ফ্যান্টাসিময় অভিযান : নৌকা বানিয়ে ঢাকা টু সেন্টমার্টিন
মুসা ইব্রাহীম
তার কথা শুনলে মনে হবে ফ্যান্টাসি জগতটাই আসল, আর বাসত্দবটা ফুটো। ফ্যান্টাসিই যেন জীবন। তার মতে, শহুরে আটপৌরে জীবনের দাম কানাকড়িও থাকা উচিত নয়। যে জীবনে অ্যাডভেঞ্চার নেই, চ্যালেঞ্জ নেই_ সে জীবন পরজীবীর মতো। এই বয়স্ক মানুষটির দুঃসাহসিক কর্মকা-ও তার মতের সমার্থক। সেই সঙ্গে যে কোনো বিষয় বা কাজ নিজের মতো করে যে করা যায়, জীবনটাকে যে নিজের মতো করে পরিচালনা করা যায়, এ বিশ্বাসের পানে যে যাত্রা শুরম্ন করেছি, তাতে তার অবদান অসামান্য।
কাজেই বেশ কয়েকদিন ধরে তিনি যে বয়ান করে চলেছেন, ‘ফাইবারের একটা ছোট্ট ছিমছাম নৌকা করেছি চিটাগাং জাহাজ-ভাঙা শিল্প এলাকা থেকে। পুরোনো জাহাজের বয়া টাইপের নৌকা। সেখান থেকে শক্তিশালী ইঞ্জিনও কিনে এনেছি। এখন কামরাঙীর চর এলাকায় ওটাকে নিজের মতো করে আকার দেয়ার পর্ব চলছে। ভাবছি, যেকোনো দিন সদরঘাট থেকে এই নৌকায় করে সেন্টমার্টিন দ্বীপে রওয়ানা দিব। যাবেন না কি?’ শুনে একটুও অবাক হই না।
স্বপ্নদ্রষ্টার দেশে ফেরা
প্রশ্নটি কাজী হামিদুল হকের। বয়স পঞ্চাশ অতিক্রম করেছে। দীর্ঘদিন কেটেছে প্রবাসে। লেখাপড়া ভাস্কর্যের ওপর, আমেরিকায়। কিন্তু আগ্রহ ফটোগ্রাফিতে। সুতরাং ফাইন আর্টসের লেখাপড়ায় ঠিকুজি গড়া হয়নি। বরং পেশাদার ফটোগ্রাফিতেই তার সাবলীল পদচারণা বছরানত্দে স্থায়ী হয়। এ ছাড়াও তার সমুদ্রপাড়ে মাছ ধরার শখ। সেটাই তাকে টেনে নিয়ে চলে সমুদ্রতলের ছবি তোলার দিকে। এভাবেই সমুদ্রের সঙ্গে ২৫ বছরের দীর্ঘ সময় কাটান_ তলদেশের বিচিত্র জীবজন্তুর ছবি তোলার পেছনে। এ সময় স্কুবা ডাইভিংও চলত পাশাপাশি।
আমেরিকার এমন সৌখিন জীবনকে বিদায় জানিয়ে কাজী হামিদুল হক দেশে স্থায়ীভাবে ফিরে আসেন নব্বইয়ের দশকের মাঝামাঝি। তার সঙ্গে পরিচয় ২০০০ সালের শেষ দিকে।
ড্রিম মিশন-এর প্রস্তুতি
মানুষটির অপ্রচলিত ধারার কর্মকা-ের সঙ্গে পরের কয়েক বছরে বেশ পরিচিত হয়ে উঠেছি। সে সময়ে তার কাছ থেকে শোনা ফ্যান্টাসির মধ্যে ‘নৌকায় করে ঢাকা থেকে সেন্টমার্টিন দ্বীপে যাওয়ার পরিকল্পনা’টাই সর্বশেষ। তবে সদরঘাট থেকে সেন্টমার্টিন দ্বীপ? তাও আবার রূপানত্দরিত লাইফ-বোটে করে? এতো বড় ফ্যান্টাসি?
তাই সিদ্ধানত্দ নিতে বেশ ঝামেলায় পড়তে হলো। কারণ একদিকে অপরিচিত অ্যাডভেঞ্চারের আহ্বান। অন্যদিকে তীব্র মাত্রার ফ্যান্টাসি। কেউ তো এভাবে যায় নি, কেউ যায় না। ভাবতে বসলাম, এর কি কোনো বাসত্দবতা আছে? সুতরাং কি করব, যাবো, না কি যাবো না_ সিদ্ধানত্দ নিতে দোটানায় ক’দিন পার হল। এই ফাঁকে সেই ফ্যান্টাসিও ফিকে হয়ে এল।
দু’তিন সপ্তাহ পর কি একটা কাজে কাজী হামিদুল হকের আজিমপুরের বাসায় গিয়েছি। তার কণ্ঠে ফের একই আবাহন। তখন ব্যাপারটাকে গুরম্নত্বভরে নিতেই হল। একদিকে চাকরির চিনত্দা_ ছুটি পাওয়া যাবে তো? এমনিতে অফিস কামাই দেয়ার একটা সিল গায়ে পড়ে গেছে। কিন্তু রক্তেই যার অ্যাডভেঞ্চার, তার এত চিনত্দাভাবনা করলে চলে? এবার তাই চিনত্দা ডালপালা ছড়ানোর আগেই সিদ্ধানত্দ নিলাম_ যাবো।
তার বাসা থেকে বের হয়েই শুরম্ন হলো টেনশন_ অফিস ম্যানেজ করবো কিভাবে? অবশ্য ফিচার সম্পাদক আমার এই ‘অ্যাডভেঞ্চার ম্যানিয়া’ সম্পর্কে জানেন। তাই ‘ভ্রমণ’ পাতা চালানোর দায়িত্বটাও গছিয়েছেন। আমিও সমালোচনা ঠেকাই এই বলে যে_ আরে ঘুরে না বেড়ালে ভ্রমণ পাতার লেখা যোগাড় হবে কোত্থেকে?
সুযোগ বুঝে এক সময় ফিচার সম্পাদককে ‘নৌকা বানিয়ে ঢাকা টু সেন্টমার্টিন দ্বীপ অভিযান’-এর কথা জানালাম। শুনে তিনি আকাশ থেকে পড়লেন_ এও সম্ভব? তাকে কাজী হামিদুল হকের গল্প বলে আশ্বসত্দ করা গেল। বললাম, তিনি আসলেই নৌকাটা এমনভাবে বানিয়েছেন যাতে কমপৰে ১৫ জন আরোহী তাতে করে সদরঘাট টু সেন্টমার্টিন দ্বীপ পাড়ি দিতে পারে। চিনত্দাভাবনা শেষে তিনি যেতে দিতে সম্মত হলেন। তবে নিরাপত্তার ব্যাপারে সাবধানে থাকতে বললেন।
এর আগে নদীপথে বহুবার ঢাকা থেকে দৰিণাঞ্চলীয় জেলা, একবার সুনামগঞ্জ থেকে টাঙ্গুয়ার হাওর ইত্যাদি ভ্রমণের অভিজ্ঞতা ছিল। কিন্তু সেগুলোর সবই ‘পরিচালিত ভ্রমণ’। কিন্তু এবার নিজেরাই নৌকার সারেং-কাম-পরিচালক। তাই নৌকায় এ নদীভ্রমণের ব্যাপারে বারবারই চ্যালেঞ্জ অনুভব করছিলাম। সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ ছিল কাজী হামিদুল হকের জন্য। তিনি এর রূপকার, আয়োজক, দলনেতা সবই।
নৌকা আর ইঞ্জিন কেনার পর এর মধ্যে বছর দুয়েক সময় পার হয়ে গেছে। নানা উপকরণ পরীক্ষা-নিরীক্ষা করতে করতে আরও সময় লেগে যায়। নৌকাটা গোছানো যখন প্রায় শেষ, যাত্রার সময় যখন ঘনিয়ে এল_ সে সময়ে কাজী হামিদুল হকের বাসায় আলাপ চলতে থাকে_ ভূ-পৃষ্ঠে বা পাহাড়-পর্বতে আমাদের বিচরণ শুরম্ন হলেও প্রকৃত অর্থেই পানির নিচে সবকিছুই আমাদের অজানা। আমাদের ব্রজেন দাস ছিলেন, কিন্তু তার উত্তরসূরী কেউ উঠে আসল না। পানি বা সমুদ্র মাঝে আমাদের অ্যাডভেঞ্চার এখনো তীর অতিক্রম করেনি। পানির নিচের জগৎটা কেমন, তার বাসিন্দাদের প্রকৃতি কেমন, মানুষের সঙ্গে তাদের ‘ইন্টারঅ্যাকশন’ কেমন হয়_ এসব সম্পর্কে আমাদের জ্ঞান এখনো টেলিভিশনের পর্দা পর্যায়েই রয়ে গেছে। এ ব্যাপারে ‘ফার্স্ট হ্যান্ড’ অভিজ্ঞতা রয়েছে, এমন বাংলাদেশীর সংখ্যা কড়ায় গুণে ফেলা সম্ভব। সুতরায় নিজেরাই এ জগৎকে দেখব, নিজেদের মতো করে দেখব, এর কাছে যাব_ সে উদ্দেশ্যেই এ পরিকল্পনা।
সবাই একটা নীতিগত ব্যাপারে একমত ছিলাম যে, স্থলপথে বাংলাদেশকে চষে ফেলেছেন অনেকেই। কিন্তু জলপথে এ দেশ যে আরও মোহনীয়, তা এ প্রজন্ম ভুলে যেতে বসেছে। সুযোগটা তৈরি করা গেলে এদের জন্য চালু হবে অ্যাডভেঞ্চারের নতুন এক চ্যাপ্টার। তখন হয়তো প্রতি বছরই একটা করে দল ঢাকা থেকে উত্তরে তেঁতুলিয়া বা দৰিণে সেন্টমার্টিন অথবা এক প্রানত্দ থেকে আরেক প্রানত্দে নৌকাভ্রমণে বের হবে। বাংলাদেশকে আবিষ্কার করবে নতুন চেহারায়।
অবশ্য কাজী হামিদুল হকের আরেকটি সমানত্দরাল লৰ্য ছিল। তিনি ক্যালিফোর্নিয়া, ফ্লোরিডায় সমুদ্রতলে স্কুুবা ডাইভিং ও সঙ্গে ফটোগ্রাফি করেছেন। তিনি জানালেন, ওইসব এলাকার লোকজন তাদের সামুদ্রিক পরিবেশ রেখেছে সুন্দর করে। এর প্রকৃতিকে একটুও বদলাতে বা নষ্ট হতে দেয়নি। আর সেন্টমার্টিন দ্বীপে ১৫ বছর আগেও হাঁটুপানিতে শৈবাল দেখা যেত। দিনে দিনে সেসব নষ্ট হতে চলেছে। খাবারের মোড়কের পলিথিনে ছেয়ে যাচ্ছে সমুদ্রের তলদেশ। এভাবে সেন্টমার্টিন দ্বীপের প্রবাল-শৈবাল, অপূর্ব সুন্দর সমুদ্রতল এখন ধ্বংসপ্রায়। সেই সেন্টমার্টিনের সমুদ্র তলদেশের ছবি তোলার জন্যই মূলত তিনি এ অভিযান আয়োজন করেন।
অভিযাত্রী : সংখ্যায় ১৩
সবকিছু মিলিয়ে তার নৌকা যখন নদীপথে চলার সার্বিক উপযোগী হয়ে উঠল, সে সময়ে এ মতের বিশ্বাসী মোট ১৩ জন_ ফজলুল কবির সিনা, রফিকুল ইসলাম (রফিক), রবিউল হাসান মনা, মাহবুব, প্রলয় রহমান, তমাল, প্রিন্স, কামাল আনোয়ার বাবু, জাহাঙ্গীর, মুনতাসির মামুন ইমরান আর আমি কাজী হামিদুল হকের সঙ্গী হয়ে কিশোর মাঝির সহায়তায় বাংলাদেশের সেই রূপের খোঁজেই নৌকা নিয়ে বেরিয়ে পড়েছিলাম। যোগ দিলাম নতুন মাত্রার অ্যাডভেঞ্চারে। ঢাকা থেকে নৌ-পথে গিয়ে উঠতে হবে সেন্টমার্টিন।
দিনটি ছিল ২৩ ডিসেম্বর ২০০৪, বিকাল পাঁচটা। প্রয়োজনীয় কাপড়চোপড়, ক্যামেরা সরঞ্জাম ব্যাগে ভরে সবাই জড়ো হতে লাগলাম কামরাঙ্গীর চরে। সেখানেই নৌকা ঘাটে রাখা। নৌকা চলার পর্যাপ্ত জ্বালানি নেয়া হল। সঙ্গে খাবার। তবে পেঁৗছতে কত দিন লাগবে, কী হবে কারোরই জানা নেই। এ পথে শহুরে মানুষের টানা যাত্রা খুব সম্ভব এটাই প্রথম। তাই সবার ভেতর একটা রোমাঞ্চ।
যোগাড়-যনত্দর শেষ করে রাত বারটার সময় নৌকার কাছে গিয়ে থমকে যেতে হলো। ভাটায় পানি সরে গেছে। ফলে শুকনায় আটকা পড়েছে নৌকা। সুতরাং অপেৰা। এ ফাঁকে সবাই মিলে নুড্লস বানিয়ে খেয়ে নিলাম, কেউ কেউ বিস্কুট। কপালে জুটল মশার কামড়_ ‘ফ্রি’।
২৪ ও ২৫ ডিসেম্বর : স্বপ্নের অভিযান
রাত সাড়ে তিনটায় হালে পানি লাগল। কিন্তু ঠা-ায় ইঞ্জিন জমে গেছে। সেলফ স্টার্টার-এ চালু হলো না। খানিকটা সময় ইঞ্জিনের কারিকুরির পেছনে ব্যয় হল। তবে ইঞ্জিন বশে এল না কিছুতেই। সুতরাং সর্বশেষ উপায় ম্যানুয়াল পদ্ধতি_ হাতলের মাধ্যমে ঘুরিয়ে ইঞ্জিন চালু করা। উহু, ইঞ্জিন এবারও চালু হল না। মাঝি কিশোর_ পারলেন না। কামাল আনোয়ার বাবু_ চেষ্টা করে ব্যর্থ হলেন। তখন ভাবলাম_ দেখি না চেষ্টা করে চালু হয় কি না। এ ভেবে আমি একবার হাতল ঘোরাতেই চালু হয়ে গেল নৌকার ইঞ্জিন। মাঝি হাল ধরলেন। পরে বুঝলাম যে এতৰণ ধরে চেষ্টা করার কারণে ইঞ্জিন গরম হয়ে ছিল। তাই শক্তি দিয়ে একবার ঘোরাতেই ইঞ্জিন চালু হয়েছিল।
বুড়িগঙ্গার কোল ধরে নৌকা এগিয়ে চলে। যান্ত্রিক ঢাকা শহরে তখনও মিটমিট করে জ্বলতে থাকা বাতিগুলোকে বিদায় জানালাম। যে শহুরে অত্যাচারে নদীর ওপর কুয়াশা উধাও হয়ে গিয়েছিল, সদরঘাট পার হতেই কুয়াশার চাদরে জড়ানো ভোর ফিরে এল। তার মধ্যে ছোট্ট নৌকায় নেই পথ নির্দেশক বাতি। অনুমানে ভর করে বাতি ছাড়াই কুয়াশা কেটে সামনের দিকে নৌকা চালাতে লাগলেন কিশোর।
আবারও বিধি বাম। ঘন কুয়াশায় পথ হারিয়ে তুরাগ নদীর দিকে নৌকা যে প্রায় আধঘণ্টা পথ এগিয়ে গেছে_ টের পেলাম ইট-বালু বহন করা নৌকার মাঝিদেরকে জিজ্ঞেস করায়। ফের পথ ভুল হতে পারে_ এ দুশ্চিনত্দায় নৌকা নোঙর করে নদীর মাঝে বসে থাকলাম সকাল সাড়ে দশটা পর্যনত্দ। এ সময় দেখছিলাম বেশ কিছু বার্জ, ইট-বালু বহনকারী নৌকা কত সহজে এদিক-ওদিক চলে যাচ্ছে। যেন সাপের মতো বয়ে চলা নদীর পিঠ তাদের হাতের তালুর মতই পরিচিত। কুয়াশা কেটে যেতে দেখলাম একটা ইটের ভাটার পাশে নৌকা নোঙর করে রাখা হয়েছে।
এগারটার দিকে নৌকা ফের চলতে লাগল। এ সময় কখনো তুলে দেওয়া হল পাল। ১৩ জন যাত্রীর সবাই সবসময় কাজ-কর্মে ব্যস্ত। ফাঁকে ফাঁকে চলত হাসি-ঠাট্টা। দুপুরের পর মুন্সিগঞ্জ পেরিয়ে গোয়ালন্দের আগে মেঘনা নদীতে গিয়ে পড়ল নৌকা। সন্ধ্যার কিছু আগে চর ইদ্রিস, মোহনপুর এবং মেঘনা ও ডাকাতিয়া নদীর মিলনস্থল পার হয়ে চাঁদপুর পুরাতন ঘাটে থামলাম। এখানে বিরতি টানা হল প্রথম দিনের অভিযানের।
এখানে বাড়তি একদিন থাকার পরিকল্পনা। পরদিন ঘাট সংলগ্ন বাজার ঘুরে চাল-ডাল, নুন-তেল, সবজি ইত্যাদি কেনা হল। সবাই মোবাইল ফোনসেট চার্জ করে নিলেন। সারাদিন সব কাজ শেষে এল আরেকটা চমৎকার রাত। নৌকা দুলছে পানির ওপর। আকাশে চাঁদ উঠেছে। কুয়াশা যেন জাঁকিয়ে বসছে নদীর তীর ধরে। সস্নিপিং ব্যাগের মধ্যে ঢুকতেই দুলুনিতে গভীর ঘুমে তলিয়ে গেলাম। বাড়তি পাওনা থাকল পেলব চাঁদের কোমল আলো। সারা রাত জেগে সেই চাঁদ আলো বিলিয়ে গেল।
২৬ ডিসেম্বর : সমুদ্রের ডাক
ভোরের আলো ফোটার কিছুৰণ পরেই সেন্টমার্টিনের উদ্দেশ্যে ফের যাত্রা শুরম্ন হল। ঢাকা থেকে এ যাত্রা শুরম্নর মাত্র কয়েকদিন আগে নৌকায় রং করা হয়েছে। তাই সকালে নৌকার গলুই ধরে এগোতে গিয়ে হাতে ও কাপড়ে তেমন না শুকানো রং লেগে গেল। তাই সাবধানে বসে দেখছিলাম নদীর পারের অধিবাসীদের দিনের শুরম্নতে কর্মচাঞ্চল্য। কেউ মাঠে নিড়ানি দিচ্ছেন তো কেউ গরম্নটাকে ঘাস খাওয়াতে নিয়ে যাচ্ছেন। কেউ কেউ নদীতে এই সাতসকালেই নেমে পড়েছেন গোসল সারতে।
নৌকার গতি ঘণ্টাপ্রতি সর্বোচ্চ ৮ কিলোমিটার। খুব দ্রম্নত বা ধীর_ কোনোটাই নয়। আসলে নৌকার গড়নটাই দ্রম্নত গতিতে চলার পথে বাঁধা। কারণ এটি ছিল জাহাজের ‘লাইফবোট’ ঘরানার। তাকে রূপানত্দর করে ঢাকা-সেন্টমার্টিন দ্বীপ অভিযানে নামানো হয়েছে। তাই বলে পানি কেটে দ্রম্নত এগিয়ে যাওয়ার জন্য নৌকায় যে ধরনের নকশা থাকা প্রয়োজন, তা এতে অনুপস্থিত। সুতরাং মাঝেমধ্যেই আমাদেরকে অতিক্রম করে যাচ্ছিল কিছু মালবাহী নৌকা। আমরা যেমন চারপাশের প্রকৃতি দেখে অবাক হচ্ছিলাম, তেমনি আমাদের নৌকার গড়ন দেখে অবাক হয়েছেন ডাঙা বা পানির বুকে ছুটে চলা সব লোকজন। এমন অদ্ভুত নৌকা তারা আর দেখেছেন কি না সন্দেহ আছে। এসব দৃশ্য স্টিল ও মুভি ক্যামেরার স্মৃতিতে ধরে রাখছিলাম সবাই।
সবকিছুই তার গতিতেই এগোচ্ছিল। হাইমচর পার হয়ে নৌকা লক্ষ্মীপুর জেলায় পেঁৗছাতেই মেঘনা নদীর নাম বদলে গেল। তখন সেটা শাহবাজপুর নদী। এ নদী ধরেই কালুপুরা, হাজারী, চর লরেন্স, চর আলেঙ্ান্ডার, চর গজারিয়া, রামগতি, নলছিড়া পার হয়ে চর শ্রীজনী ও চর শাহবানির মাঝামাঝি পথে নৌকা সন্দীপে পেঁৗছাল। এখানে কেটে গেল নৌ-যাত্রার তৃতীয় দিন।
২৭ ডিসেম্বর : সুনামির ধাক্কা
ভোর সাড়ে চারটার দিকে ঘুম ভেঙ্গে গেল। উঠে দেখলাম কাজী হামিদুল হক নামাজ পড়ছেন। হঠাৎ দেখলাম নদীর ওপর চাঁদ। সেরাত ছিল পূর্ণিমার। নদীর ওপর থালার মতো বিশাল চাঁদ নীরব, নিশ্চুপ, একা। না কোনো মহাজাগতিক বস্তু, না কোনো পৃথিবীবাসী তাকে সঙ্গ দিচ্ছে। নদীর বুকেও কোনো জলযান না থাকায় সেও চাঁদের মৌনতার সঙ্গী। সন্দ্বীপের তীরের যে জায়গাটিতে আমাদের নৌকা নোঙর করা, সেই নদীপাড়ও স্থির। যেন নদীর বুকে পূর্ণিমার সমর্পণ দেখতে সবকিছুই সেই ভোরে ঠায় অপেৰা করছিল।
সন্দ্বীপের যে জায়গাটায় নৌকা নোঙর করা হয়েছিল, তার কোনাকুনিভাবে উত্তরে মাটি, দৰিণে পানি। গাছের ওপর দিয়ে সূর্যোদয়ের হালকা আভাষ পেলাম। আরেকদিকে পানির ওপর পূর্ণিমার চাঁদ ডুবছিল। একেই যেন বলে অপূর্ব মিলন। চাঁদ-সুরম্নজের মিলিত চেষ্টায় রাতের অাঁধার দূর করার এমন মিলিত চেষ্টা আর কবে হয়েছে, সে ইতিহাস জানার ইচ্ছে হল না। ভেবে নিলাম_ এটাই প্রথম, এটাই শেষ। আর একমাত্র সাৰী হয়ে আমি মহাসৌভাগ্যবান। পূর্ণিমার সেই জোৎস্ন্যা আর কোনোদিনও সেভাবে কুর্ণিশ হতে দেখিনি। আহ! অসাধারণ! সব কষ্ট যেন মুহূর্তে ভুলে গেলাম। সকাল হতেই নৌকার ইঞ্জিন চালু হয়ে গেল। এগিয়ে চললাম সেন্টমার্টিনের দিকে।
কিন্তু মাইটভাঙ্গা পার হওয়ার পর শাহবাজপুর নদী ও সাগরের মিলনস্থল_ হাতিয়া চ্যানেলে নদী দুপুরের দিকে হঠাৎ অশানত্দ হয়ে উঠল। এই বিসত্দীর্ণ মোহনায় চারদিকে অথৈ পানি। এখানে নদীতে সবসময় ঢেউ থাকে। ফলে প্রায়ই নৌকা পানিতে তলায়। সেদিন আমাদের নৌকাও টালমাটাল, চঞ্চু যেন আকাশ ছুঁতে চায়_ এমন আচরণ শুরম্ন করল। এটা কি প্রকৃতির ঠাট্টার কারণে মোহনার উন্মত্ততা, না কি অন্য কোনো তান্ডব_ শুরম্নতে কেউই তা বুঝতে পারলাম না। করণীয় কি, সে ব্যাপারেও কেউ নিশ্চিত নয়। তাই একেকজনের গলা আরেকজনকে ছাপিয়ে উঠতে চায়_ ‘সবাই শক্ত করে নৌকা ধরেন’ বা ‘নৌকার ছাদ থেকে নামা উচিত’ অথবা ‘ইঞ্জিন বন্ধ করবো কি?’ ইত্যাদি ইত্যাদি।
সবাই শক্ত হাতে নৌকা ধরে দাঁড়িয়ে রইলাম। কিন্তু নদীর পাগলামি বেড়ে যাওয়ায় সবাই হুড়মুড় করে জড়ো হলাম নৌকার পেছনে। কিন্তু নৌকার মাথা নাহলে পেছনদিক_ একেকবার আছড়াতে লাগল পানির ওপর। এর আগে শুধু টেলিভিশনে বা মুভিতে এরকম ঘটনা ঘটতে দেখেছি। এ ধরনের ঘটনার সঙ্গে সশরীরে পরিচয় এই প্রথম। তবে মুভির চরিত্রগুলো কিভাবে এ ধরনের পরিস্থিতি থেকে উদ্ধার পেয়েছিল, তা মনে পড়ল না। আর কোনো নৌকা থেকে যে কোনো সহায়তা পাব_ সে আশাও নেই। কারণ কাছে-পিঠে কোনো নৌকাই পাওয়া গেল না।
এ অবস্থায় কেউ কেউ লাইফজ্যাকেট গায়ে চড়ালেন। পরিস্থিতির ভয়াবহতায় অস্থির হয়ে পড়লাম। টানা ঘণ্টাখানেক উত্তাল চ্যানেলে এভাবেই নৌকা চলতে থাকল। দিকহারা ঢেউয়ের কারণে নৌকার কোর্স ধরে রাখা কঠিন হয়ে পড়ল।
নৌকা পতেঙ্গা চ্যানেলের কাছাকাছি পেঁৗছানোর পরপরই চোখে পড়ল আরেক অভাবনীয় দৃশ্য। দূর থেকেই দেখছিলাম পতেঙ্গার বহির্নোঙ্গরে থাকা গোটা পঞ্চাশেক সমুদ্রগামী জাহাজ দাঁড়িয়ে আছে। কিন্তু কাছে যেতেই বুঝলাম জাহাজগুলো দাঁড়িয়ে নয়, মিছিলের মতো করে এক সারিতে গভীর সমুদ্রে চলে যাচ্ছে। এতোগুলো জাহাজ একই সঙ্গে গভীর সমুদ্রে যাওয়ার অর্থ তখন স্পষ্ট না হলেও পরিস্থিতি যে সুবিধার নয় তা বেশ বুঝতে পারছিলাম। সবাই বলাবলি করছিলাম, যেকোনো কারণেই হোক সমুদ্রে কোনো সমস্যা হয়েছে। এজন্য এমন উত্তার ঢেউ নৌকায় আছড়ে পড়ছে এবং জাহাজ চলাচলের প্রকৃতিরও স্বাভাবিক নয়।
তবে কেন জানি মনে হচ্ছিল যে, এই অবস্থা সাময়িক। হঠাৎ হয়তো দেখব সবকিছু শানত্দ হয়ে গেছে। আলস্নাহ হয়তো সবার প্রার্থনা শুনলেন। ঢেউ শানত্দ হয়ে এলো_ ঠিক যেভাবে হঠাৎ করে শুরম্ন হয়েছিল। তখন সবাই জোশের সঙ্গে কাজে নেমে পড়লাম। নৌকা ফের পূর্ণ শক্তিতে ছেড়ে দিয়ে পেঁৗছে গেলাম পতেঙ্গা চ্যানেলে।
মন্তব্য করুন