ভ্রমনে পাওয়া মুখ
সেই কবে ভ্রমন বিষয়টি আমার বালক বেলায় তার সজ্ঞা বা সচেতনতার ধার না ধেরেই শুরু হয়েছিল সে দিনক্ষণ নির্দিষ্ট করে বলার আজ আর জো নেই। তবে কৈশোরে বাজার ঘুরতে যাওয়া কিংবা কারো ঘাড়ে গর্দানে চড়ে গরুদৌড়ের মাঠে হাজির হওয়ার ভ্রমণ স্মৃতি আজকাল হামেশাই মনে পড়ে। এক অখ্যাত গাঁয়ে নগরদাইর বিলের পাড়ে নয়াবাড়ির বাসিন্দা হিসাবে আশপাশের গাও গেরাম বিল, খাল, বাইদ ভ্রমণ আসলে বিচরণই ছিল ‘ঘর হইতে বাহির’ হওয়ার পয়লা ছবক। আর সে ছবকটি পেয়েছিলাম মূলত বাবার হাত ধরে কখনো বা বাড়ীর বয়সে সাবালক কারো সঙ্গী হয়ে। আর এভাবেই একদিন অবাধ বিচরণ বা ভ্রমণের সুযোগটির জন্য অপেক্ষা করে করে যখন কৈশোর উত্তীর্ণ প্রায় তখন বিদ্যালয় ছেড়ে মহাবিদ্যালয়ের পাঠ নিতে বাবার আগ্রহেই আক্ষরিক অর্থে অবাধ ভ্রমনের সুযোগটি এসে গিয়েছিল। সেই আশির দশকের গোড়ায় সামরিক আইনের জোয়ালটি যখন জাতির ঘাড়ে তখনকার কথা বলছি। ভাওয়াল সন্ন্যাসী রাজা রমেন্দ্র নারায়ন রায় আর স্বভাব কবি গোবিন্দ দাস এর স্মৃতি বিজড়িত জয়দেরপুরই সর্ব অর্থে আমার প্রথম দ্রষ্টব্য ভ্রমণভূমি। রাজবাড়ী, কালি বাড়ী, শিববাড়ী, ছায়াবীথি, জোড় পুকুর, শ্মশান ঘাট, রাজবাড়ী দীঘি, বাজবাড়ী রোডের দেবদারু ছায়ায় কতোই না এলোপাথারি বিচরণ। সেইসব বিচরণ বা ভ্রমণ ক্রমশই বিস্তৃত হয়ে কৃষি গবেষণা, ধান গবেষণা, মেশিন টুলস ফ্যাক্টরী, টাকশাল, সমরাস্ত্র কারখানার আশপাশে শিমুলতলী হয়ে সালনা, কালিয়াকৈর, টঙ্গী পর্যনত্দ বিস্তৃত হয়। কত অচেনা মুখ চেনা হয়ে যায় তখন। কত রাসত্দা-ঘাট, গাছ, পুকুর, রথতলা, রেল স্টেশন আমার ভ্রমণস্মৃতির অংশ হয়ে যায়। রথতলার বট অশ্বথের ছায়ায় যেমন ক্ষনিক তিষ্ঠানো হয়েছে তেমনি লাল মাটির বাওকুড়ানি হাওয়ায় কতবার সাময়িক আটকে দিয়েছে আমার ভ্রমন পথ।
সেসব ভ্রমণ বিনোদন ছিল না, ছিল না ছুটি কাটানো। কেবল কি যেন খুঁজে মরা। আজও খুঁজি। খুঁজতে খুঁজতে একদিন ইউরোপের শক্ত মাটিতে বসত হওয়া আমার। চলতে চলতে এ বিজাতীয় সংস্কৃতির হাওয়া এড়িযে পেছন পানে তাকালে ছাপ্পান্ন হাজার বর্গমাইলের এখানে ওখানে আতি পাতি খুঁজে মরার স্মৃতিগুলি আসন পাতে। কারণে অকারণে সেসব ভ্রমণ বিচরণেই খুঁজে পেয়েছি কত সব ষোল আনা খাঁটি বিষয় আশয়। পথ চলতে চলতেই পাওয়া পথের ইশারা। চলতে চলতেই চোখের দেখায়, বলতে বলতেই মুখের ভাষায় নানা অভিজ্ঞতা জমা হয়। সেসব টুকরো কথা স্মৃতির আদল হয়ে ওড়ে। তাতে আজও মাতাল হই। সেসব সামান্য কথা। সামান্য আয়োজন। সামান্যই রূপালংকার। বাংলার সহজ সরল যাপিত জীবনের সাধারণ্যে নানা মুখই আমার ভ্রমন সেরা সংগ্রহ। পথ চলতি সে সব মুখরাই ভেসে ওঠে পথের মানচিত্রে। সে পথ ধুলো মাখা। সে পথ বাংলার মানচিত্রের। সে মুখ যেন আমাদেরই প্রতিচ্ছবি।
চট্রগ্রাম, ঢাকা, শানত্দিনিকেতনের পথ ঘুরে আপাতত: পাশ দেয়ার পাঠ সাঙ্গ করে ফের ঢাকায় থিতু হওয়ার জোড় প্রচেষ্টা তখন আমার। চারুকলার নবীন শিক্ষকতা আর নয়া সংসার যাপনের চালচিত্রের ব্যসত্দতায় একদিন শিক্ষক শিল্পী সমরজিৎ রায় চৌধুরীর আমন্ত্রণে এক বিকেলে পরিবাগ মার্কেটের দোতলায় অবস্থিত হসত্দশিল্প বাজারজাত কারী প্রতিষ্ঠান কারিকা’য় এক সভায় হাজির হই। ‘ঐতিহ্যবাহী জাতীয় লোক ও কারুশিল্প প্রদর্শনী বাংলাদেশ’ আয়োজনের প্রস্তুতি সভা ছিল সেটি। আলোচনা ক্রমে সেদিন গঠিত কমিটির সদস্য হিসাবে আমিও নির্বাচিত হই। ক্রমেই এ সংক্রানত্দ আলোচনা পরিকল্পনায় অংশ গ্রহণ বাড়তে থাকে। সাড়া দেশ ব্যাপী হসত্দশিল্পজাত সামগ্রীর নমুনা সংগ্রহের প্রসত্দাব অনুমোদিত হয়। কমিটির সর্ব কনিষ্ঠ সদস্য হিসাবে এ জাতীয় ছোটাছুটির বিশেষ দায়িত্ব বর্তায় আমার উপর। আর সে সূত্রে ভ্রমণ বিচরণ সংক্রানত্দ দায়িত্ব পালনে আমার আগ্রহও ছিল সীমাহীন।
ঠিক হল প্রথমে ঢাকার আশপাশে কালিয়াকৈর ও ধামরাই অঞ্চলের মৃৎশিল্পীদের এলাকা ঘুরে নমুনা সংগ্রহ করার। তৎকালীন চারুকলা ইনস্টিটিউটের মৃৎশিল্প বিভাগের শিক্ষক প্রখ্যাত মৃৎশিল্পী মরনচাদ পাল এর সঙ্গী হব আমি। নির্দিষ্ট দিনে স্যারের সাথে সকাল সকালই রওনা হব ঠিক হল। চারুকলার গেটে সাক্ষাত শেষে আমরা রওনা হই কালিয়াকৈরের উদ্দেশ্যে। টঙ্গী হতে বাস বদল করে টাঙ্গাইল গামী বাসে চড়ি আমরা। যাত্রী ভীড়ে আমরা দুজন বিচ্ছিন্ন দুটি আসনে বসি। আমার সহযাত্রীটি শুরু থেকেই কেন জানি আমার আগ্রহের সৃষ্টি করে। তাঁর শীর্ন ছোট খাট দেহ। বয়স আনুমানিক ষাটোর্ধ। ছোট করে ছাটা দাড়ি যার অধিকাংশই পাকা। গায়ে পাঞ্জাবী। পরনে লুঙ্গী।
আমিই প্রথম কথা পাড়ি। চাচা কই যাইবেন? মৃদু স্বরে উত্তর আসে টাঙ্গাইল। বাড়ী টাঙ্গাইল শহরে? উত্তর আসে না, দেলদুয়ার। তারপর চোখ ফেলি জানালা দিয়ে। আমাদের বাস তখন আশুলিয়া পেড়িয়ে চন্দ্রামুখী। এরই মধ্যে বাস ভাড়া দিতে গিয়ে টাকা কিছু কম হওয়ায় কন্টাকটরকে মিনতি করতে দেখেছি সহযাত্রীকে। বয়োবৃদ্ধের চাহনিতে রাজ্যের দুশ্চিনত্দার ছাপ। আমার পাশে তার বসা মোটেই স্বাচ্ছন্দ্য মনে হচ্ছিলনা বোধ করি। কেননা যদি তার আচরণে অসাবধানতায় আমার মত সাহেবী সুরতধারী লোকের পাছে কোন অসুবিধা হয় গোছের। আবার ও আমিই কথা তুলি। ঢাকায় কই গেছিলেন জিজ্ঞেস করতে খুবই সংক্ষিপ্ত ছোট ছোট উত্তরে সব জানান দিচ্ছিলেন। একটি বিখ্যাত কারুপন্য বিপনীর নাম বলাতে আমার উৎসুক্য আরো বেড়ে যায়। কারন জানতে চাইলে আমাকে রীতিমত অবাক করে দিয়ে তার ভাষায় জানালেন তিনি আসলে একজন কর্মকার, মানে কারুশিল্পী। জেনে নিলাম আরো আগ্রহ করে তার কাজের ধরন ও তৎসংক্রানত্দ নানা কথা। স্যার পেছনের সীট থেকে ডেকে বললেন আমরা কালিয়াকৈরের কাছাকাছি চলে এসেছি। ভাবলাম চাচার ঠিকানাটা নিয়ে নেই। আমি খাতা কলম বের করে তার ঠিকানা চাইতেই কাঁদো কাঁদো হয়ে কান্না জড়ানো কন্ঠে বললেন, আমি যেন তাকে এইবারের মত মাফ করে দেই। তার সামান্য আয়ে সংসার চলে। কোন বিপদ হলে ছেলের বউ নাতি না খেয়ে মরবে ইত্যাদি ইত্যাদি। প্রায় আমার পা জাপটে ধরার জোগাড়। আমি তাঁকে আশ্বসত্দ করে বললাম, আমিও তার মতো কারিগর। স্যারকে দেখিয়ে বললাম তিনি আমার ওসত্দাদ। আপনার বাড়ী যাব কাজ দেখতে। ভালমন্দ কথা শুনতে। বেচারা কি বুঝলেন জানিনা এবার তিনি ঠিকানা বললে আমি তা চটপট টুকে নেই, জয়নাল আবদীন খান, গ্রাম- নলুয়া, বটতলা চৌরাসত্দা, দেলদুয়ার, টাঙ্গাইল। পাশে লিখে রাখি অলংকার শিল্পী। ততক্ষনে বাস কালিয়াকৈর স্টপেজে পেঁৗছালে চাচাকে বলি ‘আমারে চিনবেন তো আপনার বাড়ীত গেলে? তিনি সম্মতি দেন। আমার বিদায়ে বৃদ্ধ স্বসত্দি পেয়েছিলেন হয়তো কিন্তু তাঁর সঙ্গে ফের দেখা হবে সে সম্ভাবনার কথা তখন মোটেও ভেবেছিলেন কি?
ভ্রমন পথের এই কুড়িয়ে পাওয়া মুখই আরেকটি ভ্রমনের জন্ম দিয়েছিল তার কিছুদিন পরেই। এবার সে কথাই বলতে চাই। ‘ঐতিহ্যবাহী জাতীয় লোক ও কারুশিল্প প্রদর্শনী বাংলাদেশ’ এর পরবর্তী সভায় এই অলংকার শিল্পীর নাম উত্থাপিত হলে অনুমোদন পাওয়া যায়। পরের দফায় আমি একাই রওনা হই দেলদুয়ার। আমার মূল আগ্রহের বিষয়টি ছিল বংশ পরম্পরয়ায় এ মুসলিম জনগোষ্ঠির কর্মকার পেশা। তারা মূলত ঐতিহ্যবাহী রূপার অলংকার গড়েন। আমার একসময়ের সহপাঠি টাঙ্গাইলের তপেস বসাক কে সঙ্গে নিয়ে দেলদুয়ারে ঠিকানা মত এক পড়নত্দ বিকেলে হাজির হই। অনেক খোঁজাখুঁজির পর এক কিশোরের সহায়তায় পাড়ার এক বাড়ির আঙ্গিনায় তাসের আড্ডায় তাঁকে আবিস্কার করি। বৃদ্ধ বিস্মিত। সেদিনের বাসের সহযাত্রী তার সামনে দাঁড়িয়ে। আমাকে জড়িয়ে ধরেছেন। তার কৃতজ্ঞতার যেন শেষ নেই। দুচালা টিনের ঘরের গাদাগাদি সারির একটিতে গিয়ে বসি। তার হাতে গড়া চাদির অলংকার দেখাতে লাগলেন। আদুল গায়ের নাতিকে কোলে নিয়ে ছেলের বউ ও এসে যোগ দিয়েছে ততক্ষনে। এই অখ্যাত অলংকার শিল্পীর চোখের পর্দায় আর আগের মত দুপুরের আলো ফোটে না। ফলে কাজ আর আগের মত হয় কই বলে অনুতাপ করেন। আমার আর তপেসের আক্ষেপ হয়। পূর্বপুরুষের পেশা পরম্পরয়ায় ছেলেও নাম লিখিয়েছিল। কিন্তু আয় রোজগার ভাল নয়। ছেলে শহরে অন্য কাজের সন্ধান করছে। ভাল দিনের সন্ধান।
পেছনের সেদিনের কথা বললেন। যেদিন খরচ করে ঢাকায় গিয়েও মজুরী ছাড়াই ফেরত আসছিলেন সেদিনের কথা। আমি তাঁর স্কেচ করছি আর চোখে ভাসছিল কারুশিল্পীদের প্রমোট করার নামে ব্যবসায়ীদের ঝা চকচকে চেহারা। আর পক্ষানত্দরে অন্নের সংস্থান করতে না পেরে উঠা এ কারুশিল্পীর মুখ। চারদিকে তাদের অর্থ দৈন্যতা দাত খিঁচিযে আছে যেন। আর তাকে বার বার আড়াল করতে সচেষ্ট তাদের সুন্দর শৈল্পিক নকশার আলো। ততক্ষনে কবুতরের খোপে পায়রার ডাক বেসামাল হয়। আমরাও সব সামলে নিযে ঠিকানা দিয়ে কারুশিল্পী জয়নাল আবদীন কে ‘ঐতিহ্যবাহী জাতীয় লোক ও কারুশিল্প প্রদর্শনী বাংলাদেশ’ এ অংশগ্রহনের আমন্ত্রন জানাই। নমুনা হিসাবে সংগে নেই অলংকার শিল্পী জয়নাল আবদীনের নিজ হাতে গড়া রূপার তাজমহলের লকেট, হাসুলি, আংটি ইত্যাদি।
এই সুদূর প্রবাসে বয়ে আনা খেরো খাতায় ২০০৩ সালের কোন একদিন অাঁকা তাঁর মুখ, আর গয়নার মুখ যেন আলো ছড়ায়। সংগ্রহের হাসুলি মাদুলি দেলদুয়ার এর এক প্রবীন কারুশিল্পীর মুখ হয়ে, বাংলা ভ্রমনের মুখ হয়ে, আমার মায়ের মুখ হয়েই যেন এই প্রবাসে সোনা রঙে চিলিক দিয়ে উঠে।
শফিকুল কবীর চন্দন
মিলান, ইতালী
জানুয়ারি পয়লা সপ্তাহ, ২০০৯ খৃীস্টাব্দ
পবষষ ঢ়য- ০০৩৯ ৩৩৩৬৯ ৩৮১৮৭
ব-সধরষ ংশপযধহফধহ@যড়ঃসধরষ.পড়স
নধমধৎঃরংধহ@মসধরষপড়স
বিন- িি.িংশধনরৎ-ভরনবৎধৎঃ.পড়স
লেখক পরিচিতি
শফিকুল কবীর চন্দন
জন্ম-১৯৬৮, বাংলার বয়ন ঐতিহ্যের প্রাণভূমি নরসিংদিতে।
তন্তুকলা তথা বয়নচিত্র ও তন্তু ভাস্কর্য (ট্যাপেষ্ট্রি ও ফাইবার স্কাল্পচার) বিষয়ে স্নাতকোত্তর করেছেন কলাভবন, বিশ্বভারতী, শান্তিনিকেতন, ভারত থেকে।
২০০৪ সালে আকস্মিক সিদ্ধান্তে ইউরোপে প্রবাস জীবন শুরু করার আগ পর্যন্ত কারুশিল্প বিভাগ, চারুকলা ইনস্টিটিউট, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের খন্ডকালীন প্রভাষক ও বাংলাদেশ গার্হস্থ্য অর্থনীতি কলেজের বয়ন বিষয়ের অতিথি শিক্ষক হিসাবে কর্মরত ছিলেন।
মন্তব্য করুন