নীলগিরির টানে
আহমেদ রিয়াজ
দূর থেকে চিম্বুকের পাহাড় দেখা যাচ্ছে। দূর থেকে দেখা যাচ্ছে চিম্বুকের টাওয়ার। কিছুক্ষণ পর আর দেখা গেল না। মেঘ গিলে ফেলেছে টাওয়ারসমেত পুরো চিম্বুক পাহাড়। যদিও আমাদের গনতব্য চিম্বুক নয়। আমাদের গনতব্য চিম্বুক থেকে আরো ২৫ কিলোমিটার দক্ষিণে কাপ্রুপাড়া। ওয়াইজংশন পেরিয়ে এসেছি বেশিক্ষণ হয়নি। বান্দরবান থেকে চিম্বুকের পথে একটা রাসতা দুভাগ হয়ে গিয়েছে। রাসতাটা দেখতে ইংরেজি ওয়াই-এর মতো বলে এর নাম ওয়াইজংশন। বাম দিকের রাসতা চলে গেছে রুমার দিকে। আর ডানদিকেরটা চিম্বুক ও থানছির পথে। ওয়াইজংশনে রয়েছে একটি আর্মি ক্যাম্প। রাসতা থেকে খানিকটা উঁচুতে ক্যাম্প। আমরা ক্যাম্পে গেলাম। ক্যাম্পের কমান্ডার আমাদের স্বাগত জানালেন। সঙ্গে ছিল আপ্যায়নের ব্যবস্থা। আমরা বলতে আমরা চার বন্ধু_ শামীম মাহমুদ রানা, সাইফুর রহমান মনু, মেজর দানিয়েল ও আহমেদ রিয়াজ।
আর্মি ক্যাম্পে থাকতে থাকতেই হুড়মুড়িয়ে বৃষ্টি নামল। পাহাড়ের বৃষ্টি নাকি এমন হুড়মুড়িয়ে নামে। এই আছে এই নেই। বৃষ্টি থামার পর আবার জিপে করে চিম্বুকের পথে। চিম্বুক থেকে আট কিলোমিটার আগে থাকতেই দেখা গেল মেঘের চাদরে হাওয়া হয়ে গিয়েছে চিম্বুক। এবার ওই মেঘকে ধাওয়া করবো আমরা। আঁকাবাঁকা পাহাড়ী পথে একটু জোরেই ছোটানো হলো গাড়ি। শহুরে জীবনে মেঘের ধাওয়া খাননি এমন মানুষ খুব কমই আছেন। এবার মেঘকেই ধাওয়া দেয়ার ইচ্ছেটা তাড়িয়ে বেড়াচ্ছে। কিন্তু বাতাসের যে গতি, মনে হচ্ছে চিম্বুকের মেঘ ধরা যাবে না। আসলেই ধরা গেল না। চিম্বুক পেরোনোর ঠিক সামান্য আগে পশ্চিম থেকে পূর্ব দিকে সরে গেছে মেঘ। পাহাড়ী পিচের রাসতায় যেতে যেতে একটা আফসোস থেকে গেল_মেঘের ভিতর দিয়ে যাওয়া হলো না। খানিক পর দেখা গেল ওই রাসতার ওপর এক খণ্ড মেঘ জমে আছে। মেঘখণ্ডটি এই এত্তটুকুন। রাসতার ওপর মেঘখণ্ড দেখেই সবাই খুশি।
কাপ্রুপাড়ার পথে ডানে বামে তাকিয়ে দেখা গেল আরো অনেক মেঘ ভেসে বেড়াচ্ছে পাহাড়গুলোর উপর দিয়ে। পাহাড়ী রাসতা যেমন হয়, কখনো উঁচু কখনো নিচু, কখনো ডানে ঘোরানো, কখনো বামে ঘোরানো। মেঘ দেখতে দেখতে পাহাড়ী রাসতা ধরে কাপ্রুপাড়া পেঁৗছাতে বেশিক্ষণ লাগল না। কাপ্রুপাড়ার নীলগিরি পাহাড়। জিপে করে নীলগিরিতে ওঠা হলো। তারপর জিপ থেকে নেমে চারপাশে তাকাতেই একটা অন্যরকম শিহরণ। আশপাশের সবচয়ে উঁচু পাহাড়ের উপর আমরা। চারপাশের পাহাড়গুলো কত নিচে! ওই তো মেঘেদের উড়ে যেতে দেখা যাচ্ছে। প্রায় মেঘের সতরের কাছাকাছি তখন আমরা। কিছু পাহাড় কালো, কিছু পাহাড় ঝলমলে। আবার কিছু পাহাড় মনে হচ্ছে কুয়াশায় ঢাকা। পাহাড়ের কত্তরূপ দেখা গেল নীলগিরি থেকে। কিন্তু পাহাড়ের এত রূপ কেন? বন্ধু বান্দরবান এসেছে আটমাস। এখানকার সবকিছু জানে। পাহাড়ের রূপের কথা জানতে চাওয়ার আগেই মনে হয় বুঝতে পেরেছে আমাদের প্রশ্ন। বলল, কালো পাহাড়গুলোর উপর কালো মেঘ আছে। উপর নিচে তাকিয়ে দেখলাম ঠিকই তো!
ঝলমলে পাহাড়ের উপর কোনো মেঘ নেই। আর কুয়াশার মতো যেসেব পাহাড়, সেগুলোতে এখন বৃষ্টি হচ্ছে।
নীলগিরিতে ঝলমলে রোদ শুরু হতে বেশি সময় লাগেনি। আমরা যখন আসি তখন কালো মেঘে ঢাকা ছিল নীলগিরির আকাশ। নীলগিরিতে দুটো কটেজ। কটেজদুটোর নামও চমৎকার। মেঘদূত আর আকাশলীনা। আমরা থাকবো আকাশলীনায়। আকাশলীনা হচ্ছে নীলগিরির পূর্ব দিকে আর মেঘদূত পশ্চিমে।
নীলগিরিতে আসার আগেই শুনেছিলাম এখানে মোবাইলের নেটওয়ার্ক পাওয়া যায়। বান্দরবানে মোবাইলের কোনো নেটওয়ার্ক নেই। এক ওয়াইজংশনে কিছুটা নেটওয়ার্ক পাওয়া গিয়েছিল। তবে কথা বার্তা স্পষ্ট শোনা যায়নি। কেমন ভাঙা ভাঙা ছিল। নীলগিরিতে নাকি পুরো নেটওয়ার্ক পাওয়া যায়। পকেট থেকে মোবাইল বের করে দেখলাম। কথাটা পুরোপুরি মিথ্যে মনে হলো। কারণ নেটওয়ার্কের কোনো ছিঁটেফোটাও দেখা গেল না। কথাটা জানাতেই দানিয়েল বলল, নীলগিরির সবজায়গায় তো নেটওয়ার্ক নেই। নেটওয়ার্ক আছে কেবল ওখানে।
ওখানে বলতে যে জায়গাটা দেখানো হলো সেটা হচ্ছে আকাশলীনার পশ্চিমপাশের মাঝখানের দেয়াল। ওখানেই গিয়ে দেখা গেল আসলেই সত্যি। মোবাইল সেটের নেটওয়ার্ক রেখাটা পুরো জায়গা দখল করে আছে। ওখান থেকে দুপা সামনে পিছনে বা ডানে বামে সরলেও নেটওয়ার্ক হাওয়া। রহস্যময় নেটওয়ার্কের জায়গায় দাঁড়িয়ে মোবাইলাপ সারলাম আমরা একে একে। ঢাকা ছেড়েছি দুদিন হয়। বান্দরবানে ঢোকার পর থেকে যোগাযোগ নেই কারো সঙ্গে। এবার ভালো মতো যোগাযোগ হলো।
একটু পরেই সূর্য ডুবে যাবে। সূর্যের ঠিক নিচে কিছু জায়গা চিক চিক করছে। মনে হচ্ছে ওখানে কোনো জলরাশি। কিন্তু সাঙ্গু নদীতো নীলগিরির পূর্ব দিক দিয়ে গিয়েছে। তাহলে?
একবার মনে হলো সাদা মেঘে উপর সূর্যের আলো পড়ে এমন চিক চিক করছে। এটাই ভেবে নিয়েছি। কিন্তু যতই হেলছে ততই একটা জলরাশির রেখা ফুটে উঠতে লাগল। এবং জানা গেল আসলে ওটা মেঘের উপর সূর্যের আলো প্রতিফলন নয়। ওটাই বঙ্গোপসাগর। এত দূর থেকেও দেখা যায় সাগর! দেখা তো যাবেই। সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে আড়াইহাজার ফুট উঁচু নীলগিরি। আর আমরা তখন নীলগিরির একেবারে উপরে_আকাশলীনার সামনে। নীলগিরির যেখানেই শেষ বিকেলের আলো পড়ছে, সেটাই সোনালি হয়ে গেল। ধীরে ধীরে সোনালি রঙ ফ্যাকাশে হয়ে গেল। একসময় অসত গেল সূর্য। নীলগিরি থেকে সূর্যাসত_অপূর্ব। সূর্য ডোবার অনেকক্ষণ পরেও আকাশের বেশ অনেক জায়গা রক্তিম আভা ছড়িয়ে রাখল।
সন্ধের পর রাত নামল ঝুপ করে। যতই অন্ধকার হতে লাগল, ততই আকাশে ফুটতে শুরু করল তারার ফুল। রাতের খাবারের ব্যবস্থা মুরগির বারবিকিউ আর পরোটা। বান্দরবান থেকেই দুটো মুরগি আনা হয়েছিল মশলা মাখিয়ে। সঙ্গে কয়লাও আনা হয়েছে।
রাতের খাবারের পর নীলগিরির উপর চেয়ার পেতে বসলাম সবাই। রাত বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে অন্ধকারও বাড়তে লাগল সেই সঙ্গে। সে রাতে আকাশে চাঁদ ছিল না। অমাবস্যার রাত। আকাশে তারারা যেন ঘেঁষাঘেষি করে আছে। এত তারা! ঢাকার আকাশে এত তারা দেখা যায় না। দেখা যায় না সাগর পাড়ের আকাশেও। আকাশের সঙ্গে নীলগিরির দূরত্ব সমতল থেকে আড়াইহাজার ফুট কম বলেই হয়ত এত তারা চোখে পড়েছে। খানিকপর একটা দুটো করে তারা উড়তে শুরু করল আমাদের চারপাশে। কিছু তারা যেমন মিট মিট করে জ্বলে, ঠিক তেমনি মিটমিট করে এই তারারা উড়তে লাগল আমাদের চারপাশে। আসলে এগুলো কিন্তু তারা নয়, এগুলো জোনাক পোকা। মনে হচ্ছে আকাশে যেসব তারা ঠাই পায়নি, সেগুলোই জোনাক পোকা হয়ে উড়ছে নীলগিরির উপর। আবার কখনো এত তারা দেখে মনে হয়েছে তারার সিঁড়ি বেয়ে হয়ত আমরা চলে যেতে পারবো তারার দেশে। নীলগিরির অপার সৌন্দর্য এতটাই কল্পনার জন্ম দিয়েছে।
এরমধ্যেই আমাদের বেশ ঠাণ্ডা লাগতে শুরু করেছে। ভাবছি কটেজের ভিতরে চলে যাবো। কিন্তু কটেজের ভিতরে গেলে তো নীলগিরির রাতের সৌন্দর্য দেখা হবে না। উপায়? চারজনের জন্য চারটা উইন্টার জ্যাকেটের ব্যবস্থা করা হলো। উইন্টার জ্যাকেট পরে আমরা বসে রইলাম আকাশের কাছাকাছি। আকাশ দেখতে লাগলাম। আকাশকে এতটা আপন আর কখনো মনে হয়নি। পূর্ণিমা থাকলে না জানি কেমন লাগত! আশপাশের পাহাড়ের সৌন্দর্য ধরা পড়ত অন্যরূপে।
মধ্যরাত পেরিয়ে গেছে অনেকআগেই। আগামীকাল বাংলাদেশ ভারতের প্রথম একদিনের ম্যাচ। বিশ্বকাপের পর ভারতের প্রথম বাংলাদেশ সফর। খেলা দেখতে হবে। তাই সকাল সকাল উঠতে হবে। কাজেই ঘুমতে চলে গেলাম সবাই।
নীলগিরিতে বিদু্যৎ নেই। প্রতিদিন দুঘণ্টা করে জেনারেটর ছাড়া হয়। আর জেনারেটর বন্ধ হয়ে গেলে সৌর বিদু্যতে বাতি জ্বলে। বাথরুম আর শোবার ঘরে সৌরবাতি জ্বলে।
অনেক রাতে ঘুমনোর জন্য ভোরে উঠতে পারিনি। সূর্য তখন বেশ তেতে উঠেছে। গরম পড়তে শুরু করেছে। কে বলবে গতরাতে লেপ গায়ে জড়িয়ে ঘুমতে হয়েছে!
সকালের নাসতা খেতে খেতেই বাংলাদেশের খেলা শুরু হয়ে গেল। নাসতা খেয়ে আমরা এবার গেলাম কাপ্রুপাড়ায়। এখানে মুরংদের বাস। উদ্দেশ্য মুরংদের গ্রাম দেখা আর ওদের পানির উৎস দেখা। মূল রাসতা থেকে প্রায় ৬০০ ফুট নিচ থেকে পানি নেয় মুরংরা। পাহাড়ী হাঁটা পথে নামতে সময় লেগেছে আধাঘণ্টার মতো। কিন্তু পানির উৎস দেখে মনটা দমে গেল। ছোট্ট একটু জায়গা। পাহাড়ী পাথর চুয়ে চুয়ে পানি এসে জমা হয় ওখানে। এই পানিই মুরংরা নিত্যকাজে ব্যবহার করে, পান করে। আমাদের সঙ্গে ছিলেন মুরং নেতা লঙ্কান। লঙ্কানের কাছেই জানা গেল তারা স্নান সারেন দুতিন দিন পর পর। আর পান করার জন্য যেটকুই পানিই দরকার, তা-ও এই উৎস থেকে নিতে হয়। এটিকে ওরা বলে ছড়া।
নিচে নেমে হাঁপিয়ে উঠেছি সবাই। হাঁপাননি কেবল লঙ্কান আর আমাদের সঙ্গে আসা সেনাবাহিনীর সদস্যরা। ওদের অভ্যাস আছে। পানির ছড়া দেখার পর এবার ওঠার পালা। লঙ্কান তর তর করে উঠে যাচ্ছেন। সেনাবাহিনীর সদস্যরাও উঠে যাচ্ছেন। আমরাও ওদের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে উঠতে গিয়ে বুঝতে পারলাম, নামাটা যত সহজ ছিল, ওঠা অতোটা সহজ হবে না।
সত্যি অতো সহজ হয়নি উপরে ওঠা। পাঁচ মিনিট উপরে উঠে দশ মিনিট জিরিয়ে নেই। যতই উপরে উঠতে থাকি ততই বুক ধড়ফড় করতে থাকে। উপরে তাকিয়ে দেখার চেষ্টা করি, আর কতখানি উঠতে হবে। একসময় মনে হয়, কখনো বুঝি উপরে উঠতেই পারবো না। উপরে উঠার কষ্টটা সেদিন দমে দমে বুঝেছি।
এর মধ্যেই কাপ্রুপাড়ার আকাশে কালো মেঘ জমেছে। লঙ্কান আকাশের দক্ষিণ দিকে তাকায় আর আমাদের দিকে তাকায়। একসময় আমাদের দিকে তাকানো বন্ধ করে এক দৌড়ে চলে যায় উপরে। উপরে উঠতে আরেকটু বাকি। এর মধ্যেই ঝম ঝম করে বৃষ্টি শুরু হলো। বৃষ্টি মাথায় নিয়েই উঠে বসলাম জিপে। মুরংদের পাড়ায় আর যাওয়া হলো না।
আবার নীরগিরিতে। টিভি ছেড়ে বাংলাদেশের ব্যাটিং দেখা। বাংলাদেশ যে টার্গেট দিয়েছে তাতে সবাই সন্তুষ্ট। গোসল সেরে দুপুরের খাবার সারা হলো। এবার ফেরার পালা। নীলগিরির কটেজ বুকিং দেয়া ছিল এক রাতের জন্য। সন্ধের আগেই ফিরতে হবে বান্দরবান। সন্ধের পর পাহাড়ী পথে যে কোনো যানবাহন চলাচল নিষিদ্ধ। বান্দরবান পৌঁছতে সময় লাগবে দুই-আড়াই ঘণ্টা। ভারতের ব্যাটিং দেখতে দেখতেই চলল ফেরার প্রস্তুতি। এর মধ্যেই চোখ বুলিয়ে নিলাম একটা বাঁধানো বইয়ের দিকে। আমার কৌতূহল কেড়ে নিয়েছে বইটি। পরিদর্শন বই। যারা নীলগিরি ঘুরতে আসেন তারা এই পরিদর্শন বইতে নিজেদের অভিজ্ঞতা আর স্মৃতিকথা লিখতে পারেন। পরিদর্শন বই ঘাটতে ঘাটতে কিছু চমৎকার মনতব্য পড়লাম। যেমন চট্টগ্রামের শুকরিয়া জসিম লিখেছেন_গতরাতটি ছিল চাঁদনি রাত। এখানে এসে চাঁদনিরাত পাওয়াও ভাগ্যের ব্যাপার। আমার কল্পনাকে ছাড়িয়ে গেছে নীলগিরির সৌন্দর্য। অপূর্ব, অভিভূত, বিমোহিত আমার স্মৃতিতে ভেসে বেড়াবে এর অপার সৌন্দর্যের মহিমা।
ক্যাপ্টেন মোহাম্মদ মোহসেনুল হক চৌরুরী লিখেছেন_জীবনের খুব ছোট্ট ছোট্ট সখের একটি ছিল মুক্তাকে নিয়ে নীলগিরি দেখার। অনেক বাধা পেরিয়ে, কষ্ট করে, কষ্ট সহ্য করে নীলগিরি এসে আমি মুগ্ধ।
মেজর এফ এম জসিমউদ্দিন তার অনুভূতি জানিয়েছেন এভাবে_ বান্দরবান এসেছিলাম রিক্রটমেন্টে। পরপর ২দিন সরকারি ছুটি হওয়াতে সপরিবারে চলে এলাম কাপ্রুপাড়া নীলগিরি হিল রিসোর্টে। যদিও এর সঙ্গে জড়িত ছিলাম নির্মাণের শুরুতেই। প্রাকৃতিক এই সৌন্দর্য দেখে মনে হলো এখানে না এলে পৃথিবীর অনেক কিছু থেকেই বঞ্চিত হতাম।
মেজর এস এম মনিরুজ্জামন লিখেছেন_ নীলগিরিতে পা দেবার কিছুক্ষণের মধ্যেই আমার স্ত্রীর প্রশ্ন হলো-এ রকম পাহাড় কি কিনতে পাওয়া যায়? একটা মেঘদূত তৈরি করে সারাজীবন সেখানে কাটিয়ে দেবার পরিকল্পনা এঁটে ফেলল সে। পাহাড় কেনার দুঃসাহসিক চিনতা না করলেও আমার কাছেও মনে হচ্ছিল সারাজীবন এমন জায়গায় কাটিয়ে দেবার পরিকল্পনা নেহাৎ মন্দ না…
ক্যাপ্টেন এনামের বন্ধু হিসেবে নীলগিরিতে এসেছিলেন ডাক্তার মিজানুর রহমান কলেস্নাল। মার্চের ৩০ তারিখে লেখা তার মনতব্য_ একদিন বড় সাধ ছিল আমার আকাশ ছুঁয়ে দেখার। স্বপ্নেও ভাবিনি নীলগিরি এসে আমি সেই আকাশ ছুঁতে পারব। একজীবনে মানুষের সবকিছু দেখা শেষ হয় না। তবু মনে হলো আমার আর অন্যজীবনের প্রয়োজন নেই। এখানে এসে আমি এই জীবনের সবকিছু দেখেছি।
আর বিয়ের পর নীলগিরিতে হানিমুনে এসেছিলেন যুক্তরাজ্য প্রবাসী কামরুল হাসান টিটু ও রোকসানা খান লোপা। নীলগিরির সৌন্দর্যে তারাও মুগ্ধ। বাংলাদেশেই এমন একটি চমৎকার জায়গা আছে, এখানে না এলে তাদের জানাই হতো না।
ডাঃ সামিয়া ছড়া নীলগিরির সৌন্দর্যে মুগ্ধ হয়ে পরিচিত সবাইকে নাকি আহ্বান জানাবেন এর সৌন্দর্য উপভোগ করার জন্য।
নীলগিরি থেকে ফেরার ঠিক আগে চারপাশে ভালোমতো আরেকবার চোখ বোলাতে ইচ্ছে হলো। কালো মেঘ হানা দিয়েছে নীলগিরিতে। যে কোনো সময় আবার বৃষ্টি শুরু হয়ে যেতে পারে। এদিকে আবার সন্ধের আগেই ফিরতে হবে বান্দরবান। জিপে চড়ে বসলাম সবাই। নীলগিরি বেয়ে জিপটা যখন পাহাড়ের অনেক নিচে নেমে এল, তাকালাম। কত উঁচু নীলগিরি। ওই তো অনেক দূরে দেখা যাচ্ছে কটেজ। অবাক হলাম ওই পাহাড়ের উপর ছিলাম আমরা! ভাবতেই অবাক লাগল।
সাগর নাকি মানুষকে টানে। তাই প্রতি বছর বেশিরভাগ মানুষ সাগরপাড়ে চলে যান সাগরের টানে। একবার গেলে বারবার যেতে চান। কেবল সাগর নয়, পাহাড়ও মানুষকে টানতে পারে। পাহাড়রাজ্য থেকে ঘুরে এলেই বুঝতে পারা যায়, পাহাড়ও মানুষকে কেমন করে টানে। নীলগিরি যে কাউকে টানবে। শুধু যে নীলগিরি নয়, আপনি যদি সৌন্দর্য পিপাসু মানুষ হয়ে থাকেন তাহলে বাংলার বর্ষার রূপে অবগাহনের জন্য যে কোনো পাহাড় আপনাকে টানবে। বান্দরবানের পাহাড় হলে তো কথাই নেই। আর যদি হয় নীলগিরি, তাহলে…
পাহাড়ের সৌন্দর্য অন্যরকম। কোনো পাহাড় উঁচু, কোনো পাহাড় নিচু। তবে পাহাড়ে ঘুরতে যাওয়ার উপযুক্ত সময় এই বর্ষাকাল। বর্ষায় পাহাড় সে অপার রূপ মেলে ধরে, আর কোনো ঋতুতে পাহাড়ের এই রূপ এতটা প্রস্ফুটিত হয়না। মেঘের সঙ্গে, বৃষ্টির সঙ্গে মিতালি পাতিয়ে চলে পাহাড়ের রূপের ডালি খেলা। বান্দরবানের পাহাড়ে যাওয়ার ঝক্কি ঝামেলা খুব একটা নেই। ঢাকা থেকে বান্দরবান যাওয়ার সরাসরি বাস আছে। সৌদিয়া সমপ্রতি এসি বাস সার্ভিস চালু করেছে। এস আলমের বাস তো আছেই। তবে একটু মজা করে যেতে চাইলে ট্রেনে চট্টগ্রাম, ওখান থেকে বান্দরবানের বাস অহরহ। কেবল রাত ছাড়া।
থাকার মতো পর্যটনের রেস্টহাউজ আছে বান্দরবান শহরের দুতিন কিলোমিটার আগেই। বান্দরবান শহরেও আছে থাকার মতো জায়গা। তবে পাহাড়ের কোলে মাথা রেখে বৃষ্টি ও বর্ষার মেঘ দেখার জন্য দারুণ জায়গা মিলনছড়ির হিলসাইড রিসোর্ট। চিম্বুকের পথে বান্দরবান শহর থেকে চার কিলোমিটার দূরে মিলনছড়িতে রয়েছে এই রিসোর্ট। এখানে থাকার জন্য রয়েছে বাঁশের তৈরি ঘর। আর রিসোর্টের যে রেসতোরা সেখান থেকে উত্তরদিকে তাকালে দেখা যাবে কেবল পাহাড় আর পাহাড়। পশ্চিমে তাকালে দেখা যাবে টাইগার হিল। নীলগিরি যাওয়ার সৌভাগ্য যাদের হয়না, তারা টাইগির হিলে গিয়ে দুধের স্বাদ ঘোলে মেটাতে পারেন। বান্দরবানে ঘুরতে হলে জিপের কোনো বিকল্প নেই। এছাড়া স্থানীয়রা চলাচল করে চান্দের গাড়িতে। চান্দের গাড়িতে চলাচলে অনেক সময় অপচয় হয়। আট-দশজন মিলে গেলে হিলসাইড রিসোর্ট থেকেই প্রতিদিনের জন্য জিপ ভাড়া নিলেই লাভ। খরচ একটু বেশি পড়লেও, পাহাড়ের সৌন্দর্য বাড়তি খরচ পুষিয়ে দেবে। জিপে করে দুদিন ঘুরলেই দেখা হয়ে যাবে বান্দরবানের পাহাড়ের সৌন্দর্য।
বান্দরবানে ঘোরার মতো অনেক জায়গা আছে। জায়গাগুলোর নামই আপনাকে টানবে। চিম্বুক, বেতছড়া, রাইক্ষংছড়া, মিলনছড়া, টংকাবতী, থানছি, রুমা, মেঘলা, শৈলপ্রপাত, কাপ্রুপাড়া…
আর আছে সাঙ্গু নদী। পুরো বান্দরবানে পাহাড়ের ভিতর দিয়ে পথ করে এঁকেবেকে চলেছে এই পাহাড়ী নদী। বান্দরবান শহরে দেখা পাবেন সাঙ্গু নদীর। তারপর ঘুরতে গেলেন বান্দরবান শহরে থেকে ৫০ কিলোমিটার দূরে কাপ্রুপাড়ায়, সেখানেও দেখা পাবেন এই পাহাড়ী নদীর। পাহাড়ী নদীর পাড় ঘেঁষে হাঁটার অনুভূতি অন্যরকম। এর সঙ্গে মেলানো যায় না আর দশটা সমতলের নদীর সঙ্গে। বৃষ্টির সময় পাহাড় থেকে নেমে আসা পানি প্রবাহ ঝরণার মতো ঝরে পড়ার দৃশ্য দেখা যায় শৈলপ্রপাতে। বমদের গ্রামে গিয়ে তাদের জীবনযাত্রাও দেখা যাবে শৈলপ্রপাতের ফারুক পাড়ায়। আদিবাসী ত্রিপুরাদের জীবনযাত্রার দেখা মিলবে হাতিয়াবান্ধায়। বান্দরবান শহরের আশপাশের এই দর্শনীয় জায়গাগুলো দেখার পর একটু দূর থেকে বেড়িয়ে আসা যায়। চিম্বুক। নামটাই যেন টানে। চিম্বুকে দেখা পাওয়া যাবে মুরংদের জীবনযাত্রা। জানা যাবে মুরংদের অনেক ইতিহাস আর ঐতিহ্য সম্পর্কে। চিম্বুক থেকে এরপর থানছি। আর রুমা যেতে হলে ফিরে আসতে হবে সেই ওয়াইজংশনে। এবার বামদিকের রাসতা ধরে রুমা। রুমা থেকে নৌকায় আবার ফিরে আসা যায় বান্দরবান শহরে। পথে দেখতে দেখতে আসা যায় পাহাড়ী নদীর সৌন্দর্য। পাহাড় আর জলরাশির এমন সৌন্দর্য বান্দরবান ছাড়া আর কোথায়? বান্দরবানে মশা থেকে সাবধান থাকতে হয় সব সময়। অডোভাস নামক ক্রিম মেখে নিলে ভালো। আর কামড়ানোর জন্য মশা যেহেতু পা বেছে নেয় তাই পায়ে সবসময় মোটা মোজা পরে থাকতে হয়। কোনোভাবেই মশা বসতে দেয়া যাবে না গায়ে। কারণ বান্দরবানে মশার কামড় খেলে ম্যালেরিয়া হওয়ার একটা ভয় থেকেই যায়। এমন কী নীলগিরির মতো অতি উঁচু পাহাড়েও মশা কামড়ে দিতে পারে। বেশি সাবধান থাকতে হয় সূর্যোদয় আর সূর্যাসতের সময়।
বান্দরবানে এখন আর শানতিবাহিনীর ভয় নেই। শানতি চুক্তির কারণে বেশ শানত হয়ে গিয়েছে বান্দরবান। তবু বান্দরবানে ঢোকার আগে কয়েকটা চেকপোস্ট ডিঙোতে হয়। এটা নিরাপত্তার জন্যই। কারণ নিরাপত্তাহীনতায় পরিপূর্ণ সৌন্দর্য উপভোগ করা যায় না। ভয়শূন্যই চিত্তই পারে যে কাউকে সৌন্দর্যের পুরো রসাস্বাদন করাতে।
ছবির ক্যাপশন
১. নীলগিরির পথে আমরা চারজন (বাঁ থেকে)_ রানা, দানিয়েল, আহমেদ রিয়াজ, সাইফুল।
২. আকাশে মেঘের ঘনঘটা, ঢেকে আছে চিম্বুক।
৩. বান্দরবানে এমন আলোছায়ার খেলা দেখা যায়
৪. পাহাড়ে জুম চাষ
৫. নীলগিরির পথে, দূরের ওই পাহাড়টাই নীলগিরি
৬. নীলগিরির উপরে আকাশলীনার বারান্দায়
৭. নীলগিরির দুটো গেস্টহাউস_ আকাশলীনা ও মেঘদূত
৮. অপরূপ সাঙ্গু নদী
৯. দানিয়েলের ক্যামেরায় আমরা তিন বন্ধু
১০. অবাক হয়ে তাকিয়ে থাকা- মেঘ না কুয়াশা!
১১. জুমচাষে ব্যসত্দ মুরংরা
১২. জুমচাষ
১৩. জুমচাষ
১৪. বিকেলের সোনারোদের আলোয় নীলগিরিতে
১৫. বিকেলের সোনারোদের আলোয় নীলগিরিতে-২
১৬. রাতে বারবিকিউ’র আয়োজন
১৭. মে মাসের প্রচণ্ড গরমেও নীলগিরিতে রাতে বেশ ঠাণ্ডা
১৮. নীলগিরি থেকে এমনই দেখা যায় আশপাশ
১৯. কাপ্রম্নপাড়ায় মুরংদের পানির উৎস দেখতে যাওয়ার সময়
২০. শৈলপ্রপাতের ঝর্ণা
ঠিকানা :
১. আহমেদ রিয়াজ
বাসা-২৯, রোড-২৫
পঞ্চম তলা (পশ্চিম পাশ)
রূপনগর আবাসিক এলাকা
পলস্নবী, মিরপুর, ঢাকা-১২১৬
২. আহমেদ রিয়াজ
সাব-এডিটর, দৈনিক নয়াদিগনত্দ
১৬৭/২-ই, ইনার সাকর্ুলার রোড ইডেন কমপেস্নঙ্
মতিঝিল, ঢাকা-১০০০
মোবাইল : ০১৬ ৭০১৯৯০৮০
মন্তব্য করুন