হয়েছে আরেক পর্যটন কেন্দ্রে সারি সারি ফল ও ফুল গাছের সাথে রয়েছে কিছু বনের পশু পাখি কিচির মিচির ডাকের শব্দ। সব মিলিয়ে এ উদ্যান পর্যটকদের কাছে অত্যন্ত আকর্ষনীয় স্থান হিসাবে পরিচিতি পেয়েছে। বোট ভাড়া কোথায় পাওয়া যায়ঃ ইঞ্জিন চালিত নৌকা বা বোট ভাড়া রাঙ্গামাটি শহরে কয়েকটি স্থানে পাওয়া যাবে।

 

তবলছড়ি বাজারস্থ বোট ঘাটে, রির্জাভ বাজার, বনরুপায়। এখানে বোট ওয়ালা নতুন লোক হলে আপনার কাছ থেকে হয়তো বেশী ভাড়া চাইতে পারে। তার জন্য দরদাম করে নেয়াই ভালো হবে। সারাদিনের জন্য ভাড়া বা শুভলং যেতে চাইলে আপনাকে আট থেকে এক হাজার টাকা দিতে হবে। আর যদি ২/৩ ঘন্টার জন্য ভাড়া করেন ৬/৭শ টাকা দিতে হবে। এছাড়া পর্যটনের ঝুলন্ত সেতুর পাশেও বোট ভাড়া পাওয়া যায়। তবে সেগুলো একটু ভাড়া বেশী। কেনাকাটা করতে চানঃ পাহাড়িদের তৈরী কাপড়-চোপড় ও হাতের তৈরী বিভিন্ন জিনিসপত্র আপনার বন্ধুর জন্য বা যে কারোর জন্য অথবা আপনার নিজের জন্য কেনাকাটা করতে পারেন। এসবে মধ্যে রয়েছে তবলছড়ি এলাকায়। বিশেষ করে তবলছড়ি বেইন টেক্স টাইল শো রুমে, বনরুপার জুমঘর ও রাজবাড়ি এলাকায় সজপদর। এসব শো রুম থেকে কম দামে বিভিন্ন জিনিসপত্র কিনতে পারেন। কোথায় উঠবেনঃ রাঙ্গামাটি পর্যটন মোটেল। এই মোটেল শহর থেকে একটু দূরে হলেও মনোরম প্রাকৃতিক পরিবেশে বেষ্টিত। এখানে প্রতি রুমের ভাড়া এসি বারশ টাকা, নন এসি ছয়শ টাকা। এছাড়া দল বেধে বন্ধু-বান্ধবদের নিয়ে বা পরিবার পরিজনদের নিয়ে থাকতে চান অসুবিধা নেই। এখানে কটেজের সুব্যবস্থা রয়েছে। প্রতি কটেজের ভাড়া পড়বে দেড় হাজার টাকা। বেসরকারী পর্যটন পেদাটিং টিং এ যারা নির্জন প্রাকৃতিক পরিবেশে রাতযাপন করতে পছন্দ বা যারা সদ্য বিবাহিত দম্পত্তি তারা এখানে হানিমুন করতে পারেন। এখানের প্রতিটি কটেজের ভাড়া পড়বে এক হাজার টাকা। এছাড়া হোটেল সুফিয়া, গ্রীণ ক্যাসেল, মোটেল জর্জসহ ইত্যাদি হোটেলে প্রতি রুমের এসি ভাড়া ৮শ টাকা ও নন এসি ৫শ টাকা। তবে কম দামের হোটলে থাকতে চান তাও পাবেন। কোথায় খাওয়াদাওয়া করতে চানঃ পর্যটনের নিজস্ব রেস্টুরেন্ট ও বার রয়েছে, তবলছড়ির অরণ্যেক রেস্টুরেন্ট, বনরুপায় ক্যাপে লিংক, দি রৌপ, রাজবাড়ির মেজাং ও হেবাং রেস্টুরেন্ট ,রির্জাভ বাজারের গ্রীন ক্যাসেল রেস্টুরেন্ট। এছাড়া আদিবাসীদের তৈরী নিজস্ব খাবার খেতে ইচ্ছে করে পাবেন অবশ্যই। এসব রেস্টরেন্টুটের মধ্যে রয়েছে পেদা টিং টিং। এছাড়া পেদাটিং টিং থেকে একটু নতুণ গড়ে উঠা রেস্টুরেন্ট সাংপাং। এখানে হুর হেবাং( বাশেঁর মধ্যে রান্না করা মুরগি তরকারী) বদা হেবাং(কলা পাতায় রান্নায় ডিম তরকারী) ইত্যাদি। পেদাটিং টিং টিং যেতে হলে শহর থেকে ২/৩ কিলোমিটার দূরে আপনাকে ইঞ্জিন বোটে করে যেতে হবে। অবশ্যই পেদাটিং টিং কর্তৃপক্ষের নিজস্ব বোট রয়েছে প্রতিজনকে ভাড়া দিতে হয় দশ টাকা করে। এজন্য আপনাকে রাঙ্গামাটি প্রেস ক্লাবের পাশে তাদের একটি অফিস রয়েছে সেখানে যোগাযোগ করতে হবে। অথবা ইচ্ছে করলে বোট ভাড়া করতে পারেন কয়েক ঘন্টার জন্য বোট ভাড়া লাগবে ৪/৫শ টাকা।

 

কাপ্তাই উপজেলাঃ কাপ্তাই না গেলে রাঙ্গামাটি বেড়াতে আসা আরও একটি সাধ অপূর্ন থেকে যাবে। এখানে কাপ্তাই জল বিদ্যূৎ উৎপাদন কেন্দ্র, কর্ণফূলী পেপার মিলস্, কর্ণফূলীর নদীর অপূর্ব দৃশ্য, কাপ্তাই জাতীয় উদ্যোন ইত্যাদি দেখার জায়গা রয়েছে। তবে কাপ্তাই জল বিদ্যূৎ উৎপাদন কেন্দ্র, কর্ণফূলী পেপার মিলস দেখতে চাইলে আপনাকে কর্তৃপক্ষের কাছে অনুমতি লাগবে। কাপ্তাই কর্ণফূলী নদীর ধারে খাওয়াদাওয়া করার জন্য অনেক রেস্টুরেন্টও রয়েছে। কাপ্তাইয়ে আপনি ইচ্ছে করলে রাতযাপনও করতে পারেন। তবে সে রকম ভালো মানের হোটেল নেই। তার চেয়ে কোন রেস্ট হাউসে উঠা ভালো হবে।

 

কাপ্তাই যেতে হলে আপনি তবল ছড়ি বাজার থেকে স্পীড বোটে করে যেতে পারেন। তাতে ভাড়া লাগবে ৩০টাকা। অথবা রির্জাভ বাজার থেকে বাসে করে যেতে পারেন কাপ্তাই বড়ইছড়ি পর্ষন্ত। বাস ভাড়া পড়বে প্রতিজন ২৫টাকা করে। এছাড়া ইচ্ছে করলে রাঙ্গামাটি থেকে স্পীড বোট ভাড়া করতে পারেন। ভাড়া পড়বে ১হাজার থেকে ১২শ টাকা পর্ষন্ত। আপনি ইচ্ছে করলে চট্গ্রাম থেকেও বাসে করে কাপ্তাই যেতে পারবেন। কিভাবে যাবেনঃ ঢাকা থেকে বিমান, ট্রেনে বা বাসে অথবা সরাসরি রাঙ্গামাটি যাওয়া যাবে। যদি ঢাকা থেকে বিমানে, ট্রেনে বা চট্টগ্রাম বাসে করে গেলে আপনাকে চট্টগ্রামে অবশ্যই নামতে হবে। চট্টগ্রামে পৌঁেছ অক্সিজেনএর বাস স্টান্ডে যেতে হবে। সেখান থেকে প্রতি ২৫মিনিট পর পর বিরতীহীন বাস ছাড়ে। ভাড়া পড়বে ৮৫টাকা। তবে এখান থেকে আবার লোকাল বাসও পাওয়া যায়। আর আপনি একটু আরামে চেয়ার কোস বাসে( বিআরটিসি, এস আলম, সোদিয়া, চ্যালেঞ্জার, কর্নফূলী) করে রাঙ্গামাটি যেতে চান তাও পাবেন। তবে এসব চেয়ার কোচ সব সময় পাওয়া যায় না। এসব চেয়ার কোচগুলো নিজস্ব কাউন্টার থেকে টিকিট পাওয়া যাবে। ভাড়া পড়বে একশ টাকা। এছাড়া আপনি সরাসরি ঢাকা থেকে রাঙ্গামাটিতে আসতে চান। তাতেও পাবেন। ঢাকার কমলাপুর স্টেশন, কলা বাগান, গাবতলী, টি টি পাড়া ফকিরাপুল কাউন্টার থেকে পাবেন ডলফিন, সোদিয়া, এস আলমের টিকিট। টিকিটের দাম ৪০০টাকা। এছাড়া সরাসরি শ্যামলী পরিবহনের এসি চেয়ার কোচ পাবেন কলা বাগান, মতিঝিল ও কল্যাণপুর থেকে বাসের টিকিট পাবে ৫০০টাকায় এবং কমলাপুর বিআরটিসি কাউন্ডার থেকে পাবেন বিআরটিসির নন এসরি টিকিট। আপনার ঢাকা থেকে রাঙ্গামাটি পৌঁছতে সময় লাগে ৭/৮ ঘন্টা আর চট্টগ্রাম থেকে রাঙ্গামাটিতে আসতে সময় লাগবে দুই থেকে আড়াই ঘন্টা। যোগাযোগঃ রাঙ্গামাটি পর্যটন হোটেলের ফেন নম্বর হল- ৬৩১২৬,৬১০৪৬। পেদা টিং টিং-৬২০৮২, গ্রীণ ক্যাসেল-৬১২০০, সুফিয়া-৬১১৭৪, মোনতলা-৬১৬১৮, মেজাং-৬২৯৪৪ ও অরণ্যেক-৬২০৮২।

 

 

নৈসর্গীক সৌন্দর্যের পার্বত্য সাজেক

নৈসর্গীক সৌন্দর্যের পার্বত্য সাজেক

আল-ফারুক আযম, সাজেক থেকে ফিরে ॥অনেকদিন থেকেই দেশের দক্ষিণ-পূর্বাঞ্চল ভারতের মিজোরাম রাজ্য সন্নিহিত সাজেক উপত্যকায় যাবার ইচ্ছা ছিল। তাদের নিয়ে নানা রূপকথার মত গল্প শুনেই সেখানে মন টেনেছে বার বার। বৈচিত্র্যময় উপজাতি জীবনধারা আর নৈসর্গীক অপরূপ সৌন্দর্য আমাকে হাতছানিতে ডেকেছে। কিন্তু দেশের মানচিত্রে গ্রথিত এই সাজেক উপত্যকাটি এতই দূর্গম ও অরণ্যাবৃত যে ইচ্ছে করলেই সেখানে যাওয়া যায়না। এখানে বৃটিশ শাসনামল থেকেই উপেক্ষা আর অবহেলার মধ্যদিয়ে অতিবাহিত হচ্ছে এখানকার সহজ, সরল আদিবাসীদের জীবন যাত্রা। অঘোষিতভাবে নিষিদ্ধ এই জনপদের মানুষের যাতায়াতের একমাত্র উপায় পায়ে হাটা পাহাড়ি আঁকা-বাঁকা উঁচু-নিঁচু মেঠ পথ। সেখানে টেলিফোন, মোবাইল, ই-মেইল, ইন্টারনেট তো দূরের কথা, জরুরী প্রয়োজনে এখানে কখনই ডাক পিয়ন যায়নি। এখানকার মানুষের জন্য পোষ্ট অফিস ৫০ কিলোমিটার দূরে মারিশ্যা বাজারে অবস্থিত। সবুজ পাহাড়ের বুক চিরে নিরাপত্তা কাজে নিয়োজিত সেনাবাহিনীর পৃষ্ঠপোষকতায় এই প্রথমবারের মত সাজেক পর্যন্ত সড়ক যোগাযোগ স্থাপিত হয়েছে। যা এখনও বাস্তবায়নাধীন। এই সড়ক যোগাযোগ স্থাপিত হলে এখানকার আদিবাসীরা তাদের জুমের ফসল ধান, তিল, তিসি, মিষ্টি কমলা, তরু-তরকারি অনাসায়ে বাজারজাত করতে পারবে এ স্বপ্ন দেখতে শুরু করেছে। একমাত্র সড়ক যোগাযোগের অভাবে জীবন ও জীবিকার সন্ধানে এখানকার মানুষ পারি জমাতো পার্শ্ববর্তী দেশ ভারতের মিজোরাম রাজ্যের বিভিন্ন হাট-বাজারে। সাজেকের মানুষের উঠা-বসা, হাট-বাজার, বিয়ে-সাদি, লেখা-পড়া, যাওয়া-আসা সবই চলে মিজোরামের সাথে। এসকল কারণেই অনেকদিনের কৌতুহল ছিল স্ব চোঁখে দেখবো, কেন তারা স্বদেশের মাটি আঁকড়ে ধরে ভীন দেশে পারি জমায়।

সেই থেকেই সাজেকের ভিন্ন জীবন নিয়ে খোঁজ নিতে শুরু করি……… পার্বত্য চট্টগ্রামে আরও ১০টির মত আদিবাসীর বসবাস সত্বেও সাজেকের এই ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠীর জীবন যাপন একেবারেই ভিন্ন ও বৈচিত্র্যময়। সাজেকের পাংখোয়া ও লুসাই উপজাতিদের মিজো জাতি গোষ্ঠী বলা হয়। মূলতঃ এরূপ ১০ ভাষা-ভাষি আদিবাসীকে মিজো জাতি হিসেবে পরিচিত। তাদের মধ্যে রাঙ্গামাটি জেলার সাজেক ইউনিয়নের রুইলুই, কংলক, শিয়ালদাই, বেথলিং, তৈচৈ, ওল্ড লংকর-নিউ লংকর মৌজায় পাংখোংয়া ও লুসাই উপজাতিরা বসবাস করে থাকে। এই মিজোদের চাল-চলন, আচার ব্যবহার উঠা-বসা সবই ভারতের মিজোরাম রাজ্যের সংস্কৃতির সাথে মিল খুজে পাওয়া যায়। বেশিরভাগ সাজেকবাসী গান শোনে ইংরেজি ও মিজো ভাষায়। মাঝে মাঝে হিন্দী ও ব্যান্ডের গানও শোনে তারা। কথা বলে মিজো ও ইংরেজি ভাষায়। লেখা-পড়া ইংরেজিতে হয়। মিজোরামের বিভিন্ন বিদ্যালয়ে যে লেখা-পড়া হয় তা ইংরেজি অক্ষরে। মিজোদের নিজস্ব অক্ষর ইংরেজিতে। মিজোরামের ইংরেজিতে এক্স, ওয়াই, কিউ অক্ষর নেই। সে জন্য মিজোরা ইংরেজি শিখতে পড়তে ও বলতে পারে খুব দ্রুত। তবে মিজো কথ্য ভাষার সাথে ইংরেজি ভাষার মিল নেই বললেই চলে। সাজেকবাসীর ঘুম ভাংগে ইংরেজি গান শুনে। বাংলা গান তেমন বুঝেনা বিধায় ইংরেজির প্রতি আকর্ষণ বেশি। হিন্দি ভাষাও কম বুঝে। ওয়েষ্টান কালচারে অভ্যস্ত খৃষ্টান ধর্মাবলম্বী লুসাই, পাংখোয়াদের পোষাক পরিচ্ছেদ, আচার ব্যবহার, মিজো ও ইংরেজিতে কথা বলার ধরণ দেখে মনে হবে সাজেক উপত্যাকা যেন বাংলাদেশের বুকে একখন্ড ইউরোপ। আমাদের প্রিয় মাতৃভূমি বাংলাদেশের এই জনপদের দৃশ্যপট দেখে কেউ আর কষ্ট করে টাকা খুইয়ে ভারত, নেপাল, ভূটানে যেতে চাইবেনা।

কিন্তু ভীনদেশে যাওয়া যতই না সহজ সাজেক যাওয়া তত সহজ নয়। ইন্সার্জেন্সি, কাউন্টার ইন্সারজেন্সির কারণে নিরাপত্তার অভাবে এতদিন সেখানে যাওয়া হয়নি। ১৯৯৭ সালের ২রা ডিসেম্বর পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তির পর পার্বত্য এলাকার পরিস্থিতি স্বাভাবিক হয়ে আসায় পার্বত্য জেলাগুলোতে পর্যটকদের আনাগোনা বেড়ে গেছে। তবে সাজেক এলাকায় অবাধ যাতায়াতের উপর এখনও পর্যন্ত নিষেধাজ্ঞার অদৃশ্য প্রাচীর রয়েছে। সেখানে ইচ্ছে করলেও যে কেউ যে কোন মূর্হুতে যেতে পারে না। এই অদৃশ্য প্রাচীর ভেদ করে অজানাকে জয় করতে আমরা কয়েকজন সাজেকে যাবার পরিকল্পনা করি। সাজেক আবিশ্বারের অভিপ্রায়ে যাত্রা হল শুরু……… রাজধানী ঢাকা থেকে দেশের একদল দামাল ছেলের আগ্রহ তারাও সাজেক যাবে। কোন পথে যাবে তা তাদের ছিল অজানা। দলটি প্রথমবার এসেছিল খাগড়াছড়িতে অলৌকিক দেবতা পুকুর, রহস্যময় আলুটিলা গুহা দেখতে। এরপর তারা আবার আসে তবলছড়ির অপরূপ ঝর্ণাটিলা দেখতে। সেবারই তারা সাজেক যাওয়ার বিষয়ে চূড়ান্ত সিন্ধান্ত নেয়। ঢাকায় ফিরে তারা আমার সাথে ফোনে যোগাযোগও করে যথারীতি। সাজেক জয় করার অভিপ্রায় নিয়ে অবশেষে ১০/১৫ জনের বিশাল দল বীরের বেশে খাগড়াছড়ি আসে। ইতিপূর্বে তারা দেশের সর্বোচ্চ পর্বতমালা বান্দরবানের তাজিংডং, কেউক্রডংসহ অনেক উঁচু পর্বত জয় করেছিল। খাগড়াছড়ি বাজার থেকে কাক ডাকা ভোরে ঝটপট নাস্তা খেয়ে একটি চাঁদের গাড়ীতে করে আমরা বেড়িয়ে পরি স্বপ্নে দেখা সাজেকের উদ্দেশ্যে। আঁকা-বাঁকা উঁচু-নিঁচু রাস্তার দু’পাশে পাহাড়ি সাদা কাঁশ বন পাড়ি দিয়ে, দূরে সবুজের ঢেউ তোলা দিগন্ত ছু’তে তীরের বেগে আমাদের জীপটি ছুটছে। খাগড়াছড়ি জেলা শহর থেকে ২৫ কি.মি. দূরে দীঘিনালা সেনা জোনের সামনে ধীরে চলুন, সামনে সেনা ক্যাম্প লেখা দেখে পথে প্রথম সামান্য ধাক্কা খেলাম। সেনাবাহিনীর ক্যাম্পের সামনে প্রথমে আমাদের গতীরোধ করা হয়। কোথায় যাচ্ছেন? উত্তরে বললাম বাঘাইছড়ি। আমাদের ব্যাগ তল াশীর পর ছেড়ে দেয়া হল। এরপর আরও ৫ কি.মি. যেতে না যেতেই জোড়া ব্রীজ এলাকায় আরেক দফা তল াশী।

কোথায় যাচ্ছেন? উত্তরে বললাম বাঘাইছড়ি। তেমন তল াশী ছাড়াই ছেড়ে দেয়া হয়। এরপর আরও প্রায় ১০ কি.মি. দূরে বাঘাইহাট সেনাবাহিনীর একটি জোনের সামনে রাস্তায় বাঁশ দিয়ে আটকে দেয়া হয় আমাদের জীপটিকে। খাগড়াছড়ি থেকে ৩৫ কি.মি. আসার পর বাঘাইহাট সেনা জোনের সামনে এসে জানতে পারি এখান থেকে সাজেকের মূল লক্ষ্যস্থলের দূরত্ব ৪০ কি.মি.। উলে খ্য, বাঘাইহাট জোনটিও কিন্তু সাজেক ইউনিয়নের অর্ন্তগত। এই জোন থেকে নির্দেশ আসলো সকলের ব্যাগ তল াশী করতে হবে। ব্যাগ তল াশী করা হলো। এরপর জিজ্ঞেস করা হয় কোথায় যাবেন? উত্তরে এবারই প্রথম বললাম সাজেক যাবো। সাজেকের কথা বলতেই সেনা সদস্যরা হতচকিত হয়ে বলেন কি? সাজেক! পারমিশন আছে? আমরা বললাম কিসের পারমিশন। এরপর শুরু হয় হায়ার অথরেটির সাথে ওয়ার্লেস যোগাযোগ। আমাদের আটকে দিয়ে বলা হয় বিগবস জোন কমান্ডার সাহেব আপনাদের কয়েকজনকে জোনে যেতে বলেছেন, কথা বলবেন। সবাইকে রেখে আমি রুবেল, লিপটন ভাই উপরে গেলাম। তৎকালীন জোন কমান্ডার বললেন, সাজেক যাবেন কেন? আমরা বললাম বেড়াতে। কমান্ডার বললেন, সেখানে কোন বাঙ্গালী যেতে পারে না। বললাম কেন? উত্তরে বললেন, নিরাপত্তার অভাবে। নিশ্চিত অপহরণ অথবা মৃত্যুর মূখে আপনাদের ঠেলে দেয়া ঠিক হবে না। তিনি উদাহরণ টেনে বললেন, বছর খানে আগেও সাজেকের গঙ্গারাম ব্রীজ সেনাবাহিনীর তত্বাবধানে নির্মানকালে সেনা উপস্থিতি কয়েক মিনিটের মধ্যে ছিল না এ সুযোগে সন্ত্রাসীরা অস্ত্রের মূখে ৭জন নির্মাণ শ্রমিককে অপহরণ করে নিয়ে যায়। দীর্ঘ ৩৫দিন পরে সেনাবাহিনী কমান্ড অপারেশন চালিয়ে তাদের উদ্ধার করে নিয়ে আসে। এছাড়াও খাগড়াছড়ি-রাঙ্গামাটি সড়কের কালাপাহাড়ে তিন বিদেশী প্রকৌশলী অপহরণের কথাও তিনি স্মরণ করিয়ে দিয়ে বলেন, আপনাদের অপহরণ করা হলে পুরো পার্বত্য এলাকার সেনাবাহিনী ব্যস্ত হয়ে পরবে। দেশের অনেক ক্ষতি হবে।

এই দূর্গম বিশাল রিজার্ভ বনভূমি ও পাহাড়ি এলাকায় নিরাপত্তা ব্যবস্থা তেমন জোরদার করা সম্ভব হয়নি। শুধু সাজেকের রুইলুই ও কংলাক মৌজার মাঝখানে একটি বিডিআর ক্যাম্প রয়েছে। বেথলিং ও শিয়ালদই মৌজায় বিডিআর থাকলেও পুরো এলাকা নজরদারীতে আনা বাস্তবেই কষ্ট সাধ্য ব্যাপার। আমাদের মধ্যে রুবেল ভাই বললেন সাজেক কি বাংলাদেশের অংশ নয়? উত্তরে কমান্ডার বললেন, অবশ্যই বাংলাদেশের অংশ। তাহলে কেন এভাবে নিষেধাজ্ঞা আরোপ করছেন? উত্তরে কমান্ডার বললেন, পার্বত্য চট্টগ্রাম বিশেষ এলাকা হিসেবে পরিগনিত হয়ে আসছে। আর সাজেক আরও বিশেষ এলাকা হিসেবে বৃটিশ আমল থেকেই প্রতিষ্ঠিত। কমান্ডার সাফ সাফ জানিয়ে দিয়ে বললেন সাজেক আপনাদের কোন ভাবেই যেতে দেয়া হবে না। বড় জোর মাচালং বাজার পর্যন্ত বাঙ্গালীরা যেতে পারে সেখানে পর্যন্ত যেতে পারেন। একথা বললেও তিনি অবশেষে তার সামনে দিয়ে মাচালং পর্যন্তও যেতে দিলেন না কারণ, আমরা মাচালং যেতে পারলে পায়ে হেটেই সাজেকের মূল লক্ষ্যে চলে যেতে পারি এ অশংকায়। কমান্ডারের অশংকা অবশ্য ভূল ছিল না।

আমাদের দৃঢ়তা দেখে তিনি বিশ্বাস করেছেন যে দেশের এই দুঃসাহসী ছেলেদের কোনভাবেই রুখা যাবে না। তারা সাজেক যাবেই। আলাপচারিতায় কমান্ডার অবশ্য বলেই ফেলছিলেন আপনাদের সাজেক যাওয়ার কথা শুনে আমার দেখতে ইচেছ করছে কোন সেই দুঃসাহসী ছেলেরা সাজেক যেতে সাহস করে! আমাদের জীবনের নিরাপত্তার কথা ভেবে জোন কমান্ডার আমাদের যেতে দেননি। অতিথি আপ্যায়নের মধ্যদিয়ে তাঁর আন্তরিকতার যে কোন অভাব ছিল না তা আমরা বুঝতে পেরেছিলাম। আমরা হতাশ হয়ে ফিরে আসি বাঘাইছড়ি মারিশ্যা বাজারে। সেখানে আসার আগেই আমরা জানতে পেরেছি পানি পথে সাজেকের রাস্তা রয়েছে। এজন্য মারিশ্যা বাজারে যেতে হবে। মারিশ্যা বাজার গিয়ে আমাদের দলটি ছোট হয়ে গেল ২০ জনের দলটি ১৩ জন হয়ে গেল। মারিশ্যা বাজারে এসে সন্ধ্যার পর নৌকা ঠিক করা হলো। পরদিন সকালেই আমরা বেড়িয়ে পরবো নদীপথে সাজেকের উদ্দেশ্যে। পরিকল্পনা বাস্তবায়নে জুননুন ভাই কয়েকজনের সাথে মারিশ্যার আমরা যে হোটেলে উঠেছে সেখানে বসে কয়েক দফা বৈঠক করলেন। মারিশ্যা বাজারের কয়েকজন দোকানদার বললেন ভাই কোথায় যাবেন? উত্তরে বললাম সাজেক। দোকানদাররা বললো আমাদের জম্ম মারিশ্যা বাজারে সাজেক আমাদের উপজেলার একটি ইউনিয়ন সত্বেও কোন দিনই সেখানে যেতে সাহস করিনি। আপনারা কি ওখানে মরতে যাবেন? কি দরকার সেখানে যাওয়ার। সেখানে একজাতীয় উপজাতি আছে যারা মানুষ হত্যা করে খেয়ে ফেলে। এসকল কথা শুনে আমাদের মাঝে অদৃশ্য আতংক তাড়া করে ফিরতে লাগলো।

সাজেক যাওয়া হবে কি হবে না এ জন্য দোটানায় পড়লেও গোপনে চলতে থাকে পরিকল্পনা। পরিকল্পা হয় বৌদ্ধদের একটি বনবিহারে। সেখানে আমরা সন্ধ্যার আগে আগে বেড়াতে গিয়েছিলাম। লিপটন, রুবেল, রশিদ, সিনা ও জুননুন ভাই মারিশ্যা বাজারে ফিরে এসে ভাগ্যক্রমে নৌকা ঘাটে সাজেকের কংলাক মৌজার হেডম্যান চংমিংথাংগার খোঁজ পান। তার সাথে পরিচয় হয়। তিনি বলেন, রাত্রে কথা হবে। একথা বলে চলে যান। রাতে আমরা কয়েকজন বেড়িয়ে পরি সাজেকের কংলাক মৌজার হেডম্যানের খোঁজে। তার সাথে দেখা হয় শহরের একটু ভেতরে একটি গীর্জা ঘরে। হেডম্যান বললেন, এতো লোক সাজেক যাবেন, বিপদ হতে পারে। অপহরণ করতে পারে চুক্তি বিরোধী ইউপিডিএফ’র লোকজন। তবে আমি চাই আপনারা আমাদের ওখানে যান। আমরা তো বিচ্ছিন্ন অবস্থায় থাকি। স্বদেশী অতিথিদের দেখা পাই না। আপনারা আমাদের ওখানে গেলে আমাদের জীবন যে কত কষ্টের তা জানতে পারবেন। এতো লোক একসাথে সাজেক গেলে বিডিআর, আর্মীরা তো সমস্যা করবে। আপনারা বাঙ্গালী আপনাদের কিছু হলে তাদের নিকট আমাকে জবাবদীহি করতে হবে। আবার মাচালং যাওয়ার পর পার্টির লোকেরা সন্দেহ করে ধরে ফেলবে। এসকল নানা কথার পরেও আমাদের অতিমাত্রায় চাপাচাপির ফলে হেডম্যান আমাদের সাথে মাচালং বাজার পর্যন্ত যেতে রাজি হলেন, কারণ পরদিন সকালে মারিশ্যা বাজারে বাঘাইছড়ি উপজেলা পষিদ কার্যালয়ে রাঙ্গামাটি জেলা প্রশাসক আসবেন সাজেকসহ উপজেলার বিভিন্ন বিষয় নিয়ে বৈঠক হবে। সেজন্যই তিনি সাজেক থেকে মারিশ্যা এসেছিলেন। রাতে খেতে বসেই আমাদের ঘিরে ধরে এক গাড়ি ভর্তি পুলিশ। আমাদের প্রতি নির্দেশ রুমে চলেন ব্যাগ চেক করা হবে। সন্দেহের মাত্রা দেখে মনে হয় যেন আমরা বাংলাদেশী নই।

সাজেক যাবার কথা ফাঁস হয়ে যাওয়ায় সন্দেহের আঙ্গুলি আমাদের দিকে অতিমাত্রায় ছিল। সবার নাম ঠিকানা নিয়ে ব্যাগ চেক করে কিছু না পেয়ে আমাদের প্রতি নির্দেশ দেয়া হল ঢাকায় বা খাগড়াছড়ি, রাঙ্গামাটি যেখানে খুশি ফিরে যান, সাজেক যাওয়া যাবে না। মধ্যরাত পর্যন্ত পুলিশের নজরদারীর কারণে আমরা রুদ্ধদ্বার বৈঠক করে অনেককেই অন্ধকারে রেখে সিদ্ধান্ত নেই ফজরের আজান দেয়ার সাথে সাথে নৌকায় উঠে পুলিশের চোঁখ ফাঁসি দিয়ে পানি পথে মাচালং নদী দিয়ে সাজেকের উদ্দেশ্যে প্রথমে মাচালং বাজার যাবো। সিন্ধান্ত অনুযায়ী সেভাবেই রওয়ানা হলাম। আলো আঁধারীর মধ্যে মারিশ্যা বাজারের অদূরে একটি গ্রামের পাশে দিয়ে বয়ে যাওয়া নদী ঘাটে গিয়ে দেখি তখনও নৌকা আসেনি। খানিক পরে দেখা গেল হেডম্যানসহ নৌকাটি আসছে। উঠে পরলাম সকলে সাবধানে। রিজার্ভ ফরেষ্টের মাঝ দিয়ে বয়ে যাওয়া মাচালং নদীর দু’পাশে আদিবাসীদের ঘর-বাড়ি, বড় বড় গাছ পালা, নদীর পারে নানা রকম চাষাবাদ করার দৃশ্য দেখে আমরা মুগ্ধ হয়ে উঠি। জুননুন ভাইএর ক্যামেরায় বন্দি হচ্ছিল এসকল প্রাকৃতিক সৌন্দর্যে লালীত ছবি। আমিও আমার ডিজিটাল ক্যামেরায় কিছু ছবি বন্দি করি। এরই মধ্যে চোঁখে পরে বিশাল বড় বাঁশের চালা। আদিবাসীরা জানালো লক্ষ লক্ষ বাঁশ সাজেক রিজার্ভ ফরেষ্ট থেকে আসছে, নদী পথে কাপ্তাই লেক হয়ে কর্ণফুলী পেপার মিলে যাবে। অনেক দূর গিয়ে যেখানে বাঘের ভয় সেখানেই রাত হয় অবস্থায় পরি। আবার সেই বাঘাইহাট সেনা জোন। যেখান থেকে আমাদের নিরাপত্তার অভাবের কথা বলে ফেরত পাঠানো হয়েছিল। অদৃশ্য ভয়, সংশয়ে সকলেই কিংকর্তব্য বিমূঢ় হয়ে গেল। নদীর পারেই সেনাবাহিনীর নজরদাবী রয়েছে।

বুদ্ধি করে আমরা নৌকায় শুয়ে পরি। চেক পোষ্টকে ফাঁকি দিয়ে রক্ষা পাই। নয়তো আবারও ফেরত যেতে হতো। এবার ফেরত গেলে আর সাজেক যাওয়া হতো না। এরপর কিছু দূর গিয়ে দেখি আবারও সেনাবাহিনীর ক্যাম্প। তবে তেমন নজরদারী নেই। পোষ্ট থেকে সেনাবাহিনী আমাদের দেখতে পেলেও শ্রমিক ভেবে হয়তো কিছু বলেনি। পরে জানতে পারি ইঞ্চিনিয়াংি কোরের এসকল সেনাদের দায়িত্ব সন্ত্রাসীদের নজরদারী করা নয়, নির্মাণ কাজে সহায়তা করা ও স্থাপনার নিরাপত্তা ও সংরক্ষণ করা। ক্যাম্পের পাশে মাচালং নদীতে বেশ বড় ধরণের পাশাপাশি ২টি ব্রীজ। নব নির্মিত এই গঙ্গারাম ব্রীজ থেকেই ৭ নির্মাণ শ্রমিককে সন্ত্রাসীরা অপহরণ করেছিল। যে কথা জানিয়েছিলেন জোন কমান্ডার। মাচালং বাজারে গেলেই দেখা হবে ইউপিডিএফ’র লোকজনদের সাথে এজন্য অগ্রিম গিয়ে নেতাদের সাথে দেখা করতেই সাজেক যাবার অনুমতি নিতেই রুবেল, লিপটন আমি ও হেডম্যান ব্রীজের সামনে নৌকা থেকে বিকল্প পথে রাস্তায় চলে আসি। এসেই দেখা মেলে একটি নির্জন স্থানে চায়ের দোকান। সেখানে বসে চা খাওয়ার পর্ব শেষ করতে না করতেই যাত্রীবাহী জীপ চলে আসে। আমরা জীপে উঠে দেখি জীপে কোন বাংলাভাষাভাষি লোকজন নেই। স্থানীয় আদিবাসীরাই জীপের যাত্রী। জীপটি পথে টাইগারটিলা, শুকনানন্দারাম, ভিজানন্দারামসহ কয়েকটি স্থানে সেনাবাহিনী কর্তৃক চেকিং করা হলো। জীপের হেলপারকে কানে কানে বললাম এতো চেকিং কেন? উত্তরে বললো জীপে অস্ত্র আসে তাই। কোথা থেকে আসে। বলল সাজেক থেকে। কারা আনে বলে পাহাড়িরা। আমি বললাম কই, পথে তো কোন অস্ত্র দেখি নাই বলে আগে আসতো, এখন তেমন আসে না। পথে আসতে চেঁখে পরে সবুজের প্রতি করুন নিষ্ঠুরতার প্রতিচ্ছবি। হাজার হাজার সেগুন, গামারি, কড়ই, চাপালিশ গাছ কে বা কারা কেটে নিয়ে সাবাড় করে ফেলেছে। পৌঁছে যাই মাচালং বাজারে। এখানে দেখা করি ইউপিডিএফ’র নেতা প্রদীপন খীসার সাথে। তার সাথে আমার আগে থেকেই পরিচয় ছিল। তিনি আমাদের সাজেক যাওয়ার অনুমতি দেন শর্ত সাপেক্ষে।

সাজেকের পথে সরকারি রিজার্ভ এলাকায় ১০ নম্বর গ্রামে বসবাসরত ৩০/৪০টি চাকমা পরিবার বসবাস করে। বিডিআর’র এসকল পরিবারের অনেক জুমের ক্ষেত পুড়িয়ে দিয়েছে। তাদের সরকারি রিজার্ভ ফরেষ্ট এলাকায় বসবাসের সরকারি নির্দেশের কথা বলে তাড়িয়ে দিতে চাইছে। অথচ এই আদিবাসীরা ৬০’র দশকে রাঙ্গামাটিরকাপ্তাই লেকে বাঁধ দিয়ে জল বিদ্যুতের প্রকল্প স্থাপন করায় পানিতে তাদের বস্তু ভিটা তলিয়ে যাওয়ায় উচ্ছেদ হয়ে যায়। পরবর্তীতে ৮০’র দশকে গেরিলা যুদ্ধের শিকার হয়েও এরা উদ্বাস্তু হয়ে যাযাবর জীবন যাপন করছে। কোন মত মাথা গোঁজার ঠাই এখানে করলেও সরকারের নিষ্ঠুরমত আইনের মারপ্যাচে তাদেরকে বসবাসের ন্যুন্যতম অধিকারটুকু হরণ করার চেষ্টা চলছে। প্রতিটি রাত তাদের এখন কাটে অজানা এক আশংকায়। মাচালং বাজারে পাশে একজন চাকমা আদিবাসীর বাড়িতে রাত কাটানোর কথা থাকলেও আমি নিজেই বাঁধ সাজি। সে বাড়িতে কিছুক্ষন অপেক্ষার পর একটি কিশোর আদিবাসী জানালো পথে পার্টির লোকদের দেখা হতে পারে। টর্জ লাইট জ্বালানো যাবে না। লাইট দেখে দূর থেকে তারা সেনাবাহিনী ভেবে গুলি করতে পারে। ওদিকে আমরা এই সেনাবাহিনী বা পুলিশের ভয়েই রাতে রওয়ানা হই সাজেকের দূর্গম পাহাড়ি অরণ্য পথে। তারা আমাদের খোঁজ পেলে আর সাজেক যেতে দেবে না বার বার এই আশংকা তাড়া করে ফিরছিল।

সন্ধ্যা প্রায় ঘনিয়ে আসছে এমন সময় আমরা মাচালং বাজার থেকে সাজেকের উদ্দেশ্যে রওয়ানা দেই। আমাদের সাথে ইউপিডিএফ’র দু’জন সদস্য সাজেক যাওয়ার পাহাড়ি দূর্গম পথ দেখাতে সহায়তা করেন। একে তো রাত তার উপর পাহাড়ি আঁকা-বাঁকা উঁচু নিঁচু রাস্তা। সমস্ত রাস্তা ঢাসা জঙ্গলে ঢাকা। মাঝে মাঝে ছড়া, ঝিরি ও নদী। ঝরণার পানিতে রাস্তা কখনও বা পিচ্ছিল। পুরো পথেই ক্লান্তিহীন ঝিঝি পোকার ডাক শুনে একে তো কান ঝালাপালা অবস্থা, তার উপর পাখ-পাখালী, বন্য পশু জীব যানোয়ারের হাক ডাক শুনা যাচ্ছিল। পথিমধ্যে ক্লান্ত শরীরে রাস্তার পাশে একটি টং ঘরে আশ্রয় নেই আমরা ১৫জন। ক্ষুধার তীব্র জ্বালায় আমরা মাচালং বাজার থেকে আনা খাজা মজা করে গিলে ফেলি। এরপর আবার পথ চলা। এ যেন অজানাকে জানার অচেনাকে চেনার শ্বাসরুদ্ধকর স্মৃতি এখনও ভূলতে পারি না। আমরা অবশেষে রাত ১০টার দিকে সাজেকের ১০ নম্বর গ্রামে চাকমা পাড়ায় গিয়ে পৌঁছি। সেখানে আমাদের অভ্যর্থনা জানান, এলাকার কারবারি খুলা রাম চাকমাসহ অন্যান্য গ্রামবাসী। মাঝ রাতে খাওয়া দাওয়া শেষে অবচেতনে ক্লান্ত শরীর ঘুমিয়ে পরে। সকালে সূর্য্যি মামা জাগার আগেই জুননুন ভাই পাহাড়ে সূর্যদ্বয়ের ছবি ক্যামেরা বন্দি করতে ঘুম থেকে জেগে উঠেন। ক্যামেরা বন্দি করেন এখানকার অপরূপ সব দৃশ্য। আমিও ডিজিটাল ক্যামেরায় বন্দি করি বেশ কিছু অনাবিল সুন্দর পাহাড়ের প্রথম আলোর ছবি। ছবিতে মেঘের ভেলা দেখে বিস্মিত হই খানিকটা। সকালের খাবার খেয়ে এখান থেকে আবারও পায়ে হেটে যেতে হবে আসল সাজেক পাহাড়ের চূড়ায়।

আবার রওয়ানা হলাম আমরা। হাট হাটতে অদ্ভুত সব ছবি কোনটা রেখে কোনটা ক্যামেরা বন্দি করি এনিয়েই কয়েকজন ব্যস্ত। এ কারণে এবার ক্লান্তি অনেকটাই কম আঘাত করতে পেরেছে, যদিও বা আসল কষ্টটা এখনই বেশি ছিল। পথে পথে অসংখ্য স্থানে এমন সব রাস্তা চেঁখে পড়েছে তা লেখে বর্ণনা করা আসলেই দুস্কর। কেন না এমন রাস্তাও পেয়েছি, যেখানে বিশাল গাছই হয়েছে একটি সাঁকো। গাছের উপর দিয়ে ছড়া পার হতে হবে। কোথাও খাড়া ঢালুর বাঁকে বাঁকে পথ চলতে হয়েছে। পা পিচলে গেলে নিশ্চিত মৃত্যু এমন রাস্তাও পার হতে হয়েছে। পায়ে হাটা সরু রাস্তার দু’পাশ কোটি কোটি বাঁশ রীতিমত কল্পনার ছবির মত। অনেক দূর এসে দেখা পাই সিজকছড়া নামে একটি পাহাড়ি ছড়া। পাথরের উপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে স্বচ্ছ সাদা পানি। সেখানে আমরা মনের সুখে গোসল সেরে নেই। সেখান থেকেই মূলতঃ প্রায় ২০০০ ফুট উঁচু পাহাড় চূড়ায় আসল সাজেক অবস্থিত। আর আমাদের গন্তব্য সেখানেই। উঠতে উঠতে বহু দূর উঠেও কোন কূল কিনারা পাওয়া যায়নি। মাঝে মাঝে সূর্য্যরে আলোও হারিয়ে যায় জঙ্গলের কারণে। অবশেষে হঠাৎ দেখা মেলে একটি হেলিকপ্টারের। আমরা থমকে দ্বারাই। এতো কষ্টের পরেও কি সাজেক যেতে পারবো না এ আশংকা দেখা দেয়। এই গভীর অরণ্যে কেন হেলিকপ্টার তার রহস্য তখনও অজানা ছিল। আমরা ভেবেছি সরকারের দায়িত্বশীল ব্যক্তিদের চোঁখ ফাঁকি দিয়ে সাজেকের পথ পারি দেওয়ায় আমাদের খুঁজতেই হয়তো বা হেলিকপ্টার এসেছে। কিছুক্ষণ পর হেলিকপ্টার ফিরে গেলেও হতাশার ঘোর তখনও কাটেনি। হাটতে হাটতে দূর থেকেই দেখা মেলে বৃটিশ আমলের বিডিআর ক্যাম্প। একজন লুসাই আদিবাসী আমাদের খবর দিলেন, আপনারা এখন সাজেক যাবেন না। বিডিআর ক্যাম্পে সিনিয়র অফিসার এসেছেন, এ কারণে রুইলুই গ্রামে বিডিআর টহল দিচ্ছে। একথা শুনে আমরা আরেক দফা অপেক্ষা করতে থাকি। পরে বিডিআর চলে গেলে আমরা রওয়ানা হই।

অবশেষে পৌঁছে যাই স্বপ্নের সাজেক। সাজেকের পাহাড় চূঁড়া থেকে মিজোরামের লুসাই পাহাড়ের অদ্ভুত দৃশ্য দেখে সকল ক্লান্তি ও কষ্ট নিমিষেই ¤ ান হয়ে যায়। প্রকৃতির এতো সুন্দর রূপ আগে কখনও দেখিনি। সাজেকের এই প্রাকৃতিক রূপের সাথে পাংখোয়া ও লুসাই আদিবাসীদের বৈচিত্রময় জীবন যাত্রা দেখে আরও বিস্মিত ও হতবাগ হয়ে যাই। উঁচু মাচার ঘরে গাছের গুড়ি কেঁটে বানানো সিঁড়ি, ঘরের ছাউনী বাঁশের পাতার। ঘরের সামনে ফুলের বাগান, মাঝে মাঝেই ক্যাকটাস ও অর্কিড শোভা পাচ্ছে রুইলুই গ্রামটি। ঢালুতে ২/৩ শত বছরের পুরোনো বিশাল বিশাল গাছ। বাড়ির অদূরেই অসংখ্য কমলা বানান। এরই মাঝে চোঁখে পড়ে অসংখ্য ঔষুধী গাছ-গাছড়া। একে বারে ঢালুতে যেদিন তাকাই সেদিকই লক্ষ কোটি বাঁশ আর বাঁশ। সেই ঘর থেকে একে একে বেড়িয়ে আসছে আদিবাসীরা। কেউ পানি আনতে, কেউ বা জুম ক্ষেতে উৎপাদিত ফসল আনতে ব্যস্ত তারা। পরনে তাদের জিন্সের প্যান্ট, গায়ে হাতা কাঁটা সট গেঞ্জি, ব্রা, শার্ট, স্টাট ইত্যাদি। লাবন্যময়ী রূপসী মেয়েদের দেখে মনে হয়েছে বোম্বের কোন নায়িকা এখানে শুটিং-এ এসেছে। পোষাক দেখে মনে হয়েছে এ যেন বাংলাদেশের ভেতর এক খন্ড ইউরোপ। বিকেল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত ঘোরাঘুরি এক পর্যায়ে জানাগেল তাদের ধর্ম খৃষ্টান। মিজো ভাষায় তারা কথা বললেও ইংরেজি তাদের অক্ষর ইংরেজী। লুসাই ও পাংখোয়া আদিবাসীরা বাংলা ভাষার চেয়ে ইংরেজিতে কথা বলতেই বেশি পছন্দ করে। এসকল ভিন্ন জীবন ধারার সাথে পার্বত্য এলাকার অনেক উপজাতিই পরিচিত নয়। রাতে চংমিং থাংগা (৬২)’র সাথে কথা হয়। তিনি জানান অজানা নানা কথা। এখানকার বাঁশে বাঁশে নাকি ফুল ফুটেছে। ফুল থেকে গোলা ধরে ধরে। এসকল গোলা দেখা দেয়া মানে নিশ্চিতভাবেই বলা যায় ২০০৭ সালের পর কোটি কোটি ইদুর দেখা দেবে।

এ বিশ্বাসকে লালন করে সাজেকজুড়ে দেখা দিয়েছে ইদুর বন্যা আতংক। এক জাতীয় ছোট ইদুর (মাউস) জুমের ধান, তিল,তিসি, মারফা বা শষা, মিষ্টি কুমড়াসহ সকল সফল বিনষ্ট করে ফেলবে, এ কারণে সাজেকজুড়ে দেখা দেবে দূর্ভিক্ষ। চারদিক খাদ্যের জন্য হাহাকার পরে যাবে। তখন এখানকার অধিবাসীদের বেঁচে থাকার একমাত্র অবলম্বন হবে এক জাতীয় পাহাড়ি আলু। যা আকারে লম্বা এবং মাটির ভেতর থাকে। আজ থেকে ৫০ বছর আগে একবার এরূপ ঘটনা ঘটে। তৎকালীন সরকার সামান্য রেশন দিয়ে সহায়তা করেছিল। এর আগেও একবার অর্থাৎ ১০০ বছর পূর্বে ইদুরের উৎপাত এখানকার মুরুব্বিরা দেখেছে। এ নিয়ে প্রতি ৫০ বছর পর পর ইদুর আতংক এখানকার মানুষকে তাড়া করে ফিরে। ইদুর যে আসবে তার আলামত ইতিমধ্যে স্পষ্ট হয়ে উঠেছে। সাজেকের পৃথিবী বিখ্যাত সুস্বাদু হাজার হাজার কমলা গাছ মারা গেছে। বাঁশগুলো মরে যাচ্ছে। ইদুর জুমের চাষ বিনষ্ট করার পর পরই সাজেকের বির্স্তীন সজুব বাঁশ জ্বলে পুরে হলুদ বর্ণ ধারণ করবে। ইতোমধ্যে সাজেক সংলগ্ন ভারতের মিজোরাম রাজ্যে ইদুর বন্যা আতংক দেখা দিয়েছে। সে জন্য রাজ্য সরকার আগাম প্রস্তুতি হিসেবে বাঁশগুলো তুলে ফেলছে। কৃষকদের জুম চাষের পরিবর্তে স্বল্প ও দীর্ঘস্থানী চাষাবাদে সহায়তা করছে। এছাড়াও ইদুর মারার প্রয়োজনীয় ঔষধ সরবরাহ করা হয়েছে। সম্ভাব্য দুর্ভীক্ষ সামাল দিতে মিজোরামের খাদ্য গুদামে পর্যাপ্ত খাদ্য শষ্য মওজুত করা হয়েছে। অথচ বাংলাদেশ সরকার সাজেকের এই দূর্ভীক্ষের বিষয়ে কিছুই জানে না। এ কথাগুলো শুনে সত্যিই রূপ কথার গল্প মনে হয়েছে। সাজেক নিয়ে আরও রসহ্য ঘেরা ও অলৌকিক নানা কথা শুনতে শুনতে ক্লান্ত শরীর ঘুমিয়ে পরে। সাদ সকালে সূর্য্যি মামা জানার আগেই আমি উঠে দেখি ততক্ষনে জুননুন ভাই ক্যামেরা নিয়ে প্রস্তুত, সাজেকে প্রথম সূর্যদ্বয়ের ছবি তোলার জন্য। আমিও ক্যামেরা নিয়ে প্রস্তুত। অন্ধকারের ঘোর কাঁটতে না কাঁটতেই হঠাৎ সাজেক ও মিজোরামের লুসাই পাহাড়ের মাঝ বরাবর আঁকা-বাঁকা বিশাল সাগর দেখে আমরা রীতিমত হতবাগ। এই দূর্গম পাহাড়ে আবার পানি বা সাগর এলো কোথা থেকে। যতই সামনে যাই ততই দেখি সবুজের বুক চিরে সাদার আর সাদা পানির খেলা।

তাৎক্ষনিকভাবে এই সাগরের কুল কিনারা আর রহস্য কিছুই বুঝতে পানিনি। কারণ আগের দিন বিকেলে তো এখানে কোন পানি, সাগর, নদী দেখিনি। তবে শুনেছি এই পাহাড়ের মাঝে একটি নদী আছে। যে নদীর নাম সাজেক নদী। মূলতঃ এই নদীর নামেই সাজেকের নাম করণ হয়েছে। এরই মখ্যে পূর্বাকাশে উঁকি দিয়ে ঝিলিক মারে সূর্য্যি মামা। সূর্য্যটার আলোক রস্মি সোজা আচড়ে পরছে সাজেকের উঁচু পাহাড়ে যেখানে আমরা দ্বাড়িয়ে রয়েছি। এমতাবস্থায় আমাদের ক্যামেরা ঝলকে উঠলো। ক্যামেরা বন্দি করলাম পৃথিবীর শ্রেষ্ট সব ছবি। এতো ছবি তুলি তবুও মন যে ভরে না। ম্যামোরী কার্ড শেষ হলেই মনে কষ্ট দেখা দেয়। একটু পরে তাকিয়ে দেখি এতো সাগর, মহা সাগর, নদী নয়, এতো মেঘের ভেলা ভেসে বেড়াচ্ছে লুসাই-সাজেক পাহাড়ের বাঁকে বাঁকে। সবার উপর নীল আকাশ, তার ফাঁকে লাল সূর্য্য, মাঝে সবুজ পাহাড়, নিচে সাদা মেষের সাগর আসলে এক অদ্ভুত দৃশ্য যা বাস্তবে না দেখলে বুঝানো যাবে না। ফিচার, নিউজ, গদ্য, পদ্য লিখে সাজেকের এই দৃশ্যপটের অনুভূতি ব্যক্ত করা সত্যিই দুষ্কর। লাল, নীল, সাদা, সবুজের খেলার সাথে আরও কত রঙের খেলা যে মাখা মাখি করে সাজেকের নির্জন পাহাড়ি আদিবাসী পলি তে তা ভাষায় প্রকাশ করা যায়না। কোন কবি এখানে আসলে যেতে চাইবেনা। কোন শিল্পী এখানে আসলে শুধু ছবিই আঁকবে, ভূলে যাবে নাওয়া খাওয়া, কোন গায়ক এখানে আসলে হেরে গলা ছেড়ে দিয়ে মনের আনন্দে গাইবে গান, আর কোন লেখক এখানে আসলে মনের মাধুরী মিশিয়ে এতো দীর্ঘ দেখা লেখবে তাতেই বিরক্তি অনুভব করবে না পাঠকেরা।

ভ্রমণ বিষয়ক সাংবাদিকতা

ভ্রমণ বিষয়ক সাংবাদিকতা
সৌমিত্র দেব

ভ্রমণ অনেকে করে কিন্তুূূ তারা সকলে পর্যটক নন,আর সব পর্যটক লিখতে জানেন না। সে কারণে ভ্রমণ বিষয়ক সাংবাদিকতার গুরুত্ব অনেক। সাংবাদিকতার পরিধি অনেক ব্যাপক। তথ্যের অধিকার এখন আর শুধু দাবী নয় , সংবিধানেও স্বীকার করে নেওয়া হয়েছে। ভ্রমণ বিষয়ক সাংবাদিকতার কথা আলোচনার আগে আমাদের দেখতে হবে এদেশে পর্যটন শিল্পের অবস্থাটি কি। ভ্রমণকারীদের সাধারণভাবে দুভাগে ভাগ করা যায়। তারা হলেন দর্শনার্থী ও অদর্শনার্থী। দর্শনার্থীদের পর্যটক শ্রেণীভূক্ত করা হলেও অদর্শনার্থীরা পর্যটক হিসেবে গ্রাহ্য হন না। পর্যটকেরা দেশী হতে পারেন আবার আন্তর্জাতিকও হতে পারেন। পর্যটনের দিক থেকে বাংলাদেশের সম্ভাবনা অনেক । এদেশে অনেক দর্শনীয় স্থান আছে। সিলেট ও পার্বত্য চট্টগ্্রামে আছে পাহাড়। পৃথিবীর দীর্ঘতম সমুদ্র সৈকত কক্সবাজার আমাদের দেশেই। সর্ববৃহৎ ম্যানগ্রোভ ফরেস্ট সুন্দরবনের কথা কে না জানে ! সিডরের ছোবলকে বুকে নিয়ে যে বাঁচিয়েছে বাংলাদেশের বিস্তীর্ণ জনপদ।

বা্গংালীর জাতির কৃষ্টি সংস্কৃতি তো আছেই , এমনকী আদিবাসীদের সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যও আকৃষ্ট করতে পারে পর্যটকদের। ভ্রমণপিপাসুদের কাছে বাংলাদেশের আটষট্টি হাজার গ্রাম হয়ে উঠতে পারে এক একটি পর্যটন কেন্দ্র। কিন্তু তবু বাংলাদেশ পর্যটনের দিক থেকে অনেক পিছিয়ে আছে। এখানে পর্যটন বিকশিত হওয়ার অন্তরায় রচনা করেছে সরকারের অদূরদর্শী চিন্তা, দেশবাসীর সাংস্কৃতিক পশ্চাদপদতা ও অবকাঠামোগত উন্নয়নের অভাব। ভালো হোটেল মোটেল রাস্তা ঘাট এখনো সর্বত্র নির্মিত হয়নি। পর্যটকদেও নিরাপত্তার ব্যপারটিও এখনো ঊপেক্ষিত। নেপালের মত দেশে একজন নারী পর্যটক খোলামেলা পোষাকে ঘুরে বেড়ালেও সেটা সাধারণ মানুষকে কৌতুহলী করে তোলে না। কিন্তু আমাদের দেশে একজন পুরুষ পর্যটকও যেখানে সেখানে দর্শনীয় হয়ে ঊঠেন। দর্শনীয় স্থান যেমন পর্যটককে আকৃষ্ট করে তেমনি সেখানকার মানুষ ও তাদের জীবন যাত্রাও পর্যটকের কাছে গভীর আগ্রহের বস্তু। তারা সেখানে স্বস্তিদায়ক একটি পরিস্থিতি কামনা করে ।

পাশাপাশি তাদের বিনোদনের জন্য পানীয় এবং ক্যাসিনোর ব্যাবস্থা থাকা বাঞ্ছনীয়। ইংরেজিতে একটি কথা চালু আছে Ñ ট্্র্যাভেলার ইজ আ পিওর কনজিউমার অর্থাৎ ভ্রমণকারীরাই পর্যটনের প্রধান নিয়ামক। কিন্তু দেখা গেছে বাংলাদেশ সরকারী ভাষ্যমত জিডিপির খুব কম শতাংশই লাভ করে এই পর্যটন খাত থেকে। বিশ্ব পর্যটনের অন্যান্য দেশের তুলনায় বাংলাদেশে পর্যটন শিল্পের অবস্থান কোথায় ? ২০০০ সালের একটি পরিসংখ্যান দিয়ে ব্যাপারটি বোঝা যাবে । ২০০০ সালকে বেছে নেবার কারণ ঐ সময়কাল পর্যন্ত সারা বিশ্বে পর্যটনের স্বাভাবিক গতিধারা বজায় ছিল এবং পর্যটন কার্যক্রমও স্বাভাবিক ছিল । পরবর্তীকালে ২০০৩ সালের প্রথমদিকে ইরাক যুদ্ধ, সার্স ভাইরাসের প্রাদুর্ভাব , আর্ন্তজাতিক সন্ত্রাস প্রভৃতি কারণে পর্যটন শিল্পের জন্য মহা বিপর্যয় নেমে এসেছে।

এখানে ২০০০ সাল পর্যন্ত বিশ্বে পর্যটন থেকে প্রাপ্ত আয়ের একটি পরিসংখ্যান দেখানো হলো : ছক: ১ বিশ্ব পর্যটনে উন্নত ৬টি দেশের অবস্থান দেশ পর্যটক আগমন (লক্ষ জন) পর্যটন থেকে আয় (কোটি টাকা) বিশ্ব বাজারে হিস্যা (শতাংশ) ফ্রান্স ৭৫০ ২,১০,০০০ ১৭.৬ আমেরিকা ৫৩০ ৫,০৪,০০০ ৬.৯ চীন ৩২০ ১,০২,০০০ ৩.৪ গ্রেট ব্রিটেন ২৫০ ১,২০,০০০ ৪.০ রাশিয়া ২১০ ৫৭,০০০ ১.৬ জার্মানি ১৯০ ১,১১,০০০ ৩.৬ ছক : ২ দ্বীপ ও নগর কেন্দ্রিক দেশের পর্যটন অবস্থান দেশ পর্যটক আগমন (লক্ষ জন) পর্যটন থেকে আয় (কোটি টাকা) উপমহাদেশের বাজারে হিস্যা (শতাংশ) হংকং ১৩১.০ ৮৭,৮৮০ ১৯.৭ সিঙ্গাপুর ৭০.০৯ ৩৯,৪২৮ ৮.০ ম্যাকাউ ৬৭.০ ১৮,৬০০ ৩.৩ পোর্টোরিকো ৩০.৩ ১৫,২৪৬ ১.৭ দুবাই ২৮.২৮ ৩,৯৬৯ ৬.২ মালদ্বীপ ৪.৬৫ ২,২৪৪ ৭.২ ছক : ৩ দক্ষিন এশিয়া তথা সার্কভুক্ত ছয়টি দেশের অঞ্চলভিত্তিক পর্যটন অবস্থান দেশ পর্যটক আগমন (লক্ষ জন) পর্যটন থেকে আয় (কোটি টাকা) উপমহাদেশের বাজারে হিস্যা (শতাংশ) ভারত ২৬.২৪ ১৯,৬৯৮ ৬৫.৮ নেপাল ৫.২৬ ১,১০৮ ৩.৬ মালদ্বীপ ৪.৬৫ ২,২২৪ ৭.২ পাকিস্তান ৪.৪ ৫২২ ১.৬ শ্্রীলংকা ৪.০ ১,৫১৮ ৬.০ বাংলাদেশ ১.৯ ২৬২ ০.৯৬ তিনটি ছকে দেওয়া

এই পরিসংখ্যান পর্যালোচনা করলে সহজেই বোঝা যায় বিশ্ব পর্যটন তো দূরের কথা দক্ষিণ এশিয়ার সার্কভুক্ত দেশগুলির মধ্যেও বাংলাদেশের অবস্থা পর্যটনের ক্ষেত্রে অত্যন্ত নাজুক। তবে ধীর লয়ে হলেও এদেশে এখন পর্যটনের ব্যাপারে ইতিবাচক পদক্ষেপ নেওয়া হচ্ছ্ ে। রাস্তাঘাটের উন্নয়ন হয়েছে, প্রত্যন্ত এলাকাতেও উন্নতমানের হোটেল রিসোর্ট নির্মিত হচ্ছ্।ে দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলির মধ্যে আঞ্চলিক সহযোগিতা ও আদান প্রদান বেড়েছে। বাংলাদেশ ভারতের মধ্যে বিভিন্ন সীমান্তে বাস চলাচল শুরু হয়েছে ; রেল চলাচল শুরু হয়েছে। পর্যটনের ওপর রীতিমত পড়াশোনা করছে শিক্ষার্থীরা। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পর্যন্ত ট্যুরিজম ও হোটেল ম্যানেজমেন্টের ওপর বিভাগ খোলা হয়েছে। এঅবস্থায় সহজেই অনুমান করা যায় পর্যটনের জন্য আগামীদিনে অনেক সুখবর অপেক্ষা করছে। ভ্রমণ বিষয়ক সাংবাদিকতার জন্য খুলে যাচ্ছে অনেক গুলি নতুন দিগন্ত। এবারের আলোচনা করা যাক ভ্রমণ বিষয়ক সাংবাদিকতা। এককথায় একে প্রকাশ করা কঠিন। কারণ ভ্রমণ বিষয়ক লেখালেখি করতে গিয়ে লেখক বা সাংবাদিক অনেক বেশি স্বাধীনতা ভোগ করতে পারেন। মনে রাখতে হবে যে শুধূ লেখা নয় এধরনের সাংবাদিকতার ক্ষেত্রে ফটোগ্রাফ, স্পন্সর ও মার্কেটিংও অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ বিষয়।এ বিষয়ে কিছু পাঠকের জ্ঞাথার্থে এবিষয়ে কিছু আলোকপাত করা হলো। ভ্রমণ বিষয়ক লেখা তৈরির সময় লক্ষ্য রাখতে হবে আর্টিকেল/ ফিচারটি যেন প্রাস্ঙ্গিক,ইন্টারেস্টিং, আনন্দদায়ক, তথ্যবহূল,উপকারী ও সরস হয়। লেখার মধ্যে পাঠককে বলার মত কিছু রসদ এবং গল্প থাকে। নির্দিষ্ট থিমকে ফোকাস করার মত মুন্সীয়ানা থাকাও জরুরী। ভ্রমণ বিষয়ক ভালো লেখা তৈরির কাজটি কোন কাকতলীয় বা দৈব ঘটনা নয়। সার্থক ভ্রমণ রচনা প্রকৃত পক্ষে লেখকের প্রখর ব্যক্তিত্ব, , অভিজ্ঞতা, রসবোধকেই প্রকাশ করে, স্থিরভাবে কিন্তু গুরুত্ব সহকারে পাঠককের সামনে কিছু তথ্যও তুলে ধরে। ভ্রমণকাহিনীটি পড়ার সময় পাঠক লেখকের সাথেই মানস ভ্রমণ করবেন ; তাই লেখক কে তার লেখার মধ্য দিয়ে নিজেকে একজন ই›াটরেস্টিং ও আনন্দদায়ী ভ্রমণ সংগী হিসাবে পাঠকের কাছে আর্কষণীয় হয়ে উঠতে হবে। পান্ডিত্য পূর্ন তত্ত্বীয় আলোচনা নয় বরং ফিচারটি হতে হবে প্রাসঙ্গিক ও সহজবোধ্য। ফটোগ্রাফ: প্রিন্ট মিডিয়া অত্যন্ত ভিজ্যূয়াল। লেখার চেয়েও অনেকসময় ছবিকে প্রধান্য দেওয়া হয়ে থাকে এবং এর জন্য অধিক পেমেন্ট দেওয়া হয়ে থাকে। আলোকচিত্র অনেকসময় এত বাঙময় ও হৃদয়গ্রাহী হয় যে আর্টিকেলের ভাষা ও মুন্সীয়ানাকে ছাপিয়ে যায় । তাই ভালো আলোকচিত্রর গুরুত্ব ও কম নয়।

আলোকচিত্রের মধ্যে দিয়েও পাঠক মানসচক্ষে অবোলকন করতে সক্ষম হন লেখকের ভ্রমণকৃত স্থানটি , ধারণা লাভ করতে পারেন ঐ স্থানটির স্থানীয় মানুষ সম্পর্কে ; অনুধাবন করতে সক্ষম হন তার ভৌগলিক অবস্থাও। এক কথায় অদেখা ও অচেনা ঐ স্থানটি চোখের সামনে মূর্ত হয়ে উঠতে পারে শুধু মাত্র একটি ভালো আলোকচিত্রের কারণে। তাই লেখার চেয়েও আলোকচিত্রের বিষয়টি অধিক গুরুত্বপূর্ন ট্্র্যাভেল জার্নালিজমে। ভালো আলোকচিত্র ছাড়া ভালো লেখাও অসম্পূর্ণ রয়ে যাবে। স্পন্সরশীপ: ভ্রমণ সাংবাদিকতার জন্য এয়ার লাইনন্স, ট্যুর অপারেটর ও পর্যটক কর্তৃপক্ষের স্পন্সর নিশ্চিত করা জরুরী। এদের পৃষ্টপোষকতা ব্যতীত ভ্রমণ সাংবাদিকতা অত্যন্ত অলাভজনক । সাংবাদিকতার এই শাখায় অনেক দক্ষ সাংবাদিকের অপমৃত্যু ঘটতে পারে এদের যথার্থ পৃষ্টপোষকতা পাওয়া না গেলে। অধিকাংশ সময় দেখা গেছে যে ভ্রমণ ব্যয় সাপেক্ষ বিষয়। ভ্রমণ পিপাসু অনেক সাংবাদিক – লেখক সর্বপ্রথমে এই ব্যয় এর কথা বিবেচনায় এনে ভ্রমনের আনন্দ থেকে নিজে কে বঞ্চিত রাখে । সহজেই ভ্রমণ করা যেতো এমন অনেক ভ্রমণের সুযোগ শুধু মাত্র এই কারণে নষ্ট হয়ে যেতে দেখা গেছে। অথচ আমাদের ক’ জনার পক্ষে বলা সম্ভব যে বিশ্বের কোন দর্শনীয় স্থানগুলি আমাদের পছন্দের তালিকায় রয়েছে? আমরা কোথায় কোথায় ভ্রমণে আগ্রহী? ভ্রমণ সাংবাদিক কে আগে ভ্রমণ – এর জন্য তার পছন্দের তালিকা তৈরি করতে হবে। ব্যয় এর কথা আপাতত: ভুলে গিয়ে নিজের হৃদয়ে কান পাততে হবে এবং ভ্রমণের জন্য নিজের আগ্রহ অনুযায়ী পছন্দসই সাম্ভাব্য ভ্রমণ স্থানের তালিকা তৈরি করতে হবে।

স্পন্সরশীপ- এর জন্য আবেদন করার সময় নিজস্ব বিশ্বাস ও ট্রিপের ব্যয় বাহূল্যও কথা ভুলে যেতে হবে। সিদ্ধান্ত গ্রহণ বা ট্্িরপ পানিং প্রক্রিয়ায় একজন স্পন্সরের কাছে ব্যয় বিষয়ক ইস্যূটি সম্পূর্ণ অপ্রাসাংগিক। পৃষ্ঠপোষকতার স্বার্থে ট্্িরপটি কার্যকর করার বিষয়ে মনোনিবেশ করতে হবে । শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত স্পন্সরকে আকৃষ্ট করার স্বার্থে তাদের চাহিদা কি তা খুজেঁ বের করার পাশাপাশি চুক্তির প্র¯া—বনা তৈরি করতে হবে ও পুরো প্রজেক্টটি বাস্তবায়নের পর্যায় পর্যন্ত নিয়ে যেতে হবে। ফ্্িরল্যান্স সাংবাদিকরা ভালো প্রস্তাবনা উপস্থাপন করতে পারলে স্পন্সরের কাছ থেকে বড় ধরনের আর্থিক সহযোগিতা পাওয়া অসম্ভব কিছূ নয়। সঠিকভাবে এই ক্ষেত্রে দক্ষতা অর্জন করতে সক্ষম হলে নিজের ইচ্ছেমত পছন্দসই ট্্িরপ স্পন্সরের কাছেও গ্রহণযোগ্য করে তোলা যাবে। এ পদ্ধতিতে কাজ করলে উভয়পক্ষই লাভবান হবে। মূল্যবান পৃষ্ঠপোষকতা নিরবিচ্ছিন্ন ও নিশ্চিত করার লক্ষ্যে ট্্য্্রাভেল জার্নালিষ্টকে নিত্যনতুন আর্কষনীয় আইডিয়া উদ্ভাবক হতে হবে যা উভয়পক্ষের মধ্যে মেলবন্ধন ঘটাবে সাম্ভাব্য পারস্পরিক স্বার্থে।এভাবে স্বতন্ত্র চিন্তাবিদ ও মার্কেটার হিসাবে একজন ফিল্যান্স ট্্রাভেল জার্নালিষ্ট – এর অবদান তার অনন মানসম্পন্ন লেখা ও ছবির সাথে সাথে মূল্যায়িত হতে শুরু হবে এবং স্পন্সরাও উৎসাহিত হয়ে উঠবে টাকা বিনিয়োগের জন্য। মার্কেটিং: একজন বড় মাপের লেখক বা ফটোগ্রাফার হয়েও বেশিদূর যেতে পারবেন না যদি নিজের কাজের যথাযথ ও সঠিকভাবে মার্কেটিং করতে ব্যর্থ হন। অর্থাৎ ভালো লেখক ও ফটোগ্রাফার হওয়া সত্ত্বেও যদি সুষ্ঠুভাবে মার্কের্টি ং করা না যায় তবে একজন ট্্র্যাভেল জার্নালিষ্টের কাজের কোন মূল্যই থাকবে না। মার্কেটিংকে কোন বিরক্তিকর কাজ হিসাবে গণ্য করা ঠিক নয়। সঠিক পরিকল্পনার মাধ্যমে অধিক কার্যকর ও একই সােেথ বহুবিধ উদ্ভাবনী চিন্তা ও লেখার সমন্বয় ঘটিয়ে একে আরো উপভোগ্য ও প্রাণবন্ত করে তোলা সম্ভব। নিত্য নতুন আইডিয়া নিয়ে অগ্রসর হতে হবে। চলতি লেখার প্যাকেজ ও আর্কাইভের লেখা সমূহ বার বার পড়তে হবে। যেসব লেখা প্রচারের বাইরে রয়ে গেছে সেগুলি বিদেশে অধিকমাত্রায় বিক্রয়ের জন্য প্রয়াস নিতে হবে। সূত্র : বাংলাদেশে পর্যটন শিল্পের অন্তরায় এবং উওরণ – মো: জামিউল আহমেদ জামিল

রোমাঞ্চকর টেকনাফ গেমরিজার্ভ

রোমাঞ্চকর টেকনাফ গেমরিজার্ভ

এম. আহসানুল হক খোকন

ভার ৪ টায় হোটেল সিক্রাউন, কক্সবাজার হতে মাইক্রোবাস যোগে দলনেতা ড: মনিরুল, শফিকভাই, মুস্তাফিজ, রিপন, শিহাব, সামিউল ও আমি টেকনাফ গেমরিজার্ভের উদ্দেশ্যে রওনা হলাম। মাইক্রোবাসের হেডলাইটের আলোয় নির্জনতা ভেঙ্গে আঁধার কেটে মাত্র ৫৫ মিনিটে প্রায় ৬০ কিলোমিটার পথ পেরুনো গেল। জুলাই মাস বিধায় আকাশের মুখ ভার। পুঁটিবুুনিয়া গ্রামে পৌঁছে কয়েকজন গাইড সহ সকাল ৬ টার মধ্যেই টেকনাফ গেমরিজাভের তৈঙ্গা পাহাড়ের পথে নিসর্গ সাপোর্ট প্রোগ্রামের পাখি শুমারী ও ফিল্ড মনিটরিং জন্য রওনা হলাম। বর্ষা মৌসুমে পাহাড়ের গাছগাছালী গাঢ় সবুজ রং ধারণ করেছে। গাছে গাছে ফুল ফলের সমাহার, পাখিদের কলতান সব মিলে স্বপ্নিল পরিবেশ। এর মধ্যে বুনো অশোক ও জারুল ফুলের রং আমার মন কাড়লো। প্রায় ৩ ঘন্টা চড়াই উৎরাই পেরিয়ে তৈঙ্গা পাহাড়ে পৌঁছুলাম। পথে ছোট কানাকুবো (খবংংবৎ ঈড়ঁপধষ ), মদনা টিয়া ( জবফ-নৎবংঃবফ চধৎধশববঃ ), নীলকান বসন্তবৌরী ( ইষঁব ণবধৎবফ ইধৎনবঃ ), বড়হলদেঝুঁটি কাঠকুড়ালী ( এৎবধঃবৎ ণবষষড়ি ঘধঢ়ঢ়বফ ), এশীয় দাগি কুঁটি পেঁচা ( অংরধহ ইধৎৎবফ ঙষিবঃ ), সোনাকপালী হরবলা ( এড়ষফবহ ঋৎড়হঃবফ খবধভ ইরৎফ ), নীলশিলাদামা ( ইষঁব জড়পশ ঞযৎঁংয ), বনমুরগী ( জবফ ঔঁহমষব ঋড়ষি ), র‌্যাকেটফিঙ্গে ( জধপশবঃ ঞধরষবফ উৎড়হমড় ), কালাঝুঁটি বুলবুলি ( ইষধপশ ঈৎবংঃবফ ইঁষনঁষ ), কালামাথা বুলবুলি ( ইষধপশ ঐবধফবফ ইঁষনঁষ ), কালাগলা টাুনটুনী ( উধৎশহবপশবফ ঞধরষড়ৎ ইরৎফ ), গলাফোলা ছাতারে ( চঁভভ ঃযৎড়ধঃবফ ইধননষবৎ ), লালডানা ঝাঁড়ভরত ( জঁভড়ঁং-রিহমবফ ইঁংযখধৎশ ), সিঁদুরপীঠ ফ’লঝ’রি ( ঝপধৎষবঃ-নধপশবফ ঋষড়বিৎঢ়বপশবৎ ), লালমৌটুসী ( ঈৎরসংড়হ ঝঁহনরৎফ ) প্রভৃতি পাখি দেখা গেল। তৈঙ্গাপাহাড়ের চূঁড়া থেকে দূরে সুনীল বঙ্গপোসাগর, শীলখালী গর্জন বন, নাফ চ্যানেল, মায়ানমার পাহড়শ্রেণী অবলোকন করে মনজুড়িয়ে গেল। বিশ্রামের সময় গাইডদের সংগৃহীত বুনোআম, ঢাকিজাম এর স্বাদ আস্বাদন করে সকল ক্লান্তি ভুলে গেলাম।

ঠিক এমন সময় নিকটতম পাহাড়ের ঢালে বুনো হাতীর দলে ৬টি কে দেখে আমরা নিশ্চুপে ক্যমেরার ও ভিডিও ক্যামেরার সাটার চেপে ব্যস্ত সময় আতিবাহিত করলাম। এ এক অসাধারণ দৃশ্য! প্রায় ঘন্টা খানেক সময় কাটিয়ে রওনা হবার প্রাক্কালে গ্রুপ ফটো সেশন করা হলো। ঝিরি পথে উৎরাই পথে নামার পরিকল্পনা করতেই তাকিয়ে দেখি আকাশে ঘনকালো মেঘের ঘনঘটা! দ্রুত নামার চেষ্টা করেও কিছুদুর অগ্রসর হতেই মুষলধারে বৃষ্টি শুরু হওয়ায় পথ চরম পিচ্ছিল ও বিপদজনক হয়ে উঠলো। ভুলে পা পিছলে গেলেই প্রায় ৭০০ ফুট গভীর গিরিখাদে পড়ে মৃত্যু অনিবার্য! এছাড়া শতশত জোঁক কিলবিল করে শরীরে উঠতে শুরু করলো। ফলে ইচ্ছা সত্তেও দাঁড়িয়ে থাকা গেল না বরং বিপদজনক ভাবে নামতে থাকলাম। ট্রেকিং পথ নিচিহ্ন হওয়ায় দিকভ্রম হলাম। অগত্যা তৈঙ্গা ঝর্ণার কাছে পৌঁছুনো গেলেও পাহাড়ী ঢলে ঝিরিপথ ভয়ংকর রকমের খরস্রোতা রূপ নিলো। সাথে পাহাড় ধ্বসে বিশালাকার বোল্ডার গড়িয়ে পড়ায় মৃত্যুর আশংকা! মৃত্যুভয় পেয়ে বসায় ক্যামেরা সরঞ্জাম ভিজে নষ্ট হলেও সেদিকে ভ্রুক্ষেপ করার অবকাশ নাই । ঝর্ণার পাশে নিরাপদ স্থানে আশ্রয় নিলেও আচমকা প্রচন্ড পাহাড়ী ঢল নেমে আসায় আমরা ভেসে যাবার যোগাড় ! কোনমতে গাছের ডালপালা ধরে রক্ষা পাওয়া গেল। প্রায় ২ঘন্টা প্রাণান্তকর অপেক্ষার পর বৃষ্টি কমলে ধীরেধীরে খরস্রোতা ঝিরিপথে অগ্রসর হতে শুরু করে আরো ৫ ঘন্টা পর বিকাল ৫টা নাগাদ পুঁটিবিলা গ্রামে আমাদের মাইক্রোবাসের সন্নিকটে পৌছে দেখি সকলের শরীর জোঁকের আক্রমণে রক্তাত্ত!

একটু বিশ্রাম নিয়েই সন্ধ্যার মধ্যে হেটেলে পৌঁছুলাম। রাতে শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত কোচে ফেরার পথে বিগত কয়েকদিনের টেকনাফ গেমরিজার্ভে র মনোমুগ্ধকর এ্যাডভেঞ্চারের স্মৃতি নিয়ে তন্দ্রালোকে স্বপ্নের দেশে চলে গেলাম। তথ্য কণিকা ঃ বাংলাদেশের সর্বদক্ষিণের উপজেলা টেকনাফের অর্ন্তগত সংরক্ষিত বন টেকনাফ গেমরিজার্ভ নামে পরিচিত। কক্সবাজার হতে ৪৮ কিলোমিটার দক্ষিণে এবং টেকনাফ হতে উত্তর দিকে ১৫ কিলোমিটার দূরত্বে এই গেম রিজার্ভের অবস্থান। সংরক্ষিত এ বনের ভূ-প্রকৃতি, জীববৈচিত্র এক কথায় অনন্য। সবুজ এই পাহাড়ী অঞ্চলে ভঙ্গিল পর্বতের নমুনা, মনোমুগ্ধকর প্রাকৃতিক ঝর্ণা, উষ্ণমন্ডলীয় চিরসবুজ বন পর্যটকবৃন্দকে রোমাঞ্চের বহুবিধ স্বাদ উপভোগের সুযোগ করে দেবে। এই গেম রিজার্ভের মধ্যবর্তী স্থানে লম্বা ও সরু পাহাড়ের শ্রেণী দক্ষিণ দিক হতে উত্তরে বি¯তৃত। গেম রিজার্ভের সর্বোচ্চ চূড়া “তৈঙ্গা” নামে পরিচিত। তৈঙ্গা পাহাড়ের উচ্চতা সমুদ্র পৃষ্ঠ হতে প্রায় ১০০০ ফুট। ১৯৮৩ সনে এই সংরক্ষিত গেম রিজার্ভ ঘোষিত হয়। এই গেম রিজার্ভের আয়তন ১১,৬১৫ হেক্টর। বি¯তৃত এই গেম রিজার্ভের রোমাঞ্চকর স্পট গুলোর মধ্যে নাইটং পাহাড়, তৈঙ্গা পাহাড়, তৈঙ্গা ঝর্ণা, কুদুম গুহা অন্যতম। টেকনাফ গেমরিজার্ভ ইকোটুরিজমের অন্যতম আকর্ষণ সমূহ নি¤েœ বর্ণিত হলো – জীব বৈচিত্র ঃ এই গেম রিজার্ভ দেশের সর্বোচ্চ জীববৈচিত্রপূর্ণ। বিশেষজ্ঞ জরীপে এখানে প্রায় ৩০০ প্রজাতির বৃক্ষরাজি, ২৮৬ প্রজাতির পাখি, ৫৫ প্রজাতির স্তন্যপায়ী, ১৩ প্রজাতির উভচর, ৫৬ প্রজাতির সরীসৃপ পাওয়া গেছে। বুনোহাতীর সবচেয়ে বড় দলটি ( ১৬ টি ) এই গেমরিজার্ভে অবস্থান করে যা দেশের মোট হাতীর প্রায় এক তৃতীয়াংশ। এছাড়া বনে বিলুপ্তপ্রায় বুনোকুকুর, উল ুক, সাম্বার হরিণ, উডুক্ক কাঠবিড়ালী, শজারু প্রভৃতি প্রাণীর দেখা মেলার সম্ভাবনা রয়েছে।১৯৮২ সনে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রাণীবিজ্ঞান বিভাগ পরিচালিত জরীপে দূর্লভ প্রজাতির ষ্ট্যাম্প টেইলড্ ম্যাকাক বা খাটো লেজী বান্দর দেখার রেকর্ড রয়েছে। নাইটং পাহাড় ঃ টেকনাফ শহরের ঠিক পাশেই নাইটং পাহাড়ের অবস্থান । প্রায় ৭০০ ফুট এই পাহাড়ে উঠতে ঘন্টাখানেক সময় লাগবে।

কষ্ট করে উপরে উঠলে পুরো টকনাফ শহর, দূরে বঙ্গপোসাগর, নাফচ্যানেল, মিয়ানমার পাহাড় শ্রেণী, শীলখালী প্রাকৃতিক গর্জনবন, টেকনাফ গেমরিজার্ভের সবুজ পাহাড়শ্রেণী প্রাণ ভরে উপভোগ করার দূর্লভ সুযোগ মিলবে। ভাগ্য সুপ্রসন্ন হলে বুনো হাতীর দলটির সাক্ষাৎ পেতেও পারেন। তবে হাতী দেখতে সতর্ক থাকুন কেননা এই বুনো হাতীর দল বিরক্ত হলে মানুষ মারতে দ্বিধাবোধ করে না! সতর্কতা হিসেবে সাথে অবশ্যই প্রশিক্ষিত গাইড নিতে হবে। কুঠি বা ভঙ্গিল পাহাড় ঃ বিশেষজ্ঞ গণের মতে অতীতে এই পাহাড় শ্রেণী বঙ্গোপসাগরের তলদেশ ছিল। লক্ষ লক্ষ বছরের বিবর্তনের ফল বর্তমানের এই অবস্থা। ভালোভাবে পর্যবেক্ষণ করলে দেখা যায় এই কুঠির শিলাস্তরে শামুক-ঝিনুকের জীবাø বা ফসিল এবং সল্টক্রীক বা লবণাধার। কুঠির সল্টক্রীক বুনো প্রাণীর লবণের অভাব মেটায়। রাতে বুনোপ্রাণী সল্টক্রীক চেঁটে শরীরে লবনের চাহিদা পূরণ করে। তৈঙ্গা ঝর্ণা ও ঝিরি ঃ কুঠির আনুমানিক ২০০ ফুট পশ্চিমে প্রবাহিত তৈঙ্গাঝিরি। ঝিরির পানি স্ফটিক স্বচ্ছ এবং জলজপ্রাণী বৈচিত্রে ভরপুর। প্রায় ৭০০ ফুট উচ্চতা থেকে শিলাময় পাহাড়ের ধাপে ধাপে এই ঝর্ণা ক্রমান্বয়ে ঝিরি ধরে প্রবাহিত হয়েছে। ঝিরির পানি বন্য প্রাণীদের জলের প্রয়োজন মেটায়। তৈঙ্গা চূড়া ঃ গেম রিজার্ভের অন্যতম আকর্ষণ হলো তৈঙ্গা চুড়া। এ চুঁড়া অত্যন্ত খাড়া এবং ট্রেকারদের জন্য আদর্শ। তৈঙ্গা চূঁড়া হতে দূরে বঙ্গোপসাগর, নাফনদী, মায়ানমার সীমানার পাহাড় শ্রেণী এবং গেম রিজার্ভের এরিয়েল ভিউ অবলোকন বাস্তবেই এক অপার্থিব অনুভূতি। কুদুম গুহা ঃ হোয়াইক্যং বাজার হতে শাপলাপুর অভিমূখে ৪ কিলোমিটার যাবার পর বাম দিকে পাহাড়ী ঝিরিপথ ধরে আরো ২ কিলোমিটার অগ্রসর হলে রোমাঞ্চকর এই গুহায় পৌঁছুনো যাবে। আনুমানিক ৫০০ দীর্ঘ এই গুহায় প্রবেশ করতে হলে হাঁটু জল কাঁদা মাড়িয়ে ভ্যাপসা গন্ধ উপেক্ষা করে যেতে গা ছমছম করা আঁধারে চামচিকাদের কিচিরমিচির ডাক ও ইতস্তত: উড়াউড়ি এবং পানিতে নানা জাতের মাছের আনাগোনা হৃদযে শিহরণ জাগাবে। সাথে হেডলাইট ও আত্মরক্ষামূলক লাঠি অবশ্যই নিতে ভুলবেন না যেন। কারণ এই গুহায় পাহাড়ী অজগর চামচিকা শিকারের জন্য আসে।

চাকমা গ্রাম ঃ কুদুম গুহার ধারে কাছেই ডইঙ্গাকাটা গ্রামে চাকমা সম্প্রদায়ের বসবাস। নিসর্গ সাপোর্ট প্রোগ্রামের গাইডের সহায়তায় পাড়াপ্রধানের অনুমতি নিয়ে চাকমা সম্প্রদায়ের কৃষ্টি কালচার প্রত্যক্ষ করার ব্যবস্থা করা যেতে পারে। শীলখালী প্রাকৃতিক গর্জনবন ঃ টেকনাফ গেমরিজার্ভের সবুজ পাহাড়শ্রেণী ও সুনীল বঙ্গপোসাগরের মাঝে শতবছরের পুরনো এই প্রাকৃতিক গর্জনবন ভ্রমণের স্মৃতি বনানী প্রেমিক পর্যটকের মনে নিশ্চিত অমøান থাকবে। বনে নানা পাখির কাকলী, উত্তাল সাগরের প্রমত্তা ঢেউয়েরশব্দে মন আক’ল হবে। পাখিপ্রেমিকদের জন্য স্থানটি আদর্শ। ভ্রমণের সেরা সময় ঃ অক্টোবর মাস থেকে ফেব্র“য়ারী মাস অবধি এই এলাকা ভ্রমণের সেরা সময়। মার্চ-এপ্রিল মাসে পাহাড়ের গাছ গাছালী মারা যাওয়ায় সব ন্যড়া হয়ে যায় এবং ঝিরির পানি ক্ষীণ ধারায় প্রবাহিত হতে থাকে। এ্যাডভেঞ্চার প্রিয় পর্যটক জুন-জুলাই মাসের সবুজ পাহাড়, সতেজ ঝিড়ি-ঝর্ণা দেখে আসতে পারেন। যাতায়াত ঃ ঢাকা থেকে কক্সবাজার পর্যন্ত বিমান অথবা বাসে। সেখান থেকে ননষ্টপ টেকনাফগামী বাসে হ্নীলা বাজার। হ্নীলা বাজার থেকে তৈঙ্গাপাহাড় অভিমূখে ট্রেকিং। এসি বাস ঃ ঢাকা হতে কক্সবাজার যেতে যোগাযোগ করতে পারেন গ্রীণলাইন (৯৩৩৯৬২৩, ৯৩৪২৫৮০) সোহাগ পরিবহণ (ফোন ঃ৯৩৩১৬০০, ৭১০০৪২২), সিল্ক লাইন (ফোন ৭১০২৪৬১, ৮১০৩৮২) ভাড়া ৬৫০/- টাকা হতে ৮৫০/- নন এসি বাস ঃ এই রুটে নন এসি বাসে যেতে যোগাযোগ করতে পারেন এস. আলম (ফোন ৯৩৩১৮৬৪, ৮৩১৫০৮৭) আবাসন ঃ ধারে কাছে হ্নীলা বাজার সাধারণ মানের হোটেল। ভাড়া ১৫০/- টাকা হতে ২০০/- টাকা প্রতিরাত। টেকনাফ শহরে বাংলাদেশ পর্যটন কর্পোরেশনের মোটেল ভাড়া ৫০০/- টাকা হতে ১২৫০/- টাকা। এছাড়া টেকনাফ শহরে সাধারণ মানের একাধিক হোটেল পাওয়া যাবে ২৫০/- টাকা হতে ৫০০/- টাকার মধ্যে। গাইড ঃ টেকনাফ গেমরিজার্ভ ভ্রমণের সময় প্রশিক্ষিত গাইড সাথে নেয়া আবশ্যক। নিসর্গ সাপোর্ট প্রোগ্রাম এই এলাকায় ইকোট্যুরিজম ইনফ্রাসট্রাকচার তৈরিতে নির্জনে কাজ করে চলেছে। হ্নীলা বাজারের কাছে কক্সবাজার – টেকনাফ রোডের পাশে নিসর্গ অফিসে গাইডের খোঁজ করা যেতে পারে। বিস্তারিত জানতে যোগাযোগ করতে পারেন ঃ কমিউনিকেশন স্পেশালিষ্ট, এন,এস,পি, বাড়ী-৬৮, সড়ক-১, ব ক-আই, বনানী, ঢাকা। ফোন ৯৮৭৩২২৯, ইমেল সবযৎরহ@রৎম.পড়স, ওয়েব : িি.িহরংযড়ৎমড়.ড়ৎম ফটো বিবরণ : টেকনাফ গেমরিজার্ভের দৃশ্য টেকনাফ গেমরিজার্ভ থেকে নাফ চ্যানেলের দৃশ্য কালাঝুঁটি বুলবুল হরবোলা পাখি টেকনাফ গেমরিজার্ভের হাতী বুনো অশোক তৈঙ্গা ঝর্ণা লাল মৌটুসী কালাঘাড় টুনটুনী কুদুম গুহা বুনো ফল হাতী থেকে রক্ষা পাবার জন্য মাচাঘর। মদনা টিয়ার বাসা

অবনি অনার্য

অবনি অনার্য
স্বদেশ অন্বেষা

কবি রুদ্র মোহাম্মদ শহীদুল্লাহর প্রিয়তম জায়গার একটি ছিলো মংলা। কবির ভীষণ অনুরাগী বলেই হয়তো বার তিনেক মংলায় গিয়েছি। ওখানে গেলেই রুদ্রর কথা ভেবে মন খারাপ হতো খুব। একাএকা সেই মন খারাপটা কারো সঙ্গে ভাগাভাগি করতে পারতাম না, উপায় কেবল একটাই, ওঁর বিখ্যাত সেই গানটি গাওয়াÑ ভালো আছি ভালো থেকো/ আকাশের ঠিকানায় চিঠি লিখো… আনন্দ ভাগাভাগি করলে সেটা বিস্তৃত হয়, আর দুঃখ ভাগাভাগি করলে বিভাজিত হয়ে ছোট হয়ে আসে। সেই তাড়না থেকেই ভ্রমণের জন্য চারজনের একটা ছোট্ট দল গড়া হলো আমাদের, বাকি তিনজন তখন বুয়েটের ছাত্র, এখন সবাই পুরোদস্তুর ইঞ্জিনিয়ার। ২০০২ সালের জুলাই মাসে লম্বা একটা ট্যুর করার সিদ্ধান্ত নেয়া হলোÑ ফয়’জলেক-পতেঙ্গা-কক্সবাজার-সেন্টমার্টিন-ছেঁড়াদ্বীপ-বান্দরবান-চিম্বুক-রুমা-রাঙামাটি। ভ্রমণের পরিকল্পনা অনুযায়ী সবার একইরকম টিশার্ট কেনা হলো। সাম্য পড়তো আর্কিটেকচারে, আঁকাআঁকির হাত নিয়ে বলবার কিছু নেই।

ও বসে পড়লো টিশার্টে কিছু একটা আঁকা বা লেখার জন্য। শেষমেশ লেখারই সিদ্ধান্ত হলো, এখন ট্যুরটার একটা নাম দেয়া চাই। তখন সদ্য ড. আহমদ শরীফের স্বদেশ অšে¦ষা পড়ে শেষ করেছি। নামটা ভ্রমণের সঙ্গেও যায় বলে প্রস্তাব করলাম, সবাই রাজি। টিশার্টের পেছনে লেবেল সাঁটা হলোÑ স্বদেশ অšে¦ষা। সবই ঠিক আছে, মাসটা শুধু জুলাই। বৃষ্টি চলছে। ট্যুরের যাই হোক, রেলভ্রমণ জমবে এটা নিশ্চিত জেনে কমলাপুরের সুবর্ণ এক্সপ্রেস-এর টিকেট কাটা হলো। সুবর্ণ চেপে চট্টগ্রামে। বন্ধু রাজুর মেসে। রাজু তখন চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে বিবিএ পড়ছে, এখন এমবিএ শেষে চাকুরি করছে একটা ব্যাংকে। পরদিন সকালে ফয়’জ লেক (ফয়েজ সাহেবের নয়, মি. ফয়’র লেক) এবং বিকেলে পতেঙ্গা সৈকত ভ্রমণ। এটা ছিলো মূলত ওয়ার্মআপ টাইপের। বৃষ্টি হচ্ছিলো গুঁড়িগুঁড়ি, তাতে আমাদের কী! তার পরদিন কক্সবাজারের উদ্দেশে যাত্রা। রাজু যাবে না, ওর পরীক্ষা। পথে রামুতে মন্দির দেখবো বলে বাস থেকে নেমে পড়লাম। রাখাইনদের পুরাতন মন্দিরসহ চার পাঁচটা মন্দির দেখা হলো। ওখানে প্রায় ১৫/২০টির মতো মন্দির আছে বলে জানালেন পুরোহিত। পালি ভাষায় বান্তে সে-কা-চা-রা মন্দিরের শিল্পকর্ম-স্থাপত্য দেখে মাইক্রো চেপে কক্সবাজার। হোটেলের রুম ভাড়া বিষয়ে আমাদের কারোরই কোনো পূর্বঅভিজ্ঞতা নাই। রুমের ভাড়া শুনে আমরা মোটামুটি সৈকতেই থাকার সিদ্ধান্ত নিলাম। পরে একটা হোটেলে গিয়ে ডাবল রুমের ভাড়া জিজ্ঞেস করলাম। ওটাতে চারজন থাকা যাবে কি-না জিজ্ঞেস করতেই ভদ্রলোক বুঝতে পারলেন আমাদের নিরস মুখগুলোর পেছনের ঘটনা।

জানতে পারলেন আমরা ছাত্র, আর তেমন কথা বাড়ালেন না। একটা রুমে সবার ব্যাগ রেখে টিশার্ট-শর্টস পরে সোজা সৈকতে। পড়ন্ত বিকেল। সমুদ্রের গর্জন, পর্যটকদের গাদাগাদি। ক্লান্ত-বিধ্বস্ত হবার আগ পর্যন্ত দাপাদাপি চললো। হোটেলে ফিরে পোশাক পাল্টে বৈকালিক নাস্তা সেরে ফের সৈকতে। আঁধার নেমেছে ততক্ষণে, সূর্যাস্তের আগেকার জনসমাবেশের বিরক্তিকর অনুপভোগ্য পরিবেশটি আর নেই। ক্ষুব্ধ সমুদ্রের বহমানতার স্বাক্ষরকে বুঝি আরো নিজের করে পেলাম। সৈকতের পাশে কটে শুয়ে সবাই নিশ্চয়ই হারিয়ে গিয়ে থাকবে সেই জগতে, যেখানে দ্বিতীয় সত্বার প্রবেশাধিকার নিশ্চতরূপেই নিষিদ্ধ। দৃষ্টি আকাশমুখী, ওপরে এক প্রকৃতি অন্ধকার। ক্যামেরায় ধরার চেষ্টা চালিয়েছিলো সাম্য। কিন্তু ক্যামেরায় অন্ধকার কতোটা ধরা যায়, কতোটা ধরা যায় রাঙামাটির সুবলং ঝরনার পরিপার্শ্বের পাহাড়ি প্রেক্ষাপটের অশরীরি ভয়াল নৈঃশব্দ। চোখের লেন্সকেই তাই ভরসা মেনেছি আমি। কক্সবাজার সৈকতে রাতের আঁধারে দূর আকাশের তারাগুলির উঁকি বড্ড শূণ্যতার জানান দিচ্ছিলো। সব হারানোর কষ্টগুলি আরো তীব্র আরো প্রকট হয়ে উঠেছিলো কি! হারানোর অনুভবকে আমরাও কি খুঁজিনি অন্ধকারের দুর্ভেদ্য অবয়বের বিশালত্বকে অতিক্রম করা কী দুঃসাহসী অথচ কী নিষ্পাপ তারাগুলোতে! অবচেতনেই আমার ভেতরেও কি রচিত হয়নি কোনো গান! কেবল সমুদ্রেরই তো বুঝবার কথা ছিলো এইসব। কিন্তু সমুদ্রের কি বিস্মৃতিরোগ হয়েছে! সমুদ্রও তো দাগ রেখে যায় বালুকাবেলায়। কুলে ঝিনুক রেখে ওই দূরে চলে যায় ঢেউÑ যায় কি? আমরা কী রেখে যাই?

[[ একটি গানের কয়েকটি পংক্তি মনের ভেতর গুণগুণ করছিলোÑ চাঁদটাকে ভালোবাসি তাই বলে/ চাঁদ কভু নেয়নিকো বুকে তুলে/ নীলাকাশ ভালোবাসি প্রতিদানে/ ভাসিয়েছে রাশিরাশি দুখ ঢেলে/ ভাসিয়েছে রাশিরাশি দুখ ঢেলে/ ভাসিয়েছে সে দুখ ঢেলে ॥// আদিবাসী ঝরনাটা পাখা মেলে/ যায় চলে ওই দূরে বহুদূরে/ ঢেউয়ের সাক্ষী ঝিনুক কুলে/ আর আমরা তো হেসেখেলে যাই চলে/ আমরা তো হেসেখেলে যাই চলে/ আমরা তো যাই চলে॥// সাগরের ওংকার ছুঁতে গেলে/ চকিতে পালিয়ে মিটিমিটি হাসে/ যাযাবর মন যেই ছুটে চলে/ অচিনসুতোটা কে যে টেনে ধরে/ অচিনসুতোটা কে যে টেনে ধরে/ অচিনসুতোটা টেনে ধরে॥// আমি তো সঁপেছি মালা আগুণেরে/ আগুণ বলেছে শেষে ছাই পাবো/ বলেছি দিয়েছি যারে সব দেবো/ ছাই হবো নয় পুড়ে খাঁটি হবো/ ছাই হবো নয় পুড়ে খাঁটি হবো/ ছাই হবো নয় খাঁটি হবো॥]]

সমুদ্রকে আরো আপন করে পেয়েছিলাম পরদিন, সেন্টমার্টিনে। সেন্টমার্টিনে আমাদের কটেজ ছিলো সৈকতের সবচেয়ে কাছাকাছি, হুমায়ূন আহমেদের সমুদ্রবিলাসের পাশেই। এখানকার জল পতেঙ্গা-কক্সবাজারের মতো ঘোলাটে নয়, লোভনীয় স্বচ্ছতা প্রেয়সীর মতো টানে। রাতে কটেজ থেকেই সমুদ্রের গান শুনতে পাই, আর আমরা বাংলায় গান গাই… অদেখা-প্রকৃতির এমনতর বিস্ময়কর বাস্তবতায় নিরূপায় এ-মনটা যদি দু’একবার বল্গাহীন হয়ে সব ছেড়েছুঁড়ে পালাতে চায়, তবে সে-খেয়ালীপনার অপরাধ কেবল আমার একলা নয়, দায় কিছুটা এ-প্রকৃতিরও, কিছুটা অতৃপ্ত-চিত্তের নির্মম-কাতর আকুলতারও। এও জানি, এতে তৃপ্ত হই বটে, কিন্তু সঙ্গী করবার সাধ্য কিংবা দুঃসাহসিকতা নেই। পতিতা আর কবির মতো। পতিতার দেহ কাম নেভায়, তারপর ভুট্টা ছাড়িয়ে নেয়ার পর মাঝখানে অবশিষ্ট দণ্ডের মতো, ডাস্টবিনেই যার চূড়ান্ত অবস্থান। কবির কবিতা অনুরণন ঘটায়, কিন্তু অতঃপর… কবিকে কে সঙ্গী করেছে কবে? পেরেছে? কবিরা বুঝি পতিত! সেন্টামার্টিনে ঝিনুক আর প্রবাল কুড়িয়েছি অজস্র। অদ্ভুত সব রঙয়ের বিচিত্র সমন্বয়ের বিস্ময় নেশা ধরিয়ে দেয়। আমাদের ভ্রমণের মূল লক্ষ্য কিন্তু সেন্টমার্টিনও নয়, ছেঁড়াদ্বীপ। কিছুদিন আগেই একুশে টেলিভিশনে ছেঁড়াদ্বীপ নিয়ে একটা প্রতিবেদন দেখিয়েছিলো, সেটা দেখেই আমাদের মূল লক্ষ্য দাঁড়ালো ছেঁড়াদ্বীপ। পরদিন ভোরবেলা ঝোড়ো তারুণ্য পায়ে হেঁটেই রওয়ানা করলো ছেঁড়াদ্বীপের উদ্দেশে। সঙ্গী হিসাবে পেলাম স্থানীয় এক স্কুল শিক্ষক। তিনি নিজেও কখনো ওখানে যাননি। আমাদের কথা শুনে তাই রাজি হয়ে গেলেন।

তখনও পর্যন্ত সেন্টমার্টিন তেমন একটা জমে ওঠেনি। মনে আছে, আমাদের ক্যামেরার ফিল্ম শেষ হয়ে গেলে সেই ফিল্ম পেতেই ঘণ্টা দুয়েক লেগেছিলো। একরকম দৌড়াতে শুরু করলাম, কারণ সকালের জোয়ার শেষে ভাটা শুরু হবে বারোটার দিকে, এরপর ফের জোয়ারের পালা। এরই মধ্যে বিচ্ছিন্ন সেই দ্বীপে গিয়ে ফেরত আসতে হবে। ফেরত আসতে না পারলে সলিলসমাধি। মাস্টার সাহেব আমাদেরকে ট্রলার নিতে বললেন। সেটা নেয়া যেতো, সময় তাতে কম লাগবে নিঃসন্দেহে। কিন্তু তাতে সৈকতের অজানা রহস্য অজানাই থেকে যেতো। ছুটতে শুরু করলাম সৈকত ধরে। ধারালো সব পাথর, সমুদ্রের বিরতিহীন ঢেউয়ের আঘাতে বালি থেকে এসব পাথরের সৃষ্টি। লাফ দিয়ে দিয়ে পার হচ্ছি। মাঝে মধ্যে পা ফসকে খানিকটা কেটেও যাচ্ছে। যাক, সেটা পায়ের ব্যাপার। মুশকিল হচ্ছে একদিকে তাড়াতাড়ি পৌঁছানোর দায়, অন্যদিকে অনন্যসাধারণ সব ঝিনুক-প্রবালের সমারোহ। আমি শুভ আর কনক নেমেছি প্রতিদ্বন্দ্বীতায়, কে কতোটা অপূর্ব প্রবাল বা ঝিনুক কুড়োতে পারে। যে-সৈকতের প্রধান বিস্ময়ই হচ্ছে বৈচিত্র্য, সেখানে সংগ্রহ করার মতো ঝিনুক-প্রবালের অভাব হয় না। যা দেখি সবই নিতে ইচ্ছে করে। সবাই দৌড়ে গিয়ে হুমড়ি খেয়ে পড়ছে। সাম্য ব্যস্ত ছবি ওঠানো নিয়ে, আমরা তাতে খুশি, একজন প্রতিদ্বন্দ্বী কমে গেলো। ও কিন্তু আমাদের এসব দেখে বিরক্ত হচ্ছে, সময় নিয়ে দুশ্চিন্তা হয়তো এটার কারণ। কিন্তু সে-দুশ্চিন্তা তো আমাদেরও ছিলো। হতে পারে ক্যামেরা হাতে থাকার কারণে ও ঝিনুক-প্রবাল কুড়াতে পারছে না বলে ওর ঈর্ষা হচ্ছিলো। আমাদের সবার হাতে ব্যাগ।

কাপড়-চোপড় সব কটেজে রেখে এসেছি, ব্যাগ ভরছে ঝিনুক-প্রবালে। ছেঁড়াদ্বীপ থেকে ফিরে পড়েছি বিপদে, ব্যাগ যে ভিজে যাবে, বালিতে একশা হয়ে যাবে, সেটা কারোরই মনে ছিলো না। আঁকাবাঁকা সৈকতের ধার দিয়ে অদূরেই ঝোপ, অধিকাংশই সম্ভবত কেয়া গাছ, আর আছে অজস্র নারকেল গাছ। মাঝে মধ্যে দু’একটা ঘর দেখা যায়। একটা বাড়িতে গিয়ে আমরা মাথাপিছু দুটো করে ডাব খেয়েছি। কিন্তু মাথা ছাড়াও শরীরের একটা হিসেব আছে, সে-হিসেবে শুভ একটা ডাব বেশি খেয়েছে। বিচিত্র সব ঝিনুক-প্রবালের সঙ্গে যুক্ত হলো বিশালাকৃতির সাপের মরদেহ, বড় বড় কংকাল (সম্ভবত সামুদ্রিক মাছের), সুবিশাল কচ্ছপের খোল। কিন্তু এসবের সঙ্গে যখন অতিপ্রাকৃতিক কিছু যোগ হয় তখন আমাদের আর যাত্রা বন্ধ না রেখে উপায় থাকে না। আমরা সবাই পাথরের উপর লাফিয়ে লাফিয়ে এগুচ্ছি সৈকত ধরে। হঠাৎ করেই চোখে পড়লো, কুল থেকে বিশ-পঁচিশ হাত দূরে পাথরের উপর বসে আছে একজন মহিলা। সমুদ্রের ঢেউ আছড়ে পড়ছে তাঁর গায়ে, অথচ কী অদ্ভুত! তিনি মোটেও টলছেন না। অবাক কাণ্ড! প্রথমে আমিই দেখলাম, সবাইকে দেখালাম। মাস্টার সাহেব সবার আগে পেছন দিকে পালাতে শুরু করলেন। আমরা খানিকটা পেছনে এসে খুব ভালো করে লক্ষ্য করলামÑ সবই ঠিক আছে সেই নারীদেহ, মাথা, গ্রীবা, উন্মুক্ত পিঠ, কোমর, নিতম্ব অবধি। বাকিটুকু পানিতে। কিন্তু সমুদ্রের এই উত্তাল ঢেউয়ে এভাবে বসে থাকা অসম্ভব। একেবারেই নড়ছে না দেখে আমরা কিছুটা কাছাকাছি যাবার চেষ্টা করলাম। মাতাল ঢেউ আমাদেরকে তেমন উৎসাহ দেয়নি। সাম্যর মাথায় এলো ক্যামেরার লেন্স দিয়ে পরখ করা যেতে পারে। শেষমেশ ধরা পড়লো, না এটা আসলে পাথরের মূর্তি। খেয়ালি প্রকৃতির কী বিস্ময়কর বাসনা! ছবি তুললাম বেশ কয়েকটা। ফের এগুতে থাকলাম , যেন আবিষ্কারের আনন্দে বিভোর। সৈকতের গলিপথ ধরে কখন যে চৌদ্দ-পনেরো কিলোমিটার হেঁটেছি জানি না। তিনটি বিচ্ছিন্ন দ্বীপ।

জোয়ারের সময় বিচ্ছিন্ন হয়ে যায় দ্বীপগুলো, ভাটার সময় হাঁটুপানি পার হয়ে পৌঁছানো যায়। মানুষের পক্ষে সম্ভাব্য শেষবিন্দুতে পৌঁছে ক্যামেরায় ক্লিক। ভাটাও তখন ভাটার দিকে, ফের জোয়ারের পালা শুরু হবে। অগত্যা তড়িঘড়ি ছেঁড়াদ্বীপ ছাড়লাম। এবার পুরোপুরিই অবসন্ন। একবার সিদ্ধান্ত হলো এক রাত না হয় থেকে যাই, শরীর আর পারছে না। বসে পড়লাম, সঙ্গে নিয়ে আসা রুটি-কলা-পানি দিয়ে রিচার্জ করলাম নিজেদের। বালিময় সৈকতে শুয়ে পড়লাম। হঠাৎই কনকের চোখে পড়লো দূরে একটা ট্রলার। অবসন্ন পা দু’খানি নিয়ে কোনোমতে দৌড়াতে থাকলাম সেদিকে। শার্ট খুলে উড়াতে লাগলাম। ট্রলারের যাত্রিরা নেমেছে, বেশ ভালো। আমরা দৌড়াতে দৌড়াতে কাছাকাছি গেলে আমাদেকে দেখতে পেলো ট্রলারের মাঝি-যাত্রীরা। আমাদেরকে সঙ্গে আনতে রাজি হলেন। আমাদের কাছ থেকে ভ্রমণবৃত্তান্ত শুনলেন ওঁরা। বিনিময়ে আমরা চড়ে বসলাম। একেবারে কুলে ভিড়তে পারে না ট্রলার, ট্রলারে উঠতে হলে নৌকাই ভরসা। ওখানকার ঢেউয়ের শক্তি অবিশ্বাস্য। যাহোক ছোট্ট নৌকায় চাপলাম চারজন। নৌকার পানি সরানো হয় মাথাকাটা ড্রামে করে। সাম্য পণ্ডিতি দেখানোর জন্য নিজে একটা ড্রাম নিয়ে পানি সরানোর দায়িত্ব নিলো। যথারীতি কিছুদূর যেতেই পানি ছুঁড়তে গিয়ে ড্রামসুদ্ধ সাগরে। অন্য একটা ড্রাম দিয়ে মাঝি পানি সরাচ্ছেন। পানি বেড়েই চলছে নৈৗকার ভেতর। মাঝিরা চিৎকার করে ট্রলার ডাকলো, আমরা মৃত্যুর কয়েক ইঞ্চি দূর থেকে ট্রলারে উঠতে পারলাম। সোজা সেন্টমার্টিন। আমাদের ভ্রমণের শুরুতেই সবার কাছ থেকে সমান অংকের টাকা নিয়ে একজনের কাছে রাখা হতো, তাঁর হাতেই থাকতো যাবতীয় খরচের ভার। সেন্টমার্টিনে এই দায়িত্ব আমার উপর ছিলো। সৈকতে টাকা নিয়ে যাওয়া বোকামি, তাই বুদ্ধি(!) করে কটেজের তোষকের নিচে টাকাগুলো রেখে গিয়েছিলাম। এদিকে আমাদের ওইদিনই আবার সেন্টমার্টিন ছাড়তে হবে, শেষ ট্রলারের সময় হয়ে গেছে (তখনো পর্যন্ত ট্রলারই ছিলো একমাত্র ভরসা)। তড়িঘড়ি ব্যাগ গুছিয়ে ট্রলার ধরলাম। ওইদিন সাগরের অবস্থা বেশ বেসামাল। আধঘন্টা পরই শুরু হলো সাগরের জিকির। অবস্থা এমনই দাঁড়ালো যে, আমাদের বেঁচে থাকবার কোনো সম্ভাবনাই নেই। সবাই আক্ষরিক অর্থে শেষ বিদায় নিলাম। মহিলারা নিজেদের বাচ্চাদের বুকে চেপে ধরে কাঁদতে শুরু করলেন, আর ঝগড়া শুরু করলেন কর্তাদের সঙ্গে। একজন বললেন, তোমাকে এতো করে বললাম এখন আসার দরকার নেই। উত্তরে কর্তা বললেন, আরে তুমিই তো পীড়াপীড়ি করছিলে! গিন্নী তখন বললেন, আমি বললেই তোমাকে আসতে হবে! নিজের কোনো বিবেচনা নাই? অগত্য চোখ বন্ধ করে বসে থাকলাম, বমিবমি ভাবও হচ্ছে। যাহোক এতোসবের মধ্যেও আমরা শেষমেশ টেকনাফ পৌঁছলাম, আবার কোলাকুলি, কান ধরলাম আর কখনো সেন্টমার্টিন আসবো না। ট্রলার ছেড়ে হাঁটতে শুরু করলাম, এখানেই হোটেলে থাকতে হবে, কারণ চট্টগ্রাম যাবার আর কোনো বাহন তখন নেই।

একটা হোটেলে উঠলাম, যথারীতি ডাবলরুমে চারজন। রাতে প্রথামোতাবেক হিসেবে বসলাম, কত খরচ হলো জানতে। আর তখনই টের পেলাম, আমার কাছে রাখা টাকাগুলো সেন্টমার্টিনেই ফেলে এসেছি। আমার পালস বন্ধ হয়ে গেলো, বাকিদেরও বোধহয়। তাড়াতাড়ি সামলে নেবার জন্য বললাম, ভয় নেই, কাল সকালে আমি ফের সেন্টমার্টিন গিয়ে নিয়ে আসবো। রাতে কনক বোধহয় বললো, একজন আমার সঙ্গে যাওয়া উচিত। কিন্তু কে সেই একজন? একটু ইতস্তত করে সাম্য বললো ও যাবে। কিন্তু শুভ আমার খাঁটি ভক্ত। সেও তখন বললো, না আমি যাবো। কনক সব সময়ই একটু ভীতু কিছিমের। কিন্তু এহেন মুহূর্তে সেও বললো, আমিও যাবো। আমি কিন্তু একাই যেতে চেয়েছিলাম। সকালে দেখি সিদ্ধান্ত পাল্টালো, সবাই যাচ্ছি, মৃত্যুকে নিশ্চিত জেনে। এবার কিন্তু আগে থেকেই আমাদের মৃত্যুর প্রস্তুতি ছিলো। সেটা বুঝতে পেরেই বোধহয় আমাদেরকে অবাক করার জন্যে সাগর ঠিক শান্ত-পুকুরের মতো আচরণ করলো। আমরা নিরাপদে প্রত্যাবর্তন করলাম। ওইদিনই কক্সবাজার হয়ে চট্টগ্রাম, সোজা রাজুর মেসে। গভীর রাত হয়ে গেলো। আরসি লেমনের সঙ্গে ডাবের পানি মিশিয়ে আমরা যে-পানীয় প্রস্তুত করেছিলাম সেটার কিছুটা ইচ্ছে করেই রেখে দেই। রাজুকে বললাম, ওয়াইন নিয়ে এসেছি। বেচারা এর আগে কখনো খায়নি। বেশ আয়োজন করে খেতে বসলো। এবং দুই চুমুক দিয়েই বললো, মালটা বেশ, ভালোই ধরেছে। বেচারা! পরদিন বান্দরবান গেলাম বাসে। উদ্দেশ্য চিম্বুক-রুমায় যাবো। বিকেলে আর যাত্রা করা সম্ভব না। পরের দিন চাদের গাড়িতে [পাহাড়ী পথে চড়ার জন্য বিশেষভাবে প্রস্তুতকৃত জিপ] যেতে হবে। একটা গাড়ি ঠিক করে ফেললাম। বিকেলটা স্থানীয় জায়গাটা ঘুরে দেখা হলো, আদিবাসীদের মার্কেট দেখলাম, লুঙ্গি কিনলাম সেলাই ছাড়া। সেই লুঙ্গি পরে তামাক টানবো এই আশায় তামাক এবং কলকি কিনলাম। খবরের কাগজে মোড়া তামাক বের করে কল্কিতে রাখলাম, আগুণ ধরাচ্ছি বারবার, সেটা কেবলই কয়লা হয়ে যাচ্ছে, ধোঁয়া আর হয় না। এরকমই চলছে, হঠাৎই দেখলাম যে-কাগজটা (সদ্যলুপ্ত আজকের কাগজ) দিয়ে তামাক মোড়ানো ছিলো সেটাতে তালিকা দেয়াÑ এ-বছর প্রদর্শিত নাটকসমূহ। খবরটি শিশুকিশোর নাট্য-উৎসব নিয়ে। ওইবার আমি নিজেও একটা নাটকের স্ক্রিপ্ট পাঠিয়েছিলাম বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্র, রংপুরের পক্ষ থেকে। আমাকে অবাক করে দিয়ে ওই খবরে বলছে, আমার স্ক্রিপটি মনোনীত হয়েছে, এবং মঞ্চস্থও হয়ে গেছে। মোবাইলের যুগ ছিলো না সেটা, আমি জানতেই পারিনি। নাটক নিয়ে দারুণ নাটকীয়তা হলো দেখছি! রামু-চিম্বুক ঘুরে ফের বান্দরবান হয়ে চট্টগ্রাম। এরপর রাঙামাটি। প্রকৃতি যে কতোটা প্রাকৃতিক তা রাঙামাটি না গেলে বোঝা যায় না। ভ্রমণের সর্বজনস্বীকৃত পদ্ধতি হচ্ছে ট্রলার ভাড়া করে চুক্তিতে ঘোরা। বিভিন্ন প্যাকেজ আছে, তিন/চার/পাঁচটি স্পট। আমরা সব কয়টি স্পটে যাবার সিদ্ধান্ত নেই। এর মধ্যে আছে সুবলং ঝরনা, বৌদ্ধমন্দির, পেদাতিংতিং, ডিসির বাংলো, আর ঝুলন্ত ব্রিজ। বৃষ্টিতে পিচ্ছিল হয়ে আছে সুবলং ঝরনায় চারধার। তবু ধীরে ধীরে উঠলাম, অনেকটাই। কিন্তু নামবার সময় টের পেলাম অভিকর্ষ বল কাকে বলে। পাহাড়ে ওঠা সত্যিই অনেক সহজ, অন্তত নামবার সঙ্গে তুলনা করলে। পাহাড় থেকে নিচে নামার পথ ভীষণ ভীষণ কঠিন। পাহাড়ের মতো ব্যক্তিত্ব থাকলে বোধহয় মানুষের ক্ষেত্রেও সেটা পুরোমাত্রায় প্রযোজ্য হবে।

ভ্রমণ: সুন্দরবন-কুয়াকাটা সূর্যোদয় ও সূর্যাস্তের গল্প
শাকুর মজিদ

এমণ ভট ভট করে ভদ্র লোক কখনো দরোজা ধাক্কায় না। হাতের কাছে মোবাইল নিয়ে দেখি ভোর মাত্র সাড়ে ছয়টা। এমনিতে প্রায় সারারাত আড্ডা পিটিয়ে শেষ রাতের দিকে জাহাজের চিকনা চাকনা কেবিনের এক বিছানায় শরীর এলিয়ে দিয়েছিলাম। অন্তত: ৫ ঘন্টা ঘুমালেও সকাল ৯ টায় আমাকে ডাকার কথা। কিন্তু দরোজার ওপাশে যে ভদ্রলোক দরোজা ধাবড়াচ্ছেন তার গলার আওয়াজ শুনে দরোজা না খুলে পারিনা। দরোজা যখন খুললাম তখন লাভলু ভাই। চোখ খুলতে পারি না। আস্তে আস্তে চোখের পাতা ফাঁক করার চেষ্টা করি। লাভলু ভাই আমাকে ধরে কেবিনের ওপাশের দিকে নিয়ে যান। “দ্যাখ দ্যাখ, দেখেছিস কখনো?” আমি ভাল করে তাকাতে পারি না। তারপরও দেখি। ডিমের কুসুম যেনো বিরাট এক পানির থালার উপর থেকে উঠে আসছে। দূরে কাউখালীর গ্রাম। ফেব্র“য়ারীর কুয়াশা। কুয়াশার ভেতরে এক ধরণের ধূয়াসার আবরণ। বাংলাদেশের অনেক সুন্দর প্রকৃতির দেখা আমার মিলেছে। পানির উপর ভাসতে ভাসতে চিকন চিরল গাছের ডগা দিয়ে সূর্য উঠার এমন দৃশ্য আমার দেখা হয়নি কখনো। চোখের ক্লান্তি গেলো সরে। কেবিনের খাটের তলায় আমার ক্যামেরা যুগল।

একবার ভাবলাম ওগুলো নিয়ে এসে এই দৃশ্য বন্দি করি। পরে মনে হলো,-না থাক, কিছু কিছু দৃশ্য থাকে যা একান্তই নিজের। সব কিছু সবাইকে দেখাতে নেই। তারচেয়ে বরং আমি নিজেই এর স্বাদ নেই। তেতলার ডেকে বসে বসে সূর্য উঠা দেখি। এরকম বসে থাকা আমার স্বভাবে নেই। চুপচাপ একটা চেয়ারে বসে থাকবো, ঘন্টার পর ঘন্টা কেটে যাবে, এটা আমার ধাতে নেই। কিন্তু কাল সন্ধ্যা থেকে দেখছি এ জিনিসটা আমি করতে পারছি এবং বেশ অবলীলায়। আমার বোর লাগছে না। তার কারণ চলচ্চিত্রের মতো, প্রতি মুহূর্তে আমার সামনের দৃশ্য বদল হচ্ছে। চলমান দৃশ্য আমাকে ক্লান্ত করেনা। কিন্তু একুশে ফেব্র“য়ারী তারিখের এই সকালটি আমার কাছে আজীবন অন্য কারণে স্মরণীয় হয়ে থাকবে। আগের রাতেই কানাঘুষা শুনেছি। আমাদের ৪ রজনীর এই নৌ বিহারের আয়োজক, ‘বেসটেক গ্র“প’ এর দুই প্রধান ব্যাক্তি স্থপতি তারিকুল ইসলাম লাভলু আর এনায়েত কবীর বারবার তাদের অফিস ষ্টাফের কাছে ফুল, ফুলের ডালি, শহীদ মিনার এসবের কথা বলছিলেন। তখন আকাশে কাচির ফলার মতো সিকিখানা চাঁদ। সপ্তর্ষী। ছায়াপথ। দূরে, বহু বহু দূরে টিম টিমে জ্বলে ওঠা বাতি। ওসব ছেড়ে ফুল পাতার দিকে ওতো মনোযোগীই বা হয় কে? কিন্তু মনোযোগ কেড়ে গেল তেতলার পেছনের ডেক-এ গিয়ে। বেসটেক গ্র“পের প্রায় ৮০জন কর্মী ও কর্মকর্তা, জাহাজের কর্মচারী, খালাসী, বাবুর্চি মিলে প্রায় শ’খানেক লোক। খালি পা, পাঞ্জাবী পরা। পাঞ্জাবীর বুক পকেটে কালো কাপড়ের স্ট্রীপ পিন দিয়ে আটকানো। প্রায় প্রত্যেকের হাতে ফুল। কেউ হাতে নিয়েছেন রজনী গন্ধার স্টিক, কেউ বা গোলাপের ডাল। এর মধ্যে মহড়ার অংশ হিসাবে শুরু হয়েছে গান। আমার ভাইয়ের রক্তে রাঙ্গানো একুশে ফেব্র“য়ারী- আমি কি ভুলিতে পারি। মিনিট দশেক পর শুরু হয় মিছিল।

ডান দিকের করিডোর দিয়ে শুরু করে বাম দিকের করিডোর মাতিয়ে যেখানে এসে তারা মিশলেন- সেখানে একটা জ্যান্ত শহীদ মিনার। কঠের ফ্রেমে লাল ও কালো কাপড় দিয়ে দু’টো উচ্চতায় দাঁড় করানো দু’টো ব ক। অনেকটা বুয়েটের শহীদ মিনারের একটা ছোট ভার্ষণ। দু’টোকে দাঁড় করানো হয়েছে একটা মোটা শোলা বোর্ডের প ্যাটফর্মের উপর। একুশে ফেব্র“য়ারীতে শহীদ মিনারে গান গাইতে গাইতে বাঙ্গালী ফুলের তোড়া এসে রাখবে, এটা খুব স্বাভাবিক একটা ঘটনা। দেশের এমন কোনো শহীদ মিনার পাওয়া হয়তো যেতোনা যেখানে এই প্রভাতে ফুলের প্রলেপ তার গাড়ে লাগে নি। কিন্তু এই যে, ঝালকাঠির কসাই নদীর উপর বয়ে চলা জাহাজ এম.ভি এমদাদা এর ডেকের উপর বানানো অস্থায়ী শহীদ মিনারে নদীর উপর প্রভাত ফেরীর কোন ঘটনা ঘটেছে কিনা আমি কোনো দিন শুনিনি। জাহাজ ছুটে চলে কসাই নদীর বুক চিরে মংলার দিকে। আর আমরা নদীর উপরে প্রভাত ফেরী করি। বিকেল আড়াইটায় জাহাজ পৌঁছে মংলা বন্দর। এখানে এক ঘন্টার বিরতী। বিরতী মূলত: মংলা শহর হেঁটে দেখা, জাহাজের বাবুর্চির জন্য বাজার সওদা আর পানি কেনার জন্য। মংলা থেকে দু’জন পাইলট উঠানো হলো জাহাজে। তাদের কাজ ছিলো সারেংকে দিক নির্দেশনা দিয়ে আমাদেরকে কটকা পর্যন্ত পৌছানে। মংলা থেকে জাহাজ ছাড়ার পর সুন্দরবন এলাকার প্রবেশমুখে জাহাজের অনুমতি নিতে হয়। সে বেশ ঝামেলার কাজ। জাহাজের ফী, পর্যটকের প্রবেশ ফী, এসব দিতে দিতে এবং অনুমতি নিতে নিতে প্রায় সন্ধ্যা হয়ে যায়। জাহাজ ছাড়লো বটে, কিন্তু অনেকটা পথ চলে আসার পর, হঠাৎ জাহাজটি থামিয়ে দেয়া হয়।

আমাদের বিশেষজ্ঞ পাইলট যুগল জানালেন যে, অন্ধকারে তারা ঠিক দিক নির্দেশনা দিতে পারবেন না। আমাদের মধ্যে কিছু বিশেষজ্ঞ পর্যটকও ছিলেন, যারা আগে একবার হয়তো এসেছেন এই পথে। তারা আশংকা করলেন, এভাবে মোহনার মাঝখানে জাহাজ আটকে থাকলে ডাকাতদের পক্ষে আমাদেরকে আক্রমন করা সহজ হয়। যদিও অস্ত্র সহ ছয় জন আনসার আছে আমাদের সঙ্গে। তাতেও ভরসা হচ্ছে না। পাইলট যুগলকে নেয়া হলো রিমান্ডে। জাহাজের ডেকে দাঁড় করিয়ে নানা রকম জিজ্ঞাসাবাদ। ‘পথে রাত হবে তুমি জানতে না?’ ‘যদি রাতে পথ চেনাতে না পারো তবে এসেছো কেন?’ ‘এ্যাকবারে চ্যাংদোলা করে পানিতে ফেলে দেবো”, এসব। কিছুক্ষন পর জাহার চলতে শুরু হলো। সারেং এর সাথে কথা ছিলো হিরণ পয়েন্টে এসে জাহাজ থামবে। ভোর হলে সেখান থেকে রওয়ানা হবো দুবলার চরের দিকে। দুবলার চরে আমরা এসে পৌছি বেলা প্রায় বারোটায়। আমাদের জাহাজ পুরোপুরি ভিড়ে না তীরে। হাঁটুপানি ডিঙ্গিয়ে তীরে উঠে পড়ি। বছরে ৭ মাস এই চরে মানুষ থাকে না। মানুষ থাকে ডিসেম্বর থেকে এপ্রিল, এই ৫ মাস। ৫ মাসের কাজের চূক্তি নিয়ে শুটকী-জীবিরা এখানে আসেন, থাকেন। মজার তথ্য হচ্ছে এই দ্বীপে কোন মহিলা নেই। নারীহীন দ্বীপ। থরে থরে সাজানো নানা রকমের গাছ। এদের মধ্যে আগ্রহ দেখলাম হাঙ্গরের শুটকী নিয়ে। আমাদের সহ পর্যটকেরা অস্থির হয়ে হাঙ্গরের শুটকীর ছবি তুলছেন। বেশ ক’জন সর্দার থাকেন এখানে। প্রত্যেক সর্দারের আওতায় ৪০-৫০ জন শ্রমিক। তাদের কেউ কেউ থাকে সমুদ্রে।

তারা শুধু মাছ ধরেন। কারো কারো কাজ ট্রলার নিয়ে এসে মাছ এখানে রাখা। বাকীরা মাছ শুকানোর কাজ করেন। সবচেয়ে বেশী বেতন পান ট্রলারের ক্যাপ্টেন। তার বেতন ৫ মাসে ৫০ হাজার টাকা। ৫ মাসের চূক্তিতে ১০-১২ হাজার টাকাও কাজ করেন কিছু জেলে। থাকা-খাওয়ার যোগান দেন সর্দার। দুবলার চরে ঘন্টা খানেক থাকার পর আমাদের জাহাজ ছুটে চলে কটকার দিকে। কটকা অভয়ারণ্য। এখানে একটা রেস্ট হাউজ আছে। রেস্ট হাউজের দুটো কামরা ভাড়া করা হলো। মূল কারন, দু’ কামরার দুটো বাথরুমের শাওয়ার ব্যবহার করা। দু’দিনে কারো গোসল করা হয়নি। এসিসট্যান্ট কনজারভেটর অব ফরেস্ট মহোদয় সেদিন কটকায় এসেছিলেন কি যেনো এক কাজে। আমার প্রতি যথেষ্ট সদয় হয়ে একজন কোস্ট কার্ড সঙ্গেঁ দিয়ে দিলেন। ওর নাম রাজু। বি.এ পাশ। ৩ মাস হলো চাকরী নিয়েছেন। জঙ্গঁল ওর খুব প্রিয়। ঢাকা থেকে টুরিস্ট এলে তাদের নিয়ে গহীন অরণ্যে ঢুকে যায়। আমাকে নিয়ে গেলো মাইল খানেক ভেতরে। এর মধ্যে হরিণকে ডেকে আনল। ওর ডাক শুনে এক পাল হরিণ চলে এলো কাছে। বলে, ‘দাঁড়ান ভাগ্য ভাল থাকলে আপনি বাঘও দেখে ফেলতে পারেন’। আমি বলি, ‘থাক ভাগ্য ভালো করতে চাইনা। তুমি কি ভাগ্য ভাল করেছ?’ রাজু বলে, ‘না। তবে বাঘের চিহ্ন দেখেছি। আমাদের কোয়ার্টারের পেছনে একটা মিঠা পানি পুকুর আছে। ওখানে ওরা মাঝে মাঝে পানি খেতে আসে। এই কটকায় ৫০টির মতো বাঘ আছে। এমনিতে বাঘেরা খুব ভাল। মানুষ জন ভয় না দেখালে ওরা আক্রমণ করে না। এখানকার সাপগুলোও খুব ভদ্র। আপনাকে দেখলে সমীহ করে চলে যাবে। সাপখোপ আমরা ভয় পাই না।’ রাজুর কথাবার্তা আমার সুবিধার মনে হলো না। আমি রাজুকে নিয়ে জঙ্গলের বাইরে চলে আসি। বলি সূর্য ডোবা দেখবো। কটকায় সুন্দরবনের তীর জুড়ে বালিয়াড়ি। চর জেগেছে উপকূল জুড়ে। কতগুলো গাছ পড়ে আছে। কোনোটার ডাল পালা নাই। কোনোটা উপড়ানো। কোনোটা বা কোন মতো মাটির সাথে তার জীবনের শেষ সংযোগ করে রেখেছে আধশোয়া হয়ে আছে। এগুলোর ফাঁক দিয়ে দেখা হয় সূর্যকে। ধীরে ধীরে সূর্যের তেজ কমে আসে। সকালের সূর্য উঠে তখন তার তেজ বাড়ে, আর বিকেলের সূর্য যখন ডোবে তারটা কমে। কমে কমে ¤ ান হতে হতে এক সময় অন্ধকারে মিশে যায়। কটকার জঙ্গঁলটা কালো হয় আসে। ওখানে বিদ্যুৎ নাই। রাতে জোনাকী জ্বলে। জঙ্গঁলের মধ্যে থাকা হয় না। আমরা রাতের অন্ধকার দেখার জন্য জাহাজের ডেকে আশ্রয় নেই। কাল আমরা কুয়াকাটা যাবো। কুয়াকাটার একটা যায়গা থেকে সূর্যোদয় আর সূর্যাস্ত দেখা যায়। আমরা কুয়াকাটার জন্য উদগ্রীব হয়ে যাই।