Archive for the ‘সুন্দর বন’ Category
সুন্দরবন, কিছু অনুভূতি, এবং একটি গল্পো
Posted in সুন্দর বন on সেপ্টেম্বর 13, 2008| Leave a Comment »
Posted in সুন্দর বন on সেপ্টেম্বর 13, 2008| Leave a Comment »
আচছা, লোকটা কি বাতিকগ্রস্ত নাকি? কেন ? কোন কিছু চিন্তা-ভাবনা না করেই এই যে উনি ঘোষনা দিলেন, আমাদের এই অভিযানে যদি আমরা গোলবনের হাঁস (গধংশবফ ঋরহভড়ড়ঃ) দেখতে পারি তাহলে আমাদের এই পুরো দলের বান্দরবন ভ্রমনের ব্যবস্থা করবে গাইড টুরস। আর যে অভিযাত্রী প্রথম ঐ পাখীটিকে দেখবে তার জন্য দুটো ভ্রমনই একদম ফ্রি। আরে না, উনি কি কোন চিন্তা-ভাবনা ছাড়া এই ঘোষনা দিয়েছেন নাকি গাধা ? আমার তো তাই মনে হচ্ছে। কারনটা তো আমি বুঝতে পারছিনা। একটু বুঝিয়ে বলতে পারবি ? তাহলে শোন, প্রকৃতি প্রেমিক হাসান মনসুর সাহেব বিলুপ্তপ্রায় ঐ গোলবনের হাঁস পাখীটাকে পৃথিবীর বুকে টিকে থাকা নিশ্চিত করতেই ঘোষনাটা দিয়েছেন। এই যেমন ধর ঘোষনার কারনেই কিন্তু আমরা এই জাহাজের প্রায় ৬৫ জন মানুষ পাখিটার বর্তমান অবন্থা স¤পর্কে জানতে পেরেছি। আমাদের মধ্যে খুব অল্প পরিমান হলেও পাখিটাকে পৃথিবীর বুকে তার প্রকৃত আবাসভুমিতে টিকিয়ে রাখার ইচ্ছা জন্মেছে।
এবং …….. কথোপকথোন চলছিল পৃথিবীর বৃহত্তম স্রোতজ বনভুমি সুন্দরবনের সুপতি খালের মধ্যদিয়ে চলমান জাহাজ ‘এম.ভি. অবসর‘ এর একটি কামরায়। আলোচনায় অংশগ্রহনকারীরা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাণিবিদ্যা বিভাগের চতুর্থ বর্ষের কয়েকজন ছাত্র-ছাত্রী। ওরা ছাড়াও জাহাজে আছে একই বর্ষের প্রায় ৬০ জন ছাত্র-ছাত্রী। সপ্তাহব্যাপী এক শিক্ষাসফরে তারা এখন সুন্দরবনের আনাচে কানাচে ঘুরছে। সাথে রয়েছে বিভাগের দলনেতা ছাড়াও বেশ কয়েকজন শিক্ষক-শিক্ষিকা এবং তাদের গাইড সুন্দরবন বাঘ গবেষক জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের এক তরুণ শিক্ষক। শিক্ষার্থীদের সর্বোত্তম সেবা প্রদানের লক্ষ্যে দলের সঙ্গে যোগ দিয়েছেন গাইড টুরস এর ব্যবস্থাপনা পরিচালক জনাব হাসান মনসুর সাহেবের সহধর্মিনী মিসেস তপতী মনসুর। যাত্রার দিন। পূর্বনির্ধারিত সময় বিকাল ৩ টার মধ্যে ছাত্র-ছাত্রীরা বিভাগের সামনে পৌঁছে গেছে। কি যেন এক ভীষণ অস্থিরতায় ছটফট করছে সবাই। স্বপ্নীল সেই বনভূমিতে কখন পৌঁছাবে, অজানা-অনাবিস্কৃত সেই জগতকে কিভাবে দেখবে, কিংবা প্রিয়জন বা প্রিয়স্থান ত্যাগের বেদনায় অবশ হয়ে যাচ্ছে অভিযাত্রীদের তনু-মন। সদরঘাটে অপেক্ষামান এম.ভি. অবসরে পৌঁছতে প্রায় পাঁচটা। জাহাজের আকৃতি, ডিজাইন এবং অন্যান্য সুবিধাদি দেখে সবাই একেবারে মুগ্ধ। এতটা আশা করেনি কেউই। যেন ছোট-খাটো একটা টাইটানিক! সন্ধ্যার ঘনায়মান অন্ধকার নেমে আসার আগেই অবসর, ভেঁপু বাজিয়ে যাত্রা শুরু করল আগামী সাত দিনের স্বপ্নময় অভিযাত্রায়। মাষ্টার ব্রীজ থেকে ইঞ্জিনরূমে পাঠানো টুং টাং শব্দে আপার ডেকে ভীড় করা অভিযাত্রীদের সবাই যেন স্বপনপাড়ের ডাক শুনতে পেল। সহসা তাদের মনে প্রশ্ন জাগল, স্বপ্নলোকের সোনার চাবি কি তারা খুঁজে পাবে? জবাব পেল ভেতর থেকে, ‘নিশ্চয় পাবে‘।
তীব্র এ বিশ্বাস বুকে নিয়ে মোহময় আবেশ জড়িয়ে অভিযাত্রীরা এগিয়ে চলল অজানার উদ্দেশ্যে। সেদিন রাতে আলোচনা হলো পরবর্তী দিনগুলোতে তাদেরকে কি কি করতে হবে এবং কোথায় কোথায় যেতে হবে ইত্যাদি। রাতের খাবার শেষে সবাই ভীড় করল জাহাজের ডেকে। অন্ধকারের বুক চিরে জাহাজের সার্চ লাইট তার পথ খুঁজে নিচ্ছে। দূরে চলমান বা নোঙ্গরকরা যানগুলোর স্তিমিত আলো, জাহাজের গায়ে পানির ছলাৎ ছলাৎ শব্দ, ইঞ্জিনের ধুক ধুক আওয়াজ, বি¯তৃত আকাশে হীরের টুকরোর মত দ্যুতিময় অসংখ্য তারা, মুক্ত বাতাস – এমনই এক মোহময় আবেশ সৃষ্টি করেছে যেন সেটাকে আর জাগতিক কোন বাহন মনে হয়না। এ যেন অনন্ত নক্ষত্র বীথির কোন একটাতে মহাজাগতিক, অপার্থিব কোন এক বাহন। নিয়ে যাবে কোন এক স্বপ্নলোকে। পরেরদিন। ভোরে সবার ঘুম ভাঙলো সূর্যোদয়ের অনেক আগে। জাহাজ চলছে মেঘনা নদী দিয়ে, সোজা দক্ষিণে। ঘুম ভাঙতেই জাহাজের উপরের ডেকে চলে এলো অনেকেই। দেখল বিশাল থালার মত সূর্য পূর্বাকাশে ক্ষণে ক্ষণে তার রূপ বদল করছে। কি দ্রুততায় জ্বলন্ত এই বস্তুটি একটি দিনের আগমন বার্তা জানাচ্ছে। শহরের অপরিকল্পিত এবং অসামসঞ্জস্যপূর্ণ বিল্ডিং আর চুরি হয়ে যাওয়া আকাশে তারা কখনোই এটা প্রত্যক্ষ করেনি বা হয়ত করতে পারেনি। বাকি সারাদিন কেটে গেল ডেকে বসে চারপাশের পরিবেশ আর সেসব বিষয় নিয়ে গল্প করতে করতে। দূরে, বহু দূরে যত, দূর দৃষ্টি যায়; অনন্তকাল যেন ক্লান্তিহীনভাবে সেদিকে তাকিয়ে থাকা যায়। এ যেন স্বর্গের অনুভূতি, কি অপূর্ব, কি অকৃত্রিম। অভিযাত্রীদের মনে কে যেন চুপি চুপি বলে: ভালোবাসি, ভালোবাসি, ভালোবাসি, প্রাণভরে ভালোবাসি টকটকে লাল সূর্য, নীল আকাশ, বসন্তের হাওয়া, ছোট ছোট ঢেউ খেলে যাওয়া এ নদী – তোমাদের সত্যিই খুব ভালোবাসি। সহসা তারা উপলব্ধি করল, এই প্রকৃতি কত প্রানবন্ত, কত বিশ্বস্ত, কত অকৃত্রিম। মানুষের স্বেচ্ছাচারী মনোভাব আর কার্যকলাপে বিপন্ন এই প্রকৃতির কথা ভেবে হাহাকার জাগে তাদের হৃদয়ে।
তারা কাতর মিনতি করে ‘আমাদের কাছ থেকে তোমরা কখনো হারিয়ে যেও না‘। প্রকৃতি যেন কথা বলে ওঠে ‘এই সুন্দর পৃথিবীকে আমরা পর করতে চাই না, কিন্তু তোমাদের অদূরদর্শী আর স্বেচ্ছাচারী কার্যকলাপে আজ আমার প্রাণ ওষ্ঠাগত। জেনে রেখো তোমরা না থাকলেও আমি ভালো থাকব। কিন্তু আমি ভালো না থাকলে তোমরা শান্তিতে থাকতে পারবে না‘। সন্ধা সাড়ে সাতটা। মাস্টার ব্রীজ থেকে ঘোষনা এল ‘জাহাজ সুন্দরবন নামের স্বপ্নময় জগতে প্রবেশ করছে‘। জাহাজ চলছে দক্ষিণ-পূর্ব দিকে। উদ্দেশ্য সুপতি ফরেস্ট অফিস। যেখান থেকে বনে ঢোকার অনুমতি নিতে হবে। রাতের প্রাত্যহিক আলোচনায় সুন্দরবনের পরিচয়, এর ইতিহাস, বাস্তুতন্ত্র, সংরক্ষণ প্রয়োজনীয়তা, ইত্যাদি বিষয়ে বিস্তারিত আলোচনা করলেন তরুণ গবেষক জাবির শিক্ষক, সুন্দরবন যার গবেষণার ক্ষেত্র। মন্ত্র-মুগ্ধের মত সবাই শুনল এবং মনে মনে মিলিয়ে দেখার চেষ্টা করল যা শুনছে এবং যা দেখছে তার মধ্যে সামঞ্জস্য কতটুকু। কি আশ্চর্য ? পুরোটাই মিলে যাচ্ছে। প্রকৃতি এবং প্রাণী নিয়ে গবেষণার সার্থকতা খুজে পেল তারা। রাতের খাওয়া ও আলোচনা শেষে অভিযাত্রীরা আবার চলে গেল জাহাজের খোলা ডেকে। এক অপার্থিব সৌন্দর্যে বুঁদ হয়ে রইল সবাই। ডেকে চিৎ হয়ে শুয়ে আকাশের দিকে তাকিয়ে পলকহীন চোখে চেয়ে রইল কেউ কেউ। জাহাজ চলেছে নদীর বুক চিরে, পানিতে ফেনা তুলে। চারিদিকে দিগন্ত বিস্তৃত মেঘমুক্ত আকাশ। কৃঞ্চপক্ষ রাতের মোহনীয় সৌন্দর্য আপ ুত সবাই। সপ্তর্ষী, কালপুরূষ, ক্যাসিওপিয়া, স্করপিয়ন সহ অসংখ্য নক্ষত্রপুঞ্জের সমন্বয়ে গড়ে ওঠা আকাশ যেন অসংখ্য বিরহীর অশ্রƒজলে সাজানো। শীতের হিমেল হাওয়া আর আকাশের বিশাল বি¯তৃতির পটভুমিতে মাঝে মাঝেই কেঁপে কেঁপে ওঠে অভিযাত্রীদের চঞ্চল তনু-মন। সে এক অসীম অব্যক্ত ভালোলাগা। রাত সাড়ে দশটা। সুপতি ফরেষ্ট অফিস। বনে ঢোকার অনুমতি নিতে দলনেতা এবং জাবির শিক্ষক যাচ্ছিলেন ফরেস্ট অফিসে। উপস্থিত অভিযাত্রীদেরকে জানতে চাওয়া হল, ‘কে কে যাবে‘? অমনি যে যে অবস্থায় ছিল লাফ দিলো ¯িপড বোটে। ছাত্র-ছাত্রীদের কেউ এর আগে কখনো সুন্দরবনে আসেনি, অথচ কারো কোন ভয় বা সংকোচ নেই। হয়ত এরা বিপদের তীব্রতাটাই আঁচ করতে পারেনি অথবা এরাইতো কলম্বাস, স্যাপিলাল, কুক, লিভিং ষ্টোন, ইবনে বতুতা, পার্কো পোলোর উত্তরসুরী। এদের মত মানুষেরাই তো হাতের মুঠোয় মৃত্যু নিয়ে পৃথিবীকে, পৃথিবীর মানুষকে দিয়েছে অসামান্য জ্ঞান কিন্তু নিজেরা হয়েছেন নিঃশেষ। আর তাইতো এদের মতো মানুষের দৃপ্ত পদক্ষেপের কথা ভেবেই কবিগুরু লিখেছেন : আমরা যাব যেখানে কোনো যায় নি নেয়ে সাহস করি। ডুবি যদি তো ডুবি-না কেন। ডুবুক সবি, ডুবুক তরী। প্রথমে ¯িপড বোট, পরে কাঠের নৌকা দিয়ে তারা ফরেস্ট অফিসের জেটিতে পৌঁছল।
প্রথমে অফিসে না গিয়ে, হঠাৎ কি যেন ভেবে গহীন অন্ধকারে রাওনা দিল সবাই। টর্চের অর্পযাপ্ত আলোয় সবার আগে জাবির শিক্ষক, একদম পেছনে একজন ফরেস্ট গার্ড এবং মাঝখানে দলনেতা এবং অন্যান্য অভিযাত্রী। অসাধারণ রোমাঞ্চকর এবং ভয়ঙ্কর অভিযান। ফরেষ্ট গার্ডদের ভাষ্যমতে দুই/তিন দিন আগেও বাঘ এসেছিল এখানে। যে কোন মুহুর্তে পৃথিবীর সবচেয়ে বিষাক্ত রাজগোখরা সাপসহ যে কোন সাপের সাথে দেখা হতে পারে। সামনে পড়তে পারে পৃথিবীর বিখ্যাত শিকারী প্রাণি ’বাংলার বাঘ’। নিকষ কালো বনের মধ্যদিয়ে এগিয়ে যাচ্ছে আট-দশ জনের একটি দল। সুন্দরী ও অন্যান্য স্রোতজ বৃক্ষের শ্বাসমুলের ফাকে পা বাঁচিয়ে নিঃশব্দে হাটা একেবারে সহজ কাজ নয়। অল্পদুর যেতেই হঠাৎ দেখা গেল বাঘের একেবারে টাটকা পায়ের ছাপ। মাত্র কয়েক ঘন্টা আগেই এখানে এসেছিলো আমাদের সবার আকাংখিত ‘বাঘ মামা‘। টর্চ বাহকরা এদিক ওদিক আলো ফেলছে নিজেদের নিরাপত্তার কথা ভেবে। কিন্তু এ বনে মামাকে দেখা কি এতই সহজ যে ’এলাম, দেখলাম এবং চলে গেলাম’। সুন্দরবনে কাজ করে এমন অনেক মানুষ আছেন যারা ২০/২৫ বছর জঙ্গলে থেকেও কখনো মামার মুখোমুখি হননি। দেড়-দুই ঘন্টা পর শেষ হলো নিশি অভিযান। জাহাজে ফিরলো সবাই। এরই মধ্যে অভিযানের কথা রাষ্ট্র হয়ে গেছে। দলের যারা এই নিশি অভিযানে যাওয়ার সুযোগ পায়নি তারা আগে থেকে সিদ্ধান্ত নিয়ে রেখেছে ‘বয়কট করো ওদেরকে‘। মান ভাঙ্গালেন দলনেতা, অনেক কষ্টে। পরবর্তী দিন। অভিযাত্রীদের জন্য অপেক্ষা করছে অভুতপূর্ব সব অভিজ্ঞতা। ঘুম ভেঙে কেবিন ছেড়ে বের হতেই দুই পাশের চোখ জুড়ানো, মন ভুলানো অপূর্ব সবুজ বন-বনানী। ভোর পাঁচটা। রাতের অন্ধকার তখনো কাটেনি। আকাশের দিগন্তরেখা লাল হতে শুরূ করেছে মাত্র। জঙ্গলে তখনো গভীর ঘুম। রাতের অন্ধকার ও হালকা কুয়াশার চাদরে আবৃত সবুজ। মুগ্ধ নয়নে অভিযাত্রীরা তাকিয়ে আছে মায়া মাখানো প্রকৃতির দিকে। মনে মনে ভাবছে নাগরিক জীবনের যান্ত্রিক ব্যস্ততায় আর কখনো হয়ত এমন সকাল তাদের জীবনে আসবে না। কিছুক্ষণের মধ্যেই সবুজের ফাঁকে ফাঁকে সোনালী আলোর ছটা সূর্যোদয়ের বার্তা জানালো। জাহাজের ডেকে দাঁড়ানো মানুষগুলো দু‘চোখে শিশুর সরলতা ও বিস্ময় নিয়ে অবলোকন করছে নব প্রভাতের রাঙা আলো। নদীর সোনালী পানি কেটে, দু‘পাশের নিচ্ছিদ্র সবুজ চিরে এম.ভি. অবসর চলেছে সোজা দক্ষিণে।
এ যেন পাহাড়ী খরস্রোতা নদীর ব্যগ্র হয়ে সাগরের সাথে মিলিত হবার আনন্দে সামনের দিকে ছুটে চলা। এই চলা যেন শুধুমাত্র যাত্রীদেরকে জীবনের শ্রেষ্ঠ অভিজ্ঞতাকে আবিস্কার করার। ভোর ছয়টা। জাহাজ এগিয়ে চলেছে সুন্দরবনের অন্যতম আকর্ষন ‘কটকা‘ জেটির উদ্দেশ্যে। অপেক্ষার প্রহর গুনছে সবাই। কখন নামতে পারবে তাদের সেই অতি প্রিয়, অতি প্রতিক্ষিত জঙ্গলে। ছোট চিকন কটকা খাল। জাহাজ চলছে মন্থর গতিতে। অলস সময়। হটাৎ একটি কালো রঙের অতি সাধারণ পাখি তাদের জাহাজের খুব সামনে দিয়ে উড়ে গেল। পাখিটা কিছুদুর উড়ে গিয়ে খালের ওপারে তীরের খুব কাছাকাছি পানিতে বসল। কেউ কেউ বাইনোকুলার দিয়ে চেনার চেষ্টা করল। পারল না। পরে দলনেতা এবং শিক্ষকদের মাধ্যমে জানা গেল পাখিটির নাম গোলবনের হাঁস, যেটাকে তারা হন্যে হয়ে খুজছে। অমনি শুরু হলো চিৎকার চেঁচামেচি। তাদেরকে শান্ত করলেন তপতী মনসুর। প্রতিশ্র“ত হল বান্দরবন ভ্রমণ। কটকা জেটি। নিঃশব্দে জঙ্গলে নামলো সবাই। এ এক অবর্ণনীয় রোমাঞ্চকর অনুভূতি, জঙ্গলে এত কাছ থেকে প্রকৃতি, বন্য জীবন এবং পশু-পাখি দেখা। পৃথিবীর সবচেয়ে সুন্দর হরিণগুলোর একটা, চিত্রা হরিণ, এই বনের স্থায়ী বাসিন্দা। এই মায়াবতী হরিণের দুষ্টু ও চতুর চাহুনি সবাইকে এই স্রোতজ বনের প্রেমের বাঁধনে আকড়ে ফেলল। সহসা তাদের মনে হল ‘এখান থেকে তারা আর কখনো নগরে ফিরে যাবেনা, কক্ষনো না‘। হরেক রকমের পরিযায়ী এবং স্থানীয় পাখির মনোরম সৌন্দর্য তাদেরকে পাগল করে তুলল। বিশেষজ্ঞদের কাছ থেকে তারা সেগুলোর নাম জেনে নোট বুকে লিখে নিল। ঘন্টা তিনেকের অভিযান শেষে জাহাজে ফিরল সবাই। সকালের নাস্তা ও সামান্য বিশ্রাম নিয়ে আবার বের হল সবাই। গন্তব্য কটকার সমুদ্রপাশের বনাঞ্চল। এখানে তারা এ এলাকার প্রকৃতি পর্যবেক্ষণ এবং কিছু নমুনা সংগ্রহ করবে। ঘন গরাণ আর সুন্দরীর জঙ্গল। গাছের ভিড়ে জঙ্গলের মাটির সাথে সূর্যের সখ্যতা খুবই কম। প্রায় এক থেকে দেড় ফুট লম্বা শ্বাসমুলের ভেতর দিয়ে সতর্কতার সঙ্গে নিঃশব্দে হাটতে হয়। ছন্দপতন হলেই ঝপ্পাস। নতুন হলেও অভিযাত্রীদের বেশীর ভাগ সদস্যই বেশ সাচ্ছন্দে, দ্রুতই এগিয়ে যাচ্ছে। যারা এখানে পুরানো, তাদের হাতে লম্বা লাঠি। এই লাঠি শ্বাসমুলের ভেতর দিয়ে হাটতে খুবই সাহায্য করে। যাই হোক, কটকার জঙ্গলে বাহারী প্রজাপতি অভিযাত্রীদের আনন্দ দেবার জন্যই কখনো তাদের খুব নিকটে এসে আবার দ্রুত দূরে সরে যায়। যেন ছোটদের কানামাছি খেলা। সে এক অপূর্ব পরিবেশ, অকল্পনীয় দৃশ্য। দৃশ্যটা আরো অবর্ণনীয় হয়ে ওঠে যখন জংলী পথ চলতে চলতে হঠাৎ আবিস্কার করল তাদের সামনে বিশাল সমুদ্র – শুধু সমুদ্র নয়, এটাই তো আমাদের বঙ্গোপসাগর। আসলে অভিযাত্রীরা কখনো কল্পনাও করেনি তারা হঠাৎ এতটা সামনে বঙ্গোপসাগরকে দেখবে। আর তাই খুশীর মাত্রাটা ছিল আরো একটু বেশী। হাটতে হাটতে আকস্মিক একটা শব্দ শুনে দুজন অভিযাত্রী দাড়িয়ে সেটা বোঝার চেষ্টা করল। কিছুক্ষন থেমে থেমে আসছে শব্দটা। যদিও তারা কখনো জঙ্গলে বাঘের ডাক শোনেনি, কিন্তু তারপরও এ ডাক তাদের ভুল হবার নয়। হ্যাঁ, এটা মামার ডাক, একটু থেমে থেমে আসছে, এবং তারা যেদিক থেকে এসেছে সেদিক থেকেই। বেশ কিছুক্ষন শোনার পর তারা যখন আবিস্কার করল শব্দটা আস্তে আস্তে তাদের দিকেই আসছে তখন তাদের তো জ্ঞান হারাবার জোগাড়।
ঠিক তখনই উৎঘাটিত হল সত্যিটা, বাঘরূপী প্রাণীটা হল তাদের দলের অন্য আর একজন সদস্য। দলের সদস্যদের সাহসের মাত্রাটা পরীক্ষা করার জন্য এই পরিকল্পনা। এভাবে পুরো একটা দিন তারা বনের সৌন্দর্য এবং বিভিন্ন ধরনের জীব বৈজ্ঞানিক বিষয় বুঝতেই কেটে গেল। দুপুরে খাবার পর্ব শেষ। আবার রওনা হল অভিযাত্রীরা। উদ্দেশ্য সমুদ্র সৈকত। কটকা সৈকতে এসে কেউ কেউ এত খুশী ও উদ্বেলিত হল যে কোনভাবেই তাদেরকে সমুদ্রে নামা থেকে বিরত রাখা গেল না। ছাত্র-ছাত্রীদের স্বাধীনতা থাকায় যারা সমুদ্রে নামতে আগ্রহী না তারা দু‘ভাগে ভাগ হয়ে একভাগ গেল জাবি শিক্ষকের সঙ্গে আমডাহুর গাছের ফল ও ফুলের ছবি তুলতে, অন্য দল থাকল দলের বয়োজষ্ঠ সদস্য এবং তাদের শিক্ষকদের সঙ্গে। তারা কটকা সৈকতে তাদের সুন্দর স্মৃতির সবচেয়ে উপভোগ্য সূর্যাস্তটা কাটাল। মনে মনে ভাবল জীবনে প্রতিটি সূর্যাস্ত যদি এমন হতো। ইস! তাহলে না কত মজাই হত। এমন সুন্দর স্মৃতি নিয়ে সন্ধার পর অভিযাত্রীদের পুরো দলটা জাহাজে ফিরল। রাতে খাবার পর ছাত্র-ছাত্রীরা নিজেদের উদ্যোগে এক ঘন্টার একটি সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান উপহার দিল। স্বল্প সময়ের প্রস্তুুতিতে এত সুন্দর উপভোগ্য অনুষ্ঠান যা দেখে মুগ্ধ না হয়ে পারা যায় না। রাত সাড়ে দশটার দিকে জাবি শিক্ষকের নেতৃত্ব লাইন ধরে টর্চ লাইট হাতে অভিযাত্রীরা রওনা দিল কটকা রেস্ট হাউজের সামনে হরিণ দেখতে। দলের নেতা সবার সামনে গিয়ে উজ্জল টর্চের আলো ফেলল রেস্ট হাউজের সামনে পাতা খেতে আসা হরিণ গুলোর উপর। আহা ! আকাশের মিটিমিটি তারা যেন মাটিতে নেমে এসেছে। মায়াময় আর রহস্যে ঘেরা জঙ্গল আরো বেশী রহস্যময় হয় যখন চোখের সামনে সেই তারার মেলা দ্রুত গতিতে জঙ্গলের ভেতর একে একে হারিয়ে যায়। যেন বুঁদ হয়ে সৌন্দর্য গিলছে সবাই। সে এক অবর্ণনীয় অনুভূতি। এ দৃশ্য উপভোগ করা যায়, বর্ণনা করলে কার্পণ্য হয়। অভিযান শেষে যখন পুরো দল জাহাজে ফিরল তখন ঘড়ির কাটায় মধ্য রাত পার হয়ে গেছে। পরদিন সকাল। জাহাজ চলছে ‘মান্দারবাড়ী‘। যাওয়ার পথে আবার আলোচনা। বিষয় সুন্দরবনের বাঘ ও তার জীবনবৃত্তান্ত। আলোচক জাবির শিক্ষক। চলল দুপুর পর্যন্ত। দুপুর একটা। খোলা লাউঞ্জে দুপুরের খাওয়া চলছে। হঠাৎ যেন কিসের শক্ত একটা ধাক্কা খেয়ে থেমে গেল ‘অবসর‘। জায়গাটা নীল কমলের খুব কাছে হবে। সাধ্যমত চেষ্টার পর অবসরের নাবিক জাহিদ সাহেব জানালেন, ‘আমরা চরে আটকা পড়েছি। পরবর্তী জোয়ার না আসা পর্যন্ত এখানেই থাকতে হবে‘। পাক্কা ছয় ঘন্টা। নিঃসন্দেহে দুঃখজনক খবর। কিন্তু অধিকাংশ সদস্যই এই ঘটনাকে আশীর্বাদ হিসাবে নিল। চারিদিকে অনন্ত সমুদ্র অভিযাত্রীদেরকে এমনই মোহাবিষ্ট করেছিল যে ভবিষ্যতে কি হবে না হবে সে কথা তাদেরকে ভাবিত করেনি। বরং অতি মনোরম প্রাকৃতিক পরিবেশ, ফুরফুরে হওয়া, ঢেউয়ের শব্দ, পাখির কলতান, দূরের আবছা-আবছা বনের প্রান্ত তাদেরকে এতটাই আনন্দিত করেছিল যে সেখানেই তারা তাদের বাকি জীবনটা কাটিয়ে দিতে রাজি। জাহাজ চরে আটকা পড়ায় পূর্বনির্ধারিত পরিকল্পনার কিছুটা পরিবর্তন করতে হলো। কাছেই সমুদ্র সৈকত। সিদ্ধান্ত হলো বিকালটা সেখানেই কাটানো হবে। বিকালে সৈকত অভিযান। বিস্মিত সবাই। মন্তব্য করল ‘এমন সুন্দর সৈকত এর আগে কখনো দেখিনি‘। এখানকার দিগন্ত বিস্তৃত সাগর, তার কোলে অভিযাত্রীদের স্বাগত জানালো ঝিরঝির বাতাস আর ছোট ছোট ঢেউ দিয়ে। পিছনে সুন্দরবন, সামনে মুক্ত অসীম আকাশের ছায়া বুকে নিয়ে বঙ্গোপসাগর। অভিযাত্রীরা সম্মোহিত। তাদের নিষ্পাপ আচরণ, উদ্বেলিত হৃদয়, যেন সাগরকেও ¯পর্শ করেছিল। তাইতো সে মাথায় ফেনার ফুল তুলে, প্রবল কলেবরে ঢেউ হয়ে তাদের পায়ের কাছে লুটিয়ে পড়ছিল। কখনোবা তাদের গায়ে নিজেকে আছড়িয়ে ফেলছিল। এ যেন অবনত ভঙ্গিতে কোন এক দেবতার কাছে তাঁর ভক্তবৃন্দের শ্রদ্ধার্ঘ্য। সৈকতের অভিযান শেষে ফুরফুরে মেজাজে জাহাজে ফিরতে ফিরতে সন্ধ্যা পার হয়ে গেছে। রাতে খাবার দেওয়া হয়েছে লাউঞ্জে। বেশীরভাগ সদস্য খওয়া-দাওয়া শুরু করেছে। হঠাৎ কয়েকজন ছাত্রীর চিৎকারে সচকিত হয়ে উঠল সবাই। অনেকে চিৎকারের উৎসস্থলের সন্ধান করতে ব্যস্ত। একজন ছাত্রী বিশাল একটা প্রজাপতির মতো প্রাণীকে দুই হাতের মাঝের ফাঁকে নিয়ে দৌড় দিচ্ছে জাহাজের নিচতলায় স্থাপিত সাময়িক লাইব্রেরী কক্ষে। উদ্দেশ্য বই-এর ছবির সঙ্গে মিলিয়ে মথটিকে সনাক্ত করা। অনেকক্ষণ ঘাটাঘাটির পর সনাক্ত করা সম্ভব হল। হ্যা, এটি পৃথিবীর বৃহত্তম মথগুলোর একটি, যার নাম ’এটলাস মথ’। সনাক্ত করার পর এটিকে ল্যাবরটরিতে জমা দেবার উদ্দেশ্যে ক্লোরোফর্ম দিয়ে অচেতন করে সংরক্ষণের ব্যবস্থা করা হলো। এর আগেই জাবির শিক্ষক তাঁর ক্যামেরাতে বন্দী করে রাখলেন মথটির বাহ্যিক গঠন ও আকৃতি। এভাবে হাসি আনন্দ আর কৌতুহলে কেটে গেল আরও একটা দিন। পরবর্তী দিন। সূর্য উঠার আগেই জাহাজ পৌছে গেল সুন্দরবনের সবচেয়ে দক্ষিন-পশ্চিমের দ্বীপ ‘মান্দারবাড়ি‘।
অভিজ্ঞদের মতে, জগত বিখ্যাত এই স্রোতজ বনের সবচেয়ে সুন্দর এবং মোহনীয় জায়গা এটি। এখানকার বিশেষত্ব হলো জায়গাটা একদম বন্য, আদি, অকৃত্রিম। জনমানুষের চিহ্ন লাগেনি। বছরের বেশীরভাগ সময় থাকে মানুষ যাতায়াতের অনুপযোগী। শীতকালে যখন নদী খুব শান্ত থাকে তখনই শুধু বেশ কিছু বড় নদী পার হয়ে মান্দারবাড়ী পৌঁছনো সম্ভব। সেখানে পৌঁছামাত্রই সবাই জাহাজ থেকে নেমে সুশৃংখলভাবে সৈকত ধরে হাটা শুরু করল। এখানে বাঘের সংখ্যা মোটামুটি ভালো, কদাচিৎ মানুষখেকোর সন্ধানও পাওয়া যায়। আর তাই এখানে অতিরিক্ত সাবধানতার কথা আগে থেকেই অভিযাত্রীদেরকে জানানো হয়েছিল। সৈকত ধরে হাটতে থাকার সময় অভিযাত্রীরা মেছো বাঘ এবং আরো কিছু ছোট বিড়াল গোত্রীয় প্রাণীর পায়ের ছাপ দেখল। হাটতে হাটতে একসময় সৈকত ছেড়ে অভিযাত্রীরা ঢুকে পড়ল জঙ্গলে। ঘন জঙ্গলে অসংখ্য শ্বাসমুলের মাঝে নিঃশব্দে পা ফেলে এলাকার একমাত্র মিঠা পানির পুকুরের দিকে এগিয়ে চলল সবাই। উদ্দেশ্য ‘যদি মামার দেখা পায়‘। চারপাশে অনেক বড় আর ঘন হুদো বন। দেখলেই সন্দেহ হয়, হয়ত ওখানেই লুকিয়ে আছে মামা। এই হুদো বনগুলো দেখতে এমন যে মামা যদি এর আড়ালে লুকিয়ে থাকে তবে কয়েকফুট দূর থেকেও তাঁকে খুঁজে পাওয়া যাবে না। আর সে কারণেই বাঘ এই হুদো বনের আড়াল থেকে শিকার ধরতেই সবচেয়ে বেশি পছন্দ করে। যে কোন মুহুর্তে অভিযাত্রীদের দল বাঘের শিকার হতে পারে – এমন আশংকা একেবারে উড়িয়ে দেওয়া যায় না। যদিও অস্ত্রধারী ফরেস্ট গার্ড সারাক্ষণই তাদের নিরাপত্তায় ব্যাস্ত। আর তাই, সবাই ভীরু পায়ে, চারপাশে সর্তকদৃষ্টি রেখে এগিয়ে চলছে। একসময় নিরাপদে পুকুর পাড়ে পৌছে গেল সবাই। পুকুর পাড়ে মামার দেখা না মিললেও অসংখ্য নতুন-পুরনো পায়ের ছাপ দেখা গেল। সময় হলো জাহাজে ফেরার। ঘন ঝানা গাছ এবং তার উর্দ্ধমুখী শেকড়ের মধ্যদিয়ে আলো-আঁধারি ঘেরা জঙ্গলে প্রতি মুহুর্তে বাঘের আক্রমনের আশংকায় প্রান হাতের মুঠোয় নিয়ে অভিযাত্রীরা ফেরার পথে এগিয়ে চলছে। জানিনা কখন শেষ হবে এই প্রানান্ত যাত্রা। কিছু বুঝে উঠার আগেই হটাৎ সবাই জঙ্গল থেকে সমুদ্র সৈকতে পৌছল। সবাই জানে সৈকত বিপদমুক্ত এলাকা। সুতারং এখন হাটায় সর্তকতা কম। অভিযাত্রীদের একজন সৈকতে একটি মরা সামুদ্রিক কচ্ছপ আবিস্কার করল। জানা গেল ওটা একটা সামুদ্রিক কাছিম। নাম জলপাইরঙ্গী কাছিম (ঙষরাব জরফষবু ঞঁৎঃষব)। জাবির শিক্ষক জানালেন সমুদ্রে মাছ ধরার জালে ঞঊউ (ঞঁৎঃষব ঊীপষঁফবৎ উবারপব) ব্যবহার না করায় প্রতিবছর এভাবে অসংখ্য সামুদ্রিক কাছিম মারা যাচ্ছে আমাদের সমুদ্রসীমায়। তিনি আরো জানালেন খুব শীঘ্রই ব্যবস্থা না নিলে আমাদের সমুদ্রসীমানায় সামুদ্রিক কাছিম আশংকাজনক হারে কমে যাবে। মান্দারবাড়ীর অভিযান শেষে জাহাজে ফেরা মাত্রই জাহাজ রওনা দিল হিরন পয়েন্টের উদ্দেশ্যে। নামার আগেই কারো কারো মন্তব্য ‘এখানে না এসেই জায়গাটার নাম এত শুনেছি যে এখানে না এলে সুন্দরবন অভিযান পরিপূর্ণ হতনা‘। অল্প সময়ের মধ্যেই জাহাজ হিরন পয়েন্ট পৌছে গেল। কৌতুহলী দল দ্রƒত সেখানে নামল বিস্ময়কর কিছু দেখার আশায়। এমন নামকরা জায়গায় নিশ্চয় কত রোমাঞ্চকর অভিজ্ঞতা অপেক্ষা করছে তাদের জন্য। বিপুল উৎসাহ-উদ্দীপনা নিয়ে তারা তন্ন তন্ন করে ঘুরলো হিরন পয়েন্টের প্রতিটি প্রান্ত। শেষমেশ তারা সুন্দরবনকে ‘বিশ্ব ঐতিহ্য এলাকা‘ হিসাবে ঘোষনার ফলক এবং তাতে মুদ্রিত লেখা পড়ে ব্যর্থ মনে জাহাজে ফিরে এলো। দ্রুত জাহাজে উঠে অভিযাত্রীদের স্থান ত্যাগের তাড়নাই বোঝা গেল জায়গাটার উপর তারা খুব একটা সন্তুষ্ট নয়। হিরন পয়েন্ট থেকে জাহাজ এবার চলছে উত্তর-পশ্চিম বরাবর। এদিকে দুপুরের খাওয়া শেষ করে অভিযাত্রীরা জাহাজের উপরের ডেকে উচ্চ কন্ঠে গানের জমজমাট আসর বসিয়েছে। তাদের আলোচনায় বোঝা গেল পরবর্তী গন্তব্য ‘দুবলার চর‘ নিয়ে তারা বেশ আশাবাদী। গান শেষ হতে না হতেই জাহাজ পৌছে গেল নির্দিষ্ট গন্তব্যে। দুবলার জেটিতে জাহাজ ভেড়ানোর সঙ্গে সঙ্গে নেমে পড়ল সবাই। তাদেরকে আগে থেকেই এখানকার শুটকি মাছের দুর্গন্ধ স¤পর্কে একটা ধারনা দেওয়া হয়েছিল। আর তাই কাউকে কাউকে দেখা গেল রুমাল বা খন্ড কাপড় দিয়ে তৈরী বিশেষ ধরনের মাস্ক ব্যবহার করতে। জেলে পল ীতে গিয়ে অভিযাত্রীরা কিছুটা বিস্মিত হলো। শুটকির প্রাচুর্যতা খুবই কম যদিও দেশে প্রস্তুতকৃত শুটকির একটা বড় অংশই আসে দুবলা থেকে। চরের জেলে-মহাজনদের সাথে আলোচনায় বোঝা গেল এ মৌসুমের অধিকাংশ শুটকি আগেই বাজারজাত করা হয়ে গেছে।
অভিযাত্রীদের মাঝে যারা মাৎস্যবিদ্যায় আগ্রহী তাদেরকে দেখা গেল জেলেদের সঙ্গে কথা বলতে। তাদের জীবনযাত্রা, পারিবারিক ও প্রাত্যহিক জীবন, শুটকি তৈরীর প্রক্রিয়া, বাজারজাতকরণ, ইত্যাদি বিষয় ছিল ক্ষুদে জ্ঞান পিপাসুদের জানার বিষয়বস্তু। শুটকির পরিমান কম থাকলেও তাদের শিক্ষকদের ইচ্ছায় এবং জেলেদের আন্তরিকতায় দলের সদস্যরা প্রায় ২০/২৫ রকমের শুটকির নমুনা সংগ্রহ করতে পারলো। প্রায় দু‘ঘন্টার অভিযান শেষে ফেরার পথে তারা জবা জাতীয় গাছ দেখতে পেল। গাছটিতে একই ডালে দু‘রঙের ফুল দেখে বিস্মিত সবাই। জানা গেল এটি বাগানে চাষ করা জবা ফুলের বন্য প্রজাতি। এলাকার লোকেরা একে বোলা বা ভোলা নামে ডাকে। অভিযান শেষে জাহাজ রওনা দিতে দিতে সূর্য পশ্চিম আকাশে ঢলে পড়েছে। পরিকল্পনা অনুযায়ী সন্ধ্যা এবং পরবর্তী রাতটা কাটানো হবে কচিখালি ফরেস্ট অফিসের কাছে। কারন এই পথ দিয়েই জাহাজ ফিরে যাবে ঢাকার রাস্তায়। কচিখালির আরেক নাম ‘টাইগার পয়েন্ট‘। সঙ্গী জাবির শিক্ষক জানালেন তিনি যে কয়েকবার বাঘ দেখেছেন এবং বাঘের ছবি তুলেছেন তার বেশীর ভাগই এই এলাকা থেকে। সুতারাং অভিযাত্রীদের মনে সেই পুরনো বাঘ দেখার চিন্তাটা নতুন করে আবার মাথাচাড়া দিল। সন্ধ্যার বেশ কিছুক্ষণ আগেই জাহাজ কচিখালী পৌঁছল। জাহাজ জেটিতে নোঙ্গর করা মাত্র নেমে পড়ল সবাই, বাঘ দেখতে। যেন বাঘ খাঁচায় ভরা আছে, ওরা যাবে এবং তাড়াতাড়ি শুধু একটু দেখে ফিরে আসবে। অভিযাত্রীরা সবাই খুবই নিঃশব্দে এবং সুশৃংখলভাবে কচিখালি মাঠের পুকুর পর্যন্ত পৌছে গেল। এ কয়দিনের নিয়মতান্ত্রিক জীবন যাপনে তারা এখন বেশ সুশৃংখল। পরিকল্পনা অনুযায়ী ওখানেই তাদেরকে নিঃশব্দে বসে থাকতে হবে সন্ধ্যা পার হয়ে যাওয়া পর্যন্ত। উদ্দেশ্য যদি মামা আসে তাহলে তার সঙ্গে একটা সৌজন্য সাক্ষাৎ!!! পড়ন্ত বিকাল। শব্দহীন ৬৫ জোড়া চোখ বিরামহীনভাবে খুঁজে চলেছে সেই একটি প্রাণীকে। হঠাৎ তাদের মনে প্রশ্ন এল সুন্দরবনে এসে কেন তারা শুধু বাঘের দেখা পাওয়ার চিন্তায় মগ্ন? বাঘ ছাড়া কি অন্য কিছু দেখা বা উপভোগ করার নেই এই বনে? এই যে সুন্দর এই পড়ন্ত বিকালে তাদের সামনে ঘাস খাচ্ছে কমপক্ষে শ‘দুয়েক চিত্রা হরিণ এবং তাদের বাচ্চা-কাচ্চারা। অল্পদূরেই দেখা যাচ্ছে কয়েক জোড়া বন্যশুকর বনের প্রান্ত জুড়ে মাটি খুড়ে তার খাদ্যদ্রব্য খুজছে। গাছের পাতা ও ডালের ফাঁকে মাঝেমাঝেই উকি দিয়ে শয়তানি করছে আমাদের জাত ভাই, সুন্দরবনের একমাত্র বানরগোত্রীয় প্রাণি ‘রেসাস বানর‘। প্রকৃতির এই অপূর্ব সৌন্দর্যের কি কোন মূল্য নেই? কিন্তু আমরা তাকে সেই মূল্য দিতে শিখিনি। শিখিনি কিভাবে তাকে সুন্দরভাবে আমাদের নিজেদের কাজে লাগানো যায় তার সুচিন্তিত উপায়সমূহকে। ব্যবহার করতে শিখিনি আমাদের সুস্থ্য বুদ্ধিবৃত্তিকে। আর যার ফলে আমাদের এই দুরবস্থা। ভাবতে ভাবতে তারা অনেক দূর চলে যায়। হঠাৎ চিন্তায় ছেদ পড়ে, আবার ভাবে: হ্যাঁ, এইতো…….তাদের চিন্তা অনেক দূর এগিয়েছে। তারা পারবে আগামী দিনের সমস্যা সঙ্কুল পথের হাল ধরতে। সন্ধ্যার পর এসব ভাবতে ভাবতে কখন যে তারা জাহাজে ফিরে এসেছে মনে নেই। আগামীকাল সকালে জাহাজ রওনা দেবে ঢাকার উদ্দেশ্যে। আবার ফিরে যেতে হবে সেই পরিচিত গন্ডিতে, যেখানকার মানুষ চিন্তা করে কাজ করেনা। সুন্দরবনের এই মায়াময় প্রাকৃতিক পরিবেশে এসে অভিযাত্রীরা এটুকু বুঝতে শিখেছে যে তাদের পরিচিত মানুষগুলোর অপরিকল্পিত কার্যকলাপে আজ তাদের অতি প্রিয় এই বনভুমি হুমকির সম্মুখীন। এসব চিন্তা নিয়ে ব্যথা ভরা মন নিয়ে পরদিন সন্ধ্যায় সদরঘাটে জাহাজ থেকে নামার সময় দলের সবচেয়ে কম কথা বলা ছেলে মাসুম তার সহপাঠি সাথীকে বলল, ‘বাঘ না দেখে ভালোই হয়েছে, কারণ বাঘ দেখলে এই চিন্তাগুলো করতে শিখতাম না………‘