অদেখা এক বনের পথে
মোকারম হোসেন
কোথাও বেড়াতে যাবার নিমন্ত্রণ উপেক্ষা করা কঠিন। কিন্তু আয়োজক সংস্থার কর্ণধার মশহুরুল আমিন মিলনের ভ্রমণ প্রস্তুতি ব্রীফ শুনে অনেকেই ভয়ে কেটেপড়ার কথা ভাবছিলেন। কারণ পাবলাখালী অভয়ারণ্যে নাকি হাতির উৎপাত আছে। সবশেষে তিনি আসল কথাটা পাড়লেন। সেই বনের ভেতর নাকি একটা রাতও কাটাতে হবে সবাইকে। আ্যডভেঞ্চার ট্যুর বলে কথা। সবার সঙ্গে আমিও সাহস সঞ্চয় করে বসে থাকলাম। শেষমেষ যাবার সিদ্ধান্ত হলো। রাঙামাটি জেলার মাইনি উপজেলায় অবস্থিত দেশের দ্বিতীয় বৃহত্তম অভয়ারণ্যে নতুন বছরের প্রথম সূর্য দেখতে যাব আমরা। ৩০ ডিসেম্বর রাতে গাড়িতে উঠতে গিয়ে দেখি এলাহি কান্ড। ১৩০ জনের একটা দল। নানান পথ, নানান মতের মানুষ। একদল সংবাদকর্মীও আছেন। চারচারটে গাড়ি দাঁড়িয়ে। সমস্ত কিছুই গোছাল। নওরোজ ইমতিয়াজ, মুসা ইব্রাহিম আর মশহুরুল আমিন মিলনকে ছুটোছুটি করতে দেখা গেল। আমার আগেই কথাশিল্পী ও নিসর্গী বিপ্রদাশ বড়ুয়া চলে এসেছেন। ১১টা ৪০ মিনিটে রাতের নিস্তব্ধতা ভেঙে রাঙামাটির উদ্দেশ্যে আমাদের যাত্রা শুরু হলো।
রাতভর কুয়াশার লুকোচুরি। পথের ওপরই যেন তাদের ঘরবাড়ি। আমাদের গাড়ি হঠাৎ করেই সেসব ঘরের ভেতর ঢুকে পড়ছে। তারপর আবার মুক্ত পথে। এভাবেই মধ্যরাত গড়িয়ে এলো। কুয়াশার চাদর যেন আদরমেখে আছে চারপাশে। কি মনে করে হঠাৎ থামল গাড়িটা। নষ্টটষ্ট হলো নাতো! বাইরে উঁকি দিয়ে বুঝলাম এখন চা বিরতি। অন্য গাড়িগুলোও এসে দাঁড়াচ্ছে। এটাও একটা চমক। জানতাম একছুটে একেবারেই চট্টগ্রাম। সবাই ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র দলে বিভক্ত হয়ে চা-গল্পে মেতে উঠল। অবশ্য বেশিক্ষণ এই গল্প চলল না, হ্যামিলনের বাঁশিঅলার (বাস) দিকে ছুটতে হলো।
পরিবেশ-প্রকৃতির নানান প্রসঙ্গে আমাদের নির্ঘুম রাত কাটল। ভোরের আলো ফোটার আগেই আমাদের গাড়ি চট্টগ্রাম শহর অতিক্রম করল। কুয়াশামোড়ানো ভোরে রাঙামাটি শহরের হোটেল সুফিয়াতে গাড়ি থামল। হোটেলে ঢুকে দেখি সবকিছু প্রথম গাড়ির বন্ধুদের দখলে। বাথরুমের সামনে দীর্ঘ লাইন। যেন টিকিট কেটে সবাই গাড়িতে ওঠার জন্য অপেক্ষা করছে। এটাই বাস্তবতা। সবার জন্যতো আর একটা একটা বাথরুম থাকবে না। বিপ্রদাশ বড়ুয়া আমার আগে আগেই নাস্তার টেবিলে এসে বসলেন। নাস্তা সেরে ফিশারি ঘাটে অপেক্ষমান কেয়ারি কর্ণফুলিতে চেপে শুরু হলো আমাদের চমকপ্রদ ভ্রমণ। বার কয়েক ভ্রমণের সুবাদে দু’পাশের প্রায় সব দৃশ্য আমার মুখস্ত। এই অঞ্চলের সবছিুই বিপ্রদার নখদর্পণে। পাহাড়গুলোতে কোন কোন জাতের গাছ থাকে, কোন কোন জাতের প্রাণী থাকে। মানুষের নির্মমতায় যেসব প্রাণী ইতোমধ্যেই বিলুপ্ত হয়ে পড়েছে তাদের কথাও জানা গেল। প্রসঙ্গত তিনি হাতির গল্পও বললেন। আমরা যেখানে যাচ্ছি সেখানে প্রায়শই হাতির দেখা মিলে। এসব বন্যহাতিরা যথার্থই বিপদজনক।
লঞ্চ ছাড়ার কিছুক্ষণের মধ্যেই এই দ্বিতল জলজানে উৎসব আমেজ ছড়িয়ে পড়ল। ক্রমেই দুর্গম হয়ে উঠছে পাহাড়। কোথাও খাড়া পাহাড়, কোথাও ঘনজঙ্গল, কোথাও পাহাড়ের গায়ে সময়ের বলিরেখা স্পস্ট। শাখামৃগ বানরের দল নেমে এসেছে লেকের কিনারে। এখানে তাদের বিরক্ত করার কেউ নেই। তারপর চোখে পড়ল শীতের হতশ্রী সুবলং ঝরনা। নানান কৃত্রিম স্থাপনায় এখানকার প্রাকৃতিক সৌন্দর্য বিঘি্নত হয়েছে। তারপর সুবলং বাজার। কাছাকাছি দূরত্বে পেদা তিং তিংয়ে পেটপুরে খাবার ব্যবস্থা। এদিকের পাহাড়গুলো ন্যাড়া। এরই ফাঁকে নওরোজ ইমতিয়াজের সঞ্চলনায় শুরু হলো আলোচনা পর্ব । মুসা ইব্রাহিম জানালেন অ্যাডভেঞ্চার আর পাহাড়ে ঘোরার গল্প ও করণীয়, বিপ্রদাশ বড়ুয়া বললেন এখানকার আদি ইতিহাস, জীববৈচিত্র আর প্রাকৃতিক সৌন্দর্য নিয়ে। আমি বললাম ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতার কথা। বিশ বছরের ব্যবধানে এখানে বদলে গেছে অনেক কিছুই। কিন্তু ততক্ষণে সবার চোখ দু’পাশের অপার সৌন্দর্যের কোলে সমর্পিত। জলচর পাখিদের সঙ্গে শীতের অতিথি পাখিরাও নেমেছে। কোথাও কোথাও পাহাড় অনেক দূরে সরে যাচ্ছে। মাঝে মাঝে পণ্যবাহী ট্রলার পাশকাটিয়ে চলে যায়। কিছু কিছু টিলা বিচ্ছিন্ন, দ্বীপের মতো। এমন কয়েকটি বাজারও চোখে পড়ল। সংখ্যায় আদিবাসীরা কম। বাসস্থান হারিয়ে তারা আরো গভীর পাহাড়ে ঠাঁই নিয়েছে। কাপ্তাই বাঁধের কারণে সরু নদীর পানি ফুলেফেঁপে লেকে পরিনত হয়েছে। তাতে এখানকার জীববৈচিত্রও মারাত্দক ক্ষতির সম্মুখীন হয়েছে। পৌষের সোনারোদ, পাহাড়, অরণ্য আর নীল জলরাশির মোহ সবাইকে যেন আচ্ছন্ন করে রাখল। এদিকে দুপুর গড়িয়ে এলো। তবুও ক্লান্তিহীন চোখ।
দুপুর আড়াইটার দিকে আমরা মাইনিমুখ বাজার পেঁৗছালাম। ছোট হোটেল, দুই পর্বে সারল খাবার। তারপর পাশ্ববর্তী রাবেতার কলেজের উদ্দেশ্য লঞ্চ মুখ ঘোরালো। সেখানেই আমাদের রাত যাপনের ব্যবস্থা। নিরাপত্তা ও বিবিধ কারণে পাবলাখালীতে রাতযাপনের সিদ্ধান্ত বাতিল। এতে ৪০ ভাগ অ্যাডভেঞ্চার কমে গেল। ব্যাগ-বোচকা রেখে সবাই ছড়িয়ে পড়লেও সুতার টানে আবার ৭টার দিকে লাগোয়া হ্যালিপ্যাড চত্বরে ফিরে এলো সবাই। কেউ কেউ ছুটলেন বছরের শেষ সূর্যকে বিদায় জানাতে। সেখানে পরিচয় পর্বের পর একজন সেনাকর্মকর্তা সবাইকে প্রয়োজনীয় পরামর্শ দিলেন। কলেজের মাঠেই রাতের রান্নার আয়োজন। ওদিকে প্রথম প্রহরের প্রস্তুতি। দলে দলে ভাগ হয়ে বসল সবাই। রঙিন কাগজ, সরা আর মোমবাতির সমন্বয়। একফাঁকে রাতের খাবারটা সেরে ফেলল সবাই। তারপর মধ্যরাতের আগেই সবাই লেকের ধারে জড়ো হলাম। সবার বয়েআনা মঙ্গল প্রদীপগুলো লেকের পানিতে ভাসিয়ে দেওয়া হলো। জিরো আওয়ারে রাতের আকাশ উজ্জ্বল করে জ্বলল ফ্লেয়ার। আর তখনি সবার হর্ষধ্বনি। তারপর আকাশে উড়ল ফানুস। প্রথম প্রহরের এই অনুষ্ঠানে যোগদিতে সপরিবারে এলেন মাইনির ২৫ বেঙ্গল রেজিমেন্টের জোন কমান্ডার লে. কর্ণেল মুস্তাফিজ। প্রথম প্রহরকে বরণ করার আনুষ্ঠানিকতা চলল অনেকক্ষণ। মধ্যরাতের এমন উৎসব এখানকার মানুষ কি আর কখনো দেখেছে।
এবার ঘুমোতে যাবার পালা। তাও মাত্র দু’ঘন্টার জন্য। রাত চারটায় আবার কেয়ারি কর্ণফুলির যাত্রা। উদ্দেশ্য পাবলাখালীতে গিয়েই বছরের নতুন সূর্যকে দেখা। কিন্তু আমাদের আশা নিরাশায় পরিনত হলো। ঘনকুয়াশায় যাত্রা স্থগিত। লেকের পানিতে কনকনে শীতের ভেতর সবার কাঁপাকাঁপি অবস্থা। অবশেষে ভোর ছয়টার দিকে লঞ্চ ছাড়ল। সেনাবাহিনীর একটি দলও আমাদের সঙ্গে ইঞ্জিন নৌকা নিয়ে চলল। অসংখ্য ডুবোচরে পথ হারিয়ে পাবলাখালী পেঁৗছুতে প্রায় দু’ঘন্টা সময় লাগল। তখনো দেখা নেই সূর্যদেবের। এই অরণ্যের রেস্টহাউস ‘বনসখীতে’ সকালের নাস্তার ব্যবস্থা। কিন্তু যে রসুই ঘরে তৈরি হলো আমাদের নাস্তা সে রসুইঘর নাকি কিছুদিন আগে বন্যহাতির দল গুড়িয়ে দিয়েছিল। এমন খবর শোনার পর সবার চেহারায় ফের আতঙ্কের ছাপ। রেস্ট হাউসের অদূরে গাছের ডালে বানর দেখে সেই আতঙ্ক আরো বদ্ধমূল হলো।
এবার বনে ঘোরাঘুরির পালা। কেউ কেউ থেকে গেলেন সূর্য বানাতে। আমরা চললাম বন দেখতে। বিচিত্র পাখির ডাক শোনা যাচ্ছে। ইতোমধ্যেই অনেক গাছ চোখে পড়েছে। চুন্দুল, কনকচূড়া, পাদাউক, আদি কাঁটা মেহেদী, আদি জারুল, শীলকড়ই, চাপালিশ, কাজুবাদাম, সেগুন ইত্যাদি। তারপর কিছু গর্জন, মুচকুন্দ, গুলগুলি লতা, শিমূল, নাগেশ্বর। অগভীর বনে এত অল্পকিছু দেখে মন ভরল না। নিরাপত্তার খাতিরে বেশি নিবিড়তায়ও যাওয়া গেল না। এখান থেকে মাত্র ৮/১০ কিমি. দূরে ভারতের মিজোরাম বর্ডার।
৪২ হাজার ৮৭ হেক্টর আয়তনের এই বনে আরো আছে রেসাস বানর, মুখপোড়া হনুমান, উল্লুক, বন্য শূকর, বনবিড়াল, উদবিড়াল আর বিচিত্র পাখি। হাতি আর বানর মোটামুটি সহজলভ্য। কিছুক্ষণের মধ্যেই আমরা রেস্টহাউজে ফিরে এলাম। বন্ধুদের প্রচেষ্টায় তৈরি হলো এক ঝলমলে সূর্য। তারপর তাকে মাটির শয্যায় সাজানো হলো। এবার নতুন সূর্যের পাশে দাঁড়িয়ে ছবি তোলার পালা। সূর্য উৎসবের আনুষ্ঠানিকতা এখানেই শেষ। ওদিকে দুপুর হয়ে এসেছে। আজকেই আমরা ফিরে যাব রাঙামাটি শহরে। সেখান থেকে ঢাকার গাড়িগুলো ছাড়বে। কিন্তু দুপুরের খাবার যে তখনো বাকি। সিদ্ধান্ত ছিল এখানে খাওয়া দাওয়া হবে, তারপর লঞ্চ ছাড়বে। কিন্তু সময় স্বল্পতার কারণে তা আর হলো না। বেছে নেয়া হলো এক অভিনব পদ্ধতি। খাবারগুলো একটা ছোট্ট নৌকায় তুলে কেয়ারি কর্ণফুলীর সঙ্গে বাঁধা হলো। ছেড়ে দিল লঞ্চ। পেছনে কাসালং, মাইনি আর কর্ণফুলী। আমাদের বিদায় জানাতে এসেছে গ্রামের শিশুরা। লঞ্চ ছেড়ে দেবার কিছুক্ষণের মধ্যেই খাদ্যতরী থেকে খাবার পরিবেশন শুরু হলো। সবাই সিটে বসেই খাবার খেয়ে নিল। এটাও একটা মজার অভিজ্ঞতা। আবার দু’পাশের সেই মনোহর দৃশ্য। ক্লান্ত হয় না চোখ।
মন্তব্য করুন